করোনাকালে বিয়েভঙ্গ

রওশন হক
ছোটগল্প
Bengali
করোনাকালে বিয়েভঙ্গ

মুকিত আলী ও তার স্ত্রী থাকেন আমারা বাসার বেইজমেন্টে। বাড়ি সিলেট সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। প্রায় পাঁচ বছর হতে চলেছে আমরা মোটামুটি এক পরিবারের মত আছি। তাঁদের একমাত্র ছেলের বিয়ে করাতে দেশে গেছেন। অবাক লাগে এখনো সিলেটিরাই ছেলে মেয়েদের বিয়ের জন্য টেনে এলাকায় নিয়ে যান। এখনো এলাকার মধ্যে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

আমার লেখার একমাত্র পাঠক। আমি সে সমস্ত পত্রিকায় লেখালেখি করি এই চাচাই আমাকে খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে দেন। প্রথম আলোর দুই তিন কপি বগলদাবা করে বাসার দিকে রওনা দিতে গিয়ে প্রথমআলোর ডিস্ট্রিবিউটর দলের মৃদু ধমকও খেয়েছেন বলে একদিন জানিয়েছেন। আমি ওদের দেখে নিব বলে ভাব নিতে ভুলিনি। আবার অফিসে এসেও একদিন মনজুর ভাই ছবি দেখিয়ে জানান দেয়,আমার এলাকায় বয়স্ক একজনেই কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে নেয়। আমি না চেনার ভান করি। সেসব অন্য গল্প।

আটবছর আগে চাচা শশুরবাডী বদৌলতে পারিবারিক ইমিগ্রান্ট হয়ে আমেরিকা এসেছেন। দেশে থাকাকালীন চাষবাস করেছেন। পেটানো কালচে শরীর। শরীর লেখাপড়া কতদুর করেছেন উনার মনে নেই। তবে আর রাজনীতির মারপ্যাচ খুব ভালো বোঝেন। সুলতান মনসুর সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করে পল্টি দিবেন বলে তিনিই আমাকে প্রথম বলেন। এখনো দিব্বি লুংগি পরেই প্লাস মাইনাস আবহাওয়া কাটিয়ে দেন। কিছুদিন গ্রোসারিতে জিনিসপত্র গোছগাছের কাজ করেছেন। দোকান মালিকের সাথে ঝগড়া করে কাজ ছেড়েছেন। গাল ভরে পান খান। পিক ফেলার জন্য সাথে কনটেইনার নিয়ে চলেন।

চাচা ফোন দিয়েছেন। আমার ঠিক মনে আছে তারিখটা ছিল মার্চের ২৪ তারিখ। কথা ছিল মার্চের ২৭ তারিখ চাচার একমাত্র ছেলে সুমনের বিয়ে হবে। সেই হিসাবে তারা তিনজনই দেশে পৌঁছেছেন মার্চের ১৫ তারিখ। কথা হচ্ছিল আমাদের সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়।

মাই (মা) সোহেলের বিয়ার তারিখ পিছাই দিছি। তারা আমারে আর তোমার চাচীরে ঘর বন্দী (কোয়ারিন্ট) করিলাইছে। আমার পুতরে আলগ ঘরে রাখছে।

চাচা নতুন তারিখ কোন দিন ফালাইছোইন?

না না মাই আমরা আর থাকতাম নায় যাইতামগি। তুমার ভাইর চাখরি (চাকুরী) গেছেগি। ইখানো খাইতাম কিলা! তুমি তো জানো! সব জমাইল টেখা (সঞ্চয়) বিয়ার বাজারর পিছনে শেষ করিলাইছি। বিয়া এপ্রিলের শেষে অইব।

এপ্রিলের শেষে?

অয়। হুন তারা এয়ারপোরট থাকি আমরা তিনলারে বান্দিলাইছে। তুমারে ফোন দিছি তুমি তুলছো না। এখন এপ্রিলের শেষে বিয়া ফালাইছি। দোয়া কইরো। তোমার মা রে কইয়ো।

বিয়ার তারিখ আরো কিছুদিন পিছায়ে ফেললে ভালা অইতো।

নারে মাই আমরা যাইতামগি। এদেশো আর আইতাম নায়।

ফোনে চাচার অস্তির অসহায় কণ্ঠ শুনতে পাই। স্ত্রী ছেলেসহ ঘরে কোয়ারিনটিনে। আছেন মনোকষ্টে। দেশে তার চাচার দুই ভাই তাদের ঘর বন্দী করে কোয়ারিনটিনে রেখেছে। তাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকেই আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। যেহেতু করোনা সম্পর্কে তেমনকিছু জানা নেই, তাই এই আলাদা করে ফেলাকে তিনি বেধেঁ ফেলা বলছেন। সেইথেকে তাদের কারণে পুরো বাড়ি লকডাউনে ছিলো। পরে শুনেছি পুরো এলাকাই লকডাউনে দিয়েছে স্থানীয় পুলিস। চাচার একমাত্র ছেলের বিয়ের শপিং করতে গিয়ে সব ডলার আগেই খরচ করে ফেলেছেন। বিয়ের জন্য যা ছিলো তাতেও দেশে লকডাউনে পরে খরচ করতে হচ্ছে। বাড়ীর অন্যদের হাতখালি। তাদের জমানো ডলার ভেঙ্গে দিন চলতে হচ্ছে। তিনি বর্তমানে দেশে গিয়ে দুঃশ্চিন্তা, অনিরাপদ,অসহায়বোধ করছেন। সবকিছু মিলিয়ে ক্ষোভ ও এক ধরনের অবিশ্বাস তাঁর গলায় শুনতে পাই।

মে মাসের শেষে এসে চাচা ফোন দিয়ে বলছেন মেয়ে পক্ষ বিয়ে দিতে অপারগতা জানিয়েছে। তারা এইসময়ে পছন্দমত অন্য কোন মেয়েও খুঁজে পাচ্ছেন না বলে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়ে পক্ষ কী অজুহাতে বিয়ে দিতে চাইছে না জানতে চাইলে চাচা বলেন,

আমেরিকায় করোনার মত সামান্য অসুখে পাখির মত মানুষ মরছে। রাস্তায় নাকি মানুষের মরদেহ পাওয়া গেছে। ভ্যাকসিন আবিস্কৃত না হলে সামনের দিনগুলিতে করোনার কারণে আমেরিকার অবস্থা আরো খারাপ হবে। ছেলে চাকরি হারিয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন চাকরির বাজার তৈরী হবে কীনা ঠিক নাই। হলেও দেখতে কালো ছেলে, চাকরি পাবে কীনা ঠিক নাই। আমেরিকায় শাদাদের রাজত্ব চলে। বিয়ের পর তাদের মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবে তারা আমেরিকান ছেলেকে মেয়ে বিয়ে দিতে নারাজি জানিয়েছেন। মেয়ের আত্মীয়-স্বজন বলেছে ট্রাম্প সরকার নতুন পারিবারিক ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বিয়ে করে বউ আমেরিকায় আনতে পারলেও মেয়ে তার পরিবার আনতে পারবে না। এমন হলে তো মহাসমস্যা। এদেশে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে তাদের পারিবারিক আমেরিকান সবুজ সনদ হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমন আরো কিছু কারণ দেখিয়ে মেয়েপক্ষ দিন তারিখ ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।

আমি ফোনের এপাড় থেকে সব শুনে অবাক হলাম। মাই গড! এত কিছুতো আমিও জানি না।  আবার কিছুটা খুশিইও হলাম মেয়ের পরিবারের সচেতনতা দেখে। একটাসময় ছিল আমেরিকার সম্বন্ধ পেলে মা বাবা বাড়তি খোঁজ-খবর না নিয়েই বিয়ে দিতেন। এমন অনেকের জীবন চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখেছি। এখন দিন পাল্টেছে। মেয়ের পরিবার মেয়ের বিয়ে দিতে আমেরিকার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ভাবতেই ভালো লাগছে।

মানব সভ্যতার ওপর করোনা ভাইরাসের অতর্কিত হামলায় গোটা পৃথিবীকেই অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। এতে যদি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর গ্রামের মানুষ এতটা সচেতনতা দেখাতে পারে ক্ষতি কী! চাচার পুতকে পরে দেখে শুনে বিয়ে দেয়া যাবে। পৃথিবী আজ বড্ড অশান্ত। এই বছরে বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ উৎযাপন করে নি। বাঙালির সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসবের দিন পহেলা বৈশাখ৷ তবে এবার উৎসব হল সামাজিক দূরত্ব মেনে, ‘ঘরোয়া’ পরিসরে৷

করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় নববর্ষ উদযাপনের সকল আয়োজন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল চীন৷ ধীরে ধীরে করোনা ছড়িয়েছে বিশ্বের প্রায় সবদেশে৷ আনন্দ-বিনোদনের সব আয়োজন গুটিয়ে ঘরবন্দি হয়েছে সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষ৷ করোনাকে এড়িয়ে জীবনরক্ষার এটাই যে এইসময়ে সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

ঈদ মানে আনন্দ,একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করা। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সমস্ত মুসলিম জাতি এক হয়ে যাওয়া। কিন্তু এবছর ঈদ এলো রূপ পরিবর্তন করে। এ যেন কেমন অপ্রত্যাশিত ঈদ! করোনা মানুষের ঈদের খুশি, আমেজ, আনন্দ সবকিছুকে বদলে দিয়েছে।

তাহলে একটা বিয়ে না হওয়াকে আমার কাছে তেমন গুরুত্বপুর্ণ মনে হলো না, বরং তারা সুস্থ আছেন করোনামুক্ত আছেন তাতেই আমার আনন্দ।

 

সম্পাদনা: জোবায়েন সন্ধি

রওশন হক। লেখক ও সাংবাদিক। রওশন হকের জন্ম জন্ম হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রামে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম থেকে এমবিএ করেছেন ব্যবসায়ী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক করেছেন নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ