কেন পড়ি, কেন লিখি

ধীমান চক্রবর্তী
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
কেন পড়ি, কেন লিখি

কেন পড়ি:

সমুদ্র। ডেকেছিল—হয়তো আঙুল তার কোনও কাজেই আসেনি সারাজীবন। তা ডাকলে তো টুংটাং হবেই। রিমঝিমও হবে। গেছিলাম মার্চ-এর প্রথম সপ্তাহে। গিয়েই একটা ঢেউ-এর নাম রাখলাম রতন। সমুদ্রে গেলেই একটা ঢেউ-এর নাম হয় রতন। এই বললাম প্রথমবার। সমুদ্রে যাই শুধুমাত্র জল পড়বার জন্য। যেমন পাহাড়ে… পাথর, সবুজ আর বরফ নাকী জল পড়তে। জল পড়ি কারণ, যে লোকটা এইমাত্র ডুব দিয়ে উঠলো তার জীবন আর মৃত্যু লেগে রইলো ওই জলে। আমি তো কেউ না। এসব পড়তেও চাইনি। তবু ওরা যেভাবে পড়ায়।

সবাই কিছু না কিছু পড়ে। ফলে আমাকেও। তবে সবাই তো দ্রষ্টা নয়। দেখার দায়ও নেই। পড়তে গেলে চোখ তো কিছুটা জ্যামিতি হবেই। কেউ কুয়াশার হিম তো কেউ রোদ্দুর পড়ে।তুলতুলে রঙের বিজন আর কোলাহল মুখর ফুটবল পড়ে কেউ। কেউ রঙিন পানু পড়ে তো কেউ ধর্ম। ছোটরা দুড়দাড় আর কলকল পড়তে পড়তে হইচই করে,তো বড়রা কপালের ভাঁজ পড়ে। সবাই কিছু না কিছু পড়ছে। ওই তো আশ্রয়। কেউ কেউ লাইন করে দাঁড়ানো শূন্যদের আহির ভৈরোঁ পড়ছে। কেউ বা ওয়াচটাওয়ারটির গালের টোল পড়ছে। তবে কি পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠবে আবার!  পড়তে পড়তে।

পড়লে বোধহয় নিজেকে নিজের প্রশ্নগুলো করা যায়। এই দু’ই নিজের মধ্যে কোনো ডাকটিকিট নেই। কোনো মিথ্যে নেই। টেবলের পাশে বসা প্রাচীন বাড়িটিকে আমি সকালবেলা পড়তে বসি। আমার পাশে চুপ করে বসে থাকে আমার ছায়া। জানিনা সে টেবল না প্রাচীন বাড়ি… কাকে পড়তে চায়।

আসলে আমার মতো একজন মূর্খ মানুষের আর কি বা করার থাকে? পড়া ছাড়া! এই পৃথিবীর যা যা সামনে পিছনে চারপাশে আছে… তাদের পড়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে। তবে তো নিজের সাথে, নিজের ছায়ার সাথে সারাজীবনে এক-আধটা কথা হয়তো বলে উঠতে পারবো। এক জীবনে শুধু এটুকু পড়াই যথেষ্ট মনে হয়।

কেন লিখি:

লেখা লিখি করার চেষ্টা করি বলে, প্রায়শই নিজের ভিতর থেকে বেরিয়ে নিজের সাথে দু’একটা কথা বলা যায়। যে রকম কথা বলে আমার বউ। সকালবেলা রান্নাঘরে ঢুকলেই দেখি সে কথা বলছে কড়াই, হাতা, খুন্তি বা সসপ্যানের সাথে। আর হাঁড়ির সঙ্গে তো বটেই। বুঝতে পারি একটু পরেই আমার বউ ওদের শরীরে কবিতা লিখবে। আসলে কে কোথায় কি ভাবে কি কারণে কবিতা লিখছে, আমরা হয়তো বুঝতেও পারিনা।

তো আমি যখন কোথাও চুপচাপ বসে থাকি তখন আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে আরেকটা ধীমান আমার পাশে বসে থাকে লা জবাব। কেউ কারোর সাথে কথা বলি না। আমাদের চারপাশে জড়ো হওয়া এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু দেখার চেষ্টা করি। কিছু দেখা যায়, বাকিটা না।  সে সময় গাছের গান শুনতে শুনতেই আমরা একটু বড় হয়ে উঠি। কাচের পোষাক পরে ছায়াপথ নেমে এলে রান্নাঘরের ভাঙা চোখ আলোয় ভরে ওঠে।

সেই আলোয় আমি কয়েক লাইন কবিতা লিখি বাকিটা ধীমান। আমরা দু’জন দু’জনের আশ্রয় হয়ে উঠি। তবুও মাঝে মধ্যে আমায় ফেলে রেখে ধীমান কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। বুঝতে পারি সে লেখা লিখি করতে যায়, কারণ ফিরে আসার পর দেখি ওর কাছে অনেক নতুন নতুন কবিতা। সে এসে বিছেহার এবং নববিবাহিতা রোদ্দুরের গল্প বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে পড়ে। একবার তো সে সঙ্গে করে লাবণ্যকে নিয়ে এসেছিল।

এরকম নিরুদ্দেশের সময় সারাদিন আমার পাশে বসে থাকে আমার ছায়া। রাত্রিবেলা আমার পাশে শুয়েও থাকে। তখন আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে। কোনো কোনো দিন লম্বা সেতুর ওপাশ থেকে লাবণ্য চলে আসে। তখন তোমাকে নিয়ে, তোমাদের নিয়ে, এই পৃথিবী নিয়ে আমরা সবাই হয়তো লেখালিখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আর দেশলাই সে সময় জলের মধ্যে নেমে সারারাত সারাদিন জ্বলতে থাকে। জ্বলতেই থাকে।

ধীমান চক্রবর্তী। কবি। জন্ম ৪ অক্টোবর ১৯৫৫, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতা। প্রকাশিত বই (প্রবন্ধগ্রন্থ 'বেজে ওঠা সূর্যাস্ত' ছাড়া অন্যান্য সকল গ্রন্থই কাব্যগ্রন্থ): আপনাদের স্মরণে (১৯৮৭), আগুনের আরামকেদারা (১৯৮৯), কাচ শহরের মানুষ (১৯৯১), দস্তানা ভ’রে উঠছে (১৯৯৩), যমজ পাথর (১৯৯৫), চাঁদের সাপলুডো...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..