বেশ মুশকিলেই পড়ে গিয়েছেন কণ্ব মুনি। আমাদের পল্লীর কর্ণ সেন। বেশ বড় ঢাউস বাড়ি তাঁর। বাড়ির লাগোয়া বেশ খানিকটা জমি। তাতে অনেকগুলি সেগুন আর মেহগনি বেশ মাথা চাড়া দিয়েছে। কর্ণ সেন আমাদের কলেজে সংস্কৃতের শিক্ষক। নিতান্ত অপদার্থ না হলে আজকাল কারো বাপ মা সংস্কৃত পড়তে কলেজে ভর্তি করে না। তাই কর্ণ সেনের ক্লাসে দু চারটি অতি সুন্দরী মেয়েরা ছাড়া আর কেউ পড়ে না। ছাত্র ছাত্রীরা বলে ওদের আর বিএ পাশ করে বেরোনোর দরকার নেই। তার আগেই বিয়ে হয়ে যাবে। তো কর্ণ সেনের বাড়ির ঠিক পাশাপাশি একটা ফ্ল্যাট বাড়ি। ওখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়ায় নিয়েছেন আমাদের কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক অনসূয়া ব্যানার্জি। আর দু একটি বাড়ির পরে একটি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকেন প্রীতিলতা মুখার্জি। তিনি ফিজিক্স পড়ান। সংস্কৃতের শিক্ষক বলে একটু হীনমন্যতায় ভোগেন কর্ণ সেন। তাই তিনি একটা দেখনসই গাড়ি কিনেছেন। গাড়িতে ড্রাইভারও রেখেছেন। গাড়িটি সারাদিনই কলেজে থাকে।
তো সংস্কৃত শিক্ষক কর্ণবাবুকে গাছপালাওয়ালা বাড়িতে থাকতে দেখে দুষ্টু লোকজন আড়ালে তাঁকে বলে কণ্বমুনি। আর বাড়িটিকে বলে তপোবন। ইদানিং অনসূয়া পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকায় তপোবন নামটা আরো চালু হয়ে গেছে। এমনকি প্রীতিলতাকে তারা প্রিয়ংবদা বলে চিনিয়েছে।
তো পাড়ার ছেলেদের কাছে কর্ণবাবু দাতাকর্ণ। ওটিও ব্যঙ্গচ্ছলে দেওয়া নাম। কর্ণবাবু একজন হাড় কিপটে লোক।
করোনার সময় কর্ণবাবু ওরফে কণ্বমুনি দারুণ বিপদে পড়ে গেলেন। করোনা সংকট সমাধানে বাবু বিবি সকলেই গরিব মানুষ খুঁজে তার হাতে চাল ডাল তুলে দিয়ে মোবাইলে একটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে ব্যস্ত। সরকার এইরকম ভাবে সহনাগরিক গরিব মানুষের লাচারির ছবি তুলে পোস্ট করতে নিষেধ করলেও, কে শোনে কার কথা। তো গোটা সমাজ ভরে গেছে দাতা কর্ণে। গরিব খোঁজো, চাল ডালের প্যাকেট ধরাও, ছবিটি তুলে পোস্টাও। বাজারে এখন এই হিড়িক।
কর্ণবাবু এতেই ফ্যাস্তাকলে পড়েছেন। কর্ণবাবুর বাড়িতে যে মেয়েটা রাঁধুনির কাজ করে, তার স্বামী ঠেলা চালায়। লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠেলা চালানো বন্ধ। তো বউয়ের ছুটি মেলেনি বলে ঠেলাওয়ালা বউয়ের কাছে এসে থাকছে। বাগানের মধ্যে একটা টিনের চালাঘরে , যাকে কর্ণবাবু আউটহাউস বলেন, তাতেই বউবাচ্চা নিয়ে থাকছে ঠেলাওয়ালা। খাবার লোক বাড়লেও রাঁধুনি মেয়ের খাবারের বরাদ্দের কোনো বৃদ্ধি করেন নি দাতা কর্ণ। খবর পেয়ে আমাদের কলেজের অনসূয়া ম্যাডাম ওর ঠেলাওয়ালা বরকে ডেকে বেশ খানিকটা চালডালের ব্যবস্থা করে দেন। প্রীতিলতা ওরফে প্রিয়ংবদাও কর্ণ সেনের রাঁধুনি মেয়ের টানাটানির খবর পেয়ে তাকে ডেকে চালডালের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পাড়ার ছেলেরাই দুষ্টুমি করে ম্যাডামদের কাছে রাঁধুনি মেয়ের অভাবের খবর দিয়েছিল। আর তারাই চালডাল দেবার ছবি মোক্ষম সময়ে মোবাইলে তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে। কর্ণবাবু তা জানতে পেরে, রেগে আগুন তেলে বেগুন। আমাকে ফোন করে এর বিহিত করতে বললেন। আমি তখন বললাম, আপনিও ওঁদের বাড়ির কাজের লোকদের ধরে করে ছবি তুলুন, আর পোস্টান। টিট ফর ট্যাট।
কথাটা বেশ মনে ধরল কর্ণ সেনের। বিশাল বপু নিয়ে লকডাউন পরিস্থিতিতে মুদি দোকানে তিনি মুদিকে বেশ খানিকটা অবাক করে নিচু মানের চালডাল কিনে ফেললেন। এবার অনসূয়ার ফ্ল্যাটে যে মেয়েটি কাপড় ধোয়, তার খোঁজ করলেন। ছবি তোলার জন্য নিজের আই ফোনটি দশ বছর বয়সী নাতির হাতে দিয়েছেন কণ্ব মুনি। অন্যদিন তিনি এটি কিছুতেই কাছছাড়া করেন না।
অনসূয়ার কাপড়ধোয়া মেয়ে তো কিছুতেই চালডাল নেবে না। সে বলে, দিদি আমাকে তিন মাসের মাইনে অ্যাডভান্স করেছেন, আর একমাসের মতো চালডালের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি তোমার জিনিস নিতে পারব না। তাকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে কোনো মতে রাজি করালেন দাতা কর্ণ। এদিকে দশবছর বয়সের নাতি আই ফোন সামলাতে পারে না। ছবি সে তোলে বটে। কিন্তু একবার কণ্বমুনির মুখ ঢাকা পড়ে, তো আরেকবার রজকিনী রামীর মুখ ঢাকা পড়ে। দাতা কর্ণ নাতিকে দাঁত খিঁচোন। কাপড়ধোয়া মেয়ে মুখে জোর করে হাসি টেনে টেনে এনে হয়রাণ। সে আর পোজ় দেবে না। চালডালও নেবে না। অগত্যা কর্ণবাবু চললেন প্রীতিলতার ঘরে যে মেয়েটা হোম ডেলিভারির রান্না টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে যায়, তার বাড়িতে। সে মেয়েও তেমনি ত্যাঁদড়। সে বলে, আমি সেল্ফ হেল্প গ্রুপ করি দাদু। আমি তোমার চালডাল নিবু নি। কথা বলতে বলতে সে খেয়াল করল, কণ্বমুনির চোখ তার নাইটি পরা শরীরের এখানে ওখানে ঘুরছে। রেগে মেগে স্বনির্ভর মেয়ে মুনিঠাকুরের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
দাতা কর্ণ পড়লেন সাংঘাতিক বিপদে। কাকে এখন তিনি খুঁজে বের করবেন, যার ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে লাইক পড়বে!
এমন সময় পাড়ার একটি পরিচিত পাগলকে দেখতে পেলেন দাতা কর্ণ। তাকে তুতিয়ে পাতিয়ে চালডালের সদ্গতি করবেন ভাবলেন তিনি। পাগল তো কিছুতেই চালডাল নেবে না। প্যাকেট ফাঁক করে দেখে সে বলল, চাল এনেচো, ডালও এনেচো। মশলা তেল সবই এনেচো। কিন্তু নুন কই! চোখ পাকিয়ে পাগল দাতা কর্ণের কাছে কৈফিয়ত দাবি করল, নুন ছাড়া সোয়াদ হয়?
নুনের প্যাকেট বাবদে কর্ণ সেন পয়সা দেবেন কবুল করায়, নতুন ফ্যাঁকড়া তুলল পাগলটা। বলল, রেঁধে যে খাবো আমার বাসন কই? কণ্বমুনি ধৈর্য ধরে মধুমাখা গলায় বললেন, তুই আমার বাড়িতেই রান্না করা খাবার পাবি। এখন ছবিটা তুলতে দে বাপ।
পাগল গোমড়া মুখে বলল, ও হবে নি, চালডাল গছাবে, সে এক ঝামেলা, তার উপর আবার ছবি তুলবে, অতো হবে না। তুমি ঘুরে দ্যাখো বাছা।
নিতান্তই বিরক্ত হয়ে দাতা কর্ণ নাতিকে বললেন, আমি যেই জোর করে ওর হাতে চালডাল গুঁজে দেব, অমনি তুই ভিডিও করে নিবি। এই বলে, দাতা কর্ণ পাগলের হাতে জোর করে চালডাল গুঁজতে যেতেই, ক্যামেরার আলো দেখে লজ্জায় সে নিজের অন্তর্বাসহীন শরীরের লুঙ্গিটি তুলে মাথা মুখ আড়াল করল। মুনি ঠাকুরের নাতি ততক্ষণে ফেসবুক লাইভ চালিয়ে দিয়েছে।
ফেসবুক লাইভে পাগলের কাণ্ড দেখে পাড়ার লোক কর্ণ সেনের উপর খেপে অস্থির। পাগল বলে কি মানুষ নয়! এই বলে পাড়ায় বেপাড়ায় যতো মানবাধিকার তাত্ত্বিক আছে, সবাই ওই পোস্টে কড়া কড়া কমেন্ট লিখে মুহূর্তে ভাইরাল করে দিয়েছে। পাড়ার ছেলেরা যারা পাগলটাকে দুবেলা টিটকারি ও তার সাথে ঢিল ছুঁড়ে, অশ্রাব্য গালাগালি শুনে মজা লোটে, তারা পর্যন্ত মাথায় লুঙ্গি তোলা পাগলের নৃত্য দেখে খেপে অস্থির। কর্ণমুনির তপোবনে সবাই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত করে ফেলেছে। তাঁর সদর দরজার উপর পাবলিকের চড় চাপাটি চলছে।
আমি জীপ নিয়ে ক্যাঁ কোঁ করতে করতে ঢুকে পড়লাম। পাগলটা আমায় দেখে ছুটে এল। আমি ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেলাম। আমার রক্ষী সামনে এসে পিস্তল উঁচিয়ে পজিশন নিয়ে নিল। পাগল হো হো করে হেসে বলল, আগে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধো, তবেই তোর সাথে কোলাকুলি করব।