কাজরী মজুমদারের কবিতাগুচ্ছ

কাজরী মজুমদার
কবিতা
Bengali
কাজরী মজুমদারের কবিতাগুচ্ছ

ভিজেছি আমি

চোখের জলে ভিজেছি বহুবার,
চাপা কষ্টে মন ভিজেছে শতবার,
অক্লান্ত পরিশ্রমে শরীর ভিজেছে অগুন্তিবার,
তুমি শুধালে মোরে,ভিজেছো কখনো বৃষ্টিতে?
আমার প্রথম বৃষ্টিতে পা ফেলা,
সেদিন দুজনে একসাথে পথ চলা,
দীঘির ধারে বনের মাঝে, সেদিন দুপুর বেলা,
তুমি শুধালে মোরে, ভয় পেয়েছো কখনো ভালোবেসে?
সেদিন চোখেতে চোখ রাখা,
দুজনে হাতে হাতটা ছুঁয়ে থাকা,
 লজ্জা হাসির ইশারাতে একটু কাছে ডাকা,
তুমি শুধালে মোরে, কখনো কেঁদেছো কারোর বিরহে?
হায় রে কপাল আমার!সেই তো আবার…
চোখের জলে ভিজেছি বহুবার
চাপা কষ্টে মন ভিজেছে …

মাঝিভাই

ও মাঝিভাই! আমায় নেবে ?
একটু আকাশ ছোব,
আকাশ নদী যেখানে মেশে!
আমিও আপন হবো।
তোমার দাঁড়ের ছন্দে
আমি, গাইবো অনেক গান।
কথা এখন কয়না পাখি,
হয়েছে যে তার মান।
জলের স্রোতের মাছ গুলোকে,
খেলতে দেখবো বলে।
ওদের খাবার এনেছি অনেক
বলো! ফেলবো নাকি জলে?
একটু নেবো রোদের ছোঁয়া,
তোমার সাথেও আমি?
ভাবছো এটা এমন কি আর
আমার কাছে দামি!
খোলা আকাশ,শীতল বাতাস
নীলের শুধু খেলা।
তোমার সাথে ভাসতে যে চাই
নৌকো রূপী ভেলা।
ও মাঝিভাই! কষ্ট হয়না!যখন,
তোমার শরীর ভেজে?
চলার পথে কেউ কি আছে,
তোমায় আবার খোঁজে?
তোমার শরীর দোলে ঐ,
দাঁড়ের ছন্দেই।
তুমিই আমার প্রকৃতি সাধক,
মনের আনন্দের।
তুমিও থেকো অনেক ভালো
এটুকুই প্রার্থনা,
আসবো আমি এখানে ছুটে
মেটাতে মনের যন্ত্রনা।

️বৃষ্টি

বৃষ্টি আমি চাইনা মোটেই,বৃষ্টিতে কি বা আছে,
চারিদিকে জল কাদা আর কাপড় ভেজে পাছে!
ছাতা ধরে চলতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়,
বৃষ্টিতো নয়, তারই সাথে বজ্রাপাতের ভয়।
বলবে তুমি মূর্খ আমি বৃষ্টি কবির কবিতা,
বৃষ্টি হলো চিত্রকারের তুলির টানে ছবিটা।
বৃষ্টি তুমি স্পর্শ করো হাত বাড়িয়ে জানালায়,
কখনো আবার খোলা ছাদে ভিজিয়ে তোমার সারা গায়।
আমি ভিজি ইচ্ছা বিহীন,বৃষ্টি আমি চাই না,
বৃষ্টি হলে রবি গুরুর গানও আমি গাই না।
বৃষ্টি বিনা ফসল নষ্ট,বাজার মন্দা হবে,
ভুলেই গেছি বাজার মুখো হয়েছিলাম কবে।
পান্তা ভাতে পেঁয়াজ দিয়ে লঙ্কা ডোলে খাওয়া,
দরকার কি পরে কখনো আমার বাজার যাওয়া?
সকালবেলায় ব্যাগে ভোরে ধুপকাঠির ওই প্যাকেট
হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই ছোট বড় সব লোহার গেট।
ভিক্ষা আমি চাইনা,শুধু সহযোগিতাটাই চাই,
ধুপকাঠির বাক্স নিলে একটু পয়সা পাই।
তুমিই বলো বৃষ্টি হলে ভিজবে যে আমার ধুপ
ধুপ বেচতে না পারলে মালিক থাকবে কি চুপ?
যখন শহর গরম দাহে ক্লান্ত হয়ে পড়ে,
যখন সবাই দিন রাত শুধু বৃষ্টি কামনা করে,
তখন আমার গরম জ্বালায়,ঘাম গড়িয়ে বেয়ে,
বলি ঠাকুর দিও না বৃষ্টি আকাশ পানে চেয়ে।
যেদিন জুটবে ভাতের সাথে,একটুকরো মাছ,
সেদিন বলবো বৃষ্টি তুমি ভিজিয়ে দিও গাছ।
আর ভিজিও আমার শহর আমার সারা শরীর,
সেদিন বৃষ্টির গান,কবিতা আমিও শুনবো।

বাউল

বাউল! তুমি বড্ড উদ্ধত,
চিৎকার করে গাঁও।
স্নিগ্ধতা নেই তোমার গানে,
ছন্দে নেচে যাও।
বাউল! তোমার এ কেমন ভূষণ!
রঙের ঘনঘটা,
কখনো রাখো লম্বা দাড়ি,
বাজাও একতারা টা।
বাউল তুমি ভোরের সাধক,
তোমার সুরের টান।
তোমার তালে দোলে এ মন,
ভরে মন প্রাণ।
তোমার গানে দোলে সবাই,
ছন্দে ,তালের সুরে।
খ্যাতি তোমার গানের দরূন,
অনেক দূরে দূরে।
যতই তোমার কমতি খুঁজি,
নত মস্তকে স্বীকার করবো,
তোমার গানের অন্য ধরণ,
বাউল! তুমি বাংলার গর্ব।

চাষী

মাটির উর্বরতায়,সূর্যের কঠোর তাপে,
শরীরের গঠন হয়েছে কদাকার, হালের চাপে!
মুঠো ভরা বীজ আর মাটি কুপানোর অস্ত্রে,
নোংরা,জল কাঁদা লাগানো জীর্ণ নরম বস্ত্রে।
পা ডুবিয়ে জল কাঁদায়, হয়েছে পায়ে হাজা,
ফোস্কা পড়ার ক্ষতর চিহ্ন, এ কেমন নিষ্ঠুর সাজা!
যে দিকে চাই চারিদিকে,শুধু আধার নেমে আসে,
জানি না কেন,তবুও বউটা, আমায় বড্ড ভালোবাসে!
মুখের হাসি বজায় রেখে,মুখ নামিয়ে ঘোমটা দিয়ে,
চাল ফুটিয়ে পেঁয়াজ,লঙ্কা সাজিয়ে পাতে গুছিয়ে নিয়ে,
পরিশ্রমের হাড় ভাঙানি,জীবন যখন ব্যর্থ লাগে,
বউটা আমায় কাছে টেনে ,ভাসায় তখন অন্য সুখে।
ফসল যখন মরতে বসে,বৃষ্টি রাজের কম বেশীতে,
বউটা আমার ভক্তি ভরে ঠাকুর ডাকে,হাতটা জুড়ে।
মাটি যখন শুকিয়ে শ্মশান,দেনার দায়ের লজ্জা করে!
বউটা আমার শেষ সম্বল,নোয়া খানি বেচতে বলে।
নতুন করে সরকারি সব, শর্ত মেনে,বাঁচার আশায়
হালটা ধরে,
বউটা আমার পোয়াতি হলো,বংশ আমার বাড়বে বলে।
বৃষ্টি হলো এবার অনেক,অধিক ভিজে বীজ পচলো!
বউটা আমার চেয়ে চিনতে,চাল আনিয়ে,ভাত ফুটালো।
জল সাগরে ধ্বংস ফসল,জলের শব্দ ছলাৎ ছলাৎ,
বউটা আমার অনাহারে,কষ্ট পেয়ে মরলো হঠাৎ!
চিতার ধোঁয়ায়!ভুলেই গেছি,অনাহারের নগ্ন ভুখ!
বংশ আমার ধ্বংস হল, দেখলামনা তার আর মুখ।
বউটা আমার থাকলো না আর,কপাল খারাপ ছিলো,
নয়তো সেদিন লাল কাপড়ে, কেন- আমার সিঁদুর নিলো!
ধান,গম আর  সব্জি-ফলের, চাষের রকমারি,
তোমরা কেনো চড়া দামে,আমরা ভাতে মরি।
শোন রে মেয়ে!শোন রে সবাই !করিস না তাদের বিয়ে,
যাদের কাজ বীজ ফসলের,কোদাল হাতে নিয়ে,
থাকতে হবে অনাহারে,মিলবে খাবার বাসি,
আমরা হলাম সেই অভাগা যার পরিচয় “চাষী”।

️ধর্ম️

প্রতীক্ষায় আছি বসে,আসবে তুমি যবে,
একটু হেসে হাত বাড়িয়ে ডাকবে কাছে কবে।
দেখবে সবাই, জ্বলবে সবাই, আমায় তোমায় দেখে,
তোমার স্মৃতি আমার কাছে গিয়েছিলে রেখে।
যত্ন করে তোমার কোরান আমার গীতার সাথে,
জড়িয়ে আমি লাল কাপড়ে রেখেছি বিশ্বাসে।
যেদিন সবাই জানলো তুমি ওদের মতো নও,
বললো ওরা শত্রু তুমি,মিত্র মোটেও নও।
গীতা আর কোরান নিয়ে করলাম অঙ্গীকার,
তোমায় না পেলে আমার, এ জীবন বেকার।
সেদিন ওরা দাঁ’য়ের কোপে মারবে বলে এলো,
তোমায় ভালবেসে নাকি আমার জাত গেলো।
যুগের ধারায় মরতে হবে কি আর করবো আমি,
তোমার সাথে মরতে পারলে মৃত্যু হতো দামি।
হঠাৎ করে বহু মানুষ, এলো কোথা থেকে?
সবার হাতে ফুলের থোকা, অবাক আমরা দেখে।
ঘিরে ফেললো তারা,ছিলো যাদের হাতে অস্ত্র,
তাদের সবার গায়ে একই রকম শ্বেত বস্ত্র।
বললো তারা, আমরা সবাই হিন্দু,মুসলিম মিশে,
বলুন দেখি আমাদের মাঝে তফাৎ আছে কিসে?
অস্ত্র হাতে ক্রুদ্ধ হয়ে নামলো যখন ওরা,
বললো ধর্মে পাপ ঢুকবে সইবোনা কখনোই আমরা।
বললো এরা আমরা বাঁচাবো প্রত্যেকটা রক্ত বিন্দু,
হিন্দুর জন্য মুসলিম এগোবে মুসলিমের জন্য হিন্দু।
তোমাদের ভুলেই তোমাদের ধর্ম ভাইরা মরবে যখন,
সইতে পারবেনা,করবে আফসোস তোমরা দেখো তখন।
বললাম আমি, কে তোমরা ?আমি কি দেখছি স্বপ্ন?
এরকমও সত্যি হতে পারে কখনো?
বললো তারা আমরা হলাম ফেসবুকের বন্ধু,
নেই আমাদের জাতি ভেদাভেদ,নেই স্ট্যাটাসের দ্বন্দ্ব।
শুধু নানান পোস্ট দেখি না,দেখি না শুধুই টিভি,
যুক্তি তর্কে,বানাই না শুধু দোষারোপের ঢিবি।
ধর্মের নামে মারবে যারা একে অপরকে,
আমরা রুখবো ধর্মের নামে একের জন্যে – অন্যে।
সবাই হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে এসেই দেখো,
চেষ্টা করার ইচ্ছাটাই মনের মধ্যে রাখো।
পুণ্য পাপের হিসাবে আমরা, পুণ্য ভোরেই নেবো,
সবাই মিলে ধর্মের নামে ইতিহাস বদলে দেবো।

কাজরী মজুমদার। লেখক। জন্ম ও ভিটেমাটি ভারতের কলকাতায়। বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থলের সূত্রে দিল্লিতে বসবাস। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও সামাজিক বিষয়ে সরল ভাষায় লেখালিখি করেন। তিনি বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এছাড়া বিভিন্ন ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..