করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
কিছুদিন আগে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক বলে বসলেন, “কবিতা দিয়ে কী হয়? কবিতা অলসদের কাজ!” কবিতা সম্পর্কে এ ধরনের নানান কথা হরহামেশাই শুনতে পাই। অনেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে কবিতার অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত বাক্যালাপও করে থাকেন। কবিতা- সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে সবচেয়ে মহত্তম শাখা; নোবেল বিজয়ী ওরহান পামুক এর চেতনায়- ‘কবিতা লেখা মানে ঈশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারা’, সমারসেট মম এর ভাষ্যে কবি ও কবিতার মাহাত্ম্য- ‘একজন কবি যখন যাবেন, একজন গদ্যকার তখন পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন!’ কবিতা সম্পর্কে এ রকম শত সহস্র বাক্য-বক্তব্য তুলে দেয়া যেতে পারে। তবু, প্রশ্নটি বারবার ফিরে ফিরে আসে, কর্ণকুহরে কুৎসিত বাদ্য-মাতম তোলে- “কবিতার প্রয়োজন কী?” অত্যন্ত বিব্রতকর এ প্রশ্নের উত্তর পাই কবি পার্সি বিশি শেলি’র এ ডিফেন্স অব পোয়েট্রি (১৮৪০) গ্রন্থটিতে; কবি বলছেন, Poetry lifts the veil from the hidden beauty of the world, and makes familiar objects be as if they were not familiar.
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, কবিতার মাধ্যমে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যগুলো প্রকাশিত হয় এবং একই সাথে কবিতা আমাদের চিরচেনা জিনিসগুলোকে নতুনভাবে দেখায়, অচেনা করে তোলে, কবিতা আমাদের মধ্যে নতুন একটি দৃষ্টিশক্তি উন্মোচন করে যা দিয়ে আমরা পূর্ণিমার চাঁদকে ‘ঝলসানো রুটি’, আবার প্রিয়ার ম্লান চোখকে ‘বেতের ফল’ হিসেবে অবলোকন করি। আর এখানেই কবিতার মাহাত্ম্য- আমরা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করি; একটি মহৎ কবিতা পড়ে ওঠার পর আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু সূর্যকে দেখি না, দেখি তার ক্রোধ অথবা হাসি; বৃষ্টি দেখি না, দেখি বেদনা অথবা প্রশান্তি৷ পুরোপুরি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, কবিতা আমাদের ব্যক্তিগত চেতনায় পরিবর্তন আনে যা প্রবাহিত হয় সমাজে, রাষ্ট্রে- ধীরে ধীরে। এ কারণেই, প্রতিনিয়ত লেখা হয়ে চলেছে কবিতা, সে কবি লিখুন বা অকবি, ভালো হোক বা মন্দ, কবিতা হোক বা না হোক; এ গতি মানবসভ্যতার গতির সমার্থক বলেই বোধ করি।
২.
প্রত্যেকেরই কবিতা লেখার শুরু হয় সাধারণত পদের সাথে পদ মিলিয়ে ছোট ছোট পদ্য রচনার মধ্য দিয়ে। এর একটি বিশেষ কারণ এটা হতে পারে যে, আমরা ছোট থেকেই এ বিষয়টির সাথে নানাভাবে পরিচিত হতে থাকি, মায়ের কাছ থেকে শোনা ঘুমপাড়ানি ছড়া- শিশুকালে, কিছুকাল পরে ছড়ায় ছড়ায় বর্ণমালা শেখা; এর কিছুকাল পরে ছন্দে ছন্দে নামতা বলা। এভাবে ছোট থেকেই আমরা চেতনায় অথবা অবচেতনায়, কোনো না কোনোভাবে কবিতাকে অথবা তার ছন্দকে আমাদের মধ্যে বহন করে থাকি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কবিতার মতো দেখতে হলেই তা কবিতা হয় না।
কবিতা কীভাবে হয়? মনে পড়ে যায় রবার্ট ফ্রস্ট এর উক্তি- “আমার দ্বারা এমন কোনো কবিতাই লেখা হয় নি যার শুরুতে আমি তার শেষ জানতাম।” কবিতা নিজে নিজেই আবিষ্কৃত হয়। কবিতা রচনা করা যায় না, কবিতা সৃষ্টি হয়। যাঁর চেতনায় কবিতা ‘সৃষ্টি’ হয়, তিনিই কবি; বাকি যাঁরা ‘কবিতার মতো দেখতে’ কবিতা লেখেন, তাঁরা লেখক হলেও হতে পারেন, কবি নন। আর এ কারণেই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেন, “সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।” এ কবিতা সৃষ্টি হয় কীভাবে? জীবনানন্দেরই মতানুসারে এ সৃষ্টির মাধ্যমকে আমরা কল্পনাপ্রতিভা বা ভাবপ্রতিভা বলতে পারি। সাধারণে যা দেখে, একজন কবি সেই সাধারণের দেখা সাধারণ জিনিসটিকেই আরো নিবিড়ভাবে অবলোকন করেন, তার করোটির মধ্যে প্রবেশ করেন, সেখান থেকে উৎসারণ করেন এমন কিছু যা দেখেও কখনো দেখা হয় নি; যা অচেনা, কিন্তু খুবই পরিচিত। এ চেনা জিনিসকে অচেনা করে তোলার এবং সাধারণ বস্তুকে অনন্য সাধারণ করে তোলার ক্ষমতাই হচ্ছে একজন কবির কল্পনাপ্রতিভা। কল্পনাপ্রতিভার প্রয়োজনটি আরেকটু স্পষ্ট হয় কবি অমিয় চক্রবর্তীর কথায়। তাঁর মতে, শুধু ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে দিলেই কবিতা হয় না, তাকে বরং ‘জর্নলিজম’ বলা যেতে পারে। কবির কাজ হচ্ছে, বলতে চাওয়া কথাটিকে কল্পনার বিশষত্বে নতুন করে বলা, বাস্তবে উপস্থিত বিষয়টিকে আরো মহৎভাবে উপস্থাপন করা। এক্ষেত্রে অবশ্যই ‘মহৎ’ বলতে কল্পনার এবং ভাষার মাহাত্ম্যকে বুঝতে হবে। একটি ছোট্ট উদাহরণ গ্রহণ করা যাক- কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা ‘দুর্মর’ কবিতা থেকে-
“হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান”
একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই দেখি, কবি যখন বলছেন ‘নিরীহ মাটি’, তখন মাটি আর ‘মাটি’ থাকে না, জনজীবনের প্রতিনিধি হয়ে যায়; আবার যখন সে মাটিতে জন্ম নিচ্ছে ‘সচেতনতার ধান’, তখন সে ধানও আর ‘ধান’ থাকে না, বিপ্লবী চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই কবি ন-বিশেষকে করে তোলেন সুবিশেষ এবং সাধারণকে করে তোলেন অনন্য সাধারণ।
৩.
কবিতা সৃষ্টির প্রসঙ্গ এলেই যে বিষয়টি প্রথমেই সামনে এসে হাজির হয়, সেটা হচ্ছে ছন্দ। ছন্দের বিষয়টি শুরুতেই পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। অনেকে মনে করে থাকে, পদের সাথে পদ মেলানোটাই ছন্দ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, কবিতায় শব্দের ছন্দের চেয়ে ভাবের ছন্দই বেশি বিবেচ্য।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, “শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ আছে ভাবের বিন্যাসে, সে কানে শোনবার নয়, মনে অনুভব করবার। অর্থাৎ কবিতায় ছন্দ তো অতি অবশ্যই আবশ্যক, কেননা ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাঁধা সেতার, কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে পারে।” সেতারের তার বাঁধা থাকে ঠিকই, কিন্তু তা সুরকে দেয় মুক্তি; ছন্দের কাজও তা-ই। সে ছন্দ হতে পারে শব্দের সাথে শব্দ মিলিয়ে প্রতি চরণে অন্ত্যমিল দিয়ে, অথবা শুধুই কবিতার ভাবের মধ্যে দিয়ে। কোলরিজ বলেন, “Poetry: the best words in the best order.” এ শব্দসজ্জা তো ছন্দের জন্যেই। শব্দের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে ছন্দ থাকে, কবিতার ক্ষেত্রে তা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আরো স্পষ্ট হয় ডব্লিউ এস মারউইন এর কথায়; তিনি বলছেন, “Poetry is like making a joke. If you get one word wrong at the end of a joke, you’ve lost the whole thing.” সুতরাং, শুধু শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দিলেই হবে না, বুঝতে হবে তার ছন্দ, এবং সে অনুযায়ী উপযুক্ত স্থানে তাকে স্থাপন করাটাও শেখা প্রয়োজন। কবিগুরুর কবিতা বিশ্লেষণ করে বিষয়টি ধরা যেতে পারে। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায়—
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ’পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
শুরুতে আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া কোমল শব্দবুনন, পঙ্ক্তিচয়ন; উচ্চারণ করতেই হৃদয়ে কোথাও সূর্য-হাসির কোমল স্পর্শ অনুভূত হয়। কিন্তু, ওই যে, ‘জাগিয়া উঠিল প্রাণ’! প্রাণের এ জাগরণ ও স্পন্দন আরো স্পষ্ট পরের চরণগুলিতে—
“জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।”
প্রাণ, অথবা হৃদয় জেগে ওঠে, সে জাগরণ ঘটে অতিদ্রুত, প্রথম দুটি পঙ্ক্তির দ্রুততাও সেই দ্রুততারই সমার্থক; সেই সাথে সাথে শব্দ নির্বাচনটাও অভিনব হয়ে ধরা পড়ে আমাদের সামনে— ‘উথলি’— প্রাণের যে আবেগের কথা এখানে বলা হয়েছে, তার আস্ফালন প্রকাশ করতে এর চেয়ে ভালো শব্দ আর কী-ই বা হতে পারতো! যে তাল এবং লয় পঙ্ক্তি দুটি পড়ার সময় বেজে ওঠে, তার মাধ্যমে হৃদয়-জাগরণের যে অস্থিরতা, চঞ্চলতা, অরোধ্য বিহ্বলতা কবিতায় প্রকাশ্য তা যেন কবিতা পড়ে বোঝার আগেই অনুভূত হয়ে যায়— টি এস এলিয়ট এর ভাষায়— কবিতা বোঝার আগেই অনুভূত হয়। এরপর, হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতিগুলো আর বদ্ধ বক্ষে আটকানো যায় না, বের হয়ে আসতে চায়, প্রাণের আবেগগুলো সব বন্ধন-শৃঙ্খল-দেয়াল চূর্ণ করে বের হয়ে আসে; উপরের শেষ পঙ্ক্তিটির অবয়ব-দীর্ঘতায়, কবির সে আবেগ তার অসীমতা নিয়ে, রোধ করার সকল শক্তি ভেঙে ছিটকে যেন বাইরে চলে আসে, তাকে রোধ করা যায় না। এর ঠিক পরেই—
“থর থর করে কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।”
দীর্ঘ একটি চরণ শেষে ছোট ছোট পঙ্ক্তির অবতারণা; কারণটি পরিষ্কার— ভূধরে যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে তা কবিতার পঙ্ক্তি পড়েই অনুভূত হয়, কবিতার এ পঙ্ক্তিটি উচ্চারণের সময়ও সে কম্পন প্রতিবিম্বিত হয়। রাশি রাশি শিলা খসে পড়া, জলের ওপর সৃষ্ট ফুলে ওঠা ছোট ছোট ফেনা, এবং প্রচণ্ড গর্জন— এসব কিছুই পঙ্ক্তিগুলোর অবয়বে ধরা পড়ে। এভাবে ভাবের সঙ্গে ছন্দ, ছন্দের আদলে শব্দ নির্বাচন, তাকে যথোপযুক্ত অবস্থানে স্থাপন করা— এগুলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিত— আর এ সব মিলিয়ে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার দ্বারাই কবিতার ভাব রচিত হয়, সৃষ্টি হয় কবিতা। সুতরাং, কবিতা সৃষ্টি যে কোনো দৈব প্রেরণা নয়, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
৪.
বর্তমান সময়ে, কবিতার ছন্দ নির্বাচনে, কবিগণের মধ্যে, বিশেষত নবীন কবিদের মধ্যে যে ছন্দটি সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দে গৃহীত হয়, তা হচ্ছে গদ্যছন্দ৷ খুব সম্ভব, ‘গদ্যছন্দ’ বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়ার দরুণ অনেকেই এ ছন্দটিকে সহজ ভেবে কবিতা রচনায় গ্রহণ করেন, আবার অনেকেই উপহাসে উড়িয়ে দেন এ ভেবে যে, এটি গদ্যকে ভেঙে কবিতা বানানোর অপচেষ্টা৷ ‘গদ্যছন্দ’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি শব্দ পাই— গদ্য এবং ছন্দ৷ এ কথা সন্দেহাতীত যে, গদ্যেও ছন্দ থাকে; তাই বলে ছন্দ থাকলেই কোনো গদ্য কবিতা হয়ে ওঠে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই ছন্দটি গদ্যের না হয়ে কাব্যের হয়৷ অর্থাৎ, গদ্যের শরীরে কাব্যের ছন্দ ঠিকঠাকভাবে বসাতে পারলে, তখনই কেবল গদ্যছন্দ সৃষ্টি হয়৷ গদ্যের বাক্য ভেঙে দিলেই যে গদ্যছন্দের কবিতা হয়ে যায় না, তা তার ছন্দ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়৷ কবি শামসুর রাহমান এর ‘অক্ষরের ধারণ ক্ষমতা’ কবিতাটিকে আমরা গদ্যের শরীরে লিখে দেখি গদ্যছন্দের এ কবিতাটি শেষ পর্যন্ত কবিতাই হয়ে উঠেছে—
‘যখন তোমাকে দেখি আমি, পাঁচ হাজার বছর নিষ্পলক তাকায় তোমার দিকে; অথচ আমার দৃষ্টিকে করেছে বন্দি ওরা অদৃশ্য দেয়াল গেঁথে। রাশি রাশি সিমেন্ট এবং বালি চোখে পুরে দিতে চায় সকল সময়। যেন আমি অন্ধ হলে ছিল ভালো, নদীতে হতো না ভরাডুবি। ভালো ছিল, শৈশবের শ্যামল ছায়ায় ছিলে তুমি কোনোদিন। তখন তোমাকে ছুঁলে কারো ধিক্কারের বাজ পড়তো না আমার মাথায়। আর আজ চক্ষু মিলনেই ঢি ঢি পড়ে যায় দশদিকে; কেউ কেউ এমন কি রায়বেঁশে হয়ে ওঠে।’
একটু উচ্চারণ করে পড়লেই বোঝা যায় যে, গদ্যের শরীরে লিখলেও তা কিন্তু গদ্য হয়ে ওঠেনি, কাব্যের সুষমাই তার প্রতিটি বাক্যে প্রতিসরিত হচ্ছে৷ এ কবিতাটি তাই শুধু পঙ্ক্তি ভেঙে দেয়ার কারণেই কবিতা হয়ে ওঠেনি; কবিতা হয়ে উঠেছে তার অন্তঃসার-সুষমার জন্যই৷ এ ক্ষণে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে যে, যদি গদ্যছন্দে লিখি, তাহলে পঙ্ক্তিগুলি ভাঙা হবে কোন প্রক্রিয়ায়? মনে রাখা প্রয়োজন, সকল ধরনের ছন্দের ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য— বাক্যের এবং কখনো কখনো শব্দের বক্তব্য অনুযায়ীই পর্ববিভাগ ও পঙ্ক্তিবিভাগ করা প্রয়োজন৷ কবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘বৃষ্টি’ কবিতার কিছু অংশের পঙ্ক্তিবিভাগ দেখি—
মেঘে মাঠে শুভক্ষণে ঐক্যধারে
বিদ্যুতে
আগুনে
ঘূর্ণিঝড়ে
সৃজনের অন্ধকারে বৃষ্টি নামে বর্ষাজলধারে৷৷
প্রথম পঙ্ক্তিটিতে চারটি পদ, এরপর এক একটি পদে এক একটি পঙ্ক্তি, এবং শেষে আবারো একটি বড় পঙ্ক্তি৷ একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাই, ‘বিদ্যুতে’, ‘আগুনে’ এবং ‘ঘূর্ণিঝড়ে’ শব্দ তিনটি দ্বারা পৃথক পৃথক পঙ্ক্তি রচনার ফলে এ তিনটি উদ্দীপকই বিশেষভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে; প্রথমে বিদ্যুৎ, তারপর আগুন এবং এরপর ঘূর্ণিঝড়ের চিত্রগুলো আমাদের সামনে যথেষ্ট পরিমাণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে; ওই তিনটি শব্দ এক পঙ্ক্তিতে লিখলে চিত্রকল্পটি এভাবে এতটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিত না৷ এবং শেষের তুলনামূলক বড় পঙ্ক্তিটিতে বৃষ্টির বহমানতা পঙ্ক্তিটির শব্দচয়নের সাথে সাথে তার আকারেও ধরা পড়ে; পঙ্ক্তিটি উচ্চারণ করে পড়লে আমরা ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়ার ব্যবধিটিও অনুভব করে উঠতে পারি৷
এ তো গেল পঙ্ক্তি ভেঙে গদ্যছন্দের ব্যবহারের দিক; এবারে তবে একেবারে সরাসরি গদ্যের শরীরে লেখা একটি কবিতা বিশ্লেষণ করে দেখি৷ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ‘পাহাড় চূড়ায়’ থেকে—
‘এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাবো, তারপর শুধু রুক্ষ কঠিন পাহাড়। একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা৷ আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না। আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো, প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা- এখানে আমার কোনো অহঙ্কার নেই।’
কবি ইচ্ছে করলে বাক্য ভেঙে ছোট-বড় পঙ্ক্তিতে সাজিয়েও লিখতে পারতেন; তা তিনি করেননি৷ আমাদের সামনে দৃশ্যত একটি গদ্য উপস্থাপন করেছেন; কিন্তু তার অন্তর্নিহিত কাব্য আমাদের সামনে সমহিমায় প্রকাশিত৷ তাই গদ্যের শরীরে লেখা হলেও তা গদ্য না হয়ে কবিতাই হয়ে উঠেছে; কীভাবে? কবি যে এখানে গদ্যের শরীরে পরিয়ে দিয়েছেন কাব্যের ছন্দ! আর এভাবেই একটি কবিতা তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যগুণেই কবিতা হয়ে ওঠে, অবয়বটি তাই নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়৷
আগেই বলেছি, অনেকে গদ্যছন্দকে সহজ ভেবে যাচ্ছেতাই ব্যবহারে কবিতাকে আঁস্তাকুড়যোগ্য বানিয়ে ফেলেন৷ তাই শ্রীশচন্দ্র দাশ এর সতর্কবাণী তাঁদের জন্য— ‘শক্তিমান লেখক না হইলে এই ছন্দে কবির অপমৃত্যু৷’ তবে ছন্দোবদ্ধ কবিতার তুলনায় গদ্যছন্দে যে ভাব-বিষয়টি আরও গভীর এবং স্বাধীনভাবে, আরও পরিষ্কারভাবে ধরে রাখা সম্ভব, তা বুঝতে পারি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কথায়— ‘গদ্যের আছে সহজ স্বচ্ছতা৷ তাই বলে এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে, গদ্যকাব্য কেবলমাত্র সেই অকিঞ্চিৎকর কাব্যবস্তুর বাহন৷ বৃহতের ভার অনায়াসে বহন করিবার শক্তি গদ্যছন্দের মধ্যে আছে৷’
সবশেষে আরেকবার কবিগুরুকে স্মরণ— তিনি বলেছিলেন, ‘কবিতা আমাদেরই এক আশ্চর্য পুনরুত্থান ঘটায়৷’ সকল কাব্যপ্রেমী পাঠক ও লেখকের নিকট তাই একটিই নিবেদন, আমাদের এ পুনরুত্থান যেন সৌন্দর্যমণ্ডিত সার্থক পুনরুত্থান হয়৷
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..