কাশের কারসাজি

সুদীপ ঘোষাল
ছোটগল্প
Bengali
কাশের কারসাজি

প্রথম পর্ব

 

নদীর ধার দিয়ে নিত্য আমার আনাগোনা । গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী কালো রূপে আলো ঘেরা অভয় বাণী ।বর্ষায় পরিপূর্ণ গর্ভবতী নারীরূপ । এই রূপে জলবতী নদীতে অতি বড় সাঁতারু ভুলে যায় কৌশল । আমি তখন নদীর বুকে দুধসাদা ফেনা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলি বাক্যহারা হয়ে ।

এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি । তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকী হয়ে যাই । আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে । মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার ।

নদী এরপরে হেমন্তের বুকে ছবি এঁকে এগিয়ে যায় শীত ঋতুর আহ্বানে । লোটা কম্বল বগলে আমি রাজস্থানী সাজি । কখনও ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত শাল জড়ানো খাঁটি বাঙালি । মাঝে মাঝে কোট প্যান্ট পরিহিত বিদেশী সাহেবের সুন্দর সাজ । আমি সারা পৃথিবীর সাজে সজ্জিত হতে চাই শীতের আদরে ।

শীতল আড়মোড়া ভাঙতেই বসন্তের বাসন্তী রঙের তালে তালে আমি রঙের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই । সকলের অন্তরের গোপন রঙ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি । এই সময়ে আমার রাধাভাব ছড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অজয়ের মদনমোহনের রূপে ।

আমার সমস্ত শরীর মন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মনোদেবতার মহান চরণে …

দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , “ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না” ।অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা ।ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,”আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম ” । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো । বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?

রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে ।
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,
ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।

অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।

আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা । শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে । আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না ।পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার । সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি । কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে ।

দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে । হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায় ।

কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের । এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব । মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত । হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে । দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে ।

আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন । সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের
মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন ।

আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই । কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন । অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার । মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো । প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি ।

শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো । তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ ।

 

আজ তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে । হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পরে ছিলো তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে ।

___পলাশ তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো ।

____এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার করবী ।

কে যে মরে আর হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে । সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে । আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম প্রথম সমুদ্র দেখার মতো ।

তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে । কোনোদিন ভেঙ্গে পরে নি মন । হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো । না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর ।

এখন জলপাইগুড়ির প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব । আমার এক স্প্যানিয়াল বন্ধুকে নিয়ে ঘর করি । কোনো কথা নেই , কোনো ঝগড়া নেই । ভালোবাসার চোখে দেখি একে অপরকে ।আপন মনে থাকতে থাকতে মনে চলে আসে জ্যোৎস্নার কথা । বৃষ্টির এক দুপুরে তার চিঠির কথা আজও মনে পড়ে । সে লিখেছিলো ,ধনী পিতার একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবার যেমন নজর বন্দী করে রাখে পাছে ছেলে ভালোবাসা র খপ্পরে পরে পর হয়ে না যায় । ঠিক তেমনিভাবেই রেনকোট, ছাতার আড়াল করে আমরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও বৃষ্টির ভালোবাসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি না ।বৃষ্টি বলে সুন্দরী যেমন একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবারের নজর থেকে নিজের করে নেয় ,ঠিক একইভাবে বৃষ্টি আমাদের. একমাত্র সুন্দর দেহ জামার কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে । তারপর হাঁটা পথে চলার রাস্তায় জল পরম মমতায় পায়ে জলের শে কল পরিয়ে রাখতে চায় । বৃষ্টির সময় চোখে মুখে জল আদরের প্রলেপ লাগায় । ঠোঁট চুম্বন করে শীতল স্পর্শকাতর জল । তার আদরে প্রেমজ্বরে পড়তে হয় মাঝে মাঝে । আমি ভালোবেসে তাকে বলছি, তুমি আমার জ্বরের মাঝে ঝরঝর ঝাঁপিয়ে পড়ো । আমিও বৃষ্টি হয়ে যাই ।

তারপর জানতে চেয়েছিলো কেমন হয়েছে তার চিঠি । তখনও আমি কিছুই বলতে পারি নি ।

আমি ও জ্যোৎস্না যে গ্রামে ভালোবাসা র বয়সটা কাটিয়েছি তার কথা আজ মনে সবুজ সর ফেলছে । শুধু মনে পড়ছে,

আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু ।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে । কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে । রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর । ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা । এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে । তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির । এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা । গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা । এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম । সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না ।কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড় । তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া । এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে । সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা । কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা ।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক । মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই । বেশ জেঠু জেঠু ভাব ।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি । আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া । সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই ।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।

এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান ।

আজ জ্যোৎস্না খোঁজ নিয়ে আমার জলপাইগুড়ি র বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ।এসেই নিজের ঘরের মতো এলোমেলো জীবন সাজাতে চাইছে । আর কথা বলে চলেছো অনবরত । ভালো করে তৈরি হয়ে এসে বিছানায় বসে শরীর টা এলিয়ে দিলো । তারপর শুরু করলো, মনে আছে তোমার সব ঘটনা । জানো আমি সুখী নই । কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । আবার আমার দুর্বল জায়গা জাগিয়ে তোলার জন্য পুরোনো কথা শুরু করলো ।ও জানে না আমি স্মৃতি জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছি ।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনাতে লাগলাম পুরোনো বাল্য ভারত, তুমি শোনো জ্যোৎস্না,

ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে
বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।

এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।
তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে…

কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে । আমার প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি । জ্যোৎস্না বললো, জানো বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয় । এসো আমরা এক হই পরম সুখে । আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম ।

জ্যোৎস্না কি ভুলে গেছে মনে ভাসা সবুজ সর নিয়ে ,দুঃখ কে জয় করার মানসিকতায় এক ভারতবর্ষীয় যাপনে আমি ডুব দিয়েছি জীবন সমুদ্রে….। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। আমি একা থাকতেই ভালোবাসি। মাছ ছিপ দিয়ে ধরতে ভালোবাসি। আবার ভূত দেখার বাল্যসখও আছে। অনেকে হয়তো আড়ালে হাসবেন। আমার জীবনে এই ঘটনাগুলো প্রাধান্য দিয়ে না পাওয়ার দুঃখ ভুলতে চাই। এবার একটু ছেলেমানুষ হতে ইচ্ছা হচ্ছে। জ্যোৎস্নাকেও শুনিয়েছি এই গল্প।

জানি না বিশ্বাস করবে কি না । আমি কিন্তু পেত্নী দেখেছি । সেই ঘটনাই বলছি ।আমার এক ফুলবাবা ছিলো। রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে ট্রেনে পরিচয়। সেই ফুলবাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।

ওনাদের বড়ো বড়ো পুকুর । পূর্ব বর্ধমানের এই গ্রামের মত বড় পুকুর খুব কম গ্রামেই আছে ।

আমার মাছ ধরার নেশা । কাউকে কিছু না বলে একটা মাছ ধরার হুইল নিয়ে শ্যাওড়া গাছের ছায়ায় বসেছি ।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল । বাড়িতে সকলের শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে ।এ নেশা সাংঘাতিক । যার আছে সেই জানে । ফাৎনা ডুবে গেছে । আমি খেঁচ মেরে মাছ ডাঙায় তুলে ফেলেছি ।এক হাতে টর্চ ।

হঠাৎ এক পায়ের এক সাদা কাপড় পড়া বুড়ি এসে বললো, পেলি এতক্ষণে একটা মাছ । এই দ্যাখ , আমি আনছি ।

বলেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো । দু হাতে দুটো মাছ ধরে হাসতে লাগলো ।

_____হি হি হি হি

হৃদয় থমকে দেওয়া সেই হাসি ।

তারপর এক পায়ে লাফিয়ে শ্যাওড়া গাছে উঠে বললো, আয় আয় গাছে আয় ।

আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝড় আমাকে উড়িয়ে গাছে তুলে আবার নামিয়ে দিলো ।

তারপর আমার জ্ঞান ছিলো না ।
শুনেছি আমার শালাবাবু বন্ধু দের সাথে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করে ।

তারপর আর কোনোদিন মাছ ধরার শখ হলেই অই মেছো পেত্নীর কথা মনে পড়ত

এখন আমি জেনে গেছি ভূত বলে কিছু নেই । তবু ছোটোবেলার বিশ্বাস ধরে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে । পাঠক নিশ্চয় ক্ষমা করবেন । আবার এক ঘটনা মনে পড়ছে। বলবেন, এই বয়সে । আমি বলি আমার কবি বন্ধু বলেন বয়সটা সংখ্যা মাত্র । অন্য কিছু নয় ।

আমার ছোট পিসির বাড়ি বেলুন গ্রামে । দূর থেকে যখন দেখতাম বাবলা পলাশ, শিমূলের মায়া ঘেরা একটা ছবি ভেসে উঠতো চোখের সামনে । আমার বাড়ি পুরুলে গ্রামে । তখন রাস্তা ঘাট এত উন্নত ছিল না । হাঁটা পথে আল রাস্তা ধরে আমি পিসির বাড়ি যাওয়া আসা করতাম । পিসীর আদরের টানে বার বার বেড়াতে যেতে মন হতো । কিন্তু ভয় করতো । সেই ভয়ের কথাই বলছি।

একদিন আমি ও আমার ভাই বাবু পিসির বাড়ি যাচ্ছিলাম । যেতে যেতে রাস্তায় সন্ধ্যা নেমে এলো । ছোটো কাঁদরের ধারে জঙ্গলে শিয়ালগুলো ডাকতে শুরু করেছে । তারা সুর করে বলছে, হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া, ছোটো ছেলে বাগিয়ে শোয়া । খুব ভয় করছে । তারপর আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ।

বটগাছতলার কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম বড় বড় দুটো পা রাস্তা আগলে রেখেছে।

বাবুর খুব সাহস । বললো, কে গো তুমি ,পা টা একটু সরাও না । আমরা যাবো ।

____দাঁড়া আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যা ।

____বলো কি বলছো ?

_____তোদের থলিতে কি আছে দেখা ।

____কিছু নেই ।

_____তবে রে , আমি তো মাছের গন্ধ পাচ্ছি ।

_____ঠিক বলেছো । পিসিকে দোবো ।

___আমাকে দে বলছি

এই বলে মেছে ভূতটা থলিটা উড়িয়ে নিয়ে বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতে লাগলো । জ্যোৎস্না শুনে ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করতো, সত্যি, বাবারে আমি আর শুনবো না। বলেই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। আমি বলতাম,

তারপর থেকে বাবার সঙ্গ ছাড়া আমরা পিসির বাড়ি যেতাম না ।

পরে বাবা বুঝিয়ে বলতেন, অই গাছের ডালপালা অন্ধকারে দেখতে ভয় লাগে । ভূত বলে কিছু হয় না ।

তবু আমারএই বিশ্বাস ধরে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে ।আর একবার জ্যোৎস্নাকে গল্প শুনিয়ে ছিলাম। সে অবাক হয়ে শুনেছিলো।

অন্ধ কুসংস্কার কত জনের প্রাণ কেড়ে নেয় আমার মামার বাড়িতে দেখেছিলাম ।

বীরভূম জেলার আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রামে আমার মামার বাড়ি ।গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বক্রেশ্বর নদী ।গাছে গাছে সাজানো গ্রাম । তখন আমার বয়স চোদ্দ কি পনেরো।
আমি মামার বাড়িতে এলে একমাস থাকতাম। আসার দুই দিনের মধ্যেই জানতে পারলাম বুড়ো বটগাছতলায় একটি লোক একমুখ দাড়ি নিয়ে নানা রকমের বিস্ময়কর কাজ করে দেখাচ্ছে। হাত থেকে আগুন বের করে দেখাচ্ছে। প্রচুর লোক তাকে দেখতে আসছে ।
আমি একটা লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আশায় ওখানে যাচ্ছেন।
____ আরে দাদা, উনি মহাপুরুষ , উনি যা বলেন তাই হয় ।

——কি রকম, একটু ভেঙ্গে বলুন ।

——–একটো ঘটি আছে । ঘটিটো থেকে জল ছিটিং দিছে আর তারপর যা বঁলছে তাঁই হচে ।

বীরভূম জেলার ভাষা এইরকমই । শুনতে বেশ ভালো লাগে ।

আমি পিছনে পিছনে কথা বলতে বলতে মহাপুরুষের কাছে গেলাম । দেখলাম অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ।

একজন এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমার ভবিষ্যৎ একটু বঁলে দেন কেনে ।
মহাপুরুষ তার সঙ্গীকে বললেন, এর সঙ্গে কথা বলে ওর অসুবিধা আমাকে লিখে পাঠা ।

মহাপুরুষের প্রায় দশজন সঙ্গী । গ্রামের আদিবাসী পাড়ার কয়েকজনকে বশ মানিয়ে নিয়েছে ।বেশ ভালো রকম আয় হচ্ছে তার ।

একটি তরুন এগিয়ে এসে বললো, এই ফোর জি র যুগে চিটিং বাজি ।বেটা দেবো তোমার ব্যবসা গুটিয়ে ।

মহাপুরুষ রেগে বলে উঠলেন ,তোর ফোর জি তে ঝুল জমবে । আমার অভিশাপ বারো ঘন্টার মধ্যে তোর বিপদ হবে ।

তরুণ টি বলে উঠলো, শোনো নি ফাইভ জি চালু হয়েছে অনেক দেশে । তোমার চিটিং বাজি চলবে না ।

পাঁচ ঘন্টার মধ্যে শোনা গেলো তরুণ টি মোটর সাইকেলের ধাক্কায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ।
মন টা খুবই খারাপ হয়ে গেলো । সরল মানুষ গুলিকে এরা ঠকিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন । ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম ।
অনেক ঘটনা জীবনে জলছবি হয়ে আছে । ঠিকমতো সাজাতে গেলে সুন্দর মুখও অসুন্দর হয়ে যায় । এই পাগলের প্রলাপ শুনতে জ্যোৎস্না বড়ো ভালোবাসতো। সেই ঘটনাগুলো একটু শেয়ার করলাম। বলুন এর মধ্যে ভালোবাসার গল্প কোথায়। তবু সে আমাকে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম কোনো এক ক্ষণে, মাহেন্দ্র ক্ষণে। সে ভালোবাসা টিকে আছে আজও। শরীর পেরিয়ে এক অনুভবের জগৎ এই ভালোবাসা। সব নিয়ম অমান্য করে জীবনের এই গল্প, এই কবিতা আমার জীবনে চলার পাথেয়।

আজ নববর্ষ । একটা চিঠি লিখলাম জ্যোৎস্না কে । হে নীরবতার অতীত,

নববর্ষের পূণ্য লগ্নে সবার আনন্দে অংশীদারী হয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নেবো । সকলের সুখ দুঃখেই আমার অংশগ্রহণে মনের ময়লা সাফ হয়ে গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী । নববর্ষে শপথ নেবো কেউ কারো নিন্দা করবো না । ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে পারস্পরিক বোঝা পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবো ।সকলের সুখেই সমাজের মঙ্গল । ভারতবর্ষের এই সনাতন ঐতিহ্য অটুট রেখে , জাত পাতের বালাই দূরে রেখে এগিয়ে যাবো সবাই এক সুন্দরের আহ্বানে । আপন আপন কর্মে সবাই স্থির থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবো । একজন আদর্শ মানুষ হবার চেষ্টায় রত থাকলে হিংসা ,ঘৃণা ,পরশ্রীকাতরতা দূরে সরে যাবে ।মনে রাখতে হবে কবির বাণী , সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে । আর মনে রাখতে হবে কিছুই আমি সাথে আনি নি, কিছু আমরা নিয়েও যাবো না । একমাত্র ত্যাগের এই সনাতন বাণী আমাদের প্রকৃত মানুষের মর্যাদা দিতে পারে।

এই চিঠি লেখার অনেক পরে জ্যোৎস্নার চিঠি পেয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম তার অনেক খবর। সে স্বাধীন, মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার। আমার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করবার আভাষ জানিয়েছিলো। আমি চাই নি।আমার মন বাধা দেয় বারবার।

আমার মেছো বন্ধু নবকুমার জাল নিয়ে উদোম গায়ে ঘুরত একটা শর্টপ্যান্ট পরে। একদিন সে নিজের প্রেমের গল্প, জীবনের গল্প বলেছিল। তার পালিত পিতা ছিল মনা বায়েন।

কাটোয়া ঘাটে মনা বায়েন স্নান করতে এসে দেখলো, এই কি ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া আমার ছেলে।এই গঙ্গায় স্নান করতে এসেই ছোটোবেলায় তার ছেলে হারিয়ে গেছিলো।মন জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,হে ঈশ্বর তোমার অসীম করুণা। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছো।মনা একটা ভ্যানে চাপিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে এলো।মনার স্ত্রী মায়ের যত্নে সারিয়ে তুললো ছেলেকে। মনা বললো,আমরা নতুন করে আবার আমাদের ছেলেকে ফিরে পেলাম, তাই এই ছেলের নাম দিলাম নবকুমার।ছেলেটি বললো,আমার নাম দিলেন নবকুমার।আমি কে কোথা থেকে এলাম? মনা বললো,তুমি আমাদের ছেলে। নবকুমার বললো,আমার কিছুই মনে পড়ছে না। আমি আপনার ছেলে।আমার মা কোথায়। মাকে জড়িয়ে ধরে নবকুমারের কান্না। মাথায় প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে সে ভুলে গেছে পূর্ব কাহিনী।এদিকে কপালকুন্ডলারও স্মৃতি হারিয়ে গেছে পাথরের ধাক্কায়। এক জমিদার স্নান করতে এসে উদ্ধার করলেন তাকে। দেখলেন এ তো এখানে থাকলে বিপদ হবে।লোকজনদের বললেন,একে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলো।অনেক কাজের মেয়ের মধ্যে এ বেঁচে থাকবে।বাড়িতে সুস্থ হলে মেয়েটিকে সবাই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। তাই গিন্নিমা তার নাম দিলেন পিউ।সে মেয়ের মতই থাকবে আর যতটা পারবে বাড়ির কাজ করবে।তাছাড়া পিউ লেখাপড়াও শিখতে শুরু করলো।শুরু হলো তাদের নতুন জীবন। দুবছর কেটে গেলো তাদের। তারপর এলো শরৎকাল। এক কাজের লোকের সাথে পিউ এসেছে ঢোলের খোঁজে।কাটোয়ার বায়েনপাড়ায় তারা পেয়ে গেলো নবকুমার বায়েনকে।তাকে নিয়ে চলে এলো কুন্তিঘাট।বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি। সহজে থামার নয়। আলপথে হেঁটে আসছে পিউ। তার পিছনে ঢোল কাঁধে নবকুমার বায়েন। নবকুমার নিজের বুদ্ধিতে ঢোল বাজানো শিখেছে। এবার সে জমিদার বাড়ি কুন্তিঘাটে যাচ্ছে পুজোর সময়।সেই হারানো প্রেম আবার যেন ঘুরে এসেছে। পিউ আর নবকুমার। মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের প্রেমিক প্রেমিকা। পিউ স্লিপ খেতে খেতে কাদা মাড়িয়ে চলেছে। এত পিছল যে,এক পা এগোলে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। পিউ বললো,আপনি আমার হাত ধরুণ।

নবকুমার বললো,পুজো আছে, ওখানে বাজাতে চললাম।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

লোক ভালো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

—— নিশ্চয়।আমাকে একটু হেল্প করুন প্লিজ। আমি পরে যাবো কাদায়।
—– ঠিক আছে,হাতটা দিন।
——আপনার নাম কি?
——- নবকুমার বায়েন।

নবকুমার নাম বলবে কি করে। কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে বললো। শরীরে শিহরণ খেলে গেলো নরম হাতের ছোঁয়ায়। কোথাও ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো। পিউ ভয়ে নবকুমারকে জড়িয়ে ধরলো। খুব খারাপ লাগছে নবকুমারের। তবু নিয়ন্ত্রিত মন। মহাপুরুষের মতো।

পিউ বললো,সরি,কিছু মনে করবেন না। বাজ পড়লেই ভয়ে আমি নিজের লোককে জড়িয়ে ধরি। আপনি আমার নিজের লোকের মতো বিশ্বস্ত। আপনার বাড়ি কোন গ্রামে। একটু চেনা চেনা লাগছে।
নবকুমার বললো,আমার বাড়ি অনেক দূর। কাটোয়া গ্রামে। তবে অফ সিজনেগঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে আসি।তবে অনেকদিন থেকে নানা জায়গায় ঘোরঘুরি করি। আপনাকেও বেশ চেনা চেনা লাগছে। অনেকদিন পরে এদিকে এলাম তো। তাই হয়তো চিনতে পারছি না।

কথা বলতে বলতে দুজনেই চলে এলো গ্রামের কাছাকাছি। বৃষ্টি,ঝড়ে অনেক বড়ো বড়ো গাছ উল্টে পরে আছে। গ্রামে ঢুকেই ঢালাই রাস্তা। এবার পিউ বললো বাড়ি আসুন।জল খেয়ে যাবেন।
—— না না,এখন না।দেরি হলে ঘোষ মশাই বকবেন।মন্দীরে যাই।
—- ঠিক আছে, যাবার দিন কথা হবে কিন্তু।
—- ঠিক আছে দিদিমণি।

তারপর মন্দিরের পাশেই ঢুলির ঘর। মেঝেতে খড় আর সতরঞ্চি বিছানো। নবকুমার ঢোল নামিয়ে প্রথমে ঢোলটা মুছলো। ঢোলের সঙ্গে কথা বলছে, খুব ভিজে গেলি রে। এখন আওয়াজ বেরোলে হয়। তা না হলে বাবুরা বকবে। কাঁসিটা মুছতে মুছতে বললো,কাউকে বাজাতে দিয়ে দোবো। এখন আর কাউকে কাঁসি বাজাতে এনে পরতা হয় না। আলাদা কোনো টাকা নাই।

তারপর নিজের মাথা মুছলে। গা,হাত, পা সব মুছলো। গামছা দিয়ে ঢোলটা হাওয়া করতে লাগলো। বলছে,শুকো বাবা তাড়াতাড়ি শুকো। শুকনো হলেই আওয়াজ বেরোবে। বাবা,তবেই পয়সা মিলবে।

প্রায় দুঘন্টা হলো।খিদেতে নবকুমারের পেট চোঁ চোঁ করছে । এরপর আরতি বাজিয়ে তারপর খাওয়া হবে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ট্রেনে এসে পাঁচ কিমি হেঁটেছে।

মন্দির থেকে পুরোহিত বললো,ঢুলি কাছে এসো। পুজোটা বাজিয়ে দাও। এরপর আরতি হবে। একটু পরেই আরতি শুরু হলো। একটা ছেলে কাঁসিটা নিজে থেকেই নিলো। ঘনা ভাবে ঢোলে আওয়াজ ভালো নেই। কাঁসিটা ভালো বাজছে। নাচতে নাচতে ঢোল বাজাচ্ছে। এমন সময়ে নবকুমারের পিউ দিদির সঙ্গে চোখাচোখি হলো। দিদিমণি নিশ্চয় আরতি দেখছে। ঢোলের তালে তালে নবকুমার গান ধরলো। পিউ ভাবছে, কি সুন্দর গলা। বাজায় ভালো। এর কতগুণ। শিল্পী লোক। পিউ জল নিয়ে মন্দিরে ঢুকলো। বাড়ি যাবার আগে বলে গেলো,দাদা যাবার সময় ভেতর বাড়ি যাবে। ঘনা বললো, নিশ্চয় যাবো। আজ রাত হয়ে গেছে।বাড়ি যান।

পরের দিন সকালবেলা বাড়ি বাড়ি ঢোল বাজিয়ে দশ টাকা, বিশ টাকা পেলো। আর গামছাভর্তি চাল,ডাল আর। মুড়ি পেলো। ভালো করে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। তারপর ঘোষ বাবুর কাছে টাকা নিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে বললো,বাবু এবার চামড়া ভিজে গেলো। তাই বাজিয়ে জুত হলো না। পরের বারে পুষিয়ে দোবো ভালো বাজিয়ে। ঘোষ মশাই বললেন, বায়েনের নামটা খারাপ কোরো না বুঝলে।

পিউ দা দা আসার পথ চেয়ে বসে আছে। সে ভাবছে, ও কি সুন্দর গান করে, আবার কত রকমের তাল জানে। পিউ পড়াশুনা করেছে। গুণী লোকের সম্মান দিতে জানে। সে কিন্তু প্রথম দর্শনে সুঠামদেহি নবকুমারকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কি করে বলবে। এখন বাড়িতে কেউ নেই। যদি আসে বলে ফেলবো।এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছে।

এমন সময়ে বায়েন এসে দেখলো,দরজা বন্ধ। তবু ভাবলো, একবার দরজায় টোককা দি। যদি থাকে,একবার দেখা করে চলে যাবো।

—— ঘরে কেউ আছেন? কেউ আছেন। ঠক ঠক করে দরজায় আওয়াজ করলো ।
—— যাই, কে আপনি?
—— আমি বায়েন।

দিদিমণি বেরিয়ে এলো প্যান্ট পরে। বললো,এত দেরী কেনো,মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?
—–; কি সব বলেছেন।

—–বোসো। এই বিছানায় বসো।
—- না, না তোমার বাবা মা বকবেন। আমি ছোটো জাতের ছেলে। একি বলছো তুমি,না না
আপনি।
——-তুমিই বলবে আজ থেকে। আমি যা বলবো তুমি শুনবে।
—— আমার ওপর এত জোর কিসের তোমার।
—- বুঝতে পারচো না। তোমার গান,বাজনার প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাকে একা পেয়েও তুমি সুযোগের অপব্যবহার করো নি অসভ্যদের মতো। তোমার সহজ,সরল ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। আমি নিজের জন্য তোমার। মতো সৎ ছেলের খোঁজে ছিলাম এতদিন। জমিদার বাবু আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছেন।

এই বলে তাকে বিছানায় ফেলে খুব আদর করলো পিউ। সে বাধা দিলো কিন্তু মেয়েটির ব্যবহারে নির্বাক হয়ে গেলো।

পিউ বলে চলেছে,আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সে চুপ করে রইলো

তারপর নবকুমার বাড়ি এলো। বাড়ি এসে টাকা পয়সা সব মায়ের হাতে দিলো। হাত, পা ধুয়ে নিজের ঘরে বসলো। তখনও তার হাত পা কাঁপছে। পিউকে সেও ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এ তো অসম আর্থসামাজিক প্রেম। সে ক্লাস একটু পড়েছে। সে জানে তারা বিয়ে করলে সমাজ মেনে নেবে না। তথাকথিত শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পরবে। সে এটাও জানে সমাজের সেনাপতিরা বায়েনপাড়ার কাজের মেয়েদের বিছানায় তুলে পা চাঁটে। তবু তারা প্রকাশ্যে তার স্বীকৃতি দেবে না কিছুতেই। তাহলে তাদের মুখোশ খুলে যাবে। তাই সে মায়ের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললো।

মা সন্তানদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সব শুনে তার মা ছেলেকে একটা গোপন মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন। মায়ের দেওয়া বুদ্ধিকে নবকুমার মন্ত্র বলে থাকে। এই মন্ত্র তাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।

তারপর ঝড়, বাদল পেরিয়ে অন্য ঋতু উঁকি মারছে। ঘরে ঘরে সোনার ধান গোলায় উঠছে। নবকুমার সকালে ঢোল বাজানো প্র্যাকটিস করে গান করতে করতে মাঠে গেলো। ধান কাটা,মাছ ধরা সব কাজ সে করে নিজের হাতে। মা কে কোনোদিন কাজ করার জন্য ধনীদের ঘরে পাঠায় না। সে ভাবে,সকলে তো নিজের কাজ নিজে করতে পারে। তাহলে একটা অবহেলিত সমাজ তৈরি হতো না। তার খুব খারাপ লাগে। অনেকে তাদের দাস পাড়াকে ঝিপট্টি বলে। ঝিপট্টি,বেশ্যাপট্টি সব নিজেদের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে তথাকথিত সমাজপতিরা। তাদের ঝোলার জন্য গলার দড়ি জোটে না। এই ভেবে সে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো।

পিউ সাইকেল চালিয়ে বাজারে গেছিলো। কাউকে বাজার করতে দেয় না। পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মায়ের সমান জমিদার গিন্নি। আজ পিউ এর পায়ে একটা পাথর লেগেছে। ব্যাথা হচ্ছে। রাস্তার ঢালাই এর পাথরগুলো রাক্ষসের মতো দাঁত বের করে আছে। নামেই ঢালাই। আর হবে না কেন। যারা চেয়ার দখল করে বসে আছে তারা ঘুষ খাবে। তবে অনুমোদন দেবে রাস্তা তৈরি করার। তারপর যে তৈরি করবে সে খাবে। তারপর তলানি। এতে আর কি হবে।

ভিতরে ঢুকতেই পিউ এরবান্ধবী বললো,কি হলো পায়ে। পিউ বললো,ও কিছু না,একটু লেগেছে। সে বললো,যা করবি একটু দেখে শুনে করবি।
পিউ ব্যাগ রেখে তার প্রিয় বান্ধবী রীতাকে ফোন করলো। ওর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একবার ওরা ভূত দেখেছিলো।পিউ এর বন্ধুদল বিরাট।

একবার ন্যাশানাল পাড়ার একটা বাড়িতে ভূত দেখেছিলো দুজনে। একটি বাচ্চা মেয়ে সামনে এসে বললো,একবার এসো আমাদের বাড়ি। আমার মা ডাকছে। রীতা বললো,তোর মা কে তো চিনি না।
মেয়েটি বললো,একবার এসো না।
ওরা ভিতরে গিয়েছিলো। তারপর দেখলো মেয়েটা আর ওর মা হাত বাড়িয়ে নারকোল গাছ থেকে নারকোল পেরে আনলো। তারপর এক কিল মারলো। নারকোল ভেঙ্গে গেলো। তারপর রক্ত হাতে বললো,খা, খা।
ভয়ে ওরা ছুটে বাইরে এলো। রীতা ও পিউ মামুদপুরের মেশোকে বলেছিলো ঘটনাটা। তিনিও ভয়ে পালিয়েছিলেন। মেশো তার আত্মীয় অমলকে ঘটনাটা বলেছিলো। অমল বন্ধুদের বলেছিলো। পিউ এর মনেআছে অমল ও তার বন্ধুরা সবাই আড্ডা মারছে। এমন সময় অমল বলে উঠলো, জানিস ন্যাশানাল পাড়ার বনের ধারে যে তিনতলা লাল বাড়িটা আছে সেখানে নাকি ভূত দেখা গেছে।
মিহির বললো, তাহলে তোএকদিন সবাই মিলে গিয়ে দেখে আসতে হবে।
পিউ দোকান গেছিলো। সে বললো,টোটোনদা সত্যি আমরা দেখেছি ভূত নিজের চোখে। যা করবে সাবধানে কোরো আর পারলে ঘনাদাকে সঙ্গে নিও। ওর সাহস আছে।
টোটোন বলে উঠলো, তোরা খুব আজগুবি কথা বলিস। আরে টোটোন থাকতে ভূতের বাপও বাড়ি ছেড়ে পালাবে। চল তাহলে একদিন দেখাই যাক। আমরা সামনের অমাবস্যায় ওই বাড়িতে যাবো। ফিষ্ট করবো। মাংস আর লাল জল। বুঝলি কিনা। জমবে ভালো।

অমল বললো, শোন আসল কথাটা বলি। আমার মামুদপুরের মেশো একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। বিকালে ওই বাড়ির দিকে বেড়াতে গেছিলো। একট বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মেশোকে বললো, আমার খিদে পেয়েছে। মামা জিলাপি কিনে ছেলেটাকে বললো, যাও খেয়ে নাও।

ছেলেটি নাছোড়বান্দা। বললো, আমার বাবাকে দেখবে এসো। কতদিন খেতে পায়নি। এসো দেখে যাও।
মেশো সরল লোক। মায়া হলো। ভিতরে গিয়ে দেখলো বাবা নয়। এক ভয়ংকর স্কন্ধকাটা ভূত। বললো, আমার গলা কেটে সবাইকে মেরে আমার সংসার শেষ করেছে তোর মতো একটা পাষন্ড। আমি কাউকে ছড়বো না। কাটা মুন্ডুটা হাতে। সেই মুন্ডুই কথা বলছে।
মেশো ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। এবার ভবলীলা সাঙ্গ ভাবছে মেশো। এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে বললো, বাবা এই লোকটি ভালো। জিলাপি কিনে দিয়েছে। এই বলে ছেলেটি উড়তে উড়তে জিলাপি খেতে লাগলো। উড়ন্ত অবস্থায় ছেলেটির মা বললো, এঁকে ছেঁড়ে দাঁও। যাঁও যাঁও। জিঁলাপি খাঁও।
তখন সুযোগ বুঝে মেশো পালিয়ে এসে বাঁচে।

টোটোন ভয় লুকিয়ে বাতেলা দিলো অনেক। বললো, ঠিক আছে আমরা কুড়িজন একসাথে যাবো ওই বাড়িতে। দেখা যাবে। কত ধানে কত চাল। তবে কিছু অস্ত্র সঙ্গে নিস বাবা।
চালাক টোটোন। তাই দল বাড়াচ্ছে। ঠিক হলো কুড়িজন বন্ধু একসাথে যাবে। অনেক ছেলের মাঝে নিশ্চয় ভূত আসবে না।

মাঝের কয়েকদিন যে যার কাজ নিয়ে থাকলো। তারপর এসে গেলো সেই অপেক্ষার অমাবস্যা। দিনের বেলায় সবকিছু কেনাকাটা সেরে সবাই দুরু দুরু বুকে রাতের প্রতিক্ষায়। কিন্তু কেউ ভয় প্রকাশ করছে না। বাড়িতে কেউ বলে নি। সবাই বলেছে, আজ একজন বন্ধুর জন্মদিন। রাতে বাড়ি আসবো না। ওখানেই সব ব্যবস্থা।

রাতের বেলা ন্যাশানাল সিনেমা হলের কাছে সবাই একত্র হলো। সবাই চললো এবার সেই অভিশপ্ত বাড়িতে। টোটন চুপ। কোনো কথা নেই। অমল বললো, কি রে টোটোন, চুপ মেরে গেলি কেন? কথা বল।

টোটোন বললো, এই দেখ আমার অস্ত্র। একটা মস্ত নেপালা বের করে দেখালো। তারপর বললো, ভূতের দফা রফা করবো আজই।

কথায় কথায় বাড়িটা চলে এসেছে কাছে। অমল বললো, চল ভিতরে ঢুকি। নবা বললো, তোরা যা, আমার কাজ আছে। তবে অই বাড়িতে ভূত আছে। পিউ আর রীতা আমাকে বলেছে। যাস না বাড়ি যা। ঘনাকে কেউ রাজী করাতে পারলো না। ঘনাকে পিয়ালী আড়চোখে দেখলো। মনে মনে ভাবলো, কি সুন্দর চেহারা ছেলেটার।
দুজন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। বললো, মরতে যেচো কেনে ওই বাড়িতে? খবরদার ওই দিকে মাড়িয়ো না। গেলেই মজা টের পাবে।
এখন আর ফেরার কোনো ব্যাপার নেই। হুড়মুড় করে সবাই ঢুকে পড়লো বাড়ির ভিতরে। তারপর মাকড়সার জাল, ধুলো পরিষ্কার করে রান্না শুরু করলো। এখনও অবধি কোনো ভৌতিক কান্ড ঘটে নি। ভয়টা সকলের কমে গেছে।
টেটোন বললো, অমল তোর মেশোর গাঁজার অভ্যাস আছে নাকি?
সকলের সামনে অমল একটু লজ্জা পেলো। তারপর ভাবলো, বন্ধুরা একটু ইয়ারকি মারে। ওতে ইজ্জত যায় না।
টোটোন এক পিস কষা মাংস নিয়ে লাল জলে মন দিয়েছে। সে এই দলের নেতা। সবাই অলিখিত ভাবে তাকে মেনে নিয়েছে নেতা হিসাবে। নেতা কষা মাংসতে কামড় মারার সঙ্গে সঙ্গে কষ বেয়ে লাল রক্ত। বোতলে রক্ত ভরতি। সবাই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু নেতা দেখতে পাচ্ছে না। নেতাকে রক্ত মাংস খাওয়া ভূতের মতো লাগছে।
অমল কায়দা করে তাকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। নেতা নিজের রূপ দেখে ভয়ে বু বু করতে লাগলো। সবার প্রশ্ন এত রক্ত কোথা থেকে এলো?নেতা অজ্ঞান হয়ে গেলো।

তাকে জল দিয়ে জোরে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো বন্ধুরা। তারপর জ্ঞান ফেরার পরে আবার ভয়ের পালা। রাত তখন দশটা। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। আর চার দেওয়ালের গা বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা। এত রক্ত যে মেঝে দিয়ে গড়িয়ে সকলের পা ভিজে যাচ্ছে। নেতা এবার জোড় হাত করে বলছে, আমাদের ছেড়ে দাও, এই কান মুলছি, নাক মুলছি আর কোনোদিন এই বাড়িতে ঢুকবো না। দয়া করো আমাদের দয়া করো।

তখন আড়াল থেকে কথা শোনা গেলো, তুই তো নেপালা এনেছিস। সবাই দেখলো নেপালা নিজে থেকেই শূণ্যে ভাসছে। তারপর ভূত হাজির। নেপালা একবার ভূতের মাথা কাটছে আর জোড়া লেগে যাচ্ছে। বলছে, আমাকে কাটবি। মাথা কাটবি। তোর মাথা কাটি। নেতা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে।

তখন অমল বললো, আমরা তোমার সাহায্য করবো। কে তোমাকে মেরেছে বলো। আমরা পুলিশকে জানাবো। সে শাস্তি পেলে নিশ্চয় তোমার আত্মার শান্তি পাবে। কথায় কাজ হলো সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। রক্ত মুছে গেলো। আর একটা ছবি হাওয়ায় উড়ে এলো।

টোটোন ছবি দেখে বললো, একে আমি চিনি। নিশ্চয় একে পুলিশে দেবো। আমরা কুড়িজন সাক্ষী দেবো। তারপরে পুলিশ সব দায়িত্ব পালন করেছিলো। সেই বাড়ি এখন পুলিশ থানা। চাকরি পেয়েছে কুড়িজন সাহসী ছেলে। যাদের চেষ্টায় খুনী ধরা গেছে। আর অতৃপ্ত তিনটি আত্মা মুক্তি পেয়েছে। নবকুমার পিসীর বাড়ি বেড়াতে এলেই পিউ এর সঙ্গে অনেক ধনী লোকের ছেলেদের দেখেছে।

নবকুমার ভূতে বিশ্বাস করে। ও সহজ সরল ছেলে। ঝামেলার মধ্যে ও নেই। আর ওর বাড়ি অনেক দূরে। সেদিন ঢোল সারাতে এসে ওদের সঙ্গে দেখা। নবকুমারের পিসীর বাড়ি এই গ্রামে।
নবকুমারের সাথে এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের দু একবার কথা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি নয়। তারপর পরিচয় হওয়ার পর জানতে পেরেছে দুজনেই। প্রায় এক বছর পরে ওদের দেখা। প্রথম দর্শনে কেউ বুঝতে পারে নি। পিউ হঠাৎ করে নবকুমারকে ভালোবাসে নি। ভালোবাসার সুপ্ত বীজ পিউ এর অন্তরে গেঁথে গেছিলো অনেক আগে থেকেই। সে নবকুমারকে চিনতে না পারার ভান করেছিলো।

নবকুমার ভাবে চিনতে না পারাই ভালো। ওরা ধনী।তারপর আবার উঁচু জাত। ভালোবাসলে সমানে সমানেই ভালো। সমাজের নিয়ম আগে।পিসী আগেই সাবধান করে দিয়েছেন।

মাঝে মাঝে নবকুমার জাল নিয়ে গঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে যায়।

পিউ তার বান্ধবী রীতাকে নবকুমারকে ভালোবাসার কথা অকপটে বলেছে। রীতা বলছে,তাই হয় নাকি? একটা বায়েনের ছেলের সঙ্গে প্রেম। ঘামের গন্ধে দেখবি বমি আসবে।
পিউ বললো,ফালতু বকিস না। ওসব আমি বুঝবো। তুই আমার সঙ্গে আগামীকাল যাবি গঙ্গার ধারে। আমিও নবকুমারকে ফোনে জানিয়ে দেবো। কাল ফাইনাল। আর দেরী নয়।

রীতা বললো,এখনও সময় আছে।সরে পরো, তা না হলে জল অনেক দূর গড়াবে। সামলাতে পারবি তো।
পিউ বলে,সময় বুঝে সব ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

তারপর দুজনে যে যার বাড়ি চলে গেলো।

বাড়ি গিয়ে রীতা পিউ এর জন্য খুব চিন্তা করতে লাগলো। একবার পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।

গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি। পিউ যাবা না।
— একটা তো, কিছু হবে না।

—– যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম আমি আর পিউ।

গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।

মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল। পিউকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের আদেশ পালন করলাম।

জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।

তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।

বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।

মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।
মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।

মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে
তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।

শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।

এই মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।
আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।

দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।

তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।

তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে। আমি আর পিউ অনেক পুঁথির মালা কিনেছিলাম। সেগুলো সোনার গয়নার কাছে কোনো অংশে কমদামী ছিলো না সেই স্মৃতি আজও বাক্সবন্দী হয়ে আছে। আবার কোনো কিশোরী বন্ধবাক্স খুলে ফেললে মেলার আনন্দ নতুন করে পাবে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।

হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।

তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা।

সেই বান্ধবী বাড়িতে না জানিয়ে এক ভিন্ন জাতির ছেলেকে বিয়ে করবে,এই সত্যিটা সে মেনে নিতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেলো। আর একটু পরেই বেরোতে হবে পিউ এর সাথে আর ফিরে আসবে একা। পিউয়ের বাবা মাকে কি জবাব দেবো। এই মুখ কি করে দেখাবো। মোবাইল বেজে উঠলো। মা কে বলে রীতা বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় গেলো।
দেখলো সোনা দানা পরে শাড়ি ঢাকা দিয়ে বাবা মা কে না বলে পিউ চিরদিনের মতো চলে এসেছে বাইরে।

গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে দুই বান্ধবী বসে আছে। তির তির করে জল বয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছ জলে বালি দেখা যাচ্ছে। দাঁড়কে মাছগুলো সুন্দরীদের পায়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। রীতা বললো,বেজাতে বিয়ে সমাজ মানবে না রে। পিউ বললো,রাখ তোর জাতপাত। সমাজের সেনাপতিরা যখন কাজের মেয়ের পা চেটে খায় বিছনায় তখন জাত কোথায় পালায়? সমাজের প্রতি এই রাগ রীতারও আছে।
এবার ওরা জাল কাঁধে নবকুমারকে দেখতে পেলো। পিসীর বাড়ি এলেই সে আসে গঙ্গায়।কাছে এলে পিউ বললো,এই দেখো সব সোনার গয়না পরে পালিয়ে এসেছি। জমিদার গিন্নি দিয়েছেন।তিনি আমার মায়ের মত।

কেমন লাগছে আমাকে। নবকুমার বললো,তোমাকে রাজরাণীর মতো লাগছে। রীতা বললো,তুমি খালি গায়ে কি করে বিয়ে করবে?
সে জাল নামালে। শরীর তার শক্তপোক্ত। তার চেয়ে শক্ত তার মন। সে বললো,আমি একটা কথা বলতে চাই।
পিউ বললো,আবার কি কথা?
নবকুমার বললো,এই নদী সাক্ষী। আপনারা দুজনেই শুনুন। ভুলকুড়ি গ্রামের রাস্তার ধারে মীনা বলে একটা মেয়ের বাড়ি ছিলো। আমরা ছোটোলোক ঘরের। ভালোবেসে ফেললাম মীনাকে। দুদিনের মেলামেশার পরে মীনা গর্ভবতী হলো। আমি তাকে বিয়ে করলাম। মীনা মৃত সন্তান প্রসব করলো। তখন আমি কেমো থেরাপি চালিয়ে যাচ্ছি। গাঁজা,মদ কোনো কিছু বাকি ছিলো না। তারফলে মারণ ব্যাধি বাসা বাধলো শরীরে। গত পরশু পি জি হসপিটালে গেলাম। ওরা আমাকে পাঠালেন চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালে। বাড়াবাড়ি দেখে এই ব্যাবস্থা। তারা জানিয়ে দিলেন আমার জীবনের মেয়াদ আর ছয়মাস। এখন আমি কি করি বলুন। আমি পিউকে ভালোবাসি। তাই এই ছয়মাসের মধ্যে আমি পিউ কে বিবাহিতা দেখতে চাই। আর কিছু আমার বলার নেই। পিউ কান্না শুরু করেছে। কিছুতেই রীতা তাকে থামাতে পারছে না। পিউ যখন মুখ তুলে তাকালো ততক্ষণে নবকুমার অনেক দূরে চলে গেছে।

যেতে যেতে নবকুমার ভাবছে, মায়ের দেওয়া মন্ত্রটা ভালোই কাজ দিয়েছে। গিয়ে মাকে একটা প্রণাম করতে হবে। ওই মন্ত্র ছাড়া অসম প্রেমের শক্ত শেকল ছেঁড়া যেতো না….

সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ব বর্ধমান ৭১৩১৫০ মুঠোভাষ৮৩৯১৮৩৫৯০০ মেলsudipghoshal59@gmail.com

 

 

ব্রতকথা,গল্পদাদু ও তেচোখা মাছের গল্প

সুদীপ ঘোষাল

সুনীল বড় হয়েছে বন জঙ্গলের আদর পেয়ে ।ছোটো থেকেই মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থেকেছে। বাবা থাকলেও তার সঙ্গে ভাব ছিলো না সুনীলের। তাকে এড়িয়ে চলতো সুনীল।তার কারণ বাবা খুব রাগী লোক। সবসময় মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। মাকে গালাগালি দেয়। মনের মধ্যে সুনীলের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নেই শৈশব থেকেই। সে তার মায়ের কাছে থাকে। পাড়ার দাদুর কাছে পড়াশোনার শেষে গল্প শুনতে যায়। মা বিভিন্ন সময়ে রকমারি পুজো করেন। ব্রত পালন করেন। নিজেকে এইসবের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন তিনি। মা পৌষ মাসের ব্রত পালন করেন। মা ব্রতকথা শোনানোর জন্য সুনীলকে, পাড়ার মাসিকে ডেকে আনতে বললেন। মাসি এলো, কাকিমা এলো। মাসি বলেন, পৌষ মাসে যে মহিলারা এই ব্রত পালন করেন, কথিত আছে, তাঁর পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের কল্যাণ সাধিত হয়।মা বলেন, ঠিক বলেছেন আপনি।কাকিমা বললেন, এবার আপনি বলুন। আমরা শুনি। মা বলতে শুরু করলেন,
নতুন ধানের তুঁষ আর গোবর দিয়ে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে বড় বড় চারটে নাড়ু পাকানো হয়। সর্ষে ফুল আর নাড়ু ধরে পুজো করা হয়।

১লা পৌষ থেকে প্রতিদিন ছোটো নাড়ু চারটে করে সংক্রান্তির আগের দিন অবধি পূজা করা হয়।সুনীল প্রশ্ন করে মা ক্ষীরের নাড়ু খাবো আমি। মা বলেন, নিশ্চয় খাবি। তবে পাশের বাড়ির কাকিমা, মাসিমাকে ব্রতকথা শোনাই দাঁড়া। কাকিমা বললো,আমাকে ভালো করে শিখিয়ে দাও দিদি। আমার খুব ভালো লাগে এসব।

পাশের বাড়ির কাকিমা এ সব একদম কিছু জানে না। মা তাকে শিখিয়ে দেয় নিয়মাবলী। মা বলেন, শোনো, নিয়ম তো অনেক আছে। তবে যতটা পারা যায় সংক্ষেপে বলি।

মকর সংক্রান্তির দিন ছ’ কুড়ি ছ’গন্ডা অর্থাৎ ১৪৪টি ক্ষীরের নাড়ু আর পরমান্ন তৈরি করে খেতে হয়। খাবার সময় সেঁজুতির দূর্বা ও তুঁষ তুঁষলীর নাড়ুগুলি একটি মালসা বা হাঁড়ির ভিতর রেখে তাতে আগুন দিতে হয়। পিছন দিকে রেখে খাওয়া শেষ হলে ভাসান মন্ত্র পড়ে জলে ভাসিয়ে দিয়ে আঁচিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়।

এইভাবে চার বছর পালন করার পর ব্রত উদ্ যাপন করা হয়। সরষে ফুল ওমূলা ফুল দিয়ে মন্ত্র বলা হয়

তুঁষ তুঁষুলী কাঁধে ছাতি
বাপ মার ধন যাচাযাচি
স্বামীর ধন নিজ পতি
পুত্রের ধনে বাঁধা হাতি
ঘর কোরবো নগরে
মরবো গিয়ে সাগরে
জন্মাব উত্তম কুলীন
বামুনের ঘরে।

পৌষ মাসভর পূজা করতে হয়। সংক্রান্তির দিন যে চারটি নাড়ু বেশি থাকবে তা নিয়ে ফুল দূর্বাসহ পুজো করে লক্ষীর হাঁড়িতে তুলে রাখা হয়।
ক্ষীরের নাড়ু খেতে খেতে মন্ত্র পড়া হয়

তুঁষ তুঁষুল সুখে ভাসালি আখা জ্বলন্তি পাখা চলন্তি
চন্দন কাঠে রন্ধন করে খাবার আগে তুঁষ পোড়ে
খরকের আগে ভোজন করে
প্রাণ সুখেতে নতুন বসতে
কাল কাটাব আমি জন্ম এয়োতে।

চার বছর পর ব্রত উদ্ যাপন করতে হয়।কাকিমা বলে, কি হবে এসব করে? মা হাসতে হাসতে বলেন, বিশ্বাস থেকেই ভক্তি।

পৌষমাসের শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত পালন করা হয়। এর ফলে পুত্র কন্যার অকাল মৃত্যু রোধ হয় বলে বিশ্বাস নারীমহলে। শোনো গল্প তাহলে,

নন্দী গ্রামে এক নারীর বৌমা ও ছেলে ছিলো। তার নাতিপুতি ছিলো না।

বৌমা খুব পেটুক। সে ঠাকুরের নৈবেদ্যের থালা থেকে কলাটা,সন্দেশটা নিয়ে খেয়ে নিত।

ফলে তার কোনো ছেলেপিলে হতো না।

মহিলা এক সাধুর পরামর্শে পাটাই ষষ্ঠীর ব্রত পালন করতে লাগলেন।

বাড়ির উঠোনে পুকুর কেটে বেণা ডালের পাটাই পুঁতে নৈবেদ্যের রেকাবি সাজিয়ে পুরুতকে দিয়ে পুজো করালেন।

বউএর নৈবেদ্য দেখে জিভে জল এলো।মহিলার শঙ্খধ্বনিতে তার চেতনা ফিরলো।

মহিলা বৌমাকে বললেন, পাটাই দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বর প্রার্থনা করো।

বৌমা তাই করলেন। এক বছর পরে তিনি গর্ভবতী হলেন। সংসারে ঘর আলো করে নাতনি এলো। মহিলা সুখে সংসার করতে লাগলেন।

চলিত আছে যে এই ব্রত করলে মৃতবৎসা প্রসূতির সন্তান হয় ও জীবিত থাকে।

কুমারী, সধবা,পুত্রবতী ও বিধবা সকলেই এই ব্রত পালন করতে পারেন।অষ্টচাল,অষ্টদূর্বা কলসপাত্রে ধুয়ে, শোন সবে ইতুর কথা ভক্তিযুক্ত হয়ে।
এই ব্রত কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে আরম্ভ করতে হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন পুজো শেষ করে সেইদিন ইতুরসাধ দিয়ে সকলে প্রসাদ পায়।সন্দে, মন্ডা,মিঠাই ও সাধ্যমত ফলমূল দিয়ে নৈবেদ্যের রেকাবি সাজাতে হয়। পুজো হওয়ার পরে সকলে প্রসাদ পায়।

মা গোঠষষ্ঠী ব্রত ও অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে করতে হয়। ঘটে বটের ডাল,দধি,তৈল,হলুদবাটা, ফল,ফুল সবই দিতে হয়।পিঠুলির গোঠ গঠন করে দিয়ে বাঁশের পাতায় বারো মাসে তেরো ষাট দিতে হয়। রালদুর্গা ব্রত যে নারী করেন তার সকল দুঃখের শেষ হয়ে সুখের উদয় হয়।

কুলুই মঙ্গলবার ব্রত এই মাসে পালন করতে হয়। কুলের ডাল পুঁতে ঘটস্থাপন করতে হয়। একটি বড় কুলোতে পিঁটুলির আলপনায় ১৭টি ডিঙি অঙ্কিত করে ১৭টি কুল, ১৭টি কুলপাতা, জোড়া মূলা,জোড়া কড়াইশুঁটি , ১৭ভাগ নতুন চিঁড়ে,নতুন খইয়ের মুড়কি দিয়ে কুলোয় সাজাতে হয়। আতপ চালের নৈবেদ্য সাজাতে হয় রেকাবিতে ।

এছাড়া ক্ষেত্রব্রত, সেঁজুতিব্রত, নাটাইচন্ডী ব্রত, মুলোষষ্ঠীর ব্রত প্রভৃতি ব্রত আছে যেগুলি এই মাসেই পালন করতে হয়।

নাটাইচন্ডীর ব্রতে রবিবারে মায়ের কাছে বর চাওয়া হয়। ধন সম্পত্তি হারায় না কোনোদিন এই ব্রত পালন করলে। নাটাই চন্ডীর কাছে প্রার্থনা করতে হয়,মা নাটাই চন্ডী, আমরা যেনো হারানো ধন খুঁজে পাই।

নানা উপাচারে পূজা করা হয় নাটাই চন্ডীর।
কাকিমা মায়ের কাছে ব্রতকথা শোনার পরে প্রণাম করেন। মাকেও একটা প্রণাম ঠুকে দেন। মা বলেন, করো কি বোন। কাকিমা বলেন, আপনার কাছে অনেক কিছু শিখলাম। মা বলেন, তোমাকে একদিন জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথাও শোনাবো। দেখবে ভালো লাগবে। সুনীল দেখলো মা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে ঠাকুর ঘরে ঢুকলেন। মাকে এখন সারদা মায়ের মত লাগছে।
এবার বাবা অফিসে যাবে। বন্ধুর বাড়ি যান সকালে উঠে। গল্পগুজব করে দশটায় বেড়িয়ে পরেন কাজে। বাবা বললো,সুনী, তোর মাকে বল,পিন্ডি বেড়ে দিতে। এখনি যাবো। সতীগিরি দেখাতে মানা কর। আমি সব জানি। শালা জালি মালটা আমার কপালেই জুটলো।

মা সুনীলকে পাঠিয়ে দেন গল্পদাদুর কাছে। সুনীল ভাবে, বাবা কেন মা কে জ্বালায়।মা তো খুব ভালো। ঠাকুর বাবাটা এরকম কেন? আমার বাবার উপর কি ভূত বা পেত্নী ভর করেছে। দাদু এরকম একটা গল্প বলেছিলেন। যাইহোক, মা বাইরে বাবার কথা বলতে বারণ করেছেন।কাউকে বলা যাবে না। এমনকি দাদুকেও না।

 

 

সুনীল জানে, মা মাঠের বাড়ির ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতেন অবসর সময়ে। মায়ের সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। মায়ের বাবার অফিসের মত ছুটি নেই। বিশ্রাম নেই। বৈকালিক ভ্রমণ নেই। বাবা অফিস থেকে এসেই জলখাবার খান। মা রান্নাঘরে। তারপর রাতের রান্নার ফাঁকে আমাকে পড়ানো।

সুনীল দেখে আর ভাবে, মায়ের কেন ছুটি নেই। মুখে হাসি নেই। বাবা পান থেকে চূণ খসলেই ধমকের সুরে মাকে বকেন। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলেন। বাবা বলেন, আমার পিঠে দুটো নয় তিনটে তেচোখা মাছের মত চোখ আছে। তুমি পাশের বাড়ি ভূতটার সঙ্গে প্রেম করো। আমি সব দেখতে পাই। সুনীল বাবার পিঠে চোখ দেখতে পায় না। মা ছাদে উঠলে ঘন একরাশ আলো মায়ের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ছাদ থেকে প্রতিবেশির সঙ্গে কথা বলে।

আজকে সুনীলের বাবা একটা চিঠি এনেছে। বিয়ের চিঠি। কলকাতার কাকুর মেয়ের বিয়ে। ঠিক হলো সুনীল আর বাবা যাবে। মা যাবে না। কারণ বাড়ি ফাঁকা থাকলে চোর আসে। সব কিছু চুরি করে।

সুনীল ভাবে, চোর মাকে চুরি করে নিয়ে যাবে না তো? আবার ভাবে বাবার সঙ্গে গেলে কলকাতা ঘোরা হবে। পড়া ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ঘাঁটা হবে। তবু তার মায়ের জন্য মনখারাপ করে। কিন্তু একথা বলা যাবে না কাউকে।

এখনও যাবার দিন ঠিক হয় নি। সুনীল পাড়ার দাদুর কাছে গল্প শোনে। দাদু বলেন,

বেশি কৌতূহল ভালো নয়। তেনাদের নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো তাদের ভালো লাগে। তাই তারা দল ভারি করার জন্য দলে টেনে নেয়। অপদেবতাদের বিচরণভূমি কাঁদরের ধারে,পোড়ো বাড়ির ভিতরেকিংবা জনকোলাহলহীন যে কোনো জায়গা হতে পারে।।অশুভ শক্তি এক জায়গায় জড় হয়ে নাচ করে ভূত চতুর্দশীর রাতজুড়ে। এইসব কথা আবার আমার দাদুর মুখে শোনা।

তিনি বলেন,অপমৃত্যু হওয়া আত্মাগুলো সহজে মুক্তি পায় না। সেইসব আত্মা ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্ত মনে। ,বামুন পাড়ার বিমানদাদু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি রাজা উজিরের মত থাকতেন। বিরাট আলখাল্লার আড়ালে তার দারিদ্র্য ঢাকা থাকতো।মন তার তৃপ্ত ছিলো না। প্রতিরাতে নেশা করতেন।আরও অনেক দোষ ছিলো।

কাঁদরের ধারে একটা বেলগাছ ছিলো। দাদু বলতেন, এই বেলগাছের পাশে একটা শিমূলগাছ। বহু বছর ধরে আছে। সেখানে একদিন পথকুড়ো ফুল কুড়োতে কুড়োতে যাচ্ছিলো।পথকুড়ো দেখলো,সেই শিমূল ফুল তার হাতে এসে হয়ে গেলো শিশুর মাথা। ভয় পেয়ে ছুটে এসে পড়লো ঘাটে। সেই ঘাট থেকেই একেবারে গঙ্গার ঘাটে।

পথকুড়ো মরার পরে আর কেউ ওদিকে তাকাতো না। প্রয়োজন হলেও ও পথে পা বাড়াতো না। সবাই বলতো,ওখানে অপদেবতাদের বাস। ওখানে গিয়ে ওস্তাদি করলেই সর্বনাশ হবে।

একদিন সকালে ওই শিমূল গাছে বিমান পাঠক গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিলো রাজার বেশে।

দাদু কাঁদরের এপাড় থেকে একরাতে দেখেছিলেন, যাত্রার আসরের মত জাঁকজমক। বিমান তার পোশাক পড়ে রাজার মেজাজে ঘুরতো। লাফিয়ে বেলগাছে উঠতো। দাদুর সঙ্গে আরও দুজন সাহসী লোক ছিলো। তারা দেখলো,জীবনে বিমান শখ আহ্লাদ পূরণ করতে না পারলেও অপদেবতাদের আসরে তার কোনো শখ অপূর্ণ থাকতো না।

ভূতের ভয় লাগে নি দাদুর।পালাগান শোনার মত অপদেবতাদের গান শুনেছেন। বললে,অনেকে বিশ্বাস করে না।

দাদু প্রায় প্রতি রাতে একবার করে কাঁদরের পাড়ে ঘুর ঘুর করতেন। এই দাদু পাড়ার সকলের প্রিয় ব্যাক্তি। গ্রামের লোকে বলতো,এত সাহস ভালো লয় গো। রাত বিরেতে কেনে ওখানে মরতে যাও। কোনোদিন দেখবা তোমার দশাও পথকুড়োর মত হবে।

দাদু শুনতো না। সাত কুলে তার কেউ নাই। তাই ভয়ও নাই। এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে দিন গুজরান হত দাদুর। কেউ বিপদে পড়লে জান দিয়ে তার সেবা করত।তাই তো গ্রামের সকলে তাকে মাথায় করে রাখতো। দাদু প্রায় চেঁচিয়ে একটা কথা বলতেন,পালাবার পথ নাই, যম আছে পিছে। মরণকে তার ভয় ছিলো না। তিনি বলতেন, বেঁচে থাকার চেয়ে মরণের পরে বেশি সুখ। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন না বেশি কথা। তিনি বলতেন,অপদেবতাদের অনুভূতি অন্তরে হয়। প্রকাশ করা যায় না।

তিনি তার ছাত্রজীবনের কথা আমাদের বলেছিলেন।
একবার তার বন্ধু রমেন আর কয়েকজন রাতে কাঁদরের ধারে গেছিলো।সে ডুব সাঁতারে ওপাড়ে চলে গেলো। দাদু ছিলো এপাড়ে।তারপর অপদেবতা তাকে তুলে নিয়ে গেলো বোধহয়।বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিলো।

সবাই আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছি। কখন আসবে রমেন। ঠিক সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি চলে এলো গ্রামে। আমাকে সবাই অবাক হয়ে দেখলো পুলিশের গাড়ি থেকে নামছি আমি।

এর মধ্যে নরেনও হন্ত দন্ত হয়ে আমার কাছে এসে বললো,যাক প্রাণে বেঁচে আছি । মেজবাবু তার বাবাকে বললেন,এটাই আপনার ছেলে নরেন তো?

—- হ্যাঁ স্যার।

—-আমাদের থানার আশেপাশে ঘুরতে দেখে ওকে নিয়ে এলাম। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো এটা নরেন । ওর মুখে সব কিছু শুনলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যা। যাই হোক, আমরা আসি।

পুলিশের গাড়ি চলে গেলো। প্রায় দুঘন্টা হলো দাদু ঘুমিয়ে আছে। দুপুর একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গলো।নরেন জিজ্ঞাসা করলো,আমার কি হয়েছিলো বল তো দাদু।

দাদু বলতে শুরু করলো নরেনের অলৌকিক কাহিনী।নরেনের জ্ঞান ছিলো না। দাদু বললো,আমার এক বন্ধুর তোর মত অবস্থা হয়েছিলো।

 

বন্ধু বললো,আমরা সবাই যখন কাঙরা কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খনা গলায় নিশি ভূতটা বললো,কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম,এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাবো না। নিশিটা বললো,যা বলবো শুনবি।তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো।আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এলো। নিশি বললো,কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো,গঙ্গার জলে সাঁতা কাটবি নাকি?

আমি বললাম,আমি সাঁতার জানি না।

নিশি বললো,আমি থাকলে ওসব কিছু দরকার হয় না। এই বলে আমাকে ওপর থেকে গঙ্গার বুকে ঝুপ করে ফেলে দিলো।তারপর জামাটা মুঠো করে পুতুলের মত তুলে নিয়ে ওপরে এলো।আমি ভাবলাম, আমার জীবনের শেষ দিন আজকে। নিশি মনের কথা জানতে পেরে বললো,আমরা প্রাণে মারি না কাউকে। শুধু ঘুরে বেড়াই।কাজ করি। তারপর দিনের আলো ফুটতেই নিশিটা পালিয়ে গেলো।

তারপর নরেনকে দাদু বললো, তোর দশাও এইরকম হয়েছে।সব ভূত খারাপ হয় না।

সুনীল দাদুর গল্পে, একটা ভয়, একটা মায়ার গন্ধ পায়। যা তাকে সাংসারিক সমস্ত সমস্যা বা ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখে।

দাদু সুনীলকে বললেন,যা বাড়ি যা। আবার পরে বলবো। সুনীল দাদুকে বললো, ভূতের কি তিন চোখ হয়?
দাদু বলেন, তিন কেন রে? তার থেকে বেশি হয়। ওসব এখন বুঝবি না।

 

তারপর আবোলতাবোল ছাইখেলার ছন্দে চলে এলো বিয়ের দিন। নকল পরিবেশে তিন চোখের রহস্যে সুনীলের মন একটু বিভ্রান্ত। বিয়েতে একটু আনন্দ হবে। পাঁচজনের মুখ দেখতে পাবে। এই মনে করে সে বাবার সঙ্গে চলে এলো কাকার মেয়ের বিয়েতে।

বিরাট অনুষ্ঠান। বড়লোক কাকার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। শহরে এসে সুনীল বেশ খুশি। একদিন কলকাতা চিড়িয়াখানা দেখতে এলো বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে। বাবাও আছে। সুনীল শহরে ঘুরে কত জন্তু জানোয়ার দেখলো। তারা কত কষ্টের মধ্যে আছে। বাঘগুলো খাঁচার কাছে এসে থমকে যাচ্ছে। পাখিগুলো বোধহয় ওড়া ভুলে গেছে। সব জন্তুগুলোর মুখ কেমন গম্ভীর। সুনীলকে তোতা পাখিটা বোধহয় একবার বলে উঠলো, ছেড়ে দে আমাদের।ফিরিয়ে দে আমাদের আকাশ। কিন্ত সুনীলের তো অত ক্ষমতা নেই। মানুষকে খুশি করতে গিয়ে ওরা আকাশ, অরণ্যকে বন্দি বানায়। এমন আহাম্মকি বুদ্ধি মানুষ ছাড়া আর কারও নেই। সুনীল নিজের মনে বিড়বিড় করে। ছোটো থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হওয়া ছেলেটা এতবড় মন কোথা থেকে পেলো। সুনীল ভাবে, সে কি পাগল। কই চিড়িয়াখানায় কারও তিনটে চোখ তো দেখা গেলো না। তাহলে বাবা কেন প্রায়ই এই কথা বলে। ভূতের হয় তো থাকে। দাদু বলেছে।
তারপর কাকার বাড়িতে এসে রাতে ভাই এর সঙ্গে গল্প। কাকার ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। কিন্তু বুদ্ধি খুব। সুনীল ভাবে এই ভাই যদি সবসময় আমার কাছে থাকতো ভালো হত। ভাই সুনীলকে বললো, সুনীলদা, একটা গল্প বল না। তোর পাড়ার দাদুর গল্প। ওখানে একবার দেখেছিলাম যখন তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সুনীল বললো,ওটা তোদেরও বাড়ি। তুই তো আমার ভাই। আবার ভাই বলে, ওসব কথা নয়। গল্প বল না।
সুনীল বললো, তবে শোন দাদুর আর এক বন্ধুর নাম ছিলো রতন। তখনকার এক হেড মাষ্টারমশাই এর জীবনের সুন্দর ঘটনা। দাদুর কাছে শোনা বুঝলি। দাদুর বন্ধু রতন যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ত, তখন পাকা চুলের মাষ্টারকে ভালোবেসে ফেলেছিলো!সাইকেল চালিয়ে কেতুগ্রাম থেকে মাষ্টারমশাই যখন আসতেন,মাঝ রাস্তা থেকে সাইকেলে চাপিয়ে রতনকে নিয়ে আসতেন স্কুলে! রতনকে না পেলে রাস্তায় কোনো ছাত্রকে দেখলেও তুলে নিতেন নিজের সাইকেলে! নিজের টিফিন থেকেও খাওয়াতেন ছাত্রদের.!পড়া সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন ! তিনি বলতেন,এই চল্লিশ বছরে বহু ছাত্রদের আমি পড়িয়েছি,তারা মানুষ হয়েছে! তোরাও মানুষ হ!
তারপর রতন বড় হয়েচে!হেড মাষ্টারের পরেই সেকেণ্ড মাষ্টারের নাম!তাই পাঁচ গাঁয়ের লোকজন তাকে সেকেন মাষ্টার বলে!রিটায়ার হওয়ার পরেও সকলের ভালোবাসায় স্কুলে পড়াতে আসতেন!সব সময় তার হাসিমুখে কাজ মানুষের বিপদে আপদে কাজে দিত!পৃথিবীতে কিছু মানুষ মানুষের কাজ করতেই জন্মগ্রহণ করেন!তার ভালবাসার পরশ পাথরের ছোঁয়া পেয়ে মন্দ মনের মানুষও ভাল হয়ে যেত!

রতন দেখেছে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে মানুষটা সকলের সেবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন!
একবার মাঝি পাড়ার দুখিকে সাপে কামড়েছিলো ,সেকেন মাষ্টার গিয়ে দেখেন,ওঝা এসেই ঝাড়ফুঁক শুরু করেছেন!ওঝাকে বললেন মাষ্টার,ওকে ছেড়ে দাও ,আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব!সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন মহুকুমা হাসপাতালে !দুখি ফিরে এলে ওর বাবা, মা মাষ্টারকে প্রণাম করে দুটি কুমড়ো দিয়েছিলেন !তারা বললেন ,এটা আমাদের ভালবাসার উপহার !লিতেই হবে !তিনি নিয়ে পরে ডোম পাড়ার খেনি বুড়িকে দান করে দিলেন !
সুখ দুখে তাকে ছাড়া কারও চলত না! গাঁয়ের সেকেণ্ড মাষ্টার সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন অজান্তে! একবার বন্যার সময় চার রাত স্কুলের ছাদে সকল দুর্গতদের সঙ্গে থেকে তাদের সাহায্য করেছিলেন! নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করাই ছিলো তার ধর্ম!

তিনি নামতা পড়াতেন,দুই একে দুই,বাড়ির পাশে ভুঁই !দুই দুকুনে চার,দেশ তোমার আমার,দুই তিনে ছয়,জাতি দাঙ্গা নয়!এই রকম বিভিন্ন রকমের শিক্ষামূলক ছড়া শূনিয়ে শিশুদের জীবনের ভিত শক্ত করে দিতেন!তাঁর প্রত্যেক কাজেই ছিলো জীবনের ছোঁয়া !

সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে সাইকেল চালিয়ে তিনি স্কুলে আসতেন সাধকের মনে ! স্কুল ছিলো তার সাধনার স্থান !ছাত্র ছাত্রীরা ছিলো তার ভগবান,আল্লা বা যিশু !! তিনি যখন স্কুলে নিয়মিত শিক্ষক ছিলেন তখন সকল ছাত্রদের নিজের খরচায় টিফিন খাওয়াতৈন !সিদু কাকা বলতেন ,তখন তো আর মিড দে মিল ছিলো না !এই সেকেন মাষ্টার নিজের খরচে সকলকে খাওয়াতেন ,বুঝলে বাবাসকল !তারপর তার স্ত্রী গত হলেন ! তবুও স্কুল নিয়মিত আসতেন তিনি !আমাদের অনুরোধে রিটায়ার হওয়ার পরেও তিনি স্কুলে আসেন ! ইনি হচ্ছেন আদর্শ শিক্ষক গো !আর কোথাও এমনটি দেখলুম না !গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে শোনে সিদু কাকার কথা !

প্রসন্ন মনে তাদের সেবা করতেন অবিরাম!গ্রামের মানুষজন তাকে মান্য করতেন গুরুদেবের মত!

কুকুর,বিড়াল,ছাগল কোনো প্রাণী তার করুণা থেকে বঞ্চিত হত না! এক ভালোবাসার মন্ত্রে সকলকে গেঁথে দিত তার হৃদয়!

সিদু কাকা একদিন বললেন,আমার একটা আশ্রম আছে!সেখানে অনেক অনাথ শিশু থাকে !মাষ্টার তুমি কিছু টাকা চাঁদা তুলে দিও !
সেকেন মাষ্টারের কথা কেউ ফেলতে পারে না !তার কথায় অনেক চাঁদা উঠলো আর নিজেও রিটায়ার্ডের টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা দান করলেন !

আশ্রমের শিশুরা এখন ভালভাবে খায় ,পড়ে!
সেকেন মাষ্টারের ছেলেপিলে নেই !নিঃসন্তান!

তিনি বলেন,ছাত্র ছাত্রীরাই আমার সন্তান !এইভাবেই হেসে খেলে জীবন কেটে গেলেই হলো !

দাদু এবার এক কাপ চা খেলেন। তারপর আবার শুরু করলেন কথা।

একদিন সেকেন মাষ্টার স্কুলে এলেন !শুনলেন রাষ্ট্রপতি আসবেন নিজের গ্রামে! কেতুগ্রামের পাশেই বাড়ি !বিরাট তোড়জোড় ! পুলিশের ভিড়!তার বাড়িতে পুলিশের বড় বড় ইনস্পেক্টরের ভিড়!সেকেন মাষ্টার ছেলেদের বলেন ,মানুষ হওয়া জীবনের লক্ষ্য হোক তোমাদের !মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসো !তবেই ধন্য হবে তোমাদের জীবন !
সেকেন মাষ্টার তার জীবনের ছোটোবেলার কথা মনে করছেন !তার মনে পড়ে একবার স্কুলে যাওয়ার পথে কাংরা গাবার জলে তার বন্ধু অসীম জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলো!অসীম সাঁতার জানতো না !এক সাদুবাবা বলছেন ,মর শালা !সাঁতার জানিস না তো জলে নামার দরকার কি ?সেকেন মাষ্টার দেরী না করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসীমের চুল টেনে তুলেছিলো ডাঙায় !সাদু বলেছিলো ,ভালো কাজ করলে বাবা !ছেলেটা তা না হলে মরে যেতো !মাষ্টার বললো ,আপনি নামলেন না জলে ! সাদু বললো ,জলে আমার খুব ভয় !আমিও সাঁতার শিখি নাই ! তাই তো বুক বুক করছিলাম !অসীম এখন অই স্কুলের হেডমাষ্টার ! হেডমাষ্টার হলেও সেকেন মাষ্টারের কথা কখনও ফেলেন না হেডমাষ্টার !

দুদিন পরে রাষ্ট্রপতির গাড়ি গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ! রাষ্ট্রপতি এই স্কুলেই ছোটোবেলায় পড়েছেন! তাই স্কুলে একবার এলেন ! ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিলো আনন্দে !গ্রামের লোকজন ভিড় করে এলেন !সেকেন মাষ্টার নীরবে নির্জন ঘরে বসে আছেন ! রাষ্ট্রপতি স্কুলে ঢুকেই সেকেন মাষ্টারের খোঁজ করলেন! রাষ্ট্রপতি মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন ,আপনার জন্যই এখানে এলাম !কেমন আছেন স্যার ! সেকেন মাষ্টার বললেন, ভালো!তুমি আরও ভালো মানুষ হও বাবা !

পাড়ার সবাই দেখে অবাক ! সেকেন মাষ্টারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন রাষ্ট্রপতি ! সিদু কাকা বললেন ,অনেকেই রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পায় ! কিন্তু প্রণাম কজনে পায় গো?

দাদুকে আমরা বললা, তাহলে রতনই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলো নাকি দাদু?

 

দাদু বলেন, বাকিটুকু বুঝে নাও বাবা।

কাকার ছেলে অবাক হয়ে শুনলো। তারপর বলে বসলো, আমিও রাষ্ট্রপতি হবো। সুনীল বললো, আমি ওইরকম শিক্ষক হবো। তারপর লাফাতে লাফাতে তার মায়ের কাছে চলে গেলো।

এবার সুনীল একা হয়ে পড়লো। সে ছাদে চলে গেলো। দেখলো, মায়ের মুখের মত উজ্জ্বল চাঁদটা তাকে ডাকছে। সে ভাবে, হয়ত মা তাকে ডাকছে। আর ভালো লাগছে না। দিদির বিয়ের পরের দিন চলে যাবে। বাবা বলছিলে, কন্যাযাত্রী যাবি না। সুনীল যাবে না বলে দিয়েছে।

 

তারপর রাত হলে সকলে বিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো সবাই। খাবার সময় খেলো।

 

তারপর সুনীল ঘুরে বেড়ায় বাড়িময় । মায়ের মত মুখ খোঁজে।কাকিমার মেয়ে এসে বলে,এই সুনীল,এদিকে আয়।আমার কাছে বোস। কালকে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। একটু কথা বলি তোর সঙ্গে। তোর কোন ক্লাস হোলো রে? আমি ভুলে গেছি।

সুনীল বলে, এবার ক্লাস এইট হবে।

তাহলে তুই এত বোকা হাবার মত চুপ করে থাকিস কেন?

আচ্ছা বলো তো দিদি, মানুষের তিন চোখ পিছনে হয়।

দিদি হেসে ওঠে। বলে,তুই এত বোকা কেন? এইটে পড়িস অথচ কি বোকা তুই। পিঠে কারও তিনচোখ হয় না। আর কাউকে জিজ্ঞেসও করবি না।
সুনীল কি করে বোঝায়,বাবার মুখ থেকে শোনা কথা কি করে মিথ্যা হয়। সে কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

দিদি বলে, তুই আর ভাই মিলেমিশে থাকবি। তোরা দুইভাই আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবি।
সুনীল বলে, যাবো।
সুনীল দেখে দিদির চোখে জল। দিদিকে ঠিক এখন মায়ের মত লাগছে। মায়ের চোখের জলও ঠিক এইরকম। সব মায়ের চোখের জল কি এইরকম হয়। হতেও পারে। মায়ের জাত তো।

একবার সুনীল গ্রামে বন্ধুর বাড়ি গেছিলো। সেখানেও সে তার মায়ের চোখে এইরকম জল টলটল করতে দেখেছিলো। চোখের জলের তো রঙ হয় না। তবু সুনীল একটা মিল খুঁজে পায়। আর কেউ পায় কি? সুনীল জানে না।

আজ বিয়ে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। কে কোথায় শোবে সব ব্যবস্থা হচ্ছে। পাড়ার প্রতিবেশীদের ঘর নেওয়া হয়েছে। কাছাকাছি সব বাড়ি। বেশ ভালো লাগছে সুনীলের। বাবাকে বেশি দেখতে পাচ্ছে না সে। হয়ত কাজে ব্যস্ত আছে।
সুনীলও মোবাইল নিয়ে গেম খেলে মাঝে মাঝে। চিড়িয়াখানার ছবিগুলো দেখে। কাকার ছেলে সন্তুকে দেখায়। সন্তুর আবার অনেক বন্ধু। মেগাসিটির ছেলে। বেশিক্ষণ এক জায়গার থাকে না। সে স্মার্ট। কথাবার্তা সুন্দর। অনেক বন্ধু। ছেলে মেয়েরা তাকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু সুনীল একা একা থাকতেই ভালোবাসে।
বেশি মাথা তার পছন্দ নয়। ভিড় এড়িয়ে চলাই তার মজ্জাগত অভ্যাস। একজন বললো,কি রে হাবাগোবার মত বসে আছিস কেন? যা খেলা কর। আনন্দ কর। কিন্তু সুনীলের খেলতে এখন ভালো লাগছে না। খেতেও ভালো লাগছে না। মা হয়ত খেতেও পাচ্ছে না আমার কথা মনে করে। মায়ের তো আর কেউ নেই, আমি ছাড়া। আমি মায়ের কাছে যাবো। সুনীল চঞ্চল হয়ে উঠলো।

রাত হয়ে গেলো। বর যাত্রীর বাস চলে গেলো। তবু প্যান্ডেল ভরতি লোকজন। কিন্তু সুনিল বাবাকে দেখতে পায় না। বাবা কোথায় গেলো। এবার তো শুয়ে ঘুমোতে হবে। সকালে উঠেই বাড়ি যেতে হবে। আর ভালো লাগছে না মাকে ছেড়ে। মাকে ছেড়ে সুনীলের এই প্রথম থাকা। গুটি গুটি পায়ে সুনীল বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে গেলো রায়বাড়ি। এই বাড়িতে তাদের শোয়া খাওয়ার ব্যবস্থা। ঘর খোলা।অন্ধকার ঘর। তবু পাশের বাড়ির জানালা গলে এক চিলতে আলো পড়েছে ঘরের মেঝেতে। একটা আলোছায়ার মত ঘরের মায়াময় অবস্থা। সুনীল দেখলো দুটো মানুষ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠগুলো আড়াআড়ি ভাবে আছে। ঠোঁটে ঠোঁট একবার লাগছে আবার খুলে যাচ্ছে। বাবাকে চিনতে পারা যাচ্ছে। আর ওটা কে? মাছ খাচ্ছে মনে হচ্ছে। এ নিশ্চয়ই মেছো পেত্নি। দুজনের কাপড় চোপড় এলোমেলো। বাবাকে ধরেছে, যাদু করেছে পেত্নীটা।পেত্নীটার বড় বড় মাথার চুল।দুধগুলো দুলছে বাতাবি লেবুর মত। সুনীল বাতাবি লেবু দেখেছে বাবুদের গোয়াল বাড়িতে।

দুজনের ঠোঁটে একটা করে, মোট দুটো তেচোখা মাছ। লালায় সাঁতার কাটছে। একবার এদিকে যাচ্ছে আর একবার ওদিকে। চুমু খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ হয় কেন? সুনীল জানে না। ওদের দুজনের পিঠ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে দেখা যেতো দুজনেরই কি পিঠে তিনটে চোখ?

সুনীল দেখছে মেছো পেত্নীর গালের কষ বেয়ে বাবার দাবনার কাছে তিনচোখের মাঝখানে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে। মোবাইল তার হাতে আছে। কিন্তু ছবি তুললেই ফ্ল্যাশ হবে। জেগে যাবে তিনচোখ। আর ভস্ম হয়ে যেতে পারে তার চোখ মুখ মন। তার থেকে এই মেছোপেত্নী তাড়াবার মন্ত্রটা বলি মনে মনে। মায়ের কাছে শোনা মন্ত্র।
‘খটাং খটাং খটাং, সাত ভুবনের জাহাজ খটাং। আসতে কাটে, যেতে কাটে, ছেদ কাটে, ভেদ কাটে। আমার বাবাকে যে করে হান , তার বুকে মারি শ্রীরামচন্দ্রের জলপড়া বাণ।’

সুনীল ভাবে, মাকে বাড়ি গিয়ে এই মেছো পেত্নী আর তিনচোখের কথা বলতেই হবে….

সুদীপ ঘোষাল নন্দন পাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০ মেল sudipghoshal59@gmail

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ