করোনাকালে মে দিবস

রবীন দাস
প্রবন্ধ
Bengali
করোনাকালে মে দিবস

কথা শুরুর কথা

“প্রিয়,ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠ ফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।“
(কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

আবিশ্ব আজ মারণ ভাইরাস করোনার কবলে প্রবলভাবে উৎকণ্ঠিত; মৃত্যুর খতিয়ান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় আক্রান্তের সংখ্যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির থেকে বেশিই। প্রাচুর্য ও ধনসম্পদে বলীয়ান ইউরোপ থেকে আমেরিকা, মৃত্যুর করাল থাবায় দিশেহারা, থরহরি কম্পমান আজকের আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এর ঠিক উল্টোদিকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বলীয়ান দেশগুলো এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণকে অনেকটাই প্রতিহত করতে পেরেছে, তাঁদের সামাজিক নীতিমালার জন্য, জনমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে। এমনকী আমেরিকার চিরশত্রু কিউবা, চীনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁদের চিকিৎসক দলকেও পাঠাচ্ছে, মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে করোনা ভাইরাসজনিত লকডাউনের কারণে শ্রমজীবী মানুষও পড়েছেন   নিদারুণ দুর্ভোগে; বন্ধ হয়ে গেছে কলকারখানা, বন্ধ বহুবিধ নির্মাণের কাজ, বৃহদাকার শিল্প থেকে ছোটখাটো শিল্পের সাথে যুক্ত কত কত স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক থেকে পরিযায়ী শ্রমিক (অতিথি শ্রমিক) মারা গিয়েছেন,খাবার ও চিকিৎসা না পেয়ে সাম্প্রতিককালের ভারত সরকারের অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণায়।

অত্যন্ত পরিতাপের ও বিয়োগান্তক ঘটনা এমনই যে,শুধুমাত্র কমর্হীনতা, নিরাপত্তা ও ঘরে ফেরার আকুল আশা বুকে নিয়ে লোটাকম্বলসহ পায়ে হেঁটে তিন-চারশো কিলোমিটার পথ তারা দলে দলে পারি দিয়েছেন। ঘটনায় প্রকাশ, ভারতের কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু থেকে মধ্যপ্রদেশের রাইচুড়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন, পায়ে হেঁটে হেঁটে চলেও এসেছিলেন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, বাকি ছিলো আর ১৫০ কিলোমিটার, কিন্তু সেইপথ আর পেরোনো হয়নি ঊনত্রিশ বছরের মহিলা শ্রমিক গঙ্গাম্মার; খিদের জ্বালায়,অনাহার, আর পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়ে মারা যান, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে খবরের শিরোনামে এসেছে আরো এক অসহায় বছর চল্লিশের রণবীর সিংহের নাম, যিনি দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশের নিজের গ্রামে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিলেন, দুইশো কিলোমিটার হাঁটার পরে আগ্রার রাস্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হাজারে হাজারে শ্রমিক মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করে হেঁটে হেঁটে বাড়ী ফিরছিলেন। পথেই চলন্ত ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গিয়েছে ২৯ জন শ্রমিকের, প্রায় ৩৯ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন এমন লকডাউন পরিস্থিতির কবলে পড়ে।

এতো গেলো ভারতবর্ষে লকডাউনজনিত কারণে অকারণ শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা। অপরদিকে  বাংলাদেশ নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের মত দেশগুলোর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সংক্রান্ত বিশদ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে সাম্প্রতিক ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ নামে এক সংস্থার ১৬ই এপ্রিল ২০২০,এর এক রিপোর্ট উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক,ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ”জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব দুটোই বেশি, কিন্তু তা সত্বেও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো পর্যন্ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর থেকে তুলনামুলকভাবে অনেকটাই মন্থরগতির, করোনা ভাইরাসে বিশ্বের মোট আক্রান্ত মানুষের মাত্র ১১%  মানুষ ৮টি সার্কভুক্ত দেশের বাসিন্দা, জনঘনত্ব এইসব দেশে অনেক বেশী। পৃথিবীর মাত্র ৩ শতাংশ ভুখণ্ড জুড়ে থাকা এই দেশগুলোতে বাস করেন বিশ্বের ২১ শতাংশ মানুষ। তা সত্বেও বিশ্বের ‘করোনা আক্রান্ত’ মানুষের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম ঘটেছে এই ভূখণ্ডে”।

ইতিহাসের পাতায় ফিরে দেখা

কিন্তু আমরা যদি বুনিয়াদী মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিতে প্রবেশ করে তার একটা আনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করি, আজকের এই পুঁজিবাদী সংকটকে বুঝতে, তবে ফিরে তাকাতেই হবে, ১৯ শতকের একেবারে শেষদিকে,যেখানে পুঁজিবাদ এক তীব্র সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকটের চরিত্র ছিলো ধ্রুপদী ধরনের, কারণ ওই সংকটের প্রতিটি লক্ষণ মার্ক্সবাদী বিক্ষণের সাথে চমৎকারভাবে মিলে গিয়েছিলো। সেই সময়কালে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনগুলো এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলির বিকাশও লক্ষ করা গেছে।

অপরদিকে আমরা দেখি পুঁজিবাদের সংকট দীর্ঘায়িত হয় এবং পুঁজিবাদ ক্রমে ক্রমে তা কাটিয়েও ওঠে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সে তার আমূল রূপান্তর ঘটায়; আগে ছিলো মুক্ত পুঁজিবাদ, যার মূল কথাই হলো, অবাধ প্রতিযোগিতা। এর ফলাফল হিসাবে দেখা দিল উৎপাদনে এক নৈরাজ্য। বাজার ধরার জন্য যাবতীয় কুটকৌশল সে প্রয়োগ করলো, এবং নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পেতে পুঁজিপতিরা নানাভাবে পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে লাগলো, পুঁজিবাদ যেন একটা স্থায়িত্ব লাভ করলো, শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি পেলো এবং দেশে দেশে একপ্রকার সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ লাভ করলো। কিন্তু আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে যদি আমরা দেখি, যে গোটা বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি নতুন করে সমাজতন্ত্রের প্রতি যেন দিক্ নির্দেশ করছে। কারণ মার্ক্সবাদ একথাই বলে, যে পুঁজিবাদ তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের গতির ফলেই সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলে। কারণ তার ভিতরকার দ্বন্দ্বগুলি চূড়ান্ত মীমাংসা হয় একমাত্র সমাজতন্ত্রেই। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটার বস্তুগত শর্তগুলিও -যথা বৃহদায়তন উৎপাদনের ঘনিভুতরূপ, সর্বহারা শ্রেণী ইত্যাদির জন্ম দিয়ে থাকে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সমাজ আপনা থেকেই, কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণ ঘটবে। আর এ কারণেই মার্ক্সের বিখ্যাত মন্তব্যটি ছিল এরকম,

“প্রশ্নটা হলো দুনিয়াকে পাল্টাও।“

সুদিনের আশায়:

ঐতিহাসিক মে দিবস এই লকডাউন এর জন্য সারাবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষেরা হয়তো একসাথে প্রতিপালিত করতে পারবেন না, তবুও আশাবাদী মানুষ কাঁধে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে পথে নামবেন, মেদিবসের শপথ ধ্বনিত হবে; এই অসময় কেটে যাবে, সুদিন একদিন আসবেই। তাই কমরেড লেনিন এর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সেই বিখ্যাত আহবান:

“সংগ্রামী শ্রমজীবী বন্ধুগণ, মহান মে দিবস আসন্ন৷ এইদিনে সারাদুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের শ্রেণি সচেতন অভ্যুত্থান উদযাপন করেন৷ মানুষের ওপর মানুষের শোষণ–অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ক্ষুধা–দারিদ্র্য–অবমাননা থেকে কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের জন্য তাঁরা নিজেদের আরও সংহত করার শপথ নেন৷ এই সংগ্রামে দু’টি জগৎ পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে– পুঁজিপতি শ্রেণির জগৎ আর শ্রমিক শ্রেণির জগৎ৷ একটিতে আছে শোষণ আর গোলামি, আরেকটিতে আছে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং স্বাধীনতা৷ একদিকে রয়েছে মুষ্টিমেয় ধনকুবের রক্তশোষক৷ … অন্যদিকে রয়েছে কোটি কোটি অসহায় মানুষ, যাদের দুটো পয়সার জন্য মালিকের কাছে কাজ ভিক্ষে করা ছাড়া উপায় নেই৷ তারাই শ্রম দিয়ে সমস্ত সম্পদ সৃষ্টি করে৷ অথচ সারাজীবন একটু রুটির জন্য তাদের হা–পিত্যেশ করতে হয়৷ হাড়ভাঙা খাটুনির পর গ্রামের প্রান্তে অথবা শহরের বস্তিতে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়, … মানুষের মননশক্তির সমস্ত অগ্রগতি, সমস্ত সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে গোটা সভ্যতা আরও উন্নত হোক, একজনও যেন অবদমিত না থাকে৷”

(ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন)

 

রবীন দাস। লেখক ও কমিউনিস্ট রাজনীতিক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..