কেউ কেউ মানুষ

সুদীপ ঘোষাল
গল্প
Bengali
কেউ কেউ মানুষ

রবি স্কুলে এসে প্রথমে সই করতে যায় হেডমাস্টারমশাই এর ঘরে।হেডমাস্টারমশাই বললেন,রবি আমি আজ একটু কাজে বেড়িয়ে যাচ্ছি। ক্লাসগুলো একটু দেখে নিও।
রবি বলল,আপনি কোন চিন্তা করবেন না।আমি সবকিছু দেখে নেব।
ছাত্র ছাত্রীরাও এই স্যারকে খুব ভালোবাসে।রবি মাস্টারমশাই পড়াতে এলে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রী অন্তপ্রাণ, ছাত্র-ছাত্রীরাও তাকে খুব ভালবাসে। আগের স্কুলে পাঁচজন বন্ধু ছিল। সেই পাঁচ জন বন্ধুকে নিয়ে এসে সাইকেলে স্কুল যেত এবং টিফিনে দোকানে এসে খাওয়া-দাওয়া করত। প্রায় কুড়ি বছর হল সে চাকরি করছে সকলের মন জয় করে। কিছু কাজ না করে বসে থাকতে পারে না। দেখে বাকিরাও কাজ করতে চায়। আজ তাকে দেখে অনেকেই প্রভাবিত। মাস্টারমশাই চাকরিটা করে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে করে এবং কোন কাজেই না বলে না একটার পর একটা ক্লাস নিয়েই চলে তার এই এখএবার অ্যানুয়াল পরীক্ষা এসেছে এনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে থেকেই সে টেবিল-চেয়ার সাজানো শুরু করে। সেই শিক্ষক মহাশয় কে সবসময় ক্লাসে যেতে হয় তারা বিশ্রামের সময় বলতে নেই। সময় তারা খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন এবং তারপর ক্লাসে চলে যান খুব খুশি ছেলের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণি কর্মীদের নিয়ে যখন সবাই নিজেদের প্রশ্ন করতে ব্যস্ত তখন সে নিজে চেয়ার-টেবিল সব দেখে নিয়ে সেখানে নাম্বার বসিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিজের প্রশ্ন তৈরি কাজ করত তারপর প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেলে ছাপানোর কাজ শেখানো সিদ্ধহস্ত ছাপানো হয়ে গেলে পরীক্ষা শুরু হতো পরীক্ষার গার্ড দেওয়া তারপর তার ডিস্ট্রিবিউশন করা সমস্ত কাজ করতো একা নাম শুনলে সকলের মাথার শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়। ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে সে কোনদিন অনীহা প্রকাশ করেনা এইভাবে এসে সকলের মন জয় করেছে আজও পরীক্ষা ন এই গ্রামে সে সেমন দিয়েই হাই স্কুলের গ্রামের একটি হাই স্কুল এখানে রবি চাকরি পেয়েছে তার আগে চাকরি করত।
পড়ার সময় নেই সব ক্লাসি নিতে হয় এখন আর ক্লাসে ছয়জন সকলকে টুটে ছটা ইউনিট তাকে বাদ দিলে ছয়জন আর এদিকে টিচার মধ্যে হেডমাস্টারের আছেন বৃন্দ তা সাহায্য 10 জনের মধ্যে 3 জন শিক্ষক-কর্মচারী 10 জন দেখল স্টপ সংখ্যা এখন আম এখন স্টপ সং ট্রানস্ফার উনিয়ন বলে 2005 সাল থেকে যারা অরগানাইজার টিচার ছিল তারা সকলেই আজ রিটায়েড হয়ে গেছেন তাদের আমলে বেশ একটা বয়স্কদের প্রভাব বেশি ছিল কিন্তু এখন এসেছে নতুন এসেছে সুবীর সুবীর ঘোষ সে সেই সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো তার কৃতিত্বে সুন্দরভাবে স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হলো চারিদিকে লোকজন ভিড় করলেন সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান দেখার জন্য সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ সকলের মনকে ছিল তারপর প্রফেসরি চলে গেল বেনারস তারপর তার জায়গায় এখনও ফাঁকা পড়ে আছে আস্তে আস্তে ট্রানস্ফার নীতি চালু শিক্ষক-কর্মচারী বাদ দিলে মোট ছয় জন শিক্ষক মহাশয় আছেন হওয়ার ফলে অনেক দিদিমণি মাস্টারমশাই অন্য স্কুলে চলে গেলেন এই স্কুলে স্টাফ সংখ্যা কমে গেল রঞ্জু দেখলো অশিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে এখন মোট 10 জন স্টাফ।

গ্রামগুলি মন্দিরময়।আমি দূর দূরান্তে না গিয়ে কাছাকাছি না দেখা গ্রাম দেখতে ভালোবাসি।এবার গেলাম বেলুন ইকো ভিলেজ পরিদর্শনে।হাওড়া আজিমগঞ্জ লোকাল ধরে শিবলুন হল্টে নামলাম। সেখান থেকে অম্বলগ্রাম পাশে রেখে দু কিলোমিটার টোটো রিক্সায় বেলুন গ্রাম। একদম অজ পাড়াগাঁ। মাটির রাস্তা ধরে বাবলার বন পেরিয়ে তন্ময়বাবুর স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করলাম।তন্ময়বাবু ঘুরিয়ে দেখালেন। তার জগৎ।প্রায় একশো প্রজাতির গাছ।পশু,প্রাণীদের উন্মুক্ত অঞ্চল।বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে, সেখানে।তার নিজের হাতে বানানো মা কালীর মূর্তি দেখলাম। কাঁচের ঘরে ইকো সিষ্টেমের জগৎ।কেউটে সাপ, ব্যাঙ থেকে শুরু করে নানারকমের পতঙ্গ যা একটা গ্রামের জমিতে থাকে। বিরাট এক ক্যামেরায় ছবি তুলছেন তন্ময় হয়ে।আমি ঘুরে দেখলাম প্রায় দু কোটি টাকা খরচ করে বানানো রিসর্ট।ওপেন টয়লেট কাম বাথরুম।পাশেই ঈশানী নদী।এই নদীপথে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ অট্টহাসে যাওয়া যায় নৌকায়। তন্ময়বাবু হাতে সাপ ধরে দেখালেন। শিয়াল,বেজি,সাপ,ভ্যাম আছে। তাছাড়া পাখির প্রজাতি শ খানেক।একটা পুকুর আছে। তার তলায় তৈরি হচ্ছে গ্রন্হাগার।শীতকালে বহু বিদেশী পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। তন্ময়বাবু বললেন,স্নেক বাইটের কথা ভেবে সমস্ত ব্যবস্থা এখানে করা আছে। ঔষধপত্র সবসময় মজুত থাকে।
তারপর বেলুন গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। এখানকার চাষিরা সার,কীটনাশক ব্যবহার করেন না। তারপর বিকেলে নৌকাপথে চলে গেলাম অট্টহাস সতীপীঠ।এখানে মা মহামায়ার ওষ্ঠ পতিত হয়েছিলো। সোন মহারাজ এই সতীপীঠের প্রধান। তারপর দেখলাম পঞ্চমুন্ডির আসন।ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মন্দিরে মা কালীর মূর্তি। রাতে ওখানেই থাকলাম।

তার পরের দিন সকালে হাঁটাপথে চলে এলাম কেতুগ্রাম বাহুলক্ষীতলা। কথিত আছে এখানে মায়ের বাহু পতিত হয়েছিলো। এটিও একান্ন সতীপীঠের এক পীঠ।তীর্থস্থান। সুন্দর মানুষের সুন্দর ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়।এর পাশেই আছে মরাঘাট। সেখান থেকে বাসে চেপে চলে এলাম উদ্ধারণপুর।এখানে লেখক অবধূতের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।গঙ্গার ঘাটে তৈরি হয়েছে গেট,বাথরুম সমস্তকিছু।শ্মশানে পুড়ছে মৃতদেহ।উদ্ধারণপুর থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে চলে এলাম কাটোয়া। এখানে শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পরে মাথা মুন্ডন করেছিলেন। মাধাইতলা গেলাম। বহুবছর ব্যাপি এখানে দিনরাত হরিনাম সংকীর্তন হয় বিরামহীনভাবে। বহু মন্দির,মসজিদ বেষ্টিত কাটোয়া শহর ভালো লাগলো।

বড় পুরুলিয়া বাস স্টপেজে নেমে ঢালাই রাস্তা ধরে নবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিস পেরিয়ে, সর্দার পাড়া পেরিয়ে চলে এলাম ভট্টাচার্য পাড়ায়।পুরোনো মন্দির আর মসজিদ,গির্জা আমার মন টানে। কালের প্রবাহে সেগুলো অক্ষত না থাকলেও পুরোনো শ্যাওলা ধরা কোনো নির্মাণ দেখলেই আমি তার প্রেমে পড়ে যাই।অমরবাবু ছিলেন ষষ্টি তলায়। তিনি মা মঙ্গল চন্ডীর মন্দিরে নিয়ে গেলেন আমাকে।

ভট্টাচার্য পাড়ার রঘুনাথ ব্যানার্জী বললেন,মা মঙ্গল চন্ডীর মন্দির অতি প্রাচীন।মায়ের পুজোর পালা পাড়ার সকলের একমাস করে পড়ে।মা দুর্গার পুজোর পালা তিন বছর পর এক একটি পরিবারের দায়ীত্বে আসে।সকলে মিলে পাড়ার পুজো চালায় বছরের পর বছর।হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বাজারে পাড়ায়।এখানে,ঘোষ,পাল,মুখার্জী পরিবারের বাস। মুখার্জী পাড়ার ধ্রুবনারায়ণ বললেন,আগে মুখুজ্জে পুকুরের পাড়ে শিবপুজো হতো।মন্দির প্রায় দুশো বছরেরে পুরোনো হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছিলো।কৃষিকাজের সময় জল না হলে আমাদের বাবা, কাকারা শিবলিঙ্গ বাঁধ দিয়ে জলে ডুবিয়ে দিতেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ হতো ও বৃষ্টি হতো।মানুষের বিশ্বাসে সবকিছু।

তারপর গোস্বামী পাড়ায় গেলাম। সেখানে বদরী নারায়ণ গোস্বামীর সঙ্গে দেখা হলো।তিনি বললেন,আমরা নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বংশধর। মেয়ের বংশধর,দৌহিত্র বুঝলেন।আমার কাছে বংশলতিকা আছে। আমি বললাম,বলুন, আমি শুনি।তিনি শুরু করলেন,গঙ্গামাতা, তার স্বামী ছিলেন মাধব চট্টোপাধ্যায়, তার ভিটে এটা।তারপর প্রেমানন্দ,অনন্তহরি,পীতাম্বর,গৌরচন্দ্র,লালমোহন,শ্যামসুন্দর,নিকুঞ্জবিহারী,রামরঞ্জন, বংশগোপাল, বদরীনারায়ণ,বিনোদগোপাল।তারপর তিনি মন্দিরের গাত্রে লেখা বংশলতিকা দেখালেন।আমি ছবি তুলে নিলাম।পড়া যাবে নিশ্চয়।
রাধা মাধবের মন্দিরে বারোমাস কানাই, বলাই থাকেন।অগ্রহায়ণ মাসে এই মন্দিরে রাধামাধব আসেন।তখন সারা গ্রামের লোক প্রসাদ পান।
স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু ।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে । কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে । রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর । ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা । এখানেই অনেকের চোদ্দপুরুষের ভিটে । তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির । এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা । গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা । এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম । সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না ।কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড় । তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া । এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে । সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা । কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা ।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক । মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই । বেশ জেঠু জেঠু ভাব ।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি । আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া । সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই ।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।
এই গ্রামে ই আমার সবকিছু ,ভালোবাসা, আমার গান ।

সেনপাড়ার পাশের গ্রাম ভুলকুড়ি। ভুলকুড়ি গ্রামে তৈরি হচ্ছে একটি বিশাল কালিমন্দির।এখানে কালিপুজোর সময় বিরাট মেলা হয়।মানুষের মিলন মেলায় মুখরিত হয় আশেপাশের গ্রামগুলি।

মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড় । বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয় । কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ,অধীরের আলকাপ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণ, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, কবিগান, কীর্তন,যাত্রাপালা মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। এখনও নাগরদোলা সব বয়সীদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। মেলায় আবার বিভিন্ন নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’।

উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।এখানে মানুষজন মেলার সময় খুব আনন্দ করেন।ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন আসেন।বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন মেলায় ঘোরেন।অতিথিদের আনন্দে আমাদের আনন্দ। যুবকবৃন্দ শান্তিশৃঙ্খলার দিকটা বজায় রাখেন।তাদের অবদানে গড়ে ওঠে শান্তির পরিবেশ। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন।মন্দিরটি নির্মাণে অধিবাসীদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

পূর্ব বর্ধমান জেলার বড়পুরুলিয়া গ্রামের ব্রাহ্মণ পাড়ায় মা রক্ষাকালীর ভোগমন্দির আছে। সেখানেই মায়ের কাঠামো থাকে বারোমাস।

চৈত্র মাসে গাজন উৎসবের পূর্বে আমাদের গ্রামে রক্ষাকালী পুজো হয় মহাসমারোহে। গ্রামের সকলে একত্রে পুজোর আয়োজন করেন।ভোগ রান্না করেন পাড়ার যুবকবৃন্দ।বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা গ্রামের লোকজন এসে হাজির হন রক্ষাকালী তলায়।সারে সারে প্রদীপ প্রজ্বলিত হয় সারামাস ধরে।তারপর পুজো শুরু হয় রাতে।পুজোর পরে পংক্তিভোজন হয় রাস্তাজুড়ে। মায়ের প্রসাদে তৃপ্ত হন গ্রামবাসী।
পুরাণ অনুসারে, তাঁর প্রথম আবির্ভাব হয় ভগবান শিব হতে। তিনি ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জননী। নির্দোষকে রক্ষা করার জন্য তিনি মন্দকে ধ্বংস করেন। সময়ের সাথে সাথে, কালীকে ভক্তিমূলক আন্দোলন ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের দ্বারা বিভিন্নভাবে দেবী মা, মহাবিশ্বের মা, আদিশক্তি বা পার্বতী হিসাবে পূজা করা হয়। তাকে ঐশ্বরিক রক্ষক হিসেবেও দেখা হয়। মা রক্ষাকালী জন্ম মৃত্যুর একঘেয়ে পদ্ধতি থেকে মুক্তি প্রদান করেন।

শাস্ত্রে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা।

অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী।

জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল,ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালী, ধনদকালী, রমণীকালী, ঈশানকালী, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী।

মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কালকালী কঙ্কালকালী, চিকাকালী এমন সব রূপের রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।

এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, আনন্দময়ী, ভবতারিণী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করতে দেখা যায়।রক্ষাকালী দক্ষিনাকালীর একটি নাগরিক রুপ।প্রাচীন কালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পুজা করা হতো।

আমাদের রক্ষাকালী পুজোয় কোনপ্রকার পশু বলিদান দেবার প্রথা নেই। সারাদিন ভক্তবৃন্দ উপোসী থেকে পুজোর পরে প্রসাদ গ্রহণ করেন ভক্তিভরে।

আসুন সকলে বলি, জয় মা রক্ষাকালীমাতার জয়।

সেনপাড়ার মাষ্টারমশাই বলেন,আমাদের গ্রামের মন্ডপতলায় শিবমন্দির আছে।এখন গ্রামবাসীরা মন্দিরটি নবরূপে বিশাল আকারে তৈরি করেছেন।এখানকার গাজন উৎসব বিখ্যাত। মূলত শিবের ভক্তরা সন্ন্যাসীর বেশে গাজনের কয়েকদিন সংযম পালন করে পুজো করেন।শিবলিঙ্গ পূজার তাৎপর্য বিশেষরূপে বোঝা যায় কঠোর উপবাসের কয়েকদিনে।খেজুরভাঙা,জলসন্ন্যাস ও নীলপূজার মাধ্যমে ভক্তরা শিবের ভজনা করেন।পরেরদিন হয় চড়ক। শিব পূজা দু’রকম ভাবেই হয়। মূর্তি এবং লিঙ্গ। লিঙ্গ শব্দে অনেক গুলো অর্থ আছে। লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন বা প্রতীক। সাকার রূপে এরূপ লিঙ্গ শরীর বা চিহ্ন আমরা সর্বত্রই ব্যবহার করি। প্রতিটি দেশের পরিচয় বহন করে সেই দেশের পতাকা। বিষ্ণুমন্ত্রের যারা অনুসারী তাদের পরিচয় তারা দেন দেহতে তিলক ফোঁটা ও রসকলি অঙ্কিত করে। ঘটে আমরা দেবদেবীর পুতুল এঁকে দেবতার চিহ্ন বা প্রতীকরূপে পুজো করি। এরূপ দুটি প্রতীক বা লিঙ্গ বা চিহ্ন আমরা পূজায় ব্যবহার করি। একটি শিব লিঙ্গ আরেকটি নারায়ণ শিলা। শিব লিঙ্গের গঠন প্রণালী সহজ হওয়ায় মূর্তি তৈরী থেকে লিঙ্গ পূজায় আমরা আগ্রহী বেশি। মাটি দিয়ে অতি সহজে অল্প সময়ে এ প্রতীক তৈরী করা যায় এবং পূজান্তে বিসর্জনও দেয়া যায়। কিন্তু প্রতীকটির নাম লিঙ্গ দেয়াতে আমাদের মধ্যে এ নিয়ে নীল সাহিত্য গড়ে উঠেছে যা সত্যিই দু:খজনক। অথচ একই প্রতীক ব্যবহৃত হচ্ছে নারায়ণ পূজায়, তাকে নিয়ে এরূপ আচারণ আমরা করি না। বিশেষ করে শিব-এর সঙ্গে সৃষ্টির কার্যক্রম যুক্ত থাকাতে আমরা লিঙ্গ শব্দটিকে একেবারে পার্থিব কাজের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছি। এ বিভ্রান্তি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের শিবত্বে উন্নীত হতে হবে।

আমাদের গ্রামের গাজনে ভক্তরা শিবঠাকুরকে ডাকেন,বলো শিবো মহাদেব ডাকে।ভক্তরা সমস্বরে যখন, বলো শিবো মহাদেব বলে হাঁক দেন তখন মানুষের চিত্তে ভক্তিসঞ্চার হয়, লোমকূপের শিহরণ দূর করে দেয় মনের কূপমন্ডুক ভাব।
আসুন সমস্বরে বলি,বলো শিব মহাদেব।

বড়পুরুলিয়া গ্রামে পুজোবাড়ি বিখ্যাত মন্দির।পূর্বে দুর্গাপূজা হত।এখন রাজরাজেশ্বর আছেন।তাঁর পুজো হয় নিয়মিত।দোলযাত্রার সময় নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দোল উৎসব পালন করা হয়।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন আবির বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্যদেবের জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। পুজোবাড়িতে বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি আছে।গ্রামের লোকেরা সকলে একসাথে আনন্দভোজন করেন মুখার্জি পরিবারের নিমন্ত্রণে। দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকা দহন বা ন্যাড়াপোড়া নামে পরিচিত।

আমাদের গ্রামে ন্যাড়াপোড়া চাঁচড় উৎসব নামে পরিচিত।

২৫ শে বৈশাখে মাষ্টারমশাই বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান। তাঁর মা সারদা দেবী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দার্শনিক ও কবি, মেজ ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আইসিএস; অন্য ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ও নাট্যকার এবং বোনদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ ছিল সঙ্গীত, সাহিত্য ও নাট্যাভিনয়ে মুখর। শুধু তাই নয়, বাইরের জগতের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। সেই বৃহৎ পরিবারে বালকেরা ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে বাহুল্যবর্জিতভাবে প্রতিপালিত হতো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যকালের অপূর্ব স্মৃতি-আলেখ্য রচনা করেছেন জীবনস্মৃতি গ্রন্থে। কলকাতার সেই প্রাসাদোপম বাড়িতে ছিল পুকুর, বাগান এবং আরও অনেক রহস্যঘেরা জায়গা। ভৃত্যদের শাসন এড়িয়ে বালক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষে দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তার শিশুচিত্ত বাইরের বিপুল পৃথিবীর বিচিত্র কল্পনায় বিহবল হয়ে উঠত। পরবর্তী জীবনের কবিতায়, গানে এবং দেশবিদেশ পর্যটনে শৈশবের এই আকাঙ্ক্ষাই যেন নানাভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। পরে বেশ কয়েক বছর তিনি পড়েন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত নর্মাল স্কুলে। সেখানেই তাঁর বাংলা শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয়। সবশেষে তাঁকে ভর্তি করা হয় সেন্ট জেভিয়ার্সে। কিন্তু অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য তাঁর স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাড়িতে বসে পড়াশোনা চলতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৮৭৩ সালে পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ। পথে মহর্ষি প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে কিছুদিন তাঁরা অতিবাহিত করেন। সেই প্রথম কবি নগরের বাইরে প্রকৃতির বৃহৎ অঙ্গনে পা রাখেন। এই যাত্রায় পিতার স্নেহসিক্ত সান্নিধ্য লাভ রবীন্দ্র-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পিতার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আদর্শ তাঁকে অভিভূত করে। হিমালয়ের নির্জন বাসগৃহে তিনি পিতার নিকট সংস্কৃত পড়তেন। সন্ধ্যায় মহর্ষি তাঁকে চিনিয়ে দিতেন আকাশের গ্রহনক্ষত্র। এভাবে মহর্ষির প্রকৃতিপ্রীতি ও সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে কবির নিবিড় পরিচয় ঘটে।

হিমালয় থেকে ফিরে এসে হঠাৎ যেন রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করেন। এরপর থেকে তাঁর শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চা অনেকটাই বাধামুক্ত হয়। এ সময় গৃহশিক্ষকের নিকট তাঁকে পড়তে হয় সংস্কৃত, ইংরেজি সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, প্রাকৃতবিজ্ঞান প্রভৃতি। এর পাশাপাশি চলতে থাকে ড্রয়িং, সঙ্গীতশিক্ষা এবং জিমন্যাস্টিকস। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও কবির সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকে। রবীন্দ্রনাথ প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘অভিলাষ’ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১২৮১ সনের (১৮৭৪) অগ্রহায়ণ মাসে (কারও কারও মতে প্রথম কবিতা ‘ভারতভূমি’ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়)। তাঁর দ্বিতীয় মুদ্রিত কবিতা ‘প্রকৃতির খেদ’ (১৮৭৫)। এ দুটি কবিতা তিনি পড়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির বিদ্বজ্জন সভায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৮৭৪ সালের গোড়ার দিকে ঠাকুরবাড়ির মনীষীরা বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক, সংবাদপত্র-সম্পাদকসহ বিদগ্ধজনদের আহবান করে ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ নামে এক সাহিত্য সম্মিলনীর আয়োজন করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন সম্মিলনীর উদ্যোক্তা।

পাশের গ্রামের জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত বললেন,শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম-ও দরজার বাইরে থেকে মাতা রোহিণীর গল্প শুনছিলেন। তাঁরাও নিজেদের আবেগ চেপে রাখতে পারেননি। বিশেষ করে, কৃষ্ণ মা যশোদা, বাবা নন্দ এবং বাকি বৃন্দাবনবাসীদের ছেড়ে আসার তীব্র অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন। অতঃপর তাঁর এবং বলরামের-ও সুভদ্রার মত একই অবস্থা হয়। হাত-পা পেটে ঢুকে যায়। দুই চোখ বিস্ফারিত। এই রূপই পরবর্তীকালে জগন্নাথ নামে খ্যাত হল।তবে জগন্নাথের যে হাত-পা একেবারেই নেই, তা নয়। জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর প্রভুর হাত-পা নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তখন জগন্নাথ স্বপ্নাদেশ দেন, রাজার অনুরোধ রাখতে বছরের বিশেষ কয়েকটি দিনে অস্থায়ী সোনার হাত-পা লাগাবেন। সেই থেকে বিশেষ বিশেষ তিথিতে জগন্নাথদেবের দারুকাষ্ঠের দেহে সোনার হাত-পা যুক্ত করা হয়।জগন্নাথের মূর্তি তৈরীর সময় ভাস্কররূপী বিশ্বকর্মা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে শর্ত দিয়েছিলেন যেন তাঁর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ বিরক্ত না করে। রাজা সে শর্তভঙ্গ করলে মূর্তির কাজ অসমাপ্ত রেখেই অন্তর্হিত হন বিশ্বকর্মা।পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্দির। জগন্নাথ-আরাধনার ইতিবৃত্ত এতই প্রাচীন যে এর কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া সম্ভব নয়। জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরটি শ্রীমন্দির নামে সমধিক পরিচিত। গর্ভগৃহের মাথায় রয়েছে একটি সুউচ্চ শিখর বা চূড়া। প্রদীপ উৎসর্গের জন্য রয়েছে ফসিল হয়ে যাওয়া কাঠের একটি স্তম্ভ। মন্দিরের প্রধান দ্বার সিংহদ্বারের রক্ষক দেবতা জয় ও বিজয়। মূল প্রবেশপথের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। খুরদার রাজা কোনার্কের সূর্যমন্দির থেকে এটি নিয়ে আসেন।তিন দেবতাকে সাধারণত মন্দিরের অভ্যন্তরেই পূজা করা হয়। তবে প্রতি বছর আষাঢ় মাসে তাদের রাজপথে বের করে রথারূহ করে তিন কিলোমিটার দূরে গুন্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় ভক্তরা দেবতাকে গণদর্শনের সুযোগ পান। এই বিরাট বিরাট রথগুলি প্রতি বছর কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের প্রতীকী রূপে পালিত হয়ে থাকে এই রথযাত্রা উৎসব। রথযাত্রার সময় সারা পৃথিবী থেকে এখানে ভক্ত সমাগম হয়। পুরীর রাজা রথের সম্মুখে রাস্তা ঝাঁট দেন।জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। ‘নিম্ব বৃক্ষ’ বা নিম গাছের কাঠ দ্বারা জগন্নাথদেবের প্রধাণ বিগ্রহটি(জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা) নির্মিত। এই মূর্তির চোখদুটি বড়ো বড়ো ও গোলাকার। হাত অসম্পূর্ণ। মূর্তিতে কোনো পা দেখা যায় না। বিগ্রহে অসম্পূর্ণ হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ এবং পবিত্র বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। জগন্নাথের পূজাপদ্ধতিও অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের পূজাপদ্ধতির চেয়ে আলাদা।ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরে জগন্নাথের প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দির হিন্দুধর্মের চারধামের অন্যতম।বেদে জগন্নাথের সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। তিনি দশাবতার অথবা বৈদিক হিন্দু দেবমণ্ডলীর সদস্যও নন। অবশ্য কোনো কোনো ওড়িয়া গ্রন্থে জগন্নাথকে বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।বিষ্ণুর রূপভেদ হিসেবে জগন্নাথ এক অসাম্প্রদায়িক দেবতা। তাকে এককভাবে হিন্দুধর্মের কোনো একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, স্মার্ত সকল শাখার অনুগামীরাই জগন্নাথকে পূজা করেন। এমনকি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গেও জগন্নাথের যোগ দেখানো হয়।জগন্নাথের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবটি হল রথযাত্রা। এই উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের (বড় দেউল) গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি তিনটি বিরাট রথে করে প্রায় ৩ কিলোমিটার (১.৯ মা) দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভক্তরাই এই রথগুলি টেনে নিয়ে যান। যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে, সেখানেই এই ধরনের রথযাত্রা আয়োজিত।

জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে দুটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তার কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।দ্বিতীয় কাহিনিটির অবতারণা করা হয়েছিল পূর্বোল্লিখিত উপখ্যানটির ব্যাখ্যা ও সংশয় নিরসনের উদ্দেশ্যে। বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে নিয়োগ করা হয়েছিল গোপীরা যখন কৃষ্ণের কথা আলোচনা করেন তখন কৃষ্ণ যেন তাদের নিকটবর্তী না হতে পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য। কিন্তু গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতি দেখে পরিতুষ্ট সুভদ্রা তাদেরই কথা শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন না যে তাদের দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে আসছেন। শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে এল, চোখদুটি বড় বড় হয়ে গেল এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এইপ্রকার রূপ। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করেন।

কেতুগ্রাম থানার বড়পুরুলিয়া গ্রামে নতুন জগন্নাথদেবের মন্দিরে জগন্নাথ,সুভদ্রা ও বলরামের পুজো করা হয়।পাশে রাখা আছে একটি রথ।এই রথ রথযাত্রার দিন গ্রামে ঘোরে।

জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে দুটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ, তার ভক্তের সামনে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তার কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।

দ্বিতীয় কাহিনিটির অবতারণা করা হয়েছিল পূর্বোল্লিখিত উপখ্যানটির ব্যাখ্যা ও সংশয় নিরসনের উদ্দেশ্যে। বৃন্দাবনে একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। কৃষ্ণভগিনীকে নিয়োগ করা হয়েছিল গোপীরা যখন কৃষ্ণের কথা আলোচনা করেন তখন কৃষ্ণ যেন তাদের নিকটবর্তী না হতে পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য। কিন্তু গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতি দেখে পরিতুষ্ট সুভদ্রা তাদেরই কথা শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন না যে তাদের দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে আসছেন। শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে এল, চোখদুটি বড় বড় হয়ে গেল এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এইপ্রকার রূপ। কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করেন ভক্তবৃন্দ।

১০

গ্রামের ছেলে অরূপরতন বলেন,বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত।

নদীর ধার দিয়ে নিত্য আমার আনাগোনা । গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী কালো রূপে আলো ঘেরা অভয় বাণী ।বর্ষায় পরিপূর্ণ গর্ভবতী নারীরূপ । এই রূপে জলবতী নদীতে অতি বড় সাঁতারু ভুলে যায় কৌশল । আমি তখন নদীর বুকে দুধসাদা ফেনা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলি বাক্যহারা হয়ে ।

এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি । তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকী হয়ে যাই । আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে । মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার ।

নদী এরপরে হেমন্তের বুকে ছবি এঁকে এগিয়ে যায় শীত ঋতুর আহ্বানে । লোটা কম্বল বগলে আমি রাজস্থানী সাজি । কখনও ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত শাল জড়ানো খাঁটি বাঙালি । মাঝে মাঝে কোট প্যান্ট পরিহিত বিদেশী সাহেবের সুন্দর সাজ । আমি সারা পৃথিবীর সাজে সজ্জিত হতে চাই শীতের আদরে ।

শীতল আড়মোড়া ভাঙতেই বসন্তের বাসন্তী রঙের তালে তালে আমি রঙের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই । সকলের অন্তরের গোপন রঙ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি । এই সময়ে আমার রাধাভাব ছড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অজয়ের রাধারমণের রূপে ।

আমার সমস্ত শরীর মন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মনোদেবতার মহান চরণে …

দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , “ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না” ।অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা ।ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,”আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম ” । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো । বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?

রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে ।
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,
ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।

অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।

আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা । শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে । আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না ।পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার । সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি । কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে ।

দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে । হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায় ।

কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের । এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব । মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত । হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে । দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে ।

আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন । সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের
মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন ।

আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই । কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন । অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার । মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো । প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি ।

শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো । তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ ।

ভাইফোঁটা, পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া। কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে,ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর
একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমান ভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়।হেমন্ত আসে তার রূপের পসরা নিয়ে।পুকুরের ধারে কাশ আর শিউলি মাথা নাড়িয়ে আমাদের আহ্বান করত।আমরা কাশের বনে লুকোচুরি খেলতাম।শৈশবটাকে বেঁধে রাখলে ভাল হত কিন্তু সময় তো বয়ে চলে নদীর স্রোতের মত।আধুনিক সভ্যতার যুগে বাংলার বুকে সব জায়গায় বিশেষভাবে অনুভূত হয় মাত্র চারটি ঋতু। সেগুলি হল: গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত। সভ্যতার করাল গ্রাসে বর্তমানে বাংলার ঋতুচক্র থেকে হেমন্তের নাম একরকম লুপ্তই হয়ে গেছে। শহরের বুকে তার রূপ অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন, তবে এখনও গ্রাম বাংলার বুকে অল্প দিনের জন্য হলেও হেমন্তের আভাস পাওয়া যায়। হেমন্ত ঋতু অন্যান্যদের মতই আপন মহিমায় মহিমান্বিত। তার নিজস্ব স্বকীয় সৌন্দর্য রয়েছে।

বঙ্গভূমির প্রকৃতি প্রত্যেকটি ঋতুতে বাঙালির জীবনে এনে দেয় নব নব রূপ ও রসের অপরূপ ছন্দ। বাংলার বুকে এই ষড়ঋতুর চতুর্থটি হলো হেমন্ত। বর্ষার পর উৎসবমুখর শরৎ কালের অবসানে গুটি গুটি পায়ে শীতের পূর্বে আগমন ঘটে হেমন্তের। বাংলার বুকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তের ব্যাপ্তি।

বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত। একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমান ভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়।

তবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দ থেকে। অর্থাৎ হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে মেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎকাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকাল গুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ।

তবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দপ্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আসেন দেবী দুর্গার সঙ্গে। আবার কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে কার্তিক ঠাকুরের পুজো হয়।

সূর্য উপাসনার অপর নাম ছট পুজো।এই বিশ্বাস অনুযায়ী একমাত্র সূর্য প্রতিদিন ওঠেন এবং অস্ত যায়।সূর্যের মত সত্য আর কিছু হতে পারে না।কর্মের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মনে কর্ম প্রেরণা দিয়ে থাকেন।

 

এই পূজার কখন উৎপত্তি হয়েছিল তার কোনো স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু পৌরাণিক আখ্যানে ছট পূজার নীতি নিয়মের সঙ্গে মিল থাকা উৎসব দেখা যায়। ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহে সূর্য্যবন্দনার স্পষ্ট নিদর্শন আছে। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, রোমান, মিশরীয় ইত্যাদির সভ্যতাসমূহেও সূর্য্য মূখ্য দেবতা ছিলেন। সেভাবে ঊষাও বৈদিক দেবী। বেদে উল্লেখ থাকা মতে, তিনি হলেন পূর্বের দেবী এবং অশ্বিনীকুমারদের মাতা। অগ্নি, সোম এবং ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা সকলের পরে তিনি হলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈদিক দেবী। রাত্রি হল তার ভগ্নী যাকে হয়তো পরে পৌরাণিক যুগে সন্ধ্যা এবং ছায়ারূপে কল্পিত করা হয়েছে। রামায়ণে উল্লেখ থাকা মতে, রামের কুলদেবতা সূর্য্যের জন্য রাম এবং সীতা এই পূজা করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ থাকা মতে, দ্রৌপদী ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্য্যকে আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। সঙ্গে মহাবীর কর্ণের কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য্যের উপাসনা করা উল্লেখ আছে। আজও ছট পূজা উদ্‌যাপন করা সকল মানুষকে কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য বন্দনা করতে দেখা যায়। অন্য এক আখ্যান মতে, পাণ্ডু ঋষি হত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে পত্নী কুন্তীর সঙ্গে বনে থাকায় পুত্র প্রাপ্তির জন্য সরস্বতী নদীর পারে সূর্য্য উপাসনা এবং ব্রত করেছিলেন।

পুরাণ মতে, প্রথম মনু প্রিয়বতের কোনো সন্তান ছিল না। তাই তার পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করতে পরামর্শ দেন। এর ফলে তার পত্নী মালিনী একটি মৃত পুত্র জন্ম দিলেন। মৃত শিশু দেখে তারাও বিলাপ করতে থাকায় আকাশ থেকে এক দিব্য কন্যা প্রকট হলেন। তিনি নিজকে ব্রহ্মার মানস পুত্রী বলে পরিচয় দিলেন এবং মৃত পুত্রকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সে জীবিত হয়ে উঠল। এখনও ঊষা দেবী বা ছটি মায়ের মূর্তি কোলে কিছু থাকা অবস্থায় কল্পনা করা হয় এবং পুত্র প্রাপ্তির জন্য ব্রত উপাসনা করা হয়।

তদুপরি লৌকিক দেবী হিসাবে অন্য বহু লোককথা আখ্যান হিসাবে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে।

ছটপূজাও বাংলার বুকে হয়। হিন্দু বর্ষপঞ্জীর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে উদযাপিত একটি প্রাচীন হিন্দু পার্বণ।সূর্য্যোপাসনার এই অনুপম লৌকিক উৎসব পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে পালিত হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এই পার্বণ প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হয়েছে।ছট পূজা সূর্য্য ও তার পত্নী ঊষার প্রতি সমর্পিত হয়, যেখানে তাকে পৃথিবীতে জীবনের স্রোত বহাল রাখার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আশীর্বাদ প্রদানের কামনা করা হয়। ছটে কোনও মূর্তি পূজা করা হয় না।

চারদিনের এই ব্রতের প্রথম দিনে ব্রতধারী বাড়িঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে শুদ্ধাচারে নিরামিষ ভোজন করেন (যাকে নহায়-খায় বলা হয়)। পরদিন থেকে উপবাস শুরু হয়; ব্রতী দিনভর নির্জলা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় পূজার শেষে ক্ষীরের ভোগ গ্রহণ করেন। তৃতীয় দিনে নিকটবর্তী নদী বা জলাশয়ের ঘাটে গিয়ে অন্যান্য ব্রতীর সাথে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য অর্থাৎ দুধ অর্পণ করা হয়। ব্রতের শেষদিনে পুনরায় ঘাটে গিয়ে উদীয়মান সূর্যকে পবিত্র চিত্তে অর্ঘ্যপ্রদানের পর উপবাসভঙ্গ করে পূজার প্রসাদরূপে বাঁশ নির্মিত পাত্রে সুপ, গুড়, মিষ্টান্ন, ক্ষীর, ঠেকুয়া, ভাতের নাড়ু এবং আখ, কলা, মিষ্টি লেবু প্রভৃতি ফল জনসাধারণকে দেওয়া হয়।
বারবণিতাদের হাত ধরেই কাটোয়ায় শুরু হয় কার্তিক পুজো। পরবর্তীতে বারবণিতাদের কাছে আসা বণিক ও বাবুদের আভিজাত্য প্রদর্শনীই হয়ে ওঠে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই। বর্তমানে কাটোয়া শহরের বিভিন্ন ক্লাবে আলোকসজ্জা,মন্ডপ, বাজনায় জমে ওঠে সুষ্ঠু লড়াই। যা কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াই নামে পরিচিত। তবে কার্তিকের শোভাযাত্রা যা লড়াই বলে পরিচিত তা কোভিড বিধির কারণে বন্ধ রেখেছে প্রশাসন।
কাটোয়া দেব সেনাপতির আরাধনাকে ঘিরে কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের কথা আজ আর কারও কাছে অজানা নয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে কাটোয়ার সেই কার্তিক লড়াইতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। কার্তিক পুজোর আগেই কাটোয়ার স্থানীয় ক্লাবগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বসা হয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বৈঠকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পুজো করতে হবে সম্পূর্ণ কোভিড বিধি মেনে। প্যান্ডেলে মাস্ক পরে যেতে হবে দর্শনার্থীদের। রাখতে হবে স্যানটাইজার। হবে না কার্তিক লড়াই। এছাড়া নিরাপত্তার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে। উৎসবের দিনগুলিতে গোটা কাটোয়া শহরে নজরদারি চালাবে প্রায় ২০০টি সিসি ক্যামেরা।
অন্য বার কাটোয়া শহরের লেনিন সরণি থেকে শুরু করে পুরসভা মোড়, সংহতি মঞ্চের মোড়, টেলিফোন ময়দান, মাধবীতলা এলাকায় দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। আগে থেকে শোভাযাত্রার রুট নির্দিষ্ট করে দেয় প্রশাসন। এ বার বিকেল থেকে ফাঁকাই ছিল ওই সব রাস্তা। বাইরে থেকে কোনও দর্শককে শহরে ঢুকতে দেখা যায়নি। তবে রাত ৮টার পরে, রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েন শহরের অনেক বাসিন্দাই। শোভাযাত্রা না থাকলেও ভিড় করে রাস্তায় ঘুরতে বা মণ্ডপে যেতে দেখা যায় অনেকজনকে। যদিও পুলিশের দাবি, পুরোটাই স্বাস্থ্য-বিধি মেনে হয়েছে।
বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির সাংবাৎসরিক কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়।পূর্বের তুলনায় এখন কার্তিক জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়।কলকাতাতে তার মন্দির আছে।

কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে৷ সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তার মিল৷তিনি বাচ্চা বড় না হওয়া অব্দি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন ৷তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ , ধনলাভ হয় ৷সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তুু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয় ।যা প্রজাপতি বিস্কুট সিনেমাতে ও দেখানো হয়েছে। সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত।কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলে । কার্তিক পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে । সব পুজো-মণ্ডপের দলবল তাদের ঠাকুর নিযে বেরোয় শোভাযাত্রায়। চলে লড়াই কার ঠাকুর আগে যাবে।এ যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরোয়াল নিয়েও চলে। হালিশহরের’জ্যাংড়া কার্তিক’ ও ‘ধুমো কার্তিক’ পূজা ও খুব বিখ্যাত। এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি।

প্রাচীন বর্ধমান তথা আজকের পশ্চিম বর্ধমান জেলার গৌরবাজার গ্রামে বিগত ১৬৬ বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে । এই পুজোর বিশেষত্ব হল তিনটি কার্তিক- বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোটো কার্তিক। বর্ধমান রাজাদের অধীনে তখন পালদের জমিদারি ছিল।তারা খুব বিখ্যাত ছিল। ১৮৫৩ সালের ঘটনা। জমিদার জয়নারায়ণ পাল, শ্যাম পাল ও লক্ষ্মীনারায়ণ পালের কোনো সন্তান ছিল না। তারা চরম চিন্তায় ছিলেন। অনেক উপায় অবলম্বন করেও কোনও সুরাহা হয় নি। তখন একদিন রাত্রে স্বপ্নে জয়নারায়ণ পাল আদেশ পান তাদের তিন ভাই কার্তিক পুজো করলে তাদের শূন্য‌ ঘর আলো হবে। তাই তাঁরা তিন ভাই মিলে ঘটা করে কার্ত্তিক মন্দির তৈরি করে একসাথে তিন কার্তিকের পূজা করতে লাগলেন। তারপরে ১৮৫৭ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ পালের ধ্বজাধারী পাল নামে এক পুত্র সন্তান হয়।বাকি দুই ভাইয়ের একটি করে কন্যা সন্তান লাভ হয়। সেই থেকে এখানে পালদের বংশধরেরা আজও পুজো করে আসছেন । এর ফলে এই বংশে আর নেই নিঃসন্তান হয় নি। এখানে এখনো ধুমধামের সাথে কার্তিক পূজা করা হয়।

কাটোয়ার থাকা কার্তিকের কাঠামোয় রামায়ণ মহাভারতের কোন কাহিনী নিয়ে পুতুল গড়া হয়।পরপর সাজানো থাকে মূর্তিগুলো।কাটোয়ার কার্তিক পুজোর পরের দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিযোগিতা চলে দিনভর।এই প্রতিযোগিতা কার্তিক লড়াই নামে পরিচিত। থেকে। অর্থাৎ হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে মেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎকাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকাল গুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ।

হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমের রাতে ওই গানটিতে লিখেছেন,

“হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,

হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।

ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,

জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’

বিশ্বকবি তার নৈবদ্যে স্তব্ধতা কবিতায় লিখেছেন,

‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে

জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে

শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার

রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার

স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..