কিক-অফ

স্বপন রায়
ছোটগল্প
Bengali
কিক-অফ

সে ফোন নামিয়ে রাখে। বাইরে বৃষ্টি। তিনটে মিসড কল। সেঁজুতির। মনে হয় এবারে সে ঠিক পারবে। সে আবার ফোন তোলে, মন খারাপ জড়ো করে। চিউইংগামের গন্ধে মেশা তার শোকের উদ্দেশ্য সেঁজুতি জানুক সে চায়না। সেঁজুতি খুব ভাল মেয়ে। ওর বাবা অরবিন্দ চন্দ্রকে সবাই এক ডাকে চিনতো। সৎ, উদার, উপকারী অরবন্দকে কে বা কারা এভাবে খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে খুন করল? প্রশ্ন উঠছে। আরে এই খুনের জন্যই আজ তার কাছে প্রথম সুযোগ এসেছে তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় পা রাখার। সুযোগ। সে চায়না সেঁজুতি এই ‘সুযোগে’র গন্ধ পাক!

আল। গোধুলি। সেঁজুতির বাবা, অরবিন্দ চন্দ্র। পুলিশ। প্রমথ সেন। বিজলি সমাদ্দার। ক্লাবের ছেলেরা। লাশ পড়ে আছে। আল। পুলিশ। গোধুলিতে!

প্রমথ সেন , এই অঞ্চলের দাপুটে নেতা। বললেন,এটা একটা পরিকল্পিত চক্রান্ত! অরবিন্দবাবু আমাদের সমর্থক ছিলেন। উনি চেয়েছিলেন জঙ্গল বাঁচুক, কাঠ পাচার বন্ধ হোক, উনি কাঠ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। আমরা সঙ্গে ছিলাম।

আমাদের পার্টিও ওঁর সঙ্গে ছিল।আমি জানিনা সৎ মানুষদের এ ভাবে চলে যেতে হয় কেন? তবে যে বা যাঁরা ওঁকে এ ভাবে খুন করেছে তাদের প্রশাসন উচিৎ শাস্তি দেবে, আমরা এর জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবো!

প্রমথ সেন শেষ করতেই বিজলি সমাদ্দার সাংবাদিকদের বললো, আপনারা এই দোকানটায় আসুন, বাকি কথা চায়ের সঙ্গে হবে!
এক তরুণ সাংবাদিক অবাক হয়ে বলেই ফেলল, ম্যাডাম আপনি পারেন বটে, এর মধ্যে চায়ের ব্যবস্থাও করে ফেললেন?

বিজলি সমাদ্দার হাসে! এ অঞ্চলে বলা হয় বিজলি যখন হাসে/দেশ দুনিয়া ফাঁসে! তরুন সাংবাদিকেরও ফাঁস লাগে। সে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ওঠা নামা করে। বিজলিদের দুটো হোটেল,শপিং মল,প্রাইভেট স্কুল। এ ছাড়া রিয়েল এস্টেটের কারবার। বিজলির বাবা রণেন সমাদ্দার। সেরিব্রাল স্ট্রোকে শয্যাশায়ি।বিজলিই এখন সব দেখে। সব। আর বিজলিকে দেখে সবাই। বিজলি এত ব্যস্ততার মধ্যেও পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে ‘সেলফ হেল্প গ্রুপ’ তৈরি ক’রে কাজ করে। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও ওকে দেখা যায়। আর বিজলিকে দেখে পিপাসা পায় তরুণদের। ভীড় জমে যায়। বিজলি হাসি উপহার দেয় অকাতরে…

বিদ্ধ হয় সবাই। যেমন তরুণ সাংবাদিকটি। গোধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। আলের ধারে সেঁজুতির বাবা পড়ে আছে। পুলিশ। চা। পকৌড়া। ভালমানুষ অরবিন্দ এবার ময়নাতন্তে যাবেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ। বিজলি সেই তরুণ সাংবাদিকের কাছে এসে বলে, এই যে দুষ্টু ছেলে, কি দেখছিলে ওভাবে?

সে অপ্রস্তুত, হাসে!

বিজলি বলে, আমি তোমার সঙ্গে ফিরবো, বাইক আছে তো?

সে শিহরিত হয়, বিজলি ওর বাইকের পিছনে….

বিজলি বলে ,তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, নিয়ে যাবে তো আমায়?

সে আর বিজলি। মোরামের একহারা রাস্তায় মোমপারানি আলো। তাতে গ্রীবা গ্রীবা গাছেদের ছায়া। বিজলি..বিজলির হাত… বেষ্টনি… স্পর্শ! সে শিহরের চূড়ান্তে উঠে স্পিড বাড়াতে থাকে। বিজলি ওকে আঁকড়ে ধরে আরো। একসময় কানের কাছে মুখ এনে বলে,তুমি কি জানো এরপরের ইলেকশনে প্রমথদার বদলে অরবিন্দ চন্দ্রকে টিকিট দেওয়ার কথা নেতৃত্ব ভাবছিল? প্রমথ দা’র ভাবমূর্তি নিয়ে পার্টি চিন্তায় ছিল, আর ইনি ছিলেন দেবতার মত মানুষ। তাঁকে এ ভাবে মরতে হল! প্রমথ দা’র কটা কাঠের গোলা জানো, এক ডজন। কাঠ মাফিয়াদের সঙ্গে ওর ওঠা বসাও আছে। দলের কাছেও খবর আছে। আমি ভাবছি এর মধ্যে এ সব আবার নেই তো? দেখো আমি ওঁকে শ্রদ্ধা করতাম। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও যেন প্রমথদা রয়েছে। তোমাদের কাগজ তো ইনভেস্টিগেটিভ রিপোরটিং-এর জন্য বিখ্যাত। লড়ে যাবে নাকি? শেষ কথাটা বলার সময় পিঠের ওপর নরম দ্বৈত প্রেসার ওকে আবিল করে দেয়! চাপ বাড়ছে আর সেই চাপের কাছে নত হতে হতে সে জানায়, আমিই এই কেসটা দেখছি, আপনি যা বললেন এতো ভাবা যায়না!

বিজলি বলে, তোমার খিদে পায়নি?

আচমকা ব্রেক দিয়ে বিজলিকে পিঠের ওপরে ফেলে দিয়ে সে বলে, পেয়েছে, ভীষণ খিদে, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
বিজলি হাসে। ঝিরঝিরে হাসি। বলে, কী গরম! চলো ঠাণ্ডা কিছু নেওয়া যাক…

দিন বা রাত এরপরেও থেমে থাকেনা। সে কাগজের পাতায় অরবিন্দ হত্যার জন্য প্রমথকে সন্দেহবিদ্ধ করে। প্রমথ ওকে ডেকে ধমকায়। আর একটা কাগজ জড়িয়ে দেয় বিজলিকে। তারা লেখে বিজলি’র রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় কাঠের যোগান দিত মাফিয়ারা। তাদেরই কাজ এই হত্যা। কারণ খুন হয়ে যাওয়া মানুষটি এ সব জানতে পেরে গিয়েছিল! কাগজে কাগজে লড়াই চলে। দুটো কাগজেরই বিক্রি বাড়ে। প্রমথ আবার থ্রেট করে। বিজলি ওকে আস্কারা দেয়…

একদিন সকালে অরবিন্দ চন্দ্র’র ডায়েরি নিয়ে সেঁজুতি আসে! সেঁজুতি’র সঙ্গে ওর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, সেঁজুতিকে নিয়েই তো থাকার কথা ওর! সেঁজুতির ভালমানুষ বাবা আর নেই। কিন্তু বিজলি আছে, ইতিমধ্যে ওর জীবনে বিজলি চলে এসেছে!

ডায়েরিতে সেঁজুতির ভালমানুষ বাবা অরবিন্দ লিখে গেছেন কাঠমাফিয়াদের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে প্রমথ আর বিজলি! প্রমথর কাঠগোলা হয়ে বিজলি’র রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় চলে যায় জঙ্গলের কাঠ, কোটি কোটি টাকা আয় করে দুজনে। সে তার সাংবাদিকতার বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারে সেঁজুতি’র কাছে যে ডায়েরিটা আছে সেটা প্রকাশিত হলে বিস্ফোরণ হবে। সে সময় নেয়। সেঁজুতি’কে ভালোবাসে ও, নাকি বাসতো? বিজলি’র সঙ্গে এখন তো প্রায়ই। শুধু শরীর? বিজলী কি শুধু শরীর, স্বার্থ নেই?

সেঁজুতিকে ডায়েরিটা রেখে যেতে বলে ও।

সেঁজুতি যাওয়ার আগে বলে, তোমার জন্য আমার চিন্তা হয়। ডায়েরিটার কথা ওরা জানতে পারলে তোমায় শেষ করে দেবে…
সে বলে, কিছু হবে না আমার, তারপর চুইংগাম মুখে নেয় আর সেঁজুতির চলে যাওয়া দেখে….

বিজলি ডায়েরিটা পড়ে। হাসে। বলে, আমি জানতাম তুমি পারবে। প্রমথদা এখন দলের ভেতরে কোণঠাসা। আমার সাহায্য চাইছে, আর দেখো এই ডায়েরিটাও এসময়ে আমার হাতে চলে এল! গ্রেট, চলো আমরা সেলিব্রেট করি। তুমি কাল ‘চিফ রিপোর্টার’ হচ্ছো। আমার সঙ্গে ব্রজেশবাবুর কথা হয়ে গেছে, কাল অর্ডার বেরোবে ডার্লিং…

সে ঘন হয়ে আসে, বিজলিও পড়ে যায়! যাবতীয় শব্দের ওপরে দিব্য ছিটকে যায় আশ্লেষের, উন্মাদনার ধ্বনিগুলো, বাইরে বৃষ্টি নামে…

দিন যায়, না গিয়ে আর কি করবে ব’লেই যায়। সে ভাবে, সেঁজুতি খুব ভাল। ওর বাবাও খুব ভাল ছিলেন। এবার সে বিজলি’র দিয়ে যাওয়া যন্ত্রটা তোলে। দেখে, ছোট্ট কিন্তু অমোঘ! সে নামিয়ে রাখে যন্ত্রটা। বাইরে বৃষ্টি। মোবাইলে মিসড কল। সেঁজুতি’র। এখন আর কথা নয়। সেঁজুতিকে অফ করে দেয় ও আর ভাবে পারতেই হবে ওকে, সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না!

বেশ কিছুদিন পরে আরেকটা মৃতদেহ পাওয়া যায়! খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। একটা বুলেট সরসরি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। প্রফেশনালদের কাজ,পুলিশ জানায়। এবারে বিজলি সব সামলায়। সাংবাদিকদের বলে, আমাদের দলের খুব বড় ক্ষতি হয়ে গেলো, সেঁজুতি’র বাবা আর সেঁজুতি দু’জনকেই কেড়ে নিল মাফিয়ারা। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়বো, হত্যাকারীদের ছাড়া হবে না…

আল।গোধুলি।ধানখেত।একটি মেয়ের মৃতদেহ। ভাল মেয়ে। ভাল পৃথিবী। ভাল সময়। সে দেখে… মুখ ফিরিয়ে নেয়… বাইকে স্টার্ট দেয়…

বিজলি পিছনে। সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসে মোম পেরনো আলো। ছুটন্ত গ্রীবা ছায়াদের, গাছে মিশে যায়। বিজলি দু’দিকে পা দিয়ে বসে তাকে বলে, স্পিড বাড়াও…

ওরা ঘটনাস্থল থেকে দূরে যেতে চায়। সে সেঁজুতিকে ভাবে। ভাবে তিনটে গুলি নেওয়ার সময় সেঁজুতি’র চোখে কি হাসির আভাস ছিল, অনুকম্পা ছিল?

ওরা দূরে যেতে থাকে। আল, সেঁজুতি’র দেহ, পুলিশ আর ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে। বাইকে’র দ্রুতিতে মিশে যায় সেঁজুতি’র চিৎকার। ও নিশ্চিত হয় কারণ বিজলি ওকে জড়িয়ে আছে। তবে এতটা নিশ্চিতও হতে পারেনা যে অকারণেই গেয়ে উঠবে, এই পথ যদি না শেষ হয়…

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ