প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
চৈত্রের খরায় পোড়া মাটিগুলো অনেক ডেকেছে বৃষ্টিকে। বুকে চিরে খোলা আকাশকে দেখিয়েছে যন্ত্রণা। বিরহের পোড়া শুষ্ক ক্ষত। ঘাসগুলো কেঁদেছে অনেক। তৃষ্ণাকাতর হলুদ বর্ণ। কচিরা তপ্ত মাটিতে মাথা নুইয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায়। মাঠের উপর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তা। দু পাশে পাতাহীন দুর্ভিক্ষ শরীরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাছ। খোলা মাঠে ভর দুপুরে চরতে থাকা কয়েকটি গরু। গাছগুলোর অল্প ছায়ায় বিশ্রামে পথিক। মাথার উপরে প্রতপ্ত সূর্যের উন্মাদ নৃত্য। তাপসী কৃষকের চোখ আকাশের দূর দিগন্তে। যেদিক দিয়ে ভেসে আসে মেঘের ভেলা। ক্লান্ত শরীরের বুকের হাপর থেকে বেরিয়ে আসে গরম নিঃশ্বাস। কল্পানায় বারিধারার ছবি এঁকে বৃষ্টির কামনা।
এমন এক দুপুর শেষে ভেসে এল মেঘমালা। তাই তো, বৃষ্টি নেমেছে চিতলডাঙায়। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে খুশিতে মেতেছিল মাঠ, গাছ, ঘাস, পতঙ্গরা। সেই সঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে আমার চোখেও। তবে তা কষ্টের, বিরহের, প্রিয়হারা বেদনায়। আমার রাঙা বৌ সানজিদা আমাকে ছেড়ে আজ চলে গেছে অসীমের পারে।
প্রতিদিনের মতো আজকের দিনটাও স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছিল। সকালে বাড়ি থেকে এক সঙ্গে বের হয়েছিলাম। সানজিদা ব্যাংকে চাকুরি করে। সে কর্মস্থলে আর আমি পাখি শিকারে। বাড়ি থেকে অল্প দুরেই চিতলডাঙা মাঠ। সেখানেই পাখি শিকারে গিয়েছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফোন আসে। সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও বেদনাদায়ক সংবাদটি আমি পাই। সানজিদা মারা গেছে। কিভাবে সম্ভব! রিকশায় অফিসে যাওয়ার পথে নাকি বেপরোয়া ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সানজিদা মারা গেছে।
সানজিদা নেই! আমি বিশ্বাস করিনি। আমি বিশ্বাস করতেও চাইনি।
ফোনটা পেয়ে আমি ছুটে যাই হাসপাতালে। সেখানে সানজিদার নিথর দেহ পড়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। অল্প পরেই স্বজনরা চলে আসে। আমি নিঃস্বঙ্গতার শূন্যে ভাসতে থাকি। সত্যি সানজিদা নেই! বারান্দায় সাদা কাপড়ে ঢাকা যে লাশটি পড়ে আছে তা কি সানজিদার? না সানজিদার না। আমি বিশ^াস করতে চাই না ওটা সানজিদা। সে তো ব্যাংকে আছে। আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল ফোনটা খুঁজতে থাকি। সানজিদাকে ফোন করতে হবে। সংবাদটি শোনার পর থেকেই আমি এমনটি কয়েকবার করেছি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। ফোনটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আশেপাশে ঘিরে থাকা স্বজনদের মোবাইলটা চেয়েছি সানজিদাকে ফোন দেয়ার জন্য। কেউ ফোন দেয়নি। সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে।
না, আমি কাঁদিনি। আমি কাঁদতে চাই না। কাঁদবো কেনো? সানজিদা তো বেঁচে আছে। হাসপাতালে শুয়ে থাকা লাশটা সানজিদার নয়।
আমি লাশটি দেখার অনুরোধ জানাই। কিন্তু আমাকে ঘিরে থাকা স্বজনরা বাধা দেয়। কেনো বাধা দিচ্ছে সেটিও আমি বুঝতে পারছি না। আমি দেখবো। তারা কিছুতেই আমাকে দেখতে দেয় না। আমার কান্না আসছে। বুকের ভেতরটা থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু কাঁদতে পারছি না। কান্না যেনো বুকের মাঝে কোথাও এক জায়গায় শোকের পলেস্তারায় চাপা পড়েছে। সবাই কাঁদছে। আমি কাঁদতে পারছি না। বুকের ভেতরে আমার আমিটা ভীষণ কাঁদছে। তোড়পাড় চলছে। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি না। কিছুতেই না। চোখ দুটো শুষ্ক। মরুভূমির মতো। আমার চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে।
সানজিদা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! সানজিদার ক্ষতবিক্ষত মুখটা যখন শেষবারের মতো দেখি তখনও বিশ্বাস করিনি। মনের সঙ্গে বিশ্বাসটা না করার যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু যখন সাদা কাপড়ে জড়ানো সানজিদার শরীরটা আমি কবরে নামালাম। তখন বিশ্বাসটা আমার বুকে জেঁকে বসেছে। সানজিদা নেই। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে আর ফিরে আসবে না। কোনদিন না।
আমার মনে হয়েছিল ওই মাটির গর্তে আমি সানজিদাকে রাখিনি। রেখে এসেছি আমার ভালোবাসা, সুখ, আবেগ, অনুভূুতি, স্বপ্ন। সব সবকিছু রেখে এসেছি। আমি নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরছি। সব মাটির ওই গর্তে রেখে এসেছি। মানুষের জীবন বুঝি এমনই। সকালেই স্বপ্নগুলো সাজানো ছিল। বিকেলেই সব শেষ। মাটির গর্তে চাপা পড়েছে।
বিকেলে দুই তলার বেলকনিতে বসে আছি। একটু আগেই আমার সবকিছু একটি মাটির গর্তে রেখে এসেছি। আমি এখন নিঃস্ব। আমার ভালোবাসা, সুখ, আবেগ, অনুভুতি, স্বপ্ন নেই। এ পৃথিবীতে আমি বড়ই একা। আমি একাই থাকতে চাই। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এমন সমাগম আমার ভালো লাগছে না। সানজিদা যে নেই।
এরমধ্যে বাড়ির কাজের ছেলেটা আমাকে দুই বার ডেকে ফিরে গেছে। প্রতিবারই এসে গলা ঝেড়ে বলেছে, খালু আপনেরে বাড়ির ভিতর ডাকিচ্চে। ম্যালা মানুষ আইছে। আপনের সঙ্গে দেখা করার লাগি।
আমি কাজের ছেলের কথা প্রতিবারই শুনেছি। কিন্তু কোন উত্তর দেইনি। এই মুহুর্তে আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি যাচ্ছি না। ঘরটাতে এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি একা থাকতে চাই। সানজিদার মতো।
আমার ভীষণ অভিমান হচ্ছে সানজিদার উপরে। সে আমাকে একা রেখে চলে গেলো। এমনতো কথা ছিল না। বলেছিল সারা জীবন সানজিদা আমার পাশে থাকবে। সে কথা রাখেনি। আমাকে নিঃস্ব করে সে চলে গেছে।
আমার সামনে ফাঁকা টেবিল। কখন কে যেনো টেবিলটাতে একটা চায়ের কাপ রেখে গেছে। সম্ভবত কাজের ছেলেটা। সকাল থেকে আমি কিছু খাইনি। আমি বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারিনা। আজ আমি জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহুর্ত পার করছি। তাই খিদের বালাই নেই।
আমার বেলকনি দিয়ে সামনের ফাঁকা মাঠটা দেখা যায়। চিতলডাঙা মাঠ। আমি তাকিয়ে আছি সেদিকে। বৃষ্টি নেমেছে চিতলডাঙায়। হঠাৎ আমার চারিপাশ ঝাপসা হয়ে উঠে। আমার চোখেও বৃষ্টি নেমেছে। আমি চোখ মুছে আবার বাইরে তাকানোর চেষ্টা করি। আবার ঝাপসা হয়ে উঠে চোখ। আমি কাঁদছি। সঙ্গে কাঁদছে আকাশ। সেই কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে রোদে পোড়া শুষ্ক ক্ষত চিতলডাঙার মাটিতে। বৃষ্টির ছোঁয়ার ধীরে ধীরে ক্ষত সেরে সজীব হয়ে উঠবে চিতলডাঙার মাটি। সানজিদা বিহনে বুকের ভেতর যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা কি সারবে চোখের পানিতে?
আমি ভাবনায় ডুবে যাচ্ছি। নিঃস্ব হওয়ার ভাবনায়। সানজিদার কথা না রাখার ভাবনায়। এমন ভাবনায় কখন যেনো সামনে রাখা চায়ের কাপটা আমার হাতে উঠে এসেছে। হঠাৎ আমার মনে হয় সকালের একটি ঘটনা। সকালে চিতলডাঙা মাঠে শিকারে বের হয়েছিলাম। মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোর একটির ডালে পাশাপাশি বসে ছিল দুইটি ঘুঘু পাখি। দূর থেকে আমি বন্দুক তাক করি ওদের দিকে। গুলি করি। একটি ঘুঘু উড়ে যায়। অন্যটি সোজা মাটিতে পড়ে। শিকারী হিসেবে বেশ দক্ষ হলেও পাখি বিষয়ে আমার জ্ঞান কম। তবে আমার পাখি বিশারদ বন্ধু বলেছিল, মারা যাওয়া ঘুঘুটি স্ত্রী। পুরুষ ঘুঘুটি উড়ে যায়। খানিক দূরে একটি গাছে বসে পাখিটি আমাদের দেখছিল।
এই মুহুর্তে আমার ভাবনায় সানজিদা ও পালিয়ে যাওয়া সেই ঘুঘুটি। ঘুঘুটিও হয় তো আমার মতো নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। হয় তো পাখিটিও নিঃস্ব হয়ে তার বাসায় বসে বাইরে বৃষ্টি পড়া দেখছে। নিশ্চয় পাখিটিও কাঁদছে। কষ্ট আর অনুতাপে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এলো।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..