ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
আজ অমাবস্যা। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার।গ্রামের নাম পেরুয়া।এই গাঁয়ের মানুষ পেশা হিসেবে ‘চুরি’ লেখার পর থেকে ‘চোরের গাঁও’ নামে পরিচিতি পায়।চোরেরা অন্ধকার রাত বেছে নেয় চুরির জন্য।আর আজ কুসুম বিবি তার চাদরের নীচে দা নিয়ে বের হয়েছে।এই দা দিয়ে কামলারা বনবাদাড় সাফ করে।হাতল আছে।সামনের দিকটা রামদার মতো তবে চ্যাপ্টায় রামদার চেয়ে বেশী।আকাশে ওঠা তৃতীয়ার চাঁদ যেন।কুসুমের তলপেটের ব্যথা তাকে ঘুমাতে দেয় না।ব্যথা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।তার স্তনের চারপাশ ফুলে পেকে ঘা।ইনফেকশন।যখনই অমাবস্যা বা পূর্ণিমা আসে তখন ওর কষ্ট বাড়ে।গত আটচল্লিশ বছর ধরে শান দেয় এই দা।। শান দিয়ে দিয়ে একদম ধারালো ইস্পাতের মতো হয়ে উঠেছে।
মচমচ শব্দ হয় শুকনো পাতার উপর। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে ওঠে কুসুম।দুএকটা জোনাকী দেখা যায় ঝোঁপের পাশে।ওখানে বসে থাকে চাদর মুড়ি দিয়ে।
গান গেয়ে কে আসে? কান খাড়া করে শোনে।
‘নিশা লাগিলো রে
বাঁকা দুই নয়নে নেশা
লাগিলো রে।
হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে
মজিলো রে” সুর জড়িয়ে যাচ্ছে। বেসুরো সুরে ‘হাছন রাজা……পিয়ারীর প্রেমে ….. ‘
উচ্চারন জড়িয়ে জড়িয়ে যায়। তার মানে যে আসছে সে মাতাল।শিরদাড়া টানটান হয়ে যায় কুসুমের।হিম শীতল স্রোত নেমে যায় শিরদাড়া বেয়ে। বাম স্তনের ঘা টনটন করে ওঠে। নাভীর নীচে মনে হয় সাপ কামড় দিয়েছে।তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে ওঠে। সে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে মগজের কোষে কোষে। পনেরো ষোল বছরের শরীরের উপর কী নির্মম অত্যাচার সে রাতে শুরু হয়েছিলো।
পাতার ওপর মচমচ শব্দে আগুন্তক জানান দিচ্ছে যে সে আসছে।সে নিকটবর্তী।পাতার মচমচ শব্দ নিকটতর হয়।গান গেয়ে গেয়ে আসায় অন্ধকারেও চিনে নিতে পারে সহজেই। আর দুই পা সামনে আগাতেই পাশ থেকে কোপ বসায় কুসুম। কুসুম বিড়ালের মতো অন্ধকারেও শিকার চিনতে ভুল হয়নি। আটচল্লিশ বছর ধরে নেয়া প্রস্তুতি আজ সে শেষ করে।এত ধারালো তীক্ষ্ন সে দা মনে হলো দুই ভাগ হয়ে গেছে মাথা আর শরীর। গরম তরল ছিটকে এসে পড়লো ওর গায়ে।থুতু ফেললো কুসুম বিবি।
—ওয়াক থু ।ওয়াক থুহ।
গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার ।দা টা নিয়ে একদৌড়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে কুসুম।পুকুরে দা ফেলে দেয়। তারপর ডুব দিয়ে গা ধুয়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকার আগে দেখলো গ্রাম বাসীরা ছুটে আসছে।অনেকগুলো আলোর বিন্দু দুলছে। আলোর বিন্দু উঠছে নামছে।আলো একসাথে এগিয়ে আসছে। সাথে অনেক চিৎকার চেচামেচি। হাঁক ডাক।চিৎকারের উৎসের দিকে চোখ রেখে কুসুম বিবির খুব ঘুম পায়। কুসুম বিবি কাঁথা গায়ে ঘরে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।মাথার ভেতরের জ্বালাটা আর নাই। শরীরের জ্বালাও এখন একটু কম।
সদ্যবিবাহিতা কুসুমের শরীর কেবল ডানা মেলছে তখন।
স্বামী শয্যায় নির্যাতিত হতে এতো সুখ। সে সুখ আস্বাদন করে স্বামীর বুকে মুখ ডুবিয়ে ঘুমাতো কুসুম বিবি। এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গ্রামে আর্মি এসে পড়ে।কুসুম ও তার স্বামী গহর আলী ঐ দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক জনকে আশ্রয় দিয়েছিলো তাদের ঘরে।সিঁথির সিঁদুর মুছে চাদর পেঁচিয়ে বউ ঝি দের হাতের শাঁখা খুলে লুকিয়ে রাখে তাদের গোলাঘরের ধানের ডুলির ভেতর।আর এই অভিযোগে তাদের বাড়িতে ঢুকে তার স্বামীকে রাইফেলের বাট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে রাজাকাররা। তাকে ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে ।এনে প্রথমে রাজাকার এর সর্দার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ধর্ষণ করে।পরে সাঙ্গ পাঙ্গরাও বাদ যায় না।তারপর পালাতে চাইলেও পালাতে পারেনি।। পাক বাহীনি আর রাজাকারর সদস্যরা তার শরীর নিয়ে উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠতো। কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।আত্মহত্যা যেন করতে না পারে তার জন্য উলঙ্গ করে একটি ঘরে আটকে রাখে। চুল কেটে দেয় ।
ইজ্জত লুণ্ঠন করেই ক্ষান্ত হয়নি।সিগারেটের আগুনে উরু,নিতম্ব,গাল, বুক,হাটুতে ছ্যাকা দিতো রাজাকাররা। স্তন কামড়ে খামচে ধরতো রাক্ষসরা।পুড়িয়ে দেয়া ক্ষত আর যোনীদ্বার আর পেলভিকের নানা রোগে সারা জীবনভর ভোগান্তি ছাড়া কিছু নাই। কুসুমের সাথে নির্যাতিত হয়েছিলো আরোও নারীরা।। এই নারীরা তাদের স্বামী, সন্তান, বাবা, ভাইসহ স্বজন হারিয়েছিলেন এই রাজাকারদের হাতে।
কুসুম বিবি । এখন বয়স তার ষাটের বেশী।তবে তাকে সবাই ‘পাগল’ আখ্যায়িত করে এলাকায়। অনেকে মনে করে সে পাগলী। সারাদিন আঙুলে কারো নাম জপ করে।একা একা বির বির করে কথা বলে।কিন্তু শরীরের ব্যথায় মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদে।
-‘আর সহ্য হয় না গো আর সহ্য হয় না।আল্লা আমারে তুইল্যা নেও রে আল্লা।’
পূর্নিমা আর অমাবস্যা আসলেই শরীর বিদ্রোহ করে বসে।পাক বাহীনি যেদিন এই গ্রামে হানা দেয় তার এক মাস আগেই তার বিয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা। বাবা ছিলেন জোতদার। ধান তালের বড় আড়ত ছিলো।সুখের সংসার। গোলা ভরা ধান। পুকুরভরা মাছ। কোন অভাব নাই।বিয়ের পর চলে যায় পাশের গ্রাম পেরুয়ায়।কুসুমের স্বামী গহর আলী। মস্ত জোয়ান। বাপের জোতদারী দেখাশোনা করে।বাজারে দোকান আছে।হাসিখুসী মানুষ। পান খায় খুব।আর গানের পালা বসে যখন রাত বাড়লেও ঘরে ফিরতে চায় না।মাঝ রাতে ঘরে ফিরে কুসুমের মুখে পুরে দেয় মিষ্টিপান।
-একলা গরো আমার ডর করে ।কুসুম অভিমান করে।
-আব্বা আম্মা হক্কল গরো।ডর কিওর বউ ? কতো মানুষ।ডরাও কিতা?
-যে আন্ধাইর।ভূত পেরত আছে নাইনি।
-না না। ইনো ইতা নাই।আও আর ডরাইও না।কুসুমের সুবাসিত চুলে মুখ ডুবিয়ে দুইবাহুতে জড়িয়ে রাখে কুসুমকে।
……..‘ভালা করি গর বানাইয়া
কয় দিন থাকমু আর?’
আসরে শুনে আসা গান গাইতে গাইতে ঘুমায় ।
জাহানপুর গ্রামটি পুরনো সুরমা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত। উত্তর-পশ্চিমে হাওর। পূর্বে অনন্তপুর গ্রাম। একটি সরু খাল গ্রামটিকে পশ্চিম-পূর্বে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমে হিন্দু আর পূর্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস।সরেজমিন দেখা গেছে, পশ্চিম অংশে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকলেও পূর্ব অংশের মানুষের সেই ব্যবস্থা নেই। গ্রামের সবাই ছোট্ট খুপড়ি ঘরে বাস করে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে নানা সমস্যায় ভোগে তারা।দিরাই-শাল্লার মিলনস্থল শ্যামারচর এলাকায় যুদ্ধকালীন সময়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য। হাওরাঞ্চলের এই শীর্ষ দালাল ও তার প্রশিক্ষিত শতাধিক রাজাকার বাহিনীর হাতে ওই এলাকার আরো নারী লাঞ্ছিত হন।এদের হাতে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো কুসুম বিবিসহ আরো জনা কয়েক নারী।ডিসেম্বরের এক বিকেলে শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের পরাজিত এই প্রার্থীর নেতৃত্বে শাল্লা উপজেলার উজানগাঁও, দাউদপুর, দিরাই উপজেলার পেরুয়া, এলংজুড়ি, শামারচর গ্রামের সংখ্যালঘু ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থানকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারী-পুরুষকে ধরে এনে শামারচর ব্রজেন্দ্রগঞ্জ আর সি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো করে ।সবার সামনে সুরমা নদীর পাড়ে সাতাশ জন পুরুষ লোককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হাত পিছন দিয়ে বেঁধে, পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।এখানেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে চালায় তান্ডব আর পাশবিক নির্যাতন।দিরাই থানায় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প।এর সংলগ্ন হাসপাতালে ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। এখান থেকেই রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরিবারের উপর অত্যাচার চালাতো।তখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে পালাতে শুরু করেছে এবং দেশ প্রায় স্বাধীন হওয়ার পথে। এ খবর এখানকার দালাল রাজাকারের কাছেও ছিল।তাদের পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরেই দালালরা মরণ কামড়ের নেশায় মত্ত হয়ে উঠে। তারা ধ্বংসযজ্ঞের জন্য শ্যামারচরকেই বেছে নেয়।দালাল বাহিনী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম পেরুয়ায় আক্রমণ করে।নারীদের ধরে এনে বাঙ্কারে নির্যাতন করে। লুট করে সম্পত্তি। জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি।।পরাজিত রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে রাজাকারের দৌলতপুরের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।শ্যামারচর বাজারে সংগঠিত হতে থাকে।এই খবর পেয়ে অসংগঠিত দুটি মুক্তিযোদ্ধার দল ৬ ডিসেম্বর শনিবার ভোররাতে সুরমা নদীর পশ্চিম তীর দিয়ে পেরুয়া গ্রাম থেকে রাজাকারদের উপর হঠাৎ আক্রমণ চালায়।তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল যোগ দেয়ার কথা থাকলেও তারা যোগ দিতে পারেননি। অন্যদিকে রাজাকারদের একটি দল গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে, আরেকটি কার্তিকপুর থেকে এবং আরেকটি শ্যমারচর বাজার থেকে সরাসরি একযোগে তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। তিনদিক থেকে আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।১৯৭১ সালে নিরীহ মানুষ জনকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, বিভিন্ন জনকে অপহরণ ও নানাভাবে বিভিন্ন জনকে নির্যাতন করেছে এই রাজাকার সর্দার ও তার দোসরারা।বুকের ভেতর অনেকেরই ধিকিধিকি করে জ্বলছে তুষের আগুন।
ভোরের আলো ফুটেছে। গ্রামবাসীরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে। গ্রামে পুলিশ আসলো। ডেডবডির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলো। বাঁশের মাথায় পতাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নদীর দিকে হেঁটে যায় এক নারী। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন
-ইনি কে?
– কুসুম পাগলী।
অফিসার দেখলেন এলোমেলো পায়ে সে নারী কী যেন বির বির করে বলতে বলতে নদীর ধারের বাজারের দিকে চলে গেলেন।তার হাতে বাংলাদেশের পতাকা।
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..