করোনাকালে খালেদা-হাসিনার উদ্দেশে খোলা চিঠি

মাসকাওয়াথ আহসান
প্রবন্ধ
Bengali
করোনাকালে খালেদা-হাসিনার উদ্দেশে খোলা চিঠি

২০০১ থেকে ২০২০, এই দুইদশকে একএক করে বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আত্মহত্যা করে। এ দু’টি রাজনৈতিক দল তার ক্রেডিবিলিটি ও জনআস্থা হারিয়েছে পুরোপুরি।

২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল, এইসময়ে বিএনপি ও তার মিত্রদল ‘জামায়াতে ইসলামি’ ক্ষমতায় ছিলো। ক্ষমতাকালের শুরুর দিকে বিএনপির পারিবারিক রাজনীতির যুবরাজ তারেক রহমান এনটিভিতে দেয়া একটি ইন্টারভিউতে বলেন, যে লোকটা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালায়; সে দেশের ব্যবস্থাপনা চালাতে সক্ষম। কারখানা ব্যবস্থাপনা যে করে; দেশ ব্যবস্থাপনা তার পক্ষে সহজ হয়।

‘বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা দেওয়ার’ এই রাজনীতিকে বরণ করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই। ব্যবসায়ী নীতি নির্ধারণে থাকলে একটি দেশ কেবল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে, নাগরিকের স্বার্থ হয় উপেক্ষিত। রাজনীতিতে এই ট্র্যাজেডির কুরুক্ষেত্র আমাদের বাংলাদেশ।

বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আমি জার্মানির ডয়চেভেলে বাংলা বিভাগের সম্পাদক ও ওয়েবপোর্টাল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। ফলে একজন সাংবাদিক হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের শাসনকালটিকে ইতিহাসের প্রামাণিক দলিলে রেকর্ড করে রাখা খুব সহজ ছিলো।

দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ-প্রতিপক্ষের ওপর গ্রেনেড হামলা-ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা-‘ছায়া সরকার’ হাওয়া ভবনের বেআইনি কার্যকলাপ; বিএনপি ও জামায়াত প্রতিদিন দেশশাসনের নামে যে শাসন-ত্রাসন-সংহার করেছে; তা আর্কাইভ হয়ে আছে ডয়চেভেলের অডিও জাদুঘরে। সুতরাং আত্মঘাতী বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক মৃত্যুর প্রামাণিক উপস্থাপনা হাজিরের চেষ্টা করেছি সে সময়ের ডয়চেভেলের পরিবেশনায়।

পাশাপাশি লেখা ‘সতত হে নদ‘ ও ‘অদ্ভুত আঁধার এক‘ উপন্যাসে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত শাসনকালটিকে চিত্রিত করি। এভাবে দু’টো কাজের মধ্যে ইতিহাস সংরক্ষণের সংকল্প করি।

এরজন্য ২০০৪ সাল থেকে একাধিক হুমকি পাই। বিসিএস তথ্য সার্ভিস থেকে লিয়েনে যাওয়ায়, ক্ষমতাসীন সরকার আমাকে বারবার দেশে ফেরার জন্য পত্রাঘাত করে। কিন্তু সাংবাদিকতায় যাবার প্রস্তুতি ছিলো আমার জীবনের শুরু থেকেই। ফলে কোন রাজনৈতিক দলের জিঘাংসার খপ্পরে পড়ার মতো বোকামি আমি ২৫ বছরের মিডিয়া অভিজ্ঞতায় করি নি। আর সংবাদ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নৈতিকতা এমনভাবে অনুসরণ করি, যেখানে আইনের চোখে প্রতিটি কাজই নির্ভুল প্রমাণিত হবে; এ ব্যাপারে আমি খুবই নিশ্চিত।

এসময় বিএনপির মুখপাত্র ‘দৈনিক দিনকাল‘ আমার বিরুদ্ধে ‘কে এই মাসকাওয়াথ‘ নামে একটি কল্প-প্রতিবেদন ছাপে। যে এই প্রতিবেদনে লেখা ছিলো, “তার কাছে জার্মানিতে থাকা স্বপ্নের ব্যাপার“। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘জার্মানিতে থাইকা যাওনের লাইগা হুমকির নাটক সাজাইছে‘। জার্মানিতে থাকাটা এমন কোন কঠিন ব্যাপার সবার জন্য নয়; বা ওরচেয়ে ভালো জীবনমানে যে দেশে বা উপমহাদেশে থাকা সম্ভব; তা তাকে বোঝাবে কে?

ডয়চেভেলের প্রবীণ সাংবাদিক ফ্রিডেমান শ্লেন্ডার তখন এশিয়া বিভাগের প্রধান, আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আবদুল্লাহ আল ফারুক তখন ডয়চেভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান। উনারা এসব ডিফেমেশান অগ্রাহ্য করে কাজ করে যেতে বললেন। কারণ আমার লক্ষ্য সত্যান্বেষণ ও তা প্রচার। বলাবাহুল্য এসময় বিএনপি-জামায়াতের কিছু সংকীর্ণ চিন্তার মানুষ আমাকে ‘ভারতের দালাল‘ তকমা দিতে থাকে।

সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকে যারা কোমল কাজ মনে করেন; তারা হয়তো ধারণাই করতে পারেন না কীরকম স্নায়ুচাপ আর ঝুঁকির কাজটি সাংবাদিক ও লেখকরা হাসিমুখে সতত করে চলেছে জনস্বার্থে। সত্যানুসন্ধান আর সত্য প্রকাশের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আর নেই।

আওয়ামী লীগের ২০০৯ থেকে ২০১৩ সময়টিতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হওয়ায়, সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে সর্বময় দুর্নীতির ঘটনাগুলোকে কিছুকাল এগনোর করি। আর একটা আশা ছিলো এ দলকে ঘিরে, যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দলটির অগ্রগামী ভূমিকা ছিলো। এসময় অনলাইন মাধ্যম এসে যাওয়ায় ইতিহাস সংরক্ষিত হয় প্রতিটি মানুষের ফেসবুকের আইডিতে। আত্মঘাতী আওয়ামী লীগের শাসনকাল স্বচ্ছ আয়নায় প্রতিবিম্বিত প্রতিদিন।

২০১৪-র নির্বাচনটি দেখেও ভাবলাম, বিএনপি যেহেতু আগুন সন্ত্রাস করছে; ফলে আওয়ামী মন্দের ভালো থিওরিতে পরপর দু’বার দেশশাসন করলে হয়তো উন্নয়ন ধারাবাহিকতাটুকু থাকবে। কিন্তু অবস্থা দাঁড়ালো ভয়াবহ। বিএনপির হাওয়া ভবনের মতো অসংখ্য ছায়াভবন দাঁড়িয়ে গেলো আওয়ামী লীগের নেশাতলে; যারা প্রকাশ্যে দুর্নীতি চালিয়ে গেলো; আর কলতলার হৈ চৈ-এ ফেসবুক সরগরম করে রাখতে ‘সিপি গ্যাং‘সহ নানারঙের গ্যাং ছেড়ে রাখলো। এদের কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশপ্রেম শেখানো ‘চ-বর্গীয়’ গালি দিয়ে। সেই ফাঁকে ব্যাংক লুট করে বিদেশে টাকা পাচার চলতে থাকে।

কাউকে সত্যানুসন্ধান ও সত্যপ্রকাশ করতে দেখলেই এইসব গ্যাং তার ‘বেডরুমের খবর প্রকাশ কইরা গান্ধা কইরা দিমু; মাইরা ফালামু, কাইটা ফালামু‘ ইত্যাদি বলতে থাকে। জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের উগ্র জাতীয়তাবাদী নাৎসিদের যে মনোবিকৃতি, একই মনোবিকৃতি খুঁজে পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের এসব গ্যাং-এর মধ্যে।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করে ফেসবুকে এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে, এবার কোন মূলধারার মিডিয়া না পেয়ে একটা দুটো আওয়ামী ডটকমে কল্পনা প্রতিবেদন এসে যায়; কে এই মাসকাওয়াথ?

এইসব গ্যাং সদস্য, যাদের স্বপ্নই দালালি করে পেটের ভাত জোগাড় করা; তারা তাদের কল্পনায় সবাইকে দালাল মনে করে। মনে করে দালালি না করলে কী ভাত পাওয়া যায়! এইডা কী কইরা সম্ভব!

২০০৪ সালে বিএনপির দিনকালের চোখের ‘ভারতীয় দালাল‘ এবার ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ডটকমের কাছে ‘পাকিস্তানের দালাল‘ তকমা পেয়ে গেলো।

সাংবাদিকতার বন্ধুরা বললো, মন খারাপ করোনা; তুমি তোমার চিন্তার একই জায়গায় আছো। সে চিন্তার বিরুদ্ধের দলটি বদলেছে কেবল।

এ থেকে আমি বুঝলাম, বাঙ্গির জীবনের অভিশাপ হচ্ছে চাড্ডিপ্রেম ও পাকিপ্রেম। চাড্ডিপ্রেমে এরা ইয়াহিয়াকে ঘৃণা করে মোদিকে ভালোবাসে, আর পাকিপ্রেমে এরা মোদিকে ঘৃণা করে ইয়াহিয়াকে ভালোবাসে।

আমি এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, একইরকম অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দেশ। সে কারণে এই প্রশ্নের জবাব আমি খুঁজে পাইনা, এক ফইন্নি আরেক ফইন্নির দালাল হয় কী করে? ফইন্নি চাড্ডি বা ফইন্নি পাকি দালাল পোষার টাকা কোথায় পাবে, আর বাঙ্গিই এখন চাড্ডি-পাকিদের চেয়ে সচ্ছল; সুতরাং বাঙ্গি কারো দালাল হবার প্রশ্নই ওঠে না, এ অত্যন্ত ভ্রান্ত এক ট্যাগিং। এসব বাদ দেয়া হোক।

ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে আমরা দেখেছি দুটি সারণিতে উদ্ভিদ ও প্রাণির পার্থক্য লেখা থাকতো। ওরকম দুটি সারণিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পার্থক্য লিখতে গিয়ে বৈশিষ্ট্যের কোন পার্থক্যই খুঁজে পাই নি।

বিএনপি একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের পূনর্বাসন করেছে, আওয়ামী লীগ একবিংশের মানবতাবিরোধীদের পূনর্বাসন করে চলেছে। মিডিয়ার দিকে তাকালে লাইভ দেখতে পাবেন।

বিএনপি জামায়াতের ‘ধর্মীয় অনুভূতির দোকান’ খুলে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ হেফাজত ও শিবসেনার ‘ধর্মীয় অনুভূতির দোকান’ খুলে দিয়েছে।

বিএনপি ক্রসফায়ারে বিনাবিচারে মানুষ মেরেছে, তাদের মধ্যে আওয়ামী কর্মী ছিলো অনেক। আওয়ামী লীগ ক্রসফায়ারে বিনাবিচারে অনেক মানুষ মেরেছে, তাদের মধ্যে বিএনপির কর্মীও আছে অনেক।

বিএনপি দুর্নীতি ও টাকা পাচার বান্ধব ছিলো। আওয়ামী লীগও দুর্নীতি ও টাকা পাচার বান্ধব।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে চাটার দল ও চোরের খনিকে দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলেন, তারাই যেন একবার বিএনপির হয়ে আরেকবার আওয়ামী লীগের হয়ে খেলে বাংলাদেশকে ঝাঁঝরা করে দিলো।

আর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সত্যানুসন্ধানীদের ওপর নির্যাতন-গ্রেপ্তার চালিয়েছে একইরকম মানবতাবিরোধী ফ্যাশনে।

এই লেখাটি করোনার অবসরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সমীপে লিখছি। উনারা আমার মায়ের প্রজন্মের মানুষ। ফলে যোগ্য শ্রদ্ধাবোধ রেখেই তাঁদের উদ্দেশে লিখছি-

২০০১ সাল থেকে ২০২০ এই উনিশবছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যেরকম হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-টাকাপাচারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের অনুরূপ বিচারের ও শাস্তির দাবি রাখে কী না; তা উনারা একটু ভেবে জানালে বাধিত হই।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..