কে এলোনা

সাইফ উদ্দিন আহমেদ
গল্প
Bengali
কে এলোনা

শরবতি বিবির মনে বড়ো কষ্ট।

আজ দেড় মাস ধরে তিনি হসপিটালে

পড়ে আছেন।তাঁর চৌদ্দ সন্তানদের মধ্যে তেরো জনই তাদের স্ত্রী,জামাই,আন্ডা,বাচ্চা সহ,একাধিক বার এসে তাঁকে দেখে গেছে।

প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে।কিন্তু তাঁর একটি সন্তান একবারওযে তাঁকে দেখতে এলোনা!

শরবতি বিবি মনেই করতে পারছেননা,তার চেহারা বা তার নাম ।তিনি বড়ো কষ্টে আছেন।

তাঁকে দেখতে কোনজন এলোনা?

সাত নাম্বার ছেলেটিই নাকি? কিন্ত ও কি না এসে পারে!

ও যে শরবতি বিবির বড়ো আদরের!ও জন্মের পর থেকেই ভীষণ অসুস্থতার  মধ্যে বেড়ে উঠেছে।

সকলেই জানে ওর জন্য শরবতি বিবির আলাদা একটা টানের কথা।ওকি না এসে পারে? তাহলে কে এলোনা?

শরবতি বিবির অসুস্থ শরীরের কষ্টের চেয়ে সন্তানের নাম আর চেহারা মনে করতে না পারার কষ্ট আরো বেশী হচ্ছে।

অন্য সন্তানদের কাউকে জীজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।কিন্তু জীজ্ঞাসা তিনি করতেও পারছেননা,লজ্জায়।

এতোগুলো সন্তানের জন্ম দেয়ায় এ বুড়ো বয়সে মরবার সময়ে এসেও তিনি লজ্জা পাচ্ছেন ।

অবশ্য লজ্জা তিনি সব সময়ই পেয়েছেন।অনেক দ্বিধা দ্বন্ধ করে ছয় নাম্বার সন্তান জন্ম নেয়ার পর স্বামীকে তিনি বলেওছিলেন,

–শোনেন আমাদের আর বাচ্চা না নিলে হয়না।

শরবতি বিবির কথা শোনে মমিনুল আলি লন্ডনী অবাক চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

–বাচ্চা না নিলে হয় না মানে?কি বলতে চাও তুমি ?

স্বামীকে খুব ভয় পান শরবতি বিবি।তবুও কথাটা যখন তুলে ফেলেছেন এখন আর ভয় পেলে কি চলবে?

তিনি মিন মিন করে বলেই ফেললেন,

–না মানে শোনেছি সন্তান বেশী না হওয়ার অনেক ব্যাবস্তা ——

কথা শেষ করতে পারলেননা শরবতি বিবি।স্বামীর ধমকে থেমে গেলেন।

মমিনুল আলি লন্ডনী বললেন,

–এসব নাফরমানী কথা আমার কাছে  বলবেনা।কখনো না।আমি লন্ডনী,টাকা পয়সার আমার অভাব নাই।একশোটা সন্তান হলেও খাওয়াতে পরাতে আমার কোন অসুবিধা হবেনা।

না,একশোর ধারে কাছেও পৌছাতে পারেননি মমিনুল আলি লন্ডনী।বয়স পন্চাশের কাছাকাছি হতেই নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন বিছানায় শয্যাশায়ী থেকে পরপারে পাড়ি জমান।

তবে একটা কাজ মমিনুল আলি লন্ডনী করে যেতে পেরেছিলেন।তিনি সঠিক সময়ে তাঁর পরিবারকে লন্ডন এনে ব্রিটিশ নাগরিক করে দিয়ে গেছেন।

শেষ বয়সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে শরবতি বিবি অতীতের এসব কথা বেশ ভালো ভাবেই মনে করতে পারছিলেন।

শুধু মনে করতে পারছিলেননা,তাঁকে দেখতে কে এলোনা!

সেকি তাঁর সপ্তম সন্তান?তার নাম?

না,তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেননা।

ভীষণ অস্বস্তিতে শরবতি বিবি ছটফট করতে লাগলেন।

তাঁর বয়স তিরান্নব্বই বৎসর।তিনি ডায়াবেটিক,হাই ব্লাডপ্রেসার সহ নানান জটিল রোগে ভুগছেন।দুটি কিডনিই নস্ট হয়ে গেছে।ডায়ালিসিসের দ্বারা কোনমতে টিকে আছেন।

শারিরীক অসুস্থতা,শারিরীক ব্যথা তাঁকে তেমন আর ব্যথিত করেনা,যতোখানি ব্যথিত তিনি-কে এলোনা? আর তার নাম নিয়ে।

তিনি বিছানায় উঠে বসার চেস্টা করলেন।দেখতে পেয়ে নার্স ছুটে এলো।তাঁকে বসতে সাহায্য করে কাছের ছোট্ট টেবিলে এক জগ পানি আর গ্লাস রেখে বললো সবটা খেয়ে শেষ করতে।

সরবতি বিবি ইংরেজি বলতে না পারলেও এতো বছর এদেশে থাকার ফলে বেশ ভালো বুঝতে পারেন।

পানি খেয়ে শেষ করার কথা শোনে তিনি বাংলাতে বললেন,হারামজাদী।পানি তুই খা।তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে খাওয়াইয়া দুনিয়া শুকিয়ে দে।আমাকে খাবার কথা বলিস না ।

কিছু বুঝতে না পেরে অদভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নার্স চলে গেলো।সরবতি বিবি বললেন,মর হারামজাদী,মর।

তিনি কিছুই আর সহ্য করতে পারছেননা।কে?কে এলোনা ?

কিছুক্ষণের মধ্যে নার্স আবার ফিরে এলো।জগের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কী বলে বেড গোছাতে শুরু করলো।

সরবতি বিবি দেখলেন কি নিপুণ হাতে অল্প সময়ে সে সুন্দর করে বেড গুছিয়ে দিলো।আহা,তিনিওতো এক সময় ঘরের সব কাজ কী সুন্দর করে দ্রুতই সেরে ফেলতেন।

প্রথম যখন লন্ডন এলেন,এই এতোগুলো বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে একাই তাঁকে ঘরের যাবতীয় কাজ করতে হতো।তিনি পারতেনও।

সরবতি বিবির সব মনে আছে।তাঁর সন্তানেরা হয়তো সব ভূলে গেছে।বড়ো হয়ে গেলে,নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে,পুরনো কথা সবাই ভূলে যায়।ভূলে যাওয়াটাইতো স্বাভাবিক।

তাঁর চৌদ্দ সন্তান চৌদ্দটা ফ্লাটে থাকে।আর তিনি থাকেন একা একটা ফ্লাটে।তাঁকে দেখা শোনা করে এন এইচ এস এর কেয়ারারার।তাঁর সন্তানদের কারুরই সময় নেই বুড়ো মায়ের একটু সেবা করার!

হয়,এরকমই হয়।দুনিয়ার এটাই নিয়ম।সরবতি বিবির এ নিয়ে কোন দুঃখ নেই।দুঃখ শুধু তাঁর নিজের স্মরণ শক্তির উপর।

কে এলোনা? সে কি তাঁর সপ্তম ছেলে?কি যেনো নাম তাঁর?

যতো সময় যাচ্ছে সরবতি বিবি ততই অস্থির হয়ে উঠছেন।

একসময় অন্ধকার হয়ে গেলো তাঁর পৃথিবী।অজ্ঞান হবার আগ মুহুর্তে তার  মনে হলো,কে এলোনা,তিনি চিনতে পারছেন।তাঁর সপ্তম সন্তানের নামও মনে পড়ছে।এইতো–তার নাম–।

না, সরবতি বিবি পারলেননা।তিনি স্মরণ করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

সাইফ উদ্দিন আহমেদ (বাবর) সিলেট জেলার ওসমানি নগর থানার নিজ মান্দারুকা গ্রামে ১৯৬৯ সালে জন্ম । ১৯৮৫ সাল থেকে লন্ডন প্রবাসী। স্ত্রী,দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে, নর্থ লন্ডনে বসবাস। প্রকাশিত বই দুটি। হৃদয় কথা বলে এবং দুপারে দু হৃদয় ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..