কেন কবিতায় থাকি

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
কেন কবিতায় থাকি

এই প্রশ্নের উত্তর কোনও ভণিতা না করেই লেখা যায় আর কোনও উপায় নেই বলে। কিন্তু কেন উপায় নেই এই প্রশ্নের উত্তরে ফিরতে হবে বেশ কয়েক বছর পিছনে যখন সেই বীজ বপন করা হয়েছিল। সমস্ত বাঙালি যুবার মত শেষ কৈশোর বা প্রথম যৌবনের যে কবিতার বেগ আবেগ নিঃসরণের কাজ করে সেটাই শুরু। কিন্তু কয়েক বছর পরে সেটাই দাঁড়ালো এক অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়ায়। কিন্তু কেন? স্পষ্ট মনে পড়ে কলেজে প্রাণীবিদ্যার ব্যবহারিক ক্লাসে স্যার বলেছিলেন যে প্রাণী যত উজ্জ্বল ও দেখতে সুন্দর সে ততই বিষধর। আর ঠিক সেই সময় মাথায় ঢুকছে রিলকের সেই অমোঘ লাইন সুন্দরই ভয়ংকরের সূচনা। সেই যে কবিতা মিলে গেল জোর করে পড়া বিজ্ঞানের সঙ্গে আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। বুঝে গেছি আমার রাস্তা কবিতা বা লেখা।

কিন্তু আমার রাস্তা বিজ্ঞানও তো হতে পারত, বোঝা যেতে পারত বিজ্ঞান আর কবিতা অনেক ক্ষেত্রেই এক দিকে যেতে চায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হল না। কারণ ততদিনে আমার কবিতার প্রথম ও অমোঘ শিক্ষক জমিল সৈয়দের ক্লাসে পৌঁছে গেছি। হাতে পড়েছে তাঁর সম্পাদিত “বাংলা কবিতা রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর” – এর ভূমিকা যেখানে তিনি কবিকে এক আবিষ্কারকের আসনে বসাচ্ছেন। মাথায় ঢুকে যাচ্ছে চিরতরে ইউনিকর্ন থেকে স্বর্ণমারীচ সবই কবির আবিষ্কার। সেই আবিষ্কারের আনন্দেই মজে যাওয়া গেল প্রাথমিকভাবে। পরে অবশ্য বিখ্যাত হবার লোভ, সামাজিকভাবে কবিখ্যাতি পাবার লোভ আমাকে ক্লোন কাব্য লিখতে শেখায় যা কিনা আমার সমসময়ের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যেহেতু সে ইস্কুলে খুব একটা পাত্তা পাইনি (ভাগ্যিস!) তাই মজে গেলাম আরেকধরণের খোঁজে। কেন যেন মনে হল জার্মানিতে গিয়ে নিজের কবিতাবীক্ষা বদলে ফেলা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তই একমাত্র আদর্শ হতে পারেন। হতেই পারেন,

কিন্তু নকল করার জন্য, আরেক রকমভাবে ক্লোন কবি হবার জন্য কোনও কবিই আদর্শ হতে পারেন না। কবিকে নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। কখনও সে রাস্তা হয়ত দলবদ্ধ কোনও আদর্শ নির্ভর হতে পারে। যেমনটা বা বৈষ্ণব কবিতা বা আমাদের আদি চর্যাপদ। কিন্তু একজন ব্যক্তি কবির লিখনভঙ্গি নকল করে কবিতা লেখা যায় না। আমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় আমার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশ পাবার পর। বাংলা কবিতার স্বভাব অনুযায়ী কেউ কিছু বলেনি বা শুধুই ভাল বলেছে। শুধু এক প্রবীণ শিক্ষক যাঁর সঙ্গে আমার যোগ স্প্যানিশ ভাষা চর্চার কারণে, শ্রী রবিন পাল, আমাকে বলেন “ভাল। বেশ অলোকরঞ্জনা আছে। কিন্তু নতুন কিছু পেলাম না”।

প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। এই ঘটনার প্রায় এক বছর বাদে, তখন আমি মাদ্রিদে শিং ভেঙে বাছুরের দলে লেখাপড়া করতে গেছি, সামান্যভাবে আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ও কৌরবের সংস্পর্শে আসছি, একদিন গভীর রাতে লিখে ফেললাম একটা টানা গদ্য কবিতা।

ততদিনে স্প্যানিশ ভাষার কবিতা আমাকে আক্রমণ করে ফেলেছে। আমি শুধু আর্যনীল মুখোপাধ্যায় নয় সংস্পর্শে আসছি স্প্যানিশ ভাষার সমসাময়িক কবিতা ও কবিতাভাবুকদের।

মাদ্রিদে থাকাকালীনই আমার মাথায় নতুন করে ফিরে আসছিল আমার আদিপাঠ, আমার জমিল সৈয়দ, আমার সুব্রত সরকার, অঞ্জলি দাশ। সঙ্গে জুড়ে গেল আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের একের পর এক মেইল, সমসায়িক অন্যদেশের কবিতা। সঙ্গে জুড়ে গেল স্প্যানিশ ভাষার কবিতা ও তার ভাবনা। আমি অনুভব করলাম অভিজ্ঞতার কবিতা বা যেমনটা আমাদের বেশিরভাগ সমসাময়িক কবিতা আমি বাসে চড়লাম, প্রেম করলাম, কলকাতার রাস্তায় ট্রাম ইত্যাদি আমার কোনও কাজে লাগবে না। বা লাগলেও তা কোনও গভীর কল্পনার প্রেরণা মাত্র। দেশে ফিরলাম। কাঠ বেকার।

কিন্তু স্পেনে গোপনে একটা ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে এসেছিলাম। ২০০৮ সালের অগাস্ট মাসে আমার কাছে এল তার ফল। আমি জিতেছি, এবং সেই বিজয়ের চুক্তি অনুসারে আমাকে উত্তর-মধ্য স্পেনের এক ছোট্ট পাহাড়ি শহর সোরিয়াতে গিয়ে থাকতে হবে ৬ মাস এবং একটা কবিতার বই লিখতে হবে। সেইভাবেই লেখা হল চিতাবাঘ শহর। সেখানে মাত্র দুটি কবিতা পুরনো, সেই তার আগের বছর মাদ্রিদ ও আন্দালুসিয়ায় লেখা আমার নিজের কবিতার নতুন ছাঁচের প্রতিভূ তারা। পরে সেই বই চুক্তি অনুসারেই অনুবাদ করলাম স্প্যানিশ ভাষায়। ২০১০ সালে স্পেনে প্রকাশিত হল সেই বই। তারপর আর পিছনে তাকাই নি।

জানি না স্পষ্ট হল কিনা আমি কেন কবিতায় থাকি, তবে এক কথায় বলতে গেলে নতুন আবিষ্কারের নেশায়। তা সে কবিতা পড়ে হোক বা নিজের সামান্য কবিতা লেখায়। নিজের লেখা অন্যরকম হয় কিনা জানি না কিন্তু কল্পনা শক্তির ঝলক যেখানে আমাকে উশকে দেয়, তা সে বাক্যনির্মাণে হোক বা চিত্রকল্পে, সেই আমার কাছে কবিতা। আমি সেখানেই থাকতে চাই।

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি, স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষক। জন্ম ১৯৭৮, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়। তিনি অংশুমালীর স্প্যানিশ ভার্সনের সম্পাদক। প্রকাশিত বই: বাংলায় প্রকাশিত কবিতার বই ৪টি। ইউরোপের স্পেন থেকেও তাঁর তিনটি কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে। সম্মাননা: বৌদ্ধলেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ কাব্যগ্রন্থের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..