কুঁড়িতেই বিনষ্ট

রিমি রায়
ছোটগল্প
Bengali
কুঁড়িতেই বিনষ্ট

“আমি ৭ বছরের সুহানা বলছি”

এদিকে যখন, তোমরা সবাই পূজো পূজো করে উদ্বিগ্ন ।

ওদিকে তখন, আট ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত আমার বাবা, মা- বাড়ির কেউ তাদের এই ছোট্ট সুহানার কোনো খোঁজ পায়নি। আজকে স্কুল আসার সময় ভুল করে শুধু একবার বলে ফেলেছিলাম মাম্মা টাটা “চললাম”। মা তাওতো ছুটে এসে বকা দিয়ে বললো সোনা যাবার সময়”চললাম” বলতে নেই ”বলো আসছি”। আমার এই একটা কথা যে আমাকে আমার বাবা মার থেকে এতো দূরে নিয়ে ‘চলে আসবে’ আমি শিশু মনে ভ্রুণাক্ষরেও তা টের পাইনিগো, বিশ্বাস করো।আমাকে বাবাই রোজ স্কুলে দিয়ে যেত আবার ছুটির শেষে বাবাই আনতে আসতো। আজকেও বাবাই যদি ঠিক সময় চলে আসতো..! তাহলে আজ হয়তো আমাকে এখানে আসতে হতনা। তবে শুনছি… বাবাই নাকি নিতে এসেছিল গো.., কিন্তু ততক্ষণে আমি তো রঞ্জন কাকুর সাথে চলে এসেছি। উনিই তো বললেন সুহানা মা চলো, তোমার বাবা আজ একটা জরুরি কাজে আটকে পড়েছে। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন আমার সঙ্গে চলে যেতে বলেছে। আমি ভাবলাম তাই হবে..! নয়তো… বাবাতো এত দেরি করেনা ছুটি হওয়ার আগেই চলে আসে। তাই আমিও আর কিছু না ভেবেই বাইকে উঠে বসলাম।

তারপরতো নাকি এখন শুনছি বাবাই আনতে এসেছিল। তবে সে সব কথায় দারোয়ান কাকু বাবাকে খুলে বলেছিল বলছে। বাবা শুনে স্তম্ভিত হয়ে বলেছে “হ্যাঁ, একটা কাজ ছিল ঠিকই ..! তাই আজ একটু দেরি হয়ে গেছে আসতে। কিন্তু… আমিতো কাউকেই পাঠাইনি আনতে”। তবে? উনিতো নাকি কাউকেই পাঠাননি বলেছে.. ? তারপর যদিও সে সব কথা শুনে বাবা ওখানে আর এক মুহূর্ত নাকি দাঁড়ায়নি, এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে বাড়ি এসে দেখে তখনো আমি বাড়ি আসিনি।কিন্তু ঘড়ির কাঁটা বলছে আমার তিনটে নাগাদ ফিরে পড়ার কথা অথচ তখন অলরেডি ঘড়িতে চারটে বাজে। আমাকে না পেয়ে বাবার মুখের গল্প শুনে ততক্ষণে তো মা’র মাথায় আকাশ ভেঙে ঝুলছে। দিনকাল নাকি যে বড্ড খারাপ…? আমার বাবা মা রোজ নিউজ পেপারে কি যেন সব ভয়ের গল্প পড়ে, আজকি তবে সেই ভয়টাই তাদেরও গিলে ফেলেছে। অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে এতক্ষণেও মা আমার- সেই “মাম্মা কোথায় তুমি…? আমি এসে গেছি”। বলেই ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়েই বাড়ি মাত করা চিৎকারটা শুনতে না পেয়ে, আজ মনে হয় সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বাবাতো তারপর থেকে নাকি শুনছি মনে দোলাচল নিয়ে কাদেরকে সব ফোন করেই যাচ্ছে। আর মা ওদিকে খালি কাঁদতে কাঁদতে বলেই যাচ্ছে ”সুহানা তোকে বারবার আমি বারণ করেছিলাম কোনো অচেনা লোক ডাকলে যাবিনা… যাবিনা। কোথায় গেলি মাকে ফেলে…? ”যা বাবা তোমরাই বলো আমার দোষ কোথায়? মা তো আমায় অচেনা দুষ্টু লোকের কথা বলতো। আর রঞ্জন কাকুকে তো আমি চিনি তাইতো গেলাম। নয়তো আমিতো দারোয়ান কাকুর কাছেই দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তবে কি তখন যেতে দারোয়ান কাকু লোকটার যে বর্ণনা বাবাকে দিল তাতে করে বাবা এখনো বুঝতে পারলনা ওটা রঞ্জন কাকু ছিল। মানে ‘বাবার বন্ধু’। নয়তো বাবা ‘এ’কে কেন এখনো ফোন করছেনা? এর কাছেই তো আমি এক গা রক্ত মেখে অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ে ছটফট করছি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার! খুব কষ্ট! বিশ্বাস করো…! এরকম কষ্ট এর আগে যেন কখনো পাইনি, মাও তো কত মেরেছে বেকেছে। এটা যেন অন্য একটা অস্থির জ্বালা যন্ত্রণা। রঞ্জন কাকুকে কতবার হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললাম আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, এসব কি করছো? এটা কোথায় এনেছো আমাকে? আমি মা’র কাছে যাব। আমাকে মুখটা চেপে ধরে বললো তোর বাবার প্রতিশোধটা তোকে দিয়ে চরিতার্থ করছি। তোর বাবা আমার সাথে বেইমানি করলো, আমাদের এটা কয়েক লাখ টাকার বিজনেস ডিল ছিল। দুটো টাকা করছে বলে খুব অহংকার হয়েছেনা। এবার বুঝবে সে, ‘আমার নামো রঞ্জন সান্যাল’।

তার জন্য এ ভয়ানক শাস্তিটা আমাকে কেন দিল বলতে পারো – এই দুষ্টু লোকটা? আমার কি দোষ ছিল এতে? তবে জানোতো দুপুরে না ঘুমালে মা আমায় ভয় দেখিয়ে বলতো রাস্তায় অনেক ছেলে ধরা থাকে ওদের কাছে দিয়ে চলে আসবো। মার থেকে ওরা অনেক দূরে নিয়ে চলে যাবে, তখন জোরে জোরে চিৎকার করলেও কারো সাড়া পাবিনা। তবে কি ছেলেধরা এদেরই বলে সত্যিতো কি অন্ধকার শুনশান জায়গাটা কত্ত চিৎকার করলাম কেউ বাঁচাতে আসলনা। আমি যেন গভীর স্তব্ধতায় মুখ গুঁজে সাড়শীতে আটকানো মাকড়সার মতো ছটফট করছি। একবার, একবার কেউ যদি আমার গলাটা শুনে ছুটে এসে কোলে তুলে নিত! চিৎকার করতে করতে তেষ্টায় গলাটাও যে শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে।হাঁ করে ওপর পানে চেয়ে আছি, কেউ যদি শেষ বেলায় এসে এক ফোঁটা শরতের শিশির দিত…! সেদিন তো মা খবরের কাগজে কি সব দেখে ছুটে এসে ভয়তে আমার হ্টপ্যান্ট আর মিনি স্কার্টগুলোকে কোথায় করে দিল আর পড়তে দিতনা। বায়না করলে বলতো এসব পড়লে দুষ্টু লোকেরা ধরে নিয়ে যাবে। তা আজতো স্কুল ড্রেস পড়েছিলাম তাও কেন নিয়ে আসলো?

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! আমি পারছিনা মাগো আর পারছিনা। আমি আসলাম মাম্মা আসলাম। তোমাদের ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। কিন্তু এই কষ্টটাও আমি যে আর সহ্য করতে পারবোনা এবার সত্যি “চললাম”। তোমার কথা মতো অনেকবার উচ্চস্বরে বলেছিলাম” Don’t touch me uncle! Don’t touch me! তাও শুনলনা জামাটা টেনে ছিঁড়েই দিল। তোমার সাথে আর শেষ সময় দেখে করে একটা চুমু খেয়েও যাওয়া হলোনা রাগ করোনা হ্যাঁ, মাম্মা। সেই যে তোমার কাছে প্রমিস্ করেছিলাম আমি বড়ো হয়ে ইয়া বড়ো লেখিকা হবো। আমার বই একদিন সবার ঘরে ঘরে থাকবে তোমাদের ডেকে লোকে বলবে আপনি সুহানার মা? আপনার মেয়ের গল্প পড়েছি চোখে জল এনে দিয়েছে। আর তুমি বাড়ি এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলবে আমি পেরেছি! আমরা… পেরেছি! এটাইতো বাবা মার পরম পাওনা। সেটাও আর এই দুষ্টু লোকটা হতে দিলনা। তবে হ্যাঁ, কাল আমার গল্প সবাই পড়বে একেবারে খবরের কাগজের প্রথম পাতাতেই পড়বে। তবে এটা অন্য এক গল্প। “আমার শেষ গল্প”। বড়ো বড়ো করে “হেড লাইনে” জুড়ে থাকবে আবারো ‘একটা মা’র কোল ফাঁকা হলো’। সবাইকে তখন দেখবে অজান্তেই কেমন কাঁদিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে আমি চলে যাচ্ছি।

তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা- মাম্মা, বাবাই সবাই খুব কাঁদচ্ছেতো আমার জন্য? জানি তোমাকে ওরা কেউ সামলাতে পারছেনা। একবার যে আমি গিয়ে তোমার চোখ দুটো মুছে দিয়ে আসবো সেও তো উঠতেই পারছিনা। তুমি বাবাই খুব ভালো থেকো হ্যাঁ। আর কেঁদো না যাবার সময় তোমাদের এমন কান্না কান্না মুখগুলো দেখে গেলে আমি ওখানে কেমন করে ভালো থাকবো বলোতো। তোমরাতো জানো তোমরা কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। যদি আবার সুযোগ পাই আমি আসবো…! সুহানা হয়েই আসবো… তোমাদের কাছে। তবে এবার আসবো একটা সাহসিনী সুহানা বেশে এই নরখেকো জানোয়ারগুলোকে শেষ করতে। টাটা বাবাই মাকে দেখে রাখবে। আর হ্যাঁ, রঞ্জন কাকুুুুকে জিজ্ঞেস করো এই সাত বছরের মেয়েটার থেকে কি সুুখ আদায় করলো…?

“আমি না হয় এখন লিটিল স্টার হয়ে ওখান থেকেই তোমাদের আদর নেব”। যেতে যেতে অনেক গুলো হামি ছুঁড়ে দিলাম… ধরে নাও। (শরতের পেঁজা তুলোর আড়ালে আস্তে আস্তে মিষ্টি ছোট্ট মুখটা মিশিয়ে যেতে লাগলো)

এতক্ষণ যে মর্মান্তিক কণ্ঠটা আপনারা শুনছিলেন ‘এটা আমি’ ৭ বছরের বাবা মার একমাত্র মেয়ে সুহানা মিত্র। ‘ব্যাবিলিয়ন লিটিল স্টার অ্যাকাডেমি’র ছাত্রী। সবে মাত্র চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ভূমি ছেড়ে মাথাটা তুলে ঘুরে দাঁড়িয়ে জগতটাকে দেখছিলাম। কিন্তু আমাকে আর এ শিক্ষিত সমাজ ফুটে উঠতে দিলনা, কুঁড়িতেই বিলীন করে দিল। কি দোষ ছিলগো আমার….? আমার বয়সতো মাত্র ৭ । আমিও আজ এই পিশাচগুলোর হাত থেকে রেহাই পেলামনা, যৌনতার শিকার হলাম..! আচ্ছা, আমার বাবা মা এই লোকটাকে এই লোকটার মতো আরও দুষ্টু লোকেদের তার উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে তো? নয়তো আর কত কুঁড়ি এভাবে একেরপরএক বসন্তের শুরুতেই ঝড়ে যাবে…? ঠিক এভাবেই দিনান্তে আমাদের সমাজে আমার মতো কত ছোটো বড়ো নিরাপরাধ সুহানাকেই হিংসার লালসার স্বীকার হতে হচ্ছে। আবার কখনো বা ছোটো পোশাকের দোহাই টেনে তাদের একচোখ ভর্তি স্বপ্ন কেড়ে মায়েদের কোল থেকে এভাবেই নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে; এই সমাজের কিছু নরখেকো পশুরূপী অমানুষ। এইভাবে আর কত স্বপ্ন মরবে..? আর কত মার কোল ফাঁকা হবে…? আমারা মোমবাতি মিছিল চাইনা ওতে আমাদের আরো শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। ওই আগুনে আমরা একটা ধর্ষক জ্বালিয়ে দিতে দেখতে চাই। সবাই এর কাছে তাই যাওয়ার বেলায় আমার একটা শেষ অনুরোধ রেখে গেলাম- অনেক হয়েছে..! আর না। এবার নারীজাতিকে রক্ষা করুন, ধ্বংস নয়। তারাই এই গোটা বিশ্ব সংসারটার মূল শিকড়।ধারাবাহিকতা তারাই বয়ে নিয়ে চলবে। এইভাবে একের পর এক শিকড় উগড়ে দিতে দিতে একদিন ভোর রাতে আপনিও জেগে উঠে দেখবেন এই বৃহৎ সংসারটাই আর নেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

রিমি রায়। গল্পকার। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের হাওড়ায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ