করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
নেকড়ের থেকে কুকুরের উদ্ভব এক আশ্চর্য কাহিনী। সেই নিয়ে গবেষণাও কম আশ্চর্যের নয়।
কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অন্তত ১৫,০০০ বছর পুরনো। নানারকম জীবাশ্ম (fossil) ও জিনগত (genetic) সূত্র থেকে এটুকু পরিস্কার যে কুকুরদের পূর্বপুরুষ নেকড়ে (gray wolf) জাতীয় কোনো শ্বদন্তক (canid) প্রাণী। ঠিক কবে আর কিভাবে নেকড়ে থেকে কুকুরে রূপান্তর ঘটেছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে পৃথিবী জুড়ে।
কুকুরের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে মানুষের “ভাষা” বোঝার, মানুষের নানা অঙ্গভঙ্গি বুঝে সেইমত কাজ করার। পোষা কুকুর ছুঁড়ে দেওয়া বল মুখে করে নিয়ে আসে, সকালবেলা খবরের কাগজ মুখে নিয়ে এসে মালিককে দেয়, বসতে বললে বসে, শুতে বললে শোয়, এসব আমাদের জানা কথা। কুকুর যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা এক কথায় স্বীকার করবেন যে কুকুরের চোখের দিকে তাকালে তাঁদের মন গলে যায়, কুকুররা তাঁদের সঙ্গে যেন কথা বলে। পোষা কুকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার অভিভাবকের এমন মনে হওয়া আশ্চর্য্যের নয়, কিন্ত রাস্তার নেড়ি কুকুর? তাদের দেখেও তো মানুষের দয়া হয়, মন গলে, মনে হয় “আহা বেচারা, বড্ড খিদে পেয়েছে ওর!” এই দয়ার জন্যই এতকাল ধরে টিঁকে রয়েছে হয়ত কুকুরেরা, হয়ে উঠেছে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী, সবসময়ের সাথী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের ভাষা বোঝার, এবং মানুষের সঙ্গে মানসিক যোগস্থাপন করার ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে কুকুরের বিবর্তনের চাবিকাঠি। মানুষের ভাষা বোঝার, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতাকে বলা হয় social cognition। বিভিন্ন রকম আচরণভিত্তিক ও মনস্তত্বভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে নেকড়েদের তুলনায় কুকুরদের এই ক্ষমতা অনেক বেশী। কুকুর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে অতীতে কোনো এক সময় নেকড়ে বা নেকড়ে জাতীয় কোনো পশু মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদান করতে শুরু করে, এবং যাদের মধ্যে এই social cognition বেশী প্রবল, তারা মানুষের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে শেখে। কুকুরের এই পূর্বসূরিরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আশেপাশে থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করে, স্বাভাবিক নেকড়েসুলভ হিংস্রভাব তাদের আচরণে কমে যেতে থাকে, তারা হয়ে ওঠে সহজবশ্য, পোষ মানে ক্রমশ। এই ধারণার নাম দেওয়া হয়েছে domestication hypothesis। এর মূল ভাব পোষ মানানো হলেও তফাৎ হল যে এখানে মানুষ কুকুরকে ঠিক নিজের প্রয়োজনে জোর করে বেঁধে রেখে পোষ মানায় না, কুকুর নিজেই পোষ মানতে ইচ্ছুক। এতে অবশ্য লাভ উভয়পক্ষেরই। সমস্যা হল যে কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস বোঝার জন্য বেশীর ভাগ গবেষণা করা হয় পাশ্চাত্যে, পোষা কুকুর নিয়ে। নানা জাতের পোষা কুকুর আমাদের চোখে যতই আলাদা হোক, একটি german shepherd এর সঙ্গে একটি poodle এর জিনে আসলে খুব তফাৎ নেই। প্রায় ৩৫০টি কুকুরের breed ছড়িয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীতে, এবং এরা সকলেই প্রায় মানুষের সৃষ্টি; ঠিক যেভাবে আমাদের যাবতীয় খাদ্যশস্য এবং গৃহপালিত পশু আমাদের সৃষ্টি, artificial selection পদ্ধতিতে। কুকুরের breed তৈরিতে মানুষের হাত থাকলেও, নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তন ঘটেছে এই কৃত্রিম প্রজনন আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে। অর্থাৎ, ছবিটা কিছুটা এই রকম –
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরের জিন সংগ্রহ করে কুকুর নামক প্রাণীটির বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে চেষ্টা করছেন নানা দেশের বৈজ্ঞানিকরা। গত কয়েক বছর ধরে কিছু নতুন প্রকাশিত তথ্য কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিস্কার করেছে, যদিও এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমে বলি কি কি জানা গেছে, সেই কথা, তারপরে ফিরব প্রশ্নে।
কুকুরের বিবর্তনের বিষয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজের নিদর্শন হিসেবে হয়ত ধরে নেওয়া যায় ১৯৬১-তে প্রকাশিত Magnus Degerbøl নামক এক ড্যানিশ বৈজ্ঞানিকের কাজ। তবে কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রথম প্রমাণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এ নেচার জার্নালে-এ তিন পাতার একটি গবেষণাপত্রে। ইসরায়েলের Davis ও Valla জানান যে মধ্য-প্রাচ্যের নাতুফিয়ান সংস্কৃতির (Natufian culture) এলাকার একটি বাসস্থানে একটি পাথরের নীচে একজন বয়স্ক মানুষের প্রায় আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই মানুষটি পা মুড়ে শুয়ে রয়েছেন, একটি হাত মাথার ওপরে একটি কুকুর (অথবা নেকড়ে) ছানার গায়ে রাখা। বোঝা যায় যে এই স্বাপদশিশুকে কবর দেওয়া হয়েছিল তার “মালিকের” সঙ্গে। একই সঙ্গে আরো কিছু হাড় পাওয়া যায় ওই নাতুফিয়া এলাকা থেকে। ১৯৭৮-এ এখনের মত DNA analysis ছিল না, সুতরাং এই হাড়গোড়গুলি নানাভাবে মেপে, অন্যান্য কুকুর ও নেকড়ের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করাই ছিল একমাত্র পদ্ধতি। এই কাজ থেকে পরিষ্কার হয়নি ওই হাড়গুলি কুকুরেরই ছিল কিনা, তবে ১২,০০০ বছর আগে নাতুফিয় আমলে যে কুকুরজাতীয় পশুকে মানুষ পোষ মানিয়েছিল তার সাক্ষী ১৩১ নম্বর বাসায় পাওয়া ওই কবর।
কাট টু ১৯৯৭, মার্কিন ও সুইডিশ বৈজ্ঞানিকদের কাজ থেকে প্রমাণিত হল যে নেকড়ে থেকেই কুকুরের উৎস। Science পত্রিকায় Robert K. Wayne এবং তাঁর সহকর্মীদের কাজ প্রকাশিত হয়; ৬৭টি ব্রীডের ১৪০টি পোষা কুকুর ও পৃথিবীর ২৭টি জায়গার ১৬২টি নেকড়ের mitochondrial DNA পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন তাঁরা। সেই সঙ্গে জানা যায় যে অন্ততপক্ষে ১০০,০০০ বছর আগে কুকুর বিবর্তিত হয়েছে নেকড়ের থেকে, এমনকি, কুকুরের প্রথম আবির্ভাব ১৩৫,০০০ বছর আগেও ঘটে থাকতে পারে। সমস্যা হল যে, আদিম মানুষের আশেপাশে কুকুরের যে সমস্ত চিহ্ন পাওয়া গেছে, সেগুলির বয়স অত নয়। তারও আগে যদি কুকুরের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমরা তার কোনো চিহ্ন পাইনি কেন, সেই প্রশ্ন উঠলো।
নতুন সহস্রাব্দে সহজলভ্য (ভারতে তখনো নয়) gene sequencing নিয়ে এল নতুন বিপ্লব, যেসব দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্ত, সবাই যুগপৎ নেমে পড়লেন নতুন ধরণের বিবর্তনের গবেষণায়, যার নাম molecular evolution, এবং যার মূলে রয়েছে জিন। ক্রমশ অনেক নতুন তথ্য প্রকাশ পেতে থাকল, এবং বোঝা গেল যে Wayneদের হিসেবে ভুল ছিল। তবুও, এই কাজ থেকে কুকুরের বিবর্তন বিষয়ক গবেষণার এক নতুন দিক খুলেছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস পড়লে জানা যায়, অতীতের এমন অনেক ভুলে ভবিষ্যতের অনেক আবিষ্কারের বীজ রোপিত হয়েছে।
২০০২, আবার Science পত্রিকা, আবার কুকুরের mitochondrial DNA। এবারে সুইডেন ও চীনের বৈজ্ঞানিকরা ৬৫৪টি কুকুরের জিনের বিশ্লেষণ করে জানালেন যে পৃথিবীর সব কুকুরের উৎস একটিই gene pool (বা population) এবং জন্মস্থান এশিয়ায়, উরাল পর্বতের পূর্ব দিকে, সময় ১৫,০০০ বছরের আশেপাশে। ২০০৯-এ এই বৈজ্ঞানিকদের দলটি আরো গবেষণা করে জানালেন যে ১৬,৩০০ বছর আগে চীনের দক্ষিণ দিকের বাসিন্দা কয়েকশ নেকড়ে সমগ্র সারমেয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা । সময়টা মানব ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ মোটামুটি এই সময়েই ধান চাষের সূত্রপাত ঘটে।
Peter Savolainen দের এই গবেষণা থেকে আরো জানা গেল যে এই সারমেয়কুলের মূলে একজন নয়, ছিল অন্তত ৫১ জন নেকড়ে-সরমা – অর্থাৎ সেই সময়ের চৈনিক মানুষদের মধ্যে নেকড়ে পোষ মানানর বেশ ভালই চল ছিল। চীনের এইসব অঞ্চলে আজও কুকুরের মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে কি সদ্য চাষবাস শেখা মানুষেরা নিতান্তই খাদ্য হিসেবে পোষ মানিয়েছিলেন নেকড়েদের?
এশিয়ানা ইউরোপ?
স্যাভোলেইনেনদের সঙ্গে ঠিক একমত ছিলেন না মার্কিন বৈজ্ঞানিক আডাম বোয়কো ও তাঁর সহকর্মীরা। ২০০৯-এই তাঁদের কাজ প্রকাশিত হয়েছিল PNAS journal-এ । বোয়কোদের মতে, শুধুমাত্র পূর্ব এশীয় নেড়ি কুকুরদের নিয়ে গবেষণা করেই এতদিন প্রমাণ করা হয়েছে যে কুকুরদের উৎস পূর্ব এশিয়াতে। অথচ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা জাতের কুকুর, রয়েছে অনেক জংলী বা আধপোষা কুকুরের গোষ্ঠী, রয়েছে নেড়ি কুকুরের দল। কুকুরজাতির ইতিহাস বুঝতে গেলে এই বিরাট জনসংখ্যাকে বাদ দিলে কি করে চলবে? আফ্রিকার সাতটি জায়গা থেকে ৩১৮টি নেড়ি কুকুর, আর তার সঙ্গে বিভিন্ন breed-এর (আমাদের হিসেবে যারা ভালো জাতের, বা বনেদি) কুকুরের DNA নানাভাবে নেড়েচেড়ে, তুলনা করে বোয়কোরা দেখেছিলেন যে আফ্রিকার নেড়িরা “বিলিতি” বনেদি কুকুরদের থেকে আলাদা, যদিও আফ্রিকার বনেদি কুকুরদের সঙ্গে তাদের অল্প মিল রয়েছে। মূলতঃ বোঝা গেল যে নেড়ি কুকুরদের মধ্যে জিনের বৈচিত্র বনেদীদের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং, বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে হলে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা নেড়ি কুকুরদের জিনের বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এই কাজে বনেদি কুকুরদের তেমন দাম নেই।
বোয়কো ও স্যাভোলেইনেনদের দুপক্ষের কাজেই কটাক্ষ করেছেন প্রাজ্ঞ বিবর্তন বিশেষজ্ঞ রবার্ট ওয়েন। তাঁর মতে, কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে এখনকার কুকুরের জিন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা নিতান্তই বোকামি, কারণ এই রহস্যে আলোকপাত করতে পারে একমাত্র প্রাচীন কুকুররা। অতএব, আধুনিক কুকুরদের ভুলে গিয়ে প্রাচীনদের হাড়গোড় নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। ঠিক তাই করেছেন ওয়েন ও তাঁর সহকর্মীরা – ইউরোপ ও এশিয়াতে পাওয়া ১৮টি ফসিল ও তার সঙ্গে বেশ কিছু আধুনিক কুকুর ও নেকড়ের mitochondrial genome বিশ্লেষণ করে তুলনা করেছেন । ১৫ই নভেম্বর ২০১৩-র Science পত্রিকার প্রচ্ছদ জুড়ে ছিল একটি Basenji hound-এর ছবি, কারণ সেই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ওয়েনদের গবেষণার ফল। প্রাচীন শ্বদন্তকদের DNA থেকে জানা গেছে যে আধুনিক কুকুর নামক প্রাণীটির উৎস মধ্য ইউরোপ। ১৮,৮০০ থেকে ৩২,০০০ বছর আগে এই অঞ্চলে বাস করা নেকড়েদের পোষ মানিয়েছিলেন আমাদের hunter gatherer পূর্বপুরুষরা। বলাই বাহুল্য, কুকুরপ্রেমী পাশ্চাত্য এতে খুশি হল; অতি প্রিয় ঘরের প্রাণীটি যে আসলে ভিনদেশী, তা ভাবতে কার আর ভাল লাগে!
এই ধরনের কাজের একটা সমস্যা হল, যে ফসিল পাওয়া গেছে শুধু সেগুলির ভিত্তিতেই গবেষণা চালাতে হয়, এবং তার ফলে অনেক সময় আসল ছবিটা প্রকাশিত হয় না। ওয়েনদের কাজের মধ্যেও রয়ে গিয়েছিল এই ধরণের ফাঁক, যা পরিষ্কার হল আরো বিশদ গবেষণায়।
২০১২-তে গ্রেগর লারসন ও একটি আন্তর্জাতিক টীম PNAS পত্রিকায় একটি কাজ প্রকাশ করলেন, যাতে নড়েচড়ে বসল বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী প্রচার মাধ্যম । ৩৫টি ব্রীডের মোট ১৩৭৫টি কুকুরের এবং ১৯টি নেকড়ের DNA থেকে লারসনরা বের করলেন ৪৯,০২৪টি SNP, বা single nucleotide polymorphism – নামটা খটমট শোনালেও, ব্যাপারটা বোঝা সহজ। মনে কর, তোমার একটি জিনের DNAতে ৪৫৫তম nucleotideটি হল A, কিন্তু সেই একই জিনের একই জায়গায় আমার রয়েছে T। এতে জিনটির কাজ দিব্যি চলে যাচ্ছে, কিন্তু আসলে এরা দুজনে একই জিনের দুটো আলাদা রূপ, বা allele। সুতরাং, একে বলা যায় একটি nucleotide-এর ভিন্ন রূপ, বা polymorphism, যার উৎস কোনো একটি mutation বা পরিব্যক্তি।
লারসনরা নিজেদের এই data-র সঙ্গে আগে প্রকাশিত জিনগত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক data যোগ করে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ১২১টি ব্রীডের। সমস্যা হল, প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন হল না – জিনের হিসেবে প্রাচীনতম ব্রীডগুলো যেসব অঞ্চলে পাওয়া যায়, প্রাচীনতম জীবাশ্মগুলি সেই সব অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। প্রাচীনতম তিনটি ব্রীড হল ডিঙ্গো, ব্যাসেনজি ও নিউ গিনি সিংগিং ডগ; এদের পাওয়া যায় এমন সব অঞ্চলে, যেখানে প্রাচীন কুকুর (Canis lupus) আগে ছিল না, এদের মানুষ নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে কুকুর পোষ্য হয়ে ওঠার অন্ততঃ ১০,০০০ বছর পরে। এই গরমিল দেখে লারসনরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে আরো আন্তঃবিষয়ক গবেষণার প্রয়োজন কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাসের সঠিক ছবিটা বোঝার জন্য।
আলতাই পর্বতমালার এক গুহা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি কুকুর বা কুকুর গোত্রীয় প্রাণীর দাঁত সমেত খুলি। ২০১১ তে প্রথম প্রকাশিত হয় এই বিষয়ে গবেষণা, এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয় খবরটি।
আধুনিক ও প্রাক্তন কুকুর ও নেকড়ের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই প্রাণীটির নিকটতম আত্মীয় এখনকার গ্রীনল্যান্ডের পোষা কুকুরেরা। প্রাচীনকালের নেকড়েদের সঙ্গে এদের মিল নেই বিশেষ। রেডিওকার্বন ডেটিং করে জানা গেল যে এই খুলির আনুমাণিক বয়স ৩৩,০০০ বছর। এই খুলির mitochondrial DNA বিশ্লেষণ করেন রাশিয়ার একদল বৈজ্ঞানিক, রবার্ট ওয়েনের সহযোগিতায়। ২০১৩তে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা জানান যে এই আলতাই পর্বতমালার কুকুরটির সঙ্গে আধুনিক কুকুর এবং প্রাগৈতিহাসিক কালের নতুন বিশ্ব (New World) থেকে পাওয়া শ্বদন্তকদের মিল রয়েছে, কিন্তু আধুনিক নেকড়েদের সঙ্গে মিল এদের অনেক কম। আনা দ্রুস্কভা ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীরা দাবি রাখেন যে পূর্ব এশিয়া অথবা মধ্য প্রাচ্যের বাইরে কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন, এবং এই বিষয়ে আরো বিশদভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। সমস্যা হল, এই ধরণের গবেষণার জন্য প্রয়োজন আরো জীবাশ্ম।
২০১৩-র নভেম্বর মাসে, Science-এ প্রকাশিত হল আর একটি বড় মাপের কাজ – ওয়েন, ওলাফ থালম্যান ও আরো ২৯জন নানা দেশীয় বিজ্ঞানীর যৌথ প্রয়াস। ইউরোপ-এশিয়া ও নতুন বিশ্বের থেকে পাওয়া মোট ১৮টি প্রাগেতিহাসিক শ্বদন্তকের জীবাশ্ম এবং অনেকগুলি আধুনিক কুকুর ও নেকড়ের মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ (mitochondrial DNA) নিয়ে এই কাজ। আমাদের mitochondriaতে যে DNA থাকে (mt DNA), তা আমরা পাই আমাদের মায়ের থেকে, বাবার জিনের সংমিশ্রন ঘটে না এর সঙ্গে। সুতরাং mtDNA বিবর্তনের ধারা বোঝার জন্য অনেক সময় খুবই কাজের। থালম্যানরা একটি বংশ পরিচয় তৈরী করলেন এই mtDNA -র সূত্র ধরে, এবং দেখা গেল যে আধুনিক সমস্ত ব্রীড, এমনকি ডিঙ্গোদের পর্যন্ত জন্ম ইউরোপেই। ১৮,৮০০ থেকে ৩২,১০০ বছরের মধ্যে ইউরোপেই বাস করত আজকের সমস্ত কুকুরের common ancestor, অর্থাৎ, ইউরোপ থেকেই বংশ বিস্তার করেছে সারমেয়কুল।
অক্টোবর ২০১৫-তে বোয়কোর নেতৃত্বে PNAS পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি কাজ – সেই পেপারে দেওয়া নামের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন দেশের আরো ২৬ জন; তাঁদের মধ্যে একজন ভারতীয় – রাজশ্রী খলাপ। পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ ধরনের বনেদি কুকুর রয়েছে, আর রয়েছে নেড়িরা – বিজ্ঞানের ভাষায় যাদের বলা হয় free-ranging বা free-roaming dogs – অর্থাত যারা পোষা নয়। সারা পৃথিবীর সব কুকুরের হিসেবে করলে দেখা যায় যে নেড়িরাই দলে ভারী, বিশ্বের প্রায় ৮০% কুকুর নেড়ি! ২০০৯-এর কাজের রেশ ধরে, এবারে পৃথিবীব্যাপী যজ্ঞে নেমেছিলেন বোয়কোরা। ১৬১ ব্রিডের মোট ৪,৬৭৬টি কুকুর আর তার সঙ্গে ৩৮টি দেশের ৫৪৯ গ্রাম থেকে ৫৪৯টি কুকুরের শরীর থেকে সংগ্রহ করা রক্তের নমুনা থেকে DNA নির্যাস তৈরী করে তিন ধরনের বিশ্লেষণ করেন তাঁরা। এই বিশ্লেষণের ফলে জানা যায় যে প্রথমত, বনেদি কুকুরদের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র রয়েছে নেড়িদের জিনে। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে, এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই; কুকুরদের যে নানান ব্রীড সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে, সেগুলি প্রায় সবই মানুষের হাতে তৈরী, artificial breeding বা নির্বাচনী প্রজননের ফল।
বোয়কোদের এই কাজ থেকে যে নতুন তথ্যটি পাওয়া গেল তা এল নেড়িদের থেকে – পূর্ব এশিয়ার নেড়িদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য যেমন বেশী, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও ভারতের নেড়িদের মধ্যেও জিনগত বৈচিত্র খুব বেশী। তিন ধরণের জেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা গেল যে নেকড়ে জাতীয় পূর্বপুরুষের থেকে কুকুরদের প্রথম পোষ মানা শুরু হয় মধ্য এশিয়াতে, এবং সেখান থেকে কুকুররা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায়, আফগানিস্তান, ভারত, মায় ভিয়েতনামে। বিভিন্ন অঞ্চলের নেড়িদের মধ্যে পাওয়া গেল স্পষ্ট জিনগত প্রভেদ। পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া), মধ্য এশিয়া (মোঙ্গলিয়া, নেপাল), ভারত, মধ্য প্রাচ্য (মিশর, লেবানন, কাতার, তুরস্ক, আফগানিস্তান) এবং সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকা – এই পাঁচটি মূল ভাগ পাওয়া গেল নেড়ি কুলে। ইউরোপ-আমেরিকার কুকুরদের থেকে এরা সকলেই অনেকটা আলাদা। গত ১৫,০০০ বছরে ইউরোপের কুকুর সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর জিনগত পরিবর্তন ঘটেছে, যে কারণে এখনকার ইউরোপীয় কুকুরদের ব্যবহার করে তাদের বিবর্তনের ইতিহাস বোঝা সম্ভব নয়। বোয়কোদের কাজ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় মধ্য এশিয়াতেই প্রথম কুকুররা পোষ মেনেছিল কিনা, তবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের কুকুরদের বিবর্তন যে এই সময় থেকে ভিন্ন পথে চলেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। এই গবেষণাপত্র থেকে আধুনিক কুকুরদের জিনগত আত্মীয়তা অনেকটা পরিষ্কার হলেও, তাদের পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের ইতিহাস ঠিক স্পষ্ট হয় না, কারণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব দেননি বোয়কোরা; উপরে দেওয়া ওই ১৫,০০০ বছর সংক্রান্ত উক্তিটি বাদে।
২০১৬-র জুন মাসে Science পত্রিকায় প্রকাশিত হল আরো একটি কাজ, আবার একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক দল, এবং আবার সেই লারসন; তবে এবার ডারহাম নয়, তাঁর ঠিকানা অক্সফোর্ড। এই দলের নেতৃত্বে লারসনের সঙ্গে রয়েছেন অক্সফোর্ড-এর লরেন্ট ফ্রানৎজ ও ডাবলিনের ড্যানিয়েল ব্র্যাডলি। আয়ারল্যান্ড-এর নিউগ্রাঞ্জ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি কুকুরের হাড় এই কাজের মূল চাবিকাঠি। ৪৮০০ বছর পুরনো এই হাড়ের থেকে DNA নিষ্কাশন করে তার সঙ্গে তুলনা করলেন ৫৯টি প্রাচীন কুকুরের mt DNA, ৬০৫টি আধুনিক কুকুর থেকে পাওয়া SNP (ওপরে দেখ) এবং ৮০টি আধুনিক কুকুরের সমগ্র জিনোম (whole genome)। এই বিশ্লেষণ থেকে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন – পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম ইউরেশিয়ার কুকুরদের মধ্যে বিভাজন ঘটেছিল আজ থেকে ৬৪০০ – ১৪,০০০ বছর আগে। অথচ, ইউরোপ এবং এশিয়াতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীন কুকুরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। সুতরাং, লারসন ও তাঁর সহকর্মীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে পৃথিবীর এই দুই ভাগে অন্তত দুবার নেকড়েদের পোষ মানিয়েছে মানুষ, মানুষের সঙ্গেই কুকুর ছড়িয়ে পড়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এবং নতুন জায়গায় পৌঁছে সেখানে বাস করা নেকড়েদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করেছে নতুন কোনো ব্রীড।
লারসনদের এই কাজে খুশি ছিলেন না অনেকেই, Nature News-এর পক্ষ থেকে এই কাজের সম্পর্কে বোয়কোকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে তিনি ঠিক সহমত নন ফ্রানৎজ – লারসনদের সঙ্গে, তবে এটি একটি “intriguing hypothesis” – আরো অনেক কাজ প্রয়োজন এই বিষয়টা ঠিক মত বোঝার জন্য। বছরখানেক বাদেই, জুলাই ২০১৭-তে আরো একটি কাজ প্রকাশিত হল Nature Communications -এ, নতুন একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় স্টোনি ব্রূকের বিজ্ঞানী কৃষ্ণা ভীরামাহর নেতৃত্বে। জার্মানি থেকে পাওয়া দুটি জীবাশ্ম, একটি ৭০০০ বছর পুরনো, অন্যটি ৪৭০০ বছর – অর্থাৎ, neolithic যুগের শুরু এবং শেষের সময়সীমা মাথায় রেখে বেছে নেওয়া এই দুটি জীবাশ্ম। এই দুই জার্মান সারমেয়র সঙ্গে নেওয়া হল আয়ারল্যান্ড থেকে পাওয়া ৫০০০ বছর আগের একটি জীবাশ্ম। ভীরামাহ ও তাঁর সহকর্মীরা mtDNA -র দিকে গেলেন না, বরং এই তিনটি প্রাচীন কুকুরের পুরো জেনোমিটাই বিশ্লেষণ করে ফেললেন। তারপর এদের তুলনা করলেন আধুনিক কুকুরদের সঙ্গে।
এঁরা জানালেন, ফ্রানৎজদের সঙ্গে এঁদের হিসেবে মোটেই মিলছে না – ইউরোপীয় কুকুরদের মধ্যে সেই Neolithic যুগের শুরু থেকে এখকার সময় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে অবিচ্ছিন্ন জিনগত ধারাবাহিকতা। অতএব, ইউরোপের আধুনিক কুকুরেরা এসেছে সেই Neolithic কুকুরদের থেকেই। neolithic-এর শেষের দিকে ইউরোপীয় কুকুরদের সঙ্গে মিশেছে পূর্বদিক থেকে আসা একটি জিন-ধারা, সুতরাং ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে Steppe থেকে যেসব মানুষ এই সময় ইউরোপে এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই এসেছিল এই কুকুরেরা। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তীয় কুকুরদের মধ্যে বিভাজনের সময়সীমা ১৭,০০০ থেকে ২৪,০০০ বছর, অর্থাৎ, মানুষ নেকড়েদের পোষ মানিয়েছে একবারই, ২০,০০০ থেকে ৪০,০০০ বছর আগে, এবং সেই পোষ মানা প্রাচীন কুকুররাই ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, মানুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে।
বলাই বাহুল্য, বৈজ্ঞানিক প্রচার মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ল এই খবরে, বিতর্ক বলে কথা! সমস্যা হল, এত করেও কুকুরের বিবর্তনের ছবিটা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠল না। এ যেন অনেকটা jigsaw puzzle -এর মত, একটা করে টুকরো পাওয়া যাচ্ছে, একটু করে বেরিয়ে আসছে ছবিটা, কিন্তু পুরোটা কিছুতেই মিলছে না, এখানে ওখানে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক দিন রাত কাজ করে চলেছেন এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে। একদল মানুষ যেমন জীবাশ্ম ও আধুনিক কুকুর ও নেকড়েদের জিনের মধ্যে মিল-অমিল খুঁজে চলেছেন, তেমন আর একদল চাইছেন বুঝতে, কি সেই জিনগত বৈশিষ্ট্য যা কুকুরের নিজস্ব, যেগুলির জন্য কুকুররা কুকুর, নেকড়ে নয়।
আধুনিক কুকুরদের সঙ্গে নেকড়েদের জিনগত প্রভেদ খুঁজে বের করলে এমন কিছু পরিব্যক্তি (mutation) পাওয়া যেতে পারে, যেগুলি কুকুরদের আলাদা করে তাদের নিকটতম আত্মীয়দের থেকে। ২০১৩-তে এইরকম একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় Nature -এ; কুকুর ও নেকড়ের whole genome sequence করে এরিক এক্সেলসন (Eric Axelsson) ও তাঁর সহকর্মীরা ৩৬টি জিন খুঁজে পেলেন, যেগুলি কুকুরের পোষ মানার প্রক্রিয়াতে সহায়ক হয়ে থাকতে পারে। এদের মধ্যে অনেকগুলি জিন মস্তিষ্কের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত। দশটি জিন এমন পাওয়া গেল যেগুলি শর্করা (carbohydrate) জাতীয় খাবার ও চর্বি হজম করার পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে তিনটি জিন তাঁরা চিহ্নিত করলেন, যেগুলি নেকড়েদের থাকে না, কিন্তু কুকুরদের থাকে, এবং যেগুলি শর্করা-সমৃদ্ধ খাবার হজম করার পদ্ধতিতে অত্যন্ত জরুরি।
এই কাজটির গুরুত্ব বুঝতে হলে একটু ভাবতে হবে, কিভাবে এই নতুন বা পরিবর্তিত জিনগুলি আদীম কুকুরদের সাহায্য করে থাকতে পারে। আদিম মানুষ যে সময় ক্রমশ চাষভিত্তিক জীবনযাত্রার দিকে এগোচ্ছে, সেই সময় তাদের এঁটোকাটার মধ্যে শর্করার ভাগ বাড়ছে, এবং হাড়গোড় বা মাংসের সঙ্গে মিশে থাকছে গম, ধান, জব জাতীয় খাবার। যে প্রাণী এই সমস্ত হজম করতে সক্ষম, সে অনেক বেশি পুষ্টি পেতে পারে মানুষের উচ্ছিষ্ট থেকে। সুতরাং, নেকড়েদের তুলনায় কুকুর এক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধে পেয়ে থাকতে পারে, এই নতুন তিনটে জিন থাকার জন্য।
২০১৮-র জুন মাসে BMC Biology জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে একটি নতুন কাজ, যেখানে একসঙ্গে কাজ করেছেন বোয়কো, ভীরামাহ ও আরো কয়েকজন। পৃথিবীর নানা জায়গার থেকে পাওয়া ৪৩টি নেড়ি কুকুর এবং ১০টি নেকড়ের জিনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এঁরা এমন ৪২৯টি জিন খুঁজে বের করেছেন, যেগুলি হয়ত বা কুকুরের পোষ মানার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই কাজের মূল উপসংহারটি বেশ আকর্ষণীয় – এক গুচ্ছ জিন, যেগুলি ভ্রূণের ক্রমবিকাশের প্রাথমিক পর্যায় কাজ করে, এবং এগুলির জন্য কুকুরসুলভ বেশ কিছু phenotype প্রকাশ পায়, যেমন ঝোলা কান, ছোট মাপের চোয়াল, নম্র স্বভাব, মাথার আকার ছোটো হওয়া, ইত্যাদি। কুকুর এবং নেকড়েদের মধ্যে এগুলি মূল প্রভেদ হিসেবে সহজেই চেনা যায়, এবং এই আকৃতি ও প্রকৃতিগত ভেদগুলিকে একসঙ্গে বলা হয় domestication syndorme। সুতরাং, এই পেপারটির মূল যুক্তি হল যে মানুষ আদিম কুকুরদের পোষ মানিয়েছিল কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়ে, এবং যেহেতু এই জিনগুলি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, একই সঙ্গে নির্বাচিত হয়েছিল কিছু আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য।
কুকুরের বিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখানেই – কুকুর নিজের ইচ্ছেতে পোষ মানা নেকড়ে, নাকি মানুষ চেষ্টা করে তাদের পোষ মানিয়েছে, যেমন পোষ মানিয়েছে আরো অনেক পশুকে, উদ্ভিদকে? একদল বিজ্ঞানী মনে করেন যে মানুষ শিকারের সুবিধের জন্য নেকড়েদের পোষ মানাতে চেষ্টা করেছে, এবং সেই থেকেই কুকুরের জন্ম। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেকড়েই একমাত্র বড়মাপের মাংসাশী প্রাণী যাকে পোষ মানানো হয়েছে। নেকড়ে থেকে কুকুরে পরিবর্তিত হওয়ার সময় হয়ত এদের মানুষের কাছে সবথেকে বড় প্রয়োজন ছিল শিকারে সহায়ক হিসেবে। সেই শিকারী কুকুর থেকেই ক্রমশ জন্ম নিয়েছে ল্যাব্রাডর থেকে শুরু করে চিওয়াওয়া, সব জাতের সারমেয়। প্রশ্ন হল, এই কয়েক হাজার বছরের বিবর্তনের গল্পে আমাদের নেড়িদের জায়গা কোথায়?
পৃথিবীর সমস্ত কুকুরের জনসংখ্যার ৭০-৮০% নেড়ি, যারা ছড়িয়ে রয়েছে মূলতঃ অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। যতই বিশ্বায়ন হোক, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূলস্রোত এখনও চালিত হয় পাশ্চাত্যের হাতে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে রাস্তায় কুকুর থাকে না, সুতরাং নেড়িদের নিয়ে কুকুর-গবেষকেরা বিশেষ মাথা ঘামাননি এতকাল। পোষা কুকুরদের দেহতত্ত্ব (physiology), শরীর-বিদ্যা (anatomy) নিয়ে গবেষণা পশু চিকিৎসায় বহু প্রচলিত, কারণ মানুষ তার পোষা প্রাণীটিকে সুস্থ রাখতে চায়। কুকুরের আচার আচরণ (behaviour), জ্ঞানীয় দক্ষতা (cognitive skills), মনস্তত্ত্ব (psychology) নিয়ে গত দু-তিন দশকে প্রভূত পরিমাণে গবেষণা করা হচ্ছে পাশ্চাত্যে। মানুষের হাবভাব ও ভাষা বুঝতে পারে কুকুর, এ কথা যে কোনো কুকুরপ্রেমী তো বলবেনই, এমনকি যাঁরা কুকুর পছন্দ করেন না, এ কথা তাঁরাও অস্বীকার করেন না। মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলা, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতার জন্যই তো কুকুর আমাদের এত প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে!
কিন্তু এই ক্ষমতা কি কুকুরের সহজাত? কুকুরের বিবর্তনের কোন পর্যায় তারা এই ক্ষমতা অর্জন করেছে? নেকড়ে থেকে কুকুরে বিবর্তনের পথে আগে কি নেকড়ে পোষ মেনে তারপর মানুষকে বুঝতে শিখেছে, নাকি মানুষকে বোঝার, মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা অর্জন করেছে বলেই তারা পোষ মেনে কুকুর হয়ে উঠেছে? এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইওরোপ ও আমেরিকায় বেশ কিছু বিজ্ঞানী নানা জাতের পোষা কুকুরের ওপরে নানান পরীক্ষা করে চলেছেন। এবং প্রশ্ন যেহেতু বিবর্তন নিয়ে, তুলনামূলক গবেষণার জন্য তাঁরা একই পরীক্ষা চালাচ্ছেন নেকড়েদের ওপর। তবে এই নেকড়েরা ঠিক বন্য নেকড়ে নয়, এদের রাখা হয় কোনো সংরক্ষিত এলাকায়, যথেষ্ট যত্নে, এবং এদের জন্ম থেকেই হাতে করে বড় করে তোলেন ট্রেনাররা। সুতরাং এই নেকড়েরা ঠিক পোষা না হলেও, যত্নে রক্ষিত বন্দী।
একদিকে প্রায় পোষা নেকড়ে, অন্যদিকে পুরোপুরি পোষা কুকুর – জন্ম থেকে এরা মানুষের হাতেই গড়ে ওঠে, মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করে, মানুষের দেওয়া খাবার খেতে শেখে, মানুষের আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং, এদের মধ্যে দিয়ে কোনোভাবেই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, যে মানুষকে বোঝার ক্ষমতা কুকুরের কতটা সহজাত, আর কতটা মানুষের সঙ্গে থাকার ফলে শেখা।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেকটাই সাহায্য করতে পারে নেড়িরা, কারণ তারা মানুষের আশেপাশে থাকে, মানুষের ওপর নির্ভর করে খাবারের জন্য, আশ্রয় খোঁজে মানুষের বসতির মধ্যে, তাদের রোজনামচায় মানুষ অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে। একদিকে মানুষ এদের শত্রূ, তাড়া করে, আহত করে, এমনকি মেরেও ফেলে; আবার অন্যদিকে মানুষই এদের বন্ধু, খেতে দেয়, আশ্রয় দেয়, আদর করে। সুতরাং মানুষের হাবভাব বুঝে চলা এদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী। ঠিক কতটা এই ক্ষমতা রয়েছে নেড়িদের? ওরা কি পারে মানুষের ভাষা বুঝতে, অথবা মানুষের শরীরের ভাষা (body language) বুঝতে? কিছু মানুষকে কুকুর পছন্দ করে কেন? কি করে একজন অচেনা মানুষের বন্ধু হয়ে যায় কোনো কুকুর? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে গবেষণা প্রয়োজন নেড়িদের ওপর, ভালো জাতের পোষা কুকুর এই ধাঁধার উত্তরে পৌঁছে দেবে না আমাদের। এই সহজ কথাটা আজ মেনে নিয়েছেন পাশ্চাত্যের অনেক বিজ্ঞানী, এবং দৃষ্টি পড়েছে গরীব দেশের নেড়িদের ওপরে। উত্তর এখনো মেলেনি বটে, তবে একটা বড় jigsaw puzzle -এর কিছু ছোট ছোট অংশ মিলেছে যেন, একটু একটু করে ফুটে উঠছে একটা ছবি।
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবা যাক, আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে, কোনো এক জঙ্গলের প্রান্তে, আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে রয়েছে একদল মানুষ, খেতে ব্যাস্ত তারা। আজ একটা বড় শিকার হয়েছে, সবার পেট ভরছে। বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে মায়েদের কোলের কাছে। খেতে খেতে কথা বলছে বড়রা, হাড়গুলো ছুঁড়ে ফেলছে আশেপাশে। আলোর বৃত্তের বাইরে কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। ঘাপটি মেরে বসে আছে কয়েকটা নেকড়ে। মানুষদের ছুঁড়ে ফেলা হাড়গুলো নিঃশব্দে তুলে নিচ্ছে তারা, গুটি গুটি এগিয়ে আসছে আর একটু কাছে। বেশি কাছে যাবে না তারা, দেখতে পেলেই তাড়া করবে দুপেয়েরা, এমনকি মেরেও ফেলতে পারে তাদের। যখন দলের সঙ্গে থাকে এই নেকড়েরা, তখন দুপেয়েদের ভয় পায় না, কিন্তু একা একা খাবারের খোঁজে বের হলে সাবধানে থাকতে হয়, আড়ালে থেকে টুক করে তুলে নিতে হয় খাবারের টুকরো, ভুলেও শিকার করার চেষ্টা করতে নেই। এদিকে দলের সঙ্গে যখন শিকার করে, বড় শিকার না পেলে প্রায় কিছুই জোটে না কপালে, পালের মধ্যেকার শ্রেণীবিভাগে তাদের জায়গা যে একদম তলার দিকে!
খিদের চোটে খাবার খুঁজতে বের হয় নেকড়ের পালের “হেরোরা” (subordinates), আর মানুষের দলের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে সহজেই পেয়ে যায় উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়, চামড়া, ইত্যাদি। এই সজলভ্য খাবারের লোভে হয়ত কোনো কোনো নেকড়ে দলছুট হয়ে বেরিয়ে পড়ে নতুন পথে, মানুষের পেছন পেছন চলে যায় এশিয়া থেকে ইওরোপ। এই চলার পথে কেউ মারা পড়ে মানুষের হাতে, কারো সঙ্গে ভাব হয়ে যায় কোনো মানুষের। গুহার ভেতরে দুপেয়েরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, বাইরে বসে থাকা নেকড়েরা অজান্তেই হয়ে ওঠে পাহারাদার। কোনো বুদ্ধিমান দুপেয়ে হয়ত টের পায় এই চারপেয়েদের সঙ্গে রাখার সুবিধে, এক আধ টুকরো খাবার ছুঁড়ে দেয় তাদের দিকে খেয়াল করে, শুরু হয় পোষ মানা। এই পোষ মানা হয়ত এক তরফা নয়, দুই পক্ষই পোষ মানিয়েছে একে অপরকে, যার ফলে কয়েক হাজার বছরে কুকুর ও মানুষের মধ্যে ঘটেছে সহ-বিবর্তন (co -evolution)।
এই অদ্ভুত পোষ মানা-মানির ফলে কুকুর ও মানুষের যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো নিদর্শন নেই। এই সম্পর্ক বুঝতে জানতে হবে নেড়িদের, বুঝতে হবে তাদের দৈনন্দিন জীবন, মানুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা, ভাব-ভালোবাসা। বিজ্ঞানের মূল ধারা পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে চললেও, এই বিষয়ে দিশারী হতে পারে ভারতের মত অনুন্নত দেশ, যেখানে নেড়িদের মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান অতি স্বাভাবিক, এবং এভাবেই চলে এসেছে সেই সরমার সময় থেকে। অতএব, বিজ্ঞানের চোখে দেখলে, ভারতীয় উপমহাদেশের সারমেয়কূল অতি প্রাচীনকাল থেকে হয়ত একটি continuous population, অর্থাৎ বহু প্রজন্ম ধরে এরা একইভাবে বাস করে চলেছে। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে মানুষের পারিপার্শিক, জীবনযাত্রা, বদলেছে জীবনদর্শন, আচার ব্যবহার, এবং এই সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে এই নেড়িরা।
পোষা কুকুরের বিবর্তনের পিছনে মানুষের হাত কতটা?
এখনকার দিনে বাজারে hybrid শব্দটা খুবই প্রচলিত, এবং অপ্রিয়। অথচ মানুষ কয়েক হাজার বছর ধরে হাইব্রিড বা দো-আঁশলা পশু ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করে এসেছে, কখনো প্রয়োজনে, কখনো দৈবাৎ, আবার কখনো খেলাচ্ছলে। আমাদের বেশীর ভাগ খাদ্যশস্য, সবজি, ফল, এমনকি শৌখিন সব ফুল আসলে হয় হাইব্রিড, আর নাহলে নির্বাচনী প্রজননের ফল। দুটি আলাদা প্রজাতির প্রাণীর মিলন ঘটিয়ে যে প্রাণী তৈরী করা হয়, তাকে বলা হয় বর্ণশঙ্কর বা হাইব্রিড। মানুষের হাতে তৈরী এমনই এক প্রাণী হল খচ্চর, যার মা ঘোড়া আর বাবা গাধা। সমস্যা হল, প্রকৃতিকে নিয়ে মানুষ খেললেও প্রকৃতি শেষে টেক্কা দিয়ে দেয় নানাভাবে। বর্ণশঙ্কর প্রাণীরা সাধারনতঃ প্রজনন অক্ষম হয়, সুতরাং মানুষ ঘোড়া আর গাধাকে মিলিয়ে খচ্চর তৈরী করলেও, সেই খচ্চর সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনে ব্যবহৃত হয় একই প্রজাতির প্রাণী, যাদের কিছু বৈশিষ্ট আলাদা; এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য একটাই, নানা বৈশিষ্ট মিলিয়ে আমরা ঠিক যেমন চাই, তেমন একটি জীব তৈরী করা। এই পদ্ধতিতে তৈরী প্রাণীরা অনেক সময় উদ্ভট হতে পারে, কিন্তু সাধারনতঃ প্রজননক্ষম হয়। জার্সি গরু, আরবি ঘোড়া, নানান ব্রীডের কুকুরের এভাবেই জন্ম হয়েছে মানুষের হাতে । প্রকৃতি সাধারণত বৈচিত্রময়, আর আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনের উদ্দেশ্য সেই বৈচিত্র কমান। সুতরাং কয়েক হাজার বছরের আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনের ফল যেসব কুকুরের ব্রীড, তাদের জিনগত বৈচিত্র কম না হলেই আশ্চর্য্য হতে হত।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..