কলাবউ

পাপিয়া জেরীন
অণুগল্প
Bengali
কলাবউ

গাজী পিড়ায় বইসা বউয়ের দিকে চাইয়া রইছে, আঁচলের এক কোনা দাঁত দিয়া চাইপা ধইরা চুলা ঠেলতাছে সে। আইজকা একমাস দশদিন ধইরা পাখীর লগে তার বিয়া হইছে, কিন্তু এহনও শরমের ঘুমটা। গাজী উডানে পানের পিক মারতেই পাখী কেমন নইড়া উডে। বিয়ার রাইতের আজব ঘটনার কথা মনে পইড়া যায় গাজীমিয়ার। মালাশাড়ি পইরা পাখী বইয়া রইছে খাটের মইদ্দেখানে, আধঘন্টা একই রহম বহা. .. এদিকও না হেদিকও না। আচানক বড় বড় চোখ তুইলা কয়…

আপনের মুহে কি পান?

খাইছিলাম, অহন নাইগা।

দুকান থিকা আইনা দিমু?

না, আমি চাবাইন্যাডাই খাই। দেন না!

এই নেও একছিডা, আমি দোকানে যাই। আরো পান নিয়া আহি।

আইজ রাইতে আমনের বাইরে যাওয়া নিষেদ।

আহ্! তুমিও আপার মত পাগল হইলা? আইচ্ছা থাউক যামুনা।

আরেকটু দেন

এই লও

আঙ্গুলো দ্যান, জিহ্বার থন কেমতে লমু।

এমনেই লইবা, কেমনে লইবা তুমি জানো।

আহ্! গাজীর চোখে পানি আইয়া পড়ে, কী সেই রাইত!
এহন আর সিঙ্গেল পানের কারবার নাই, ডবল পান মুখে লইয়া দুয়ার দিয়া বইয়া থাকলেও… পাখী উইড়া আইসা চাপায় চাপ দিয়া ধরে। চুইষা সব পান অর মুখে লইয়া লয়। অহন আবার রান্দন থুয়া এদিকেই আইতাছে।

বউ, তুমি থাক। আমি আইতাছি।

আহেন এইমিহি, পিড়ায় বইয়া তামশা?

এই লও পান। শোন বউ, এইরাম ঘুমটা আর কদ্দিন? আমার তো এমন মেয়েছেলে ভাল্লাগে না। আমার পছন্ হইলো বাইদানী আর যাত্রাদলের মেয়েছেলে।

হিহিহি!

হাসবা না। ঘটনা কই–বয়স তহন আডার কি উন্নিশ। গেলাম যাত্রা দেকতে। যাত্রা কওন যায়না বাল, লেংটা নাচ কইতে পার । আমার এক বনদু ইশারা দিয়া কয়… ঐ, এইডা আমগো ভাই। আর অমনেই এক মাইয়া আমার শইলে আইয়া হায়রে ডলাডলি! যাত্রার মাইয়া ত বুঝই, শইলে কাপড়ই নাই…

এই গফ্ কি আমনে আগের দুই বউরেও কইছেন?

হ রে বউ! কইছি। আমি মিছা কতা কইতে পারিনা।

হাছামিছা বুজিনা, পুরুষমানুষ কত্তা কিছু করবো তয় গোপনে। ঘরে আইয়া কইবেন কেল্লিগা? এল্লিগাই বউ থাহেনা আম্নের।

না রে বউ। এইডা কুনো কারণ না। আমি আসলে বাঁশী বাজাইতাম আগে, হেই বাঁশীতে পরী নাইমা আইছিলো। তার মইদ্দে আছিলো হাফসা নামের পরী। তয় তারে আমি দেহি নাই। কবিরাজের মুখে শুনছি, হাফছা পরীর লাইগা আমার কুনো বউ টিকেনা… তিনমাসও টিকেনা।

কন কী? আইচ্ছা বালা কতা। উডানের কোনায় ওই কাপড় পরাইন্যা কলাগাছের কাহিনী কি? আমারে ত কেউ কিছু কয় না। বড় আফায় কইছে খালি, গাছডার পাতা জানি কেউ না কাটে।

হ, গাছডা তর সতীন। পরতি আগুন মাসে হেরে একটা কইরা নতুন কাপড়, সিন্দুর আর চুড়ি দেওন লাগবো।

আমনে এডি কী কন? আমার তো হাতপাও কাল হইয়া আইতাছে।

হ কবিরাজের আদেশ গো, বউ। ডরাইও না। উনচল্লিশ মাস মানলেই চলবো।

পাখীর বুক কাইপা উডে। এই কাহিনী জানলো হবায়। আল্লারে গত রাইতে আম টুকাইতে গিয়া তয় কি দেখছিলো ভাইবা পায়না। একবার মনে হইছিলো কাপড় পইরা কেউ পিছে পিছে আইতাছে। এই কতা কি গাজীমিয়ারে কইবো কিনা বুঝবার পারেনা পাখী।আরো দুইদিন সোয়ামী সোহাগের সুম মনে হইছিলো উডানের ঐ দিকেই কেউ হাটতাছে। পস্ট শুনতে পাইছিলো। ইয়া মাবুদ!

বউ, চায়ের পানিতো হুগায়া গেলো, পাত্তি দেও।
আর চিনি ঠিকমতন দিও।

এত্ত চিনি খাইয়েন না তো।

আরে বউ, একটা সুময় খালি ফেঞ্চিডিল খাইতাম। অহন হেইডা খাইনা। তয়, বেশী চিনির নিশাডা ছাড়তে পারিনা। বুঝলা? মেয়েছেলে আর নেশাপানি… এইডাই আছিলো আমার সব। একবার কি হইছে….

আর হুনন লাগবো না। আমি সব বুঝি। আম্নে আমার মন নষ্ট করনের লাইগা এইসব কিচ্ছা বানায়া বানায়া কন। কুনো লাভ হইবো না, আমি আম্নেরে ছাইড়া কুনোহানেও যামুনা। বাপ-মা মরা মাইয়া আমি, জীবনে অনেক কষ্ট পুহাইছি। আম্নে বাইন্দা পিডাইলেও আমি মামাবাড়িতে নাইয়র যামুনা।

বিয়ার দশমাস পর।
পাখী সাতমাসের পোয়াতী। রইদে বইয়া পাখী সোয়ামীর কান্ড দেহে। রান্দাবাড়া, বাজার, থালবাসুন, ঘরদুয়ারের কাম গাজীমিয়া এক হাতে করে। পাখী পেট লইয়া লড়াচড়া করবার পারেনা, তাই সোয়ামী আইসা নিজেই চাবাইন্যা পান মুখে দিয়া যায় ঘন্টায় ঘন্টায়। সন্ধ্যারাইতে পাখী এই শইল লইয়া টিকতে পারেনা, বিছানে শইল মেইল্যা দেয়। মাঝেমইদ্দে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হইলে গাজী মিয়ারে কয় জানলা খুইলা দিতে। পেটের ভিতর থিকা বাইচ্চাডা সমানে লাইত্থায়।পাখী অবাক হয়া চাইয়া দেহে কলাবউয়েরও সুন্দর একখান মোচা বাতাসে লড়ে।
গাজী গভীর ঘুমে বেহুশ, পাখী ডাকে–

হুনছেন, এই যে হুনছেন!

কী হইছে বউ!

দেহেন না, কেমন লড়তাছে আমনের বাইচ্চা।

কই দেহি!

পেডে হাত দ্যান ক্যা? জানলা দিয়া বাইরে দেহেন। হিহিহি!

গাজী মিয়া হা কইরা চাইয়া থাকে। কী কইবো বুজনের আগেই জিহ্বা থিকা পানের ছোবলা চাইট্টা লয় পাখী!
ঘুমের ঘোরের মইদ্দেও গাজীর চোখে পানি আইয়া পড়ে। হারিকেন বাত্তিতেও পাখীরে পরীর মত লাগতে থাকে, মনে হয় এইডা পাখী না… হাফসা! গাজীর বাঁশীর সুরে নাইমা আইছে আসমান থিকা।

পাপিয়া জেরীন। কবি। বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে জন্ম (১৯ জুলাই, ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে), মুন্সীগঞ্জেই বেড়ে ওঠা। দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত বই 'ঊনসপ্ততি', প্রকাশিত হয়েছে বৈভব প্রকাশনী থেকে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..