প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
হোটেলের ওয়াইফাই বন্ধ করে রেখেছি, নতুন নাম্বার নেওয়া হয় নি। রিসেপশন থেকে বাড়িতে ফোন করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে ফোন করতে হবে ভাবতেই বিরক্তি লাগছে। কে আছে বাড়িতে? যাদের থাকার কথা তারা সবাই আছে। আছে বাবা মা, ছোট্ট ভাই। আর যার থাকার কথা সে তো নাই। ওই একজন দিয়েই কি “সবাই” বুঝায়? কী জানি? ভাল্লাগছে না এসব ভাবতে।
এখানকার চা’টা খুব চমৎকার হয়। গরুর দুধের ঘন চা। কাল হোটেলে আসতে আসতে সন্ধ্যা, যাওয়া হয় নি কোথাও আর। নীচে নেমে আশেপাশে যতটুকু হেঁটে দেখেছি খুব একটা পার্থক্য নেই বাংলাদেশের সাথে। তবু কোথাও যেন একটা অমিল।খুব পুরাণ ধাঁচের কিছু বিল্ডিং যেমনটা সিনেমায় দেখা যায় । ছোট্ট ছোট্ট জানালার মত বারান্দা, আবার টানা বারান্দা। রশিতে কাপড় ঝুলছে। যেমনটা আমার দেশেও দেখি। হাঁটতে হাঁটতে একটা লিকারের দোকান চোখে পড়ে। এই তো পার্থক্য! আমার দেশে এ তো কল্পনায় করা যাবে না। কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ঢুকবো নাকি ভেতরে। কিছু একটা বাধা দিচ্ছিল। জন্ম থেকে যে পরিবেশে আর সংস্কারে বেড়ে উঠেছি তার বয়স্ক থাবা পা টেনে ধরছিল। আবার বোধশক্তি হওয়ার পর যে চিন্তা আমার ভেতরে গজিয়ে উঠেছিল সে আমার হাত ধরে টানছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। “অহো, টাকাই তো আনি নি। থাক কাল যাবো”
মস্তিষ্ক বের করে আনল সে রাস্তা থেকে, নাকি পালিয়ে এলাম সাহসে কুলায় নি বলে?
রাতে রুমে ঢুকে ধপ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
“নক নক নক”
কে আসবে এখন? রুম সার্ভিস তো ডাকি নি। স্বাদের চায়ের পেয়ালা নামিয়ে দরজার কাছে খানিক দাঁড়িয়ে থাকলাম। না আর শোনা যাচ্ছে না। শুনতে ভুল করলাম নাকি?
রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম, যেদিক যেতে চায় সেদিকেই ছুটবো। রিসেপশন দেখে একটু থামলাম, না করবো না ফোন। মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই। লাইনটা কি ঠিক হলো? আমি কি আসলেই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন? এখানে আশেপাশে সব জায়গায় তো মানুষ। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মানুষকেই তো ডাকছি। এই যেমন এখন হলুদ ক্যাব ডাকলাম গঙ্গা ঘাটে যাওয়ার জন্য। আসলে আমি পরিচিত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই। মানুষ বলতে আমরা হয়ত আপনজনদেরই বুঝি।
উঠার আগে আরও একটা পার্থক্য দেখি। এক প্যাকেট সিগারেট কিনি কোন রকম সংকোচ ছাড়া। “মেয়ে সিগারেট কিনছে? ইয়াল্লাহ! কি নষ্ট মেয়েছেলে!” না এমন কোন কুৎসিত দৃষ্টি আশেপাশে দেখি নি । খানিক মুচকি হেসে প্যাকেট থেকে একটা বের করে ধরালামও। অভ্যাস বশত এদিক ওদিক তাকাচ্ছি দেখার জন্য কেউ ক্ষেপে গেলো কিনা! আরে ক্ষপবে কি, ওই তো সামনের লেনে দুইটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, একজনের হাতে সিগারেট। পরনে স্লিভলেস কুর্তি আর শর্টস।
গঙ্গা ঘাট মোটেও কোন শান্ত জায়গা না, তবুও আমার ভাল লাগে। হাজার মানুষের স্নান, পূজা দেখে দেখে সময় কেটে যায়। কতশত নরনারী সবাই একসাথে শুদ্ধি হচ্ছে । জল, সে তো বিভেদ মানে না কিছুর। এখানে যেই নামবে তাকেই সে গ্রহণ করবে। মানুষও যদি জলের মত হতো তবে কত সরলই না হত জগত। কিন্তু সবাই জলের মত হতে পারে না।
এই যেমন আমি, জলের মত সবাইকে গ্রহণ করলাম, ফেরত পেলাম কী? অপমান। মাঝে মাঝে সমুদ্রের মতও হতে হয়। ইচ্ছে মত গ্রহণ করবে আবার ইচ্ছে মত ছুঁড়ে ফেলে দিবে।
চোখ বুজি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বুক ভরে শ্বাস নেই, শ্বাস ছাড়ি। এই জীবন কারও জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া কি ঠিক? নিজেকে ভালবেসেও তো বেঁচে থাকা যায়? এই যে প্রকৃতির কাছে এসেছি, ঘ্রাণ নিচ্ছি, আদর নিচ্ছি, সময় নিচ্ছি এ নিয়ে তো সুখী থাকা যায়। হ্যাঁ যায়। তবু মন কেন মানুষের ভালোবাসা চায়, প্রেম চায়, গভীর আলিঙ্গন চায়, বদ্ধ চুমু চায়, সোহাগে ভরা কাঁধ চায়? কি জানি। হয়তো এই চাওয়া, চেয়ে যাওয়া, চেয়ে চেয়ে না পাওয়া, না পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষের ধর্ম, স্বভাব, প্রকৃতি।
সন্ধ্যা নামে, ঘুমও নামে। সোজা সেই লিকারের দোকানে নামলাম। ‘জ্যাক ডেনিয়াল আছে’।
দেখো কত সোজা। কেউ কিচ্ছু ভাবে নি । ওই ছেলেটিও যেমন নিয়েছে আমিও নিয়েছি। এখানে কেউ কাউকে পাত্তা দিয়ে চলে না।
রুমে ফিরে গ্লাস ভরাই। টিভি ছাড়ি। অহেতুক কিছু নরনারী নাচানাচি ছাড়া কিছু পাই না দেখার। পরপর কয়েক পেগ গিলে এখন হালকা হালকা লাগছে।
ঐ যে জানালা দিয়ে কয়েকটা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। একটা বারান্দায় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে একটি পরিবার খেতে বসেছে। বারান্দায় খায় নাকি? একটি মহিলা একটি পুরুষ আর একটি ছোকরা। হয়ত তাদের ছেলে। খাচ্ছে, মহিলাটি কিচ্ছুক্ষণ পরপর উঠে যাচ্ছে এটা সেটা আনতে। একটি পরিবার। একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। প্রতিটা জানলায় একেকটা গল্প। একেক পরিবারের একেক মানুষের একেক কাহিনী। প্রতিটা কাহিনীর একটি সারমর্ম। সুখের খোঁজ। শান্তির খোঁজ। নিজ আঙ্গিনায় নিজ ঘরে নিজ পরিবেশে সুখী হওয়ার অক্লান্তিকর চেষ্টা।
আচ্ছা সুখটা কী? কাকে বলে? এই যেমন আমি এখানে একা নিঃসঙ্গ মদ্যপান করে যাচ্ছি আমি তো কোনো দুঃখ পাচ্ছি না। আবার আমি যখন ফিরে যাবো চিরচেনা পরিবেশে তখন ঠিকই মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকবে। তাহলে সুখে থাকা কীসের উপর নির্ভর করে? পরিবেশের উপর? না মনের উপর না মানুষের উপর? নিজের ঘরে নিজের আপন মানুষের সাথে থেকেও আমি সুখ পাই নি। সে কি মনের কারণে না? এই যে এখন কেউ নেই, কোন পরিচিত চেহারা নেই। তবু তো ভাল লাগছে। শান্তি লাগছে। নিজের সাথে নিজের কি মধুর মিলন ঘটাচ্ছি। কই কোনও কিছুর অভাব তো বোধ করছি না। বরং নিজের সঙ্গই উপভোগ করছি। একেই হয়ত বলে আত্তপ্রেম।
রাত বাড়ছে । চারিদিক নিশ্চুপ থেকে নিশ্চুপতর হচ্ছে। আলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিভে যাচ্ছে চোখের পাতাও ।
“নক নক”
ধক করে উঠে বুক। এত রাতে কে ধাক্কাবে দরজা। আশ্চর্য তো।
কে?
নক নক
ভয়ে হিম হয়ে গেলাম। যা নেশা হয়েছিল কেটে গেছে এক ধাক্কাতেই।
কে?
আর হচ্ছে না শব্দ। সেই অবস্থায় রাত পার করে দিলাম । রিসেপশনে যে ফোন করে জানানো যেত সেটাও বেমালুম ভুলে গেলাম। ভয়ে ভয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাই নি।
সকাল বলতে প্রায় দুপুরে উঠে রেডি হয়ে বের হলাম ঠাকুরবাড়ি যাবো বলে। দরজা লাগিয়ে লিফটের কাছে আসতেই এক মহিলা দেখলাম ৫/৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট মেয়েটির চোখে কাল চশমা হাতে চকলেট।
মহিলা তাকাল আমার দিকে যেন কিছু বলতে চায়। একটি সৌজন্যমূলক হাসি দিলাম। দুজনেই ওহ তিনজনই একসাথে লিফটে উঠলাম। মহিলাটি উশখুশ করেই যাচ্ছে। ব্যাপার কি?
“কিছু মনে করবেন না, আপনার দরজায় কাল রাতে আমার মেয়ে টোকা দিচ্ছিল। হয়তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই আর জাগায় নি আপনাকে। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত”
“আপনার মেয়ে? আপনার মেয়ে আমার দরজায় টোকা দিবে কেন?”
“ও আসলে জন্মান্ধ। কোনভাবে বাইরে চলে গেলে সব জায়গায় টোকা দিয়ে বেড়ায় নিজের দরজা চেনার জন্য”
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। কি সুন্দর গোল গোল চেহারা। কি আরাম করেই না চকলেট খাচ্ছে। এই মেয়ে চোখে দেখে না? সে দেখবে না কোনোদিন প্রকৃতির স্বাদ রূপ গন্ধ?
“আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না”
“ না না আমি কিছু মনে করি নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই বুঝতে পারি নি”
নিচ তলায় এসে মহিলাটি মেয়ের হাত ধরে নেমে গেল। আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিচ্ছুক্ষণ ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
কি অদ্ভুত ! কি বোধগম্যহীন প্রকৃতির কাজকারবার! এই মেয়েটি একদিন বড় হবে কিন্তু কোনদিন একাকীত্ব উপভোগ করতে পারবে না। কোনদিন যদি হারিয়ে যেতে চায় নিজের সাথে নিজে পারবে না কিছু অনুভব করতে। পারবেই না কোথাও যেতে একা একা । অথবা কে জানে যারা জন্ম থেকেই একাকীত্ব নিয়ে জন্মায় তাদের নতুন করে একাকীত্ব জানতে হয় না বুঝতে হয় না শিখতে হয় না। উপভোগ করতে হয় না। কে জানে!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..