করোনাকে চিনবো, করোনা থেকে বাঁচবো

জুঁই ইয়াসমিন
প্রবন্ধ
Bengali
করোনাকে চিনবো, করোনা থেকে বাঁচবো

এই পৃথিবীতে যত ধরনের বায়োলজিক্যাল সত্তা আছে তাদের মধ্যে ভাইরাস সংখ্যাগুরু। পৃথিবীর সমস্ত ভাইরাসগুলোকে যদি একটিমাত্র লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়া যেত তবে এই লাইন আমাদের গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে যেত। আপনি যতক্ষণে লাইন দুটি পড়লেন ততক্ষণে কয়েকলক্ষ ভাইরাস আপনার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেছে আবার কয়েকলক্ষ আপনার শরীর থেকে বেরিয়েও গেছে। কয়েক ন্যানোমিটার দৈর্ঘের ভাইরাস আসলে প্রকৃতি-সৃষ্ট ন্যানো টেকনোলজির মত। এরা সকলপ্রকার জীবিত সত্তায় (মানুষ, গাছ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়াসহ সকল অণুজীব) সংক্রমণ ঘটিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। নিজস্ব বংশবৃদ্ধির কৌশলের অনুপস্থিতি সত্বেও অন্যকোন জীবিত কোষের যন্ত্রাদি ব্যবহার করে ঠিকই নিজেদের বংশ বৃদ্ধি করে এই পৃথিবীতে সর্বাধিক সংখ্যায় বসবাসকারী বাসিন্দার তকমাটা এরা নিজের করে রেখেছে।

লক্ষ লক্ষ প্রকার ভাইরাসের কথা বলা হলেও আমরা আসলে এদের মাত্র ৫ হাজার প্রকারের হদিস করতে পেরেছি। বেশিরভাগ ভাইরাসই ক্ষতিকারক নয়। তবে, এদের অনেকে আছে মানুষে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে এবং কেউ কেউ রীতিমত ভয়ংকর যেমন-মারবার্গ, ইবোলা, এইচআইভি ইত্যাদি।

করোনা ভাইরাস ফ্যামিলিতে কয়েকডজন ভাইরাস আছে তাদের মধ্যে ৭টি মানুষের রোগ সৃষ্টি করে। এদের ৪টি মৃদু সর্দি-কাশি সৃষ্টি করে আর বাঁকিগুলো অভিনব ও সাংঘাতিক প্রাণনাশক এবং মনে করা হয় এগুলো পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। এদের জুওনোটিক ভাইরাস বলে।  ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে এদের জেনেটিক উপাদানকে ঘিরে অবস্থান করা প্রোটিনের ক্যাপসিডে অসংখ্য স্পাইক প্রোটিন দেখা যায়, যাদের দেখতে পুষ্পমুকুটের (কদম ফুলের ন্যায়) মত দেখায় বলে এদের নাম করোনা বা মুকুট দেয়া হয়েছে। ১৯৬০ সালে প্রথম ভাইরাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। অনেক করোনা ভাইরাস আছ যারা শুধু প্রাণিতে বংশবিস্তার করে। তবে তাদের ধরন ভিন্ন। খুব কমক্ষেত্রে প্রাণিদের করোনা ভাইরাস মানুষে সংক্রমিত হয় এবং তা আবার মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়।

আমাদের স্মরণকালে আমরা এমন ঘটনা তিনবার ঘটতে দেখেছি সাসর্ – কোভ, মার্স – কোভ ও সার্স – কোভ -২ এর ক্ষেত্রে।  ২০০২ সালে চায়নাতে প্রথম প্রকাশ পেলেও ২০০৩ এ সার্স সিওভি কে করোনার একটি স্বতন্ত্র স্ট্রেইনরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এসময় এটি ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বমোট ৮০০০ মানুষে সংক্রমিত হয় যাদের ৮০০ জন মৃত্যুবরণ করে। ধারণা করা হয় এক ধরনের বিড়াল থেকে এটি মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল। মার্স-কোভ কে ২০১২ সালে সৌদি আরবে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আক্রান্তদের জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার মত লক্ষণ ছিল। মনে করা হয় এক কুঁজওয়ালা আরবীয় উট থেকে এটি মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৭টি দেশে এর প্রকাশ নিশ্চিত করেছিল যেখানে সর্বমোট ২,৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ৮৬০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী উহানে সার্স-কোভ-২ এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সার্স-কোভ-২ এর ফলে সৃষ্ট রোগের নামকরণ করেছেন করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯ বা কোভিড-১৯। যে মূহুর্তে প্রবন্ধটি লিখছি তখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৯টি দেশে ৭ লাখ ১৭ হাজারের বেশী মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। আপনি যখন পড়ছেন তখন এ সংখ্যাগুলো নিশ্চিতভাবে অতীত হয়ে গেছে। ভাইরাসটির উৎসের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত না হলেও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণাটি বলছে এটি বাদুর থেকে এসেছে। তবে বাদুর ও মানুষের মাঝে একটি অন্তরবর্তীকালীন পোষকদেহ ছিল যেখানে থাকাকালীন সময়েই ভাইরাসটি মূলত মানুষের শরীরে খুব সহজে প্রবেশ করবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনটি অর্জন করেছে। সেই মধ্যবর্তীকালীন পোষকদেহটি হলো প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই। চীনের উহান শহরে এই বনরুই খাওয়ার প্রচলন আছে যদিও এটি বেচাকেনার অনুমতি নেই। ৭ প্রজাতির বনরুই এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩টি প্রজাতি পাওয়া যায় যা চোরাই পথে বৈশ্বিক বাজারে পাচার হয় বলে জানা যায়।

নভেল করোনা আক্রান্ত একজন মানুষের মধ্যে ফ্লু এর মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে, ফ্লু ও করোনা ভাইরাস এক নয়। টেস্ট ব্যতিরেখে নভেল করোনা এর মৃদু লক্ষণ ও ফ্লু সংক্রমনের মধ্যে পার্থক্য বোঝা সম্ভব না। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে ফ্লু এর লক্ষণ গুলো হলো-

    • জ্বর বা জ্বর জ্বর ভাব
    • কাশি
    • গলা ব্যাথা
    • নাক দিয়ে পানি পড়া
    • শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মাংসপেশীতে ব্যাথা
    • ক্লান্তি
    • বমি বা ডায়রিয়া যা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশী হয়।

ফ্লু ও করোনা ভাইরাস উভয়েই শ্বাস-নালীর টিউবে জ্বালা সৃষ্টি করে ফলে শুকনো কাশি হয় অর্থাৎ মিউকাসবিহীন কাশি হয়। উভয় ভাইরাসই সারা শরীরে খারাপ লাগা সৃষ্টি করে বলে রোগীর কোন কাজ করতে ভালো লাগে না বরং শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আর এই উভয় ভাইরাস থেকেই এক পর্যায়ে নিউমোনিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এদের লক্ষণ এক হলেও চিকিৎসা কিন্তু আলাদা। ফ্লু এর ক্ষেত্রে ওসেলটামিভির নামে একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয় যা দেহে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি রোধ করে। এছাড়া, ফ্লু এর টিকাও একটি কার্যকরী উপায়। এটি ফ্লুকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করতে না পারলেও এর জটিলতাকে কমায়। কিন্তু  নভেল করোনা ভাইরাসটি নতুন বলে এর এখনও কোন ওষুধ বা টিকা নেই।

ভাইরাস টেস্ট ব্যতিরেকে নভেল করোনার মৃদু লক্ষণ ও সাধারণ সর্দি কাশির মধ্যে পার্থক্য বোঝাও কঠিন। আমরা যাকে কমন কোল্ড বা সাধারণ সর্দি-কাশি বলি, এটি আসলে একটি ভাইরাল সংক্রমন। ২০০ এর বেশী সংখ্যক এমন ভাইরাস আছে যারা এই মৌসুমী সর্দি-কশি সৃষ্টি করে। তবে, মোট সংক্রমণের অর্ধেক সৃষ্টি হয় রাইনোভাইরাসের কারণে। অন্যান্যগুলোর মধ্যে আছে করোনাভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনশিয়াল (বহু নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট) ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি।  সি ডি সি অনুসারে কমন কোল্ডের লক্ষণগুলো হলো-

    • হাঁচি
    • নাকে সর্দি জমা
    • নাক দিয়ে পানি ঝরা
    • গলা ব্যাথা
    • কাশি
    • গলা কাশ জমা
    • চোখ দিয়ে পারি ঝরা
    • খুব কম ক্ষেত্রে জ্বর আসা

সাধারণত সংক্রমণের ২-৩ দিনের মাথায় লক্ষণ প্রকট থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সেরে যায়।

অন্যদিকে, পৃথিবীতে এপর্যন্ত মানুষে রোগসৃষ্টিকারী ৭ ধরনের করোনা ভাইরাসের কথা মানুষের জানা আছে যাদের তিনটি হলো – সাসর্ – কোভ, মার্স – কোভ ও সার্স – কোভ -২ যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে। বাকী  চারটি করোনা ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় মৌসুমী ঠান্ডা-জ্বর হিসেবে নিয়মিত সংক্রমিত হয়। তবে এদের প্রত্যেকেই নিউমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। নিউমোনিয়া ফুসফুসের একটি রোগ। এখানে ফুসফুসের বায়ুথলিতে অণুজীব সংক্রমন থেকে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। সর্বাধিক সংখ্যক নিউমোনিয়া যদিও মূলত ঘটে স্টেপটোকক্কাস নিউমোনি নামক ব্যাকটেরিয়া থেকে। এ থেকেই এ রোগের ওইরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে, এটি ভাইরাল ইনফেকশন, অন্যপ্রকার ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, ছত্রাক সংক্রমণ এবং অল্প কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণেও হয়ে থাকে। সিডিসি অনুসারে কোভিড-১৯ এর লক্ষণগুলো হলো-

    • জ্বর
    • কাশি
    • শ্বাস কষ্ট

করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলো সংক্রমণের দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ঘটে থাকে। আর কতদিন লক্ষণ বর্তমান থাকবে তা নির্ভর করবে লক্ষণগুলোর তীব্রতার ওপর। মৃদু লক্ষণের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যে লক্ষণগুলো কমন কোল্ডের মত, তা ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে রোগটি তীব্র হয়। এসময় ভাইরাস ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং নিউমোনিয়া ঘটায়। আর এইসব ক্ষেত্রেই রোগটি সারতে দীর্ঘ সময় লাগে। লক্ষণ যেমন সদৃশ তেমনি সদৃশ মৃদু কোভিড-১৯ ও কমন কোল্ডের চিকিৎসা। উভয় ক্ষেত্রেই আসলে লক্ষণের উপশম করা হয়। প্রকৃত অর্থে ভাইরাসের কোন চিকিৎসা নেই। অর্থাৎ শরীরে ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি রোধ করার উপায় এখনও জানা নেই।

এটি মূলত: আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সাথে নির্গত জলকণার মধ্য দিয়ে ছড়ায় যা আক্রান্ত ব্যক্তির ৬ ফুটের মধ্যে অবস্থানকারী যেকোন মানুষে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এই করোনা ভাইরাসটি হাম বা পানি বসন্তের ভাইরাসের মতো বাতাসে মধ্য দিয়ে দূর দূরান্তে ছড়ায় না। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ চার্লস ডিউ বলছেন যদি আপনি একটি প্লেনে ভ্রমণ করেন যেখানে প্রথম সিটটিতে একজন করোনা আক্রান্ত মানুষ বসেছেন আর আপনি প্লেনের শেষ সিটটিতে বসেন তবে আপনার আক্রান্ত হবার সম্ভবনা শূন্য। তবে আত্রান্ত ব্যক্তির অতি নিকটে আসলে যেমন তার সাথে করমর্দন করা, সে যে দরজার নবে, টেবিলে বা অন্য কোন বস্তুতে হাত দিয়েছে সেগুলো স্পর্শ করলে সেখান থেকে ছড়াতে পারে। উনি বলছেন এসব স্থানে করোনা ভাইরাস কতক্ষণ জীবিত থাকতে পারে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোন উপাত্ত নাই। তবে অন্যান্য যে করোনা ভাইরাস আছে যেমন সারস্ এসব স্থানে ঘরের তাপমাত্রায় ২ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। নতুন কিছু রিপোর্ট বলছে এটি মলের মধ্য দিয়ে পরিবেশে ছড়াতে পারে বিশেষ করে যদি সোয়ারেইজের পাইপে লিক থাকে। সারস্ এর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

করোনা ভাইরাস এর সুপ্তাবস্থা হচ্ছে ১৪ দিন অর্থাৎ কারো দেহে প্রবেশের পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১ থেকে ১৪ দিন সময় লাগতে পারে যদিও কখনও কখনও ১৪ দিনের বেশীও লাগতে পারে।  তবে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ৫-৬ দিন সময় লাগে। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে ফ্লু এর মতো লক্ষণ থাকে এবং লক্ষণগুলো তীব্র হওয়ার আগেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। বাকী ২০ ভাগ মানুষকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। আর শতকরা ৬ ভাগ মানুষ সংকটাপূর্ণভাবে অসুস্থ হতে পারেন এবং এদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রয়োজন পড়তে পারে। সাধারণত এদের রেসপিরেটরী ফেইলিউর, সেপটিক সক বা অন্যান্য অঙ্গ যেমন হার্ট বা কিডনী ফেইলিউর এর মত ঘটনা ঘটে। যাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৫ দিন পর থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট ও নিউমোনিয়া শুরুর লক্ষণগুলো শুরু হয়, এরাই ৭ দিনের মধ্যে সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। তবে, বেশীরভাগ রোগীই ১১ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়।

নতুন ধরনের একটি স্ট্রেইন বলে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা মূলত পরীক্ষামূলক। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন ঔষধ বা টিকার যথার্থতা প্রমাণিত হয়নি যদিও সারা পৃথিবীর হাজার হাজার ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিরন্তর চলছে। এরকম একটি ওষুধ হলো অ্যান্টিভাইরাল রেসডিসিভর, যা মূলত ইবোলার জন্য তৈরী করা হয়েছিল, এখন ওয়াশিংটন স্টেইট ও চায়নাতে কিছু রোগীকে দেয়া হচ্ছে। অন্য কিছু গ্রুপে আবার অন্য কোন অ্যান্টিভাইরাল যাচাই করে দেখছেন যাদের মধ্যে অ্যান্টি-এইচ আই ভি ওষুধও আছে। ১৭ই মার্চ ফ্রান্সে ৩৬ জন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর করা গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হবার পর ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর সাথে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের ব্যবহার ওষুধটির কার্যকারিতা বারিয়ে দেয় বলে তারা দাবী করেন। একই ধরনের একটি স্টাডি চীনেও করা হয় এবং একই ফলাফল ব্যক্ত করা হয়। এমনকী ট্রাম্প প্রশাসনও এনিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন সংবাদ সম্মেলনে। এ ঘটনার পর অবশ্য বাংলাদেশের বাজারে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ওষুধটির ভয়বহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বিধায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে এর ব্যবহার বিপদজনক হতে পারে। টরেন্টো ইউনিভার্সিটির সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ আইজ্যাক বগচ বলেন এত ছোট ছোট স্টাডি থেকে এমন উপসংহার টানা সহজ নয়। হার্বার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেল্থ এর এপিডেমিওলজিস্ট এরিখ ফেইগল-ডিং বলেন রোগী ওষুধে নাকি বিশ্বাসে ভালো হয়েছেন তা বোঝা শক্ত। কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মূলত অক্সিজেন, প্রচুর তরল খাবার ও অন্যকোন ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ যেন এসময় না ঘটে তা নিশ্চিত করতে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে।

শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণকারী ভাইরাসগুলো সাধারণত ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়াতে বেশী সংক্রমণ ঘটায়। কারণ, বাতাসে ভেসে বেড়ানোর সময় ভাইরাসের দেহের চারপাশে যে জেল সদৃশ ঢাকনা আছে তাকে ঠাণ্ডা আবহাওয়া সুরক্ষা দেয়। ফলে, এরা প্রতিকূল পরিবেশে যতক্ষণ না অন্য কোন পোষক দেহে পাচ্ছে ততক্ষণ টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে উচ্চ তাপমাত্রা বিশেষ করে বাতাসে উচ্চমাত্রার জলীয় বাস্প থাকলে এসব ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে না। বাতাসের তাপমাত্রা বেশী থাকলে এতে জলীয় বাস্প বেশী থাকে। হাঁচি কাশির সাথে ভাইরাস সমৃদ্ধ যে ক্ষুদ্র পানিকণা বের হয় তা বাতাসের জলীয় বাস্পের পানিকণার সাথে মিশ্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী পানিকণা তৈরী করে যা বাতাসে না ভেসে বরং মাটিতে, ফ্লোরে বা টেবিলের উপরিভাগে অবস্থান করে। আমরা একটু খেয়াল করলে দেখব নোভেল করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে যেসব দেশে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম ছিল  (যেমন-কোরিয়া, জাপান, ইরান) সেসব দেশে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল। অন্যদিকে, যে দেশগুলোতে সেসময় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশী ছিল (যেমন-সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড) সেসব দেশে সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। আমরা দেখছি উষ্ণতর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে, টেক্সাস ও ফ্লোরিডা অপেক্ষা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশী। একটি গবেষণা বলছে ৩৭ থেকে ৬৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটে এই ভাইরাসটি সবচেয়ে বেশী সংক্রমিত হয়। ঢাকাতে এখন গড় তাপমাত্রা প্রায় ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট আর তাতে কিন্তু সংক্রমণ থেমে নেই। তাই, সামনে গরম আসছে বলে আমরা খুব একটা আশাম্বিত হতে পারছি না।

এছাড়া, উত্তর গোলার্ধে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে তো একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঋতু অবস্থান করে। চায়না ও যুক্তরাষ্ট্রে আবহাওয়া কিছুটা গরম হওয়া শুরু হলেও দক্ষিণ আমেরিকা ও ওশেনিয়াতে শীতকাল শুরু হবে। আবার এমন কিছু দেশ আছে যেখানে সারাবছর ধরেই কোথাও না কোথাও সংক্রমণ ঘটিয়ে যাবে। অর্থাৎ এটি অন্যান্য চারটি করোনা ভাইরাসের মত পৃথিবীতে হয়তো চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। অর্থাৎ এই মৌসুমে গরমকাল চলে আসার কারণে আমরা বেঁচে গেলেও নোভেল করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ আগামী বছরগুলোতে আমাদের জন্য তথা বিশ্ববাসীর জন্য ভয়ের কারণে হয়েই থাকল। জন হফকিনস সেন্টার ফর হেল্প সিকিউরিটি এর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আমেশ আদালজা মনে করছেন টীকা ছাড়া কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির উপায় কম। ১৭ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে প্রথমবারের মত ৪ জন মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে করোনা ভাইরাসের টীকা প্রদান করা হয়। তবে, টীকাটি সবকিছু ঠিক থাকলে সকল ট্রায়াল শেষে বাজারে আসতে আরো ১৬ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে। আবার বাজারে আসামাত্র কিন্তু এটি সকলের জন্য সহজলভ্য হবে না। অথনৈতিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে হয়তো আরো কয়েকটি মাস বেশী গুনতে হবে। হয়তো, এর মধ্যে আমাদেরকে করোনার আরো দুটো সংক্রমণ দেখতে হতে পারে। অর্থাৎ মাস্ক পরিধান, পরিস্কার পরিছন্নতা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার ও সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমে করোনাকে দূরে রাখা ছাড়া এই মূহুর্তে আমাদের হাতে এ থেকে বাঁচার অন্য উপায় সীমিত।

সমস্যা হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণটি এত মৃদু যে বেশিরভাগ মানুষ এটা বুঝতেও পারছেন না যে তারা করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এটা যেমন একটা  ভালো দিক তেমনি একটা খারাপ দিকও বটে। খারাপ দিক কারণ রোগী নিজে বুঝতে পারছেন না যে তিনি এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন না। আর এতে তিনি নিজের অজান্তে অন্যের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, একবার করোনা সংক্রমণের পর আবারো করোনা দ্বারা সংক্রমিত হবে কী না এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণত অন্য যে চারটি মৌসুমী করোনা ভাইরাস আছে তাতে একবার আক্রান্ত হলে ওই বিশেষ ভাইরাসের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয়।

দক্ষ মানবশক্তি ও প্রযুক্তির বিবেচনায় বিশ্বের সেরা পাবলিক হেল্থ ব্যবস্থার দেশ যুক্তরাষ্ট্র করোনার আঘাত সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে বলছেন, এর কারণ করোনাকে শুরু থেকে ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্বসহকারে নেয়নি। অন্যদিকে, সাউথ কোরিয়া খুব ভালোভাবে করোনাকে মোকাবেলা করছে। কোরিয়া ইউনিভার্সিটি গুরো হসপিটাল এর প্রফেসর কিম মনে করেন ২০০৯ এর সোয়াইন ফ্লু ও ২০১৫ এ মার্স এর দুটো প্রাদুর্ভাবের সাথে কোরিয়ার মেডিক্যাল প্রফেশনাল ও সেই সাথে জনগণ পরিচিত ছিল বলে তাদের জন্য নতুন প্রদুর্ভাবটিতে সহজে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে। তারমতে পদক্ষেপগুলো হলো, কোরিয়ার সকল মানুষ কেএফ৯৪ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করে, যা মেডিক্যাল প্রফেশনালদের জন্য প্রযোজ্য এন৯৫ মাস্কের সমতুল্য। কোরিয়াতে প্রতিদিন ১৫,০০০ রোগীর টেস্ট করা হয়। ২৮ মার্চ পর্যন্ত সেদেশে ৩,৩৮০০০টি টেস্ট করা হয়েছে। প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই তারা টেস্ট কিট তৈরিতে বেশী মনোযোগী ছিল। তারা অভিজ্ঞতা থেকে জানত যে, এসময় তাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পড়বে টেস্ট কিটের। কোরিয়ায় শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত পেছানো হয়েছে। উপাসনালয়, বার ও ইনডোর জিমকে অর্থাৎ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোকে প্রথম থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এয়ারপোর্ট দিয়ে দেশের ভেতরে প্রবেশ করা সকল মানুষের টেস্ট করা হয়েছে। ২২ মার্চ থেকে সব যাত্রীদের আলাদা হোটেলে রেখেছেন, টেস্ট করেছেন। টেস্ট পজিটিভ হলে তাদের মোবাইলে বিশেষ অ্যাপ দিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখেছেন, যা দিয়ে তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষগুলো কখন কোথায় যাচ্ছে তা বোঝা যায়। তবে, কোরিয়ার সাধারণ মানুষও করোনা মোকাবেলায় অনেক সতস্ফূর্ত ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। কোরিয়া আমাদের জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে নিঃসন্দেহে।

 

সম্পাদনা: জোবায়েন সন্ধি

জুঁই ইয়াসমিন। লেখক ও গবেষক। পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে। পরবর্তীতে ইরাসমাস মুন্ডুস প্রোগ্রামের আওতায় 'ফুড সায়েন্স, টেকনোলজি ও নিউট্রিশন' স্নাতকোত্তর। বর্তমানে স্বাধীন স্বাস্থ্য প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। স্বাস্থ্য ও মেডিসিন বিষয়ে নিয়মিত লেখালিখি করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..