প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
তামাচা ওঠ তামাচা ওঠ! আর কতো ঘুমাবি ? ধরফর করে বিছানার মধ্যে উঠে বসে তমসা। তার প্রিয় পঞ্চুর গলা। একটু ধাতস্থ হয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় চোখ রাখে। বারান্দা বলতে ফ্ল্যাট বাড়ীর তিন ফুট বাই আট ফুটের ছোট এক চিলতে ব্যালকোনি। তমসার ওই টুকুই মন ভালো করার জায়গা। গ্রিলের রেলিংয়ে বোতলে টুকটাক গাছ আর খাঁচায় তার আদরের পঞ্চু – তমসার টিয়া পাখি। তমসা ও যেমন বকবক করে পঞ্চুও শিখেছে একই রকম বকবক করা। খাঁচার কাছে গিয়ে তমসা বলে – দিলি তো আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে, তোর জ্বালায় দুদন্ড ঘুমানের জো নেই। জো কথাটা তমসার ঠাকুমার কাছ থেকে শেখা। ঠাকুমা এমন বহু ছোট শব্দ বলতেন যা আজকাল শোনা যায়না। তমসা পঞ্চুকে একটু ছোলা ভেজানো খেতে দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। গলাটা শুকিয়ে আসছে, একটু জল খায়। কেমন একটা দম বন্ধ অবস্থা এই ঘরে। একে তো ফ্ল্যাট কালচারে বন্ধ দরজার মধ্যে ভদ্রতা রক্ষার দায় তার উপরে আজ দশদিন নিজেদের ঘরের বাইরে পা রাখেনি তমসা। এটাই নাকি বর্তমান সময়ের নিয়ম। রোগের এমন নিয়ম এই জন্মে প্রথম শুনছে। অথচ তারতো কোনো রোগই হয়নি। মার্চ মাসের প্রথমে একটা পরীক্ষা দিতে তমসা ও তার চার বন্ধু দিল্লীতে গিয়েছিল। যাওয়া আসা মিলে পাঁচ দিনের ব্যাপার। ফিরে এসেই পড়ল মহা ঝামেলায়। পঞ্চুর উচ্চারনের ”তামাচা” যেন গালে এসে পড়ল।
সেদিন শুক্রবার ছিল সম্ভবত। আগের দিন রাতেই তমসা ফিরেছে।
হঠাৎ সকাল হতেই ফ্ল্যাটের অন্যান্য আবাসিক থেকে শুরু করে আশেপাশের মানুষ দরজার বাইরে ভীড় করতে শুরু করে। যেন সাংঘাতিক কোনো খুনের আসামীকে দেখতে এবং তাকে বাড়ী থেকে উৎখাত করতে কোমড় বেঁধে এসেছে। তমসা প্রথমে বুঝতে পারছিলনা সমস্যাটা কোথায়। তমসার বাবা এমন অপমানের শিকার বোধহয় জীবনে কখনো হননি। যে যা পারছে সেই ভাষায় প্রদীপ্ত বাবুকে আক্রমন করছে। কেন মেয়েকে বাড়ীতে তুলেছেন, আপনারা তো সমাজের শিক্ষিত মানুষ। আপনাদের এই সাধারণ জ্ঞানটুকু নেই যে এই মুহুর্তে বাইরে থেকে ট্রেন বা বাসে করে এলে তাকে সোজা হাসপাতালে যেতে হবে। আগে টেস্ট করাতে হবে। আর তারপর তাকে কমপক্ষে চোদ্দ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আর আপনারা তাঁকে সোজা বাড়িতে এনে তুললেন? আপনার ও আপনার মেয়ের ভুলের জন্য আমরা মরতে পারবনা।
প্রদীপ্ত বাবু ঠান্ডা মাথায় সব শুনছিলেন। তারপর বললেন মেয়েকে কোথায় রাখব আমি? ও তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুস্থ, মাত্র পাঁচদিন বাইরে ছিল। অতোশত শুনতে চাইনা বলে চেঁচিয়ে উঠলেন ঠিক উল্টো দিকের দরজার অবিনাশ কাকু। যাদের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়র মতো ঘনিষ্ঠতা আমাদের। যবে থেকে এই ফ্ল্যাটে এসেছি তবে থেকে। কোনওদিন অবিনাশ কাকুদের পরিবারকে বাইরের লোক ভাবেনি তমসারা। তাঁর কাছ থেকে এমন কথা শুনে বিস্মিত হয় তমসা।
এতক্ষনে তমসা বলে – কি চান তাহলে আপনারা? উপস্থিত সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে বলে, তুমি চোদ্দ দিন কোন হোটেলে গিয়ে থাকবে, এখানে আসবেনা আর সবাই টেস্ট করিয়ে নেবে তোমরা। তমসা বলে যদিও জানি আমি সুস্থ তবুও আপনাদের শান্তি দিতে টেস্ট করাব আমরা কিন্তু আমি কোথাও গিয়ে থাকবনা। এই বলা মাত্র বাইরের শোরগোল চরমতম সীমায় পৌঁছে যায়। ওনারা বলতে থাকে – আমরা কিন্তু থানা পুলিশ করব, মিডিয়া ডাকব, কাউন্সিলরকেও জানাব। তমসা বাবাকে ভেতরে যেতে বলে নিজেই বিক্ষোভকারীরাদের উদ্দেশ্যে বলে যা মন চায় করুন। তমসা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে টেস্ট করে আসে। মা আর যেতে রাজি হননি। ফেরার সময় টুকটাক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে যাওয়াতে বাবার পেনশনটা তোলা হয়না। একে তো তমসার মা ঘরে একা তাও আবার বিক্ষোভের মুখে। বাড়ি ফিরে আসতেই পুনরায় কিছু লোকজন ঘিরে ধরে ও বলে আজ থেকে চোদ্দ/ পনেরো দিন আপনারা ঘরের দরজার বাইরে পা রাখবেন না, বলে একটা লাল আঠাযুক্ত টেপ দরজার ওপাশ থেকে এপাশে লাগিয়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় তমসাদের তমসাচ্ছন্ন গৃহবন্দি যাপন বা বর্তমান সময়ের নতুন ও বিশেষ শব্দ কোয়ারেন্টাইন। ডিকশনারিতে কোন সময় দেখে থাকলেও এখন এর যথার্থ অর্থ বোঝার সময় এসেছে।
এইভাবে চলতে থাকে হোম কোয়ারেন্টাইন বা অন্তরীন যাপন। তিনজন মানুষের মানসিক ও সামাজিক লড়াই জীবাণু ও দুপেয়ে জীবদের সাথে। ধিরে ধিরে ঘরে থাকা সবজি, মাছ, দুধ, বিস্কুট, আটা নিত্যদিনের রসদ ফুরিয়ে আসে। প্রদীপ্ত বাবু সাধারণত প্রতি মাসের সাত/আট তারিখে পেনশন তোলেন ও মাসকাবারির বাজার সাড়েন। এবার তো সাত তারিখে দুর্যোগ দরজায় এসে ধাক্কা মেরেছে এমন যে মাসকাবারি ওষুধ কিছুই আনা হয়নি। প্রদীপ্ত বাবু সুগার ও হার্টের পেশেন্ট। যা ওষুধ আছে তাতে দিন সাতেক চলতে পারে। তমসার মা সাধারণ গৃহবধু, সংসারজীবন নিয়েই আছেন। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে কিছু করতে পারেননা শুধু ভেতরে ভেতরে চিন্তা করতে করতে মাইগ্রেইনের ব্যাথাকে আশ্রয় দেন। তমসা সব মিলিয়ে নাজেহাল। কি করবে বুঝতে পারেনা। বন্ধুদের যে বলবে কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে যেতে, তো এরা ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে দেবেনা। রাস্তার ধারে ফ্ল্যাট হওয়ায় বারান্দা দিয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে দুদিন অল্প সবজি ও মাছ কিনেছিল। কিন্তু বিস্কুট,দুধ, মুড়ি, ওষুধ আনা যায়নি। অনলাইনেও অর্ডার করা সম্ভব নয়। আজ প্রায় দশদিন হয়ে গেল এই অবস্থা চলছে। গতমাসের একটু চিড়া, ছাতু, ম্যাগী, ডাল ছিল। তা দিয়েই কদিন কোনমতে চলেছে। দুদিন চালে ডালে আলু ভাতে দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে। এখনতো একদম ভান্ডার শূন্য। এখনো চা——র দিন। যদিও তিনদিন আগে ওদের টেস্ট রিপোর্ট চলে এসেছে নেগেটিভ। তবুও অশান্তির ভয়ে তমসারা বাকি ছদিন ও দরজা বন্ধ রাখবে ভেবেছিল।
আজ আর সহ্য হচ্ছেনা। বাবার ওষুধ ও নেই,
দুধ নেই চিনি শেষ এমনকি একটু আটা পর্যন্ত নেই। অনেকক্ষণ ভেবেটেবে তমসা অনলাইনে কিছু জিনিস অর্ডার করে বসে ও মাসকাবারির দোকানে ফোন করে কিছু জিনিস পাঠিয়ে দিতে বলে। তারপর ঘরে বসে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যেই পঞ্চু “তামাচা ওঠ তামাচা ওঠ ” চিৎকার করে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল।
তামাচা মনে মনে বলে পঞ্চু তোর এই তামাচা কত জোরে গালে এসে লেগেছে দেখলি তো!
হঠাৎ দশদিন পরে আজ কলিং বেলের শব্দ। তমসা বাবা মা কে খুলতে না দিয়ে নিজেই দরজা খোলে। দেখে পাড়ার মাসকাবারির দোকানের ছেলেটা মালপত্র নিয়ে এসেছে ও উল্টো দিকের অবিনাশ কাকুরা নিচের তলার দুই পরিবার ও ওপরের তলার দুই পরিবার একসাথে জড়ো হয়ে ছেলেটাকে বকাবকি করছে কেন এখানে এসেছে।
তমসা বেরিয়ে এইসব দেখে বলে কি হয়েছে? এখানে এতো ভীড় কেন?
অবিনাশ কাকু বলে “তোর এতো সাহস তুই দরজা খুলেছিস আবার মালপত্র আনতে বলেছিস”? তমসা বলে হ্যাঁ বলেছি। তাতে তোমাদের কি অসুবিধা হয়েছে? উনি বলেন – বড়োদের মুখে মুখে কথা বলছিস, এতো বড়ো হয়ে গিয়েছিস তুই?
হ্যাঁ বলছি! বড়রা যখন বড়দের বিবেক বোধ চেতনা সম্পর্ককে হারিয়ে নিজেদের চরিত্র তুলে ধরে তখন সেই বড়দের সম্মান রক্ষার দায় আমার নেই। আজ দশদিন হলো আমরা ঘরে। তোমরা ফোন করে খোঁজ নিয়েছ আমরা কেমন আছি, কি খাচ্ছি, বাবার ওষুধ লাগবে কিনা! কেউ বলেছ যে ওষুধ এনে তোদের দরজায় ঝুলিয়ে দেব তোরা একটু দরজা খুলে নিয়ে নিস! কেউ না। আজ তিনদিন হলো আমাদের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে, তাও আমরা তোমাদের মতো অভদ্র মানুষের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে চাইনি তাই বের হইনি। এখন নিরুপায় হয়ে দরজা খুলেছি, মালপত্রের অর্ডার দিয়েছি। এইবলে তমসা মোবাইল এনে তাদের রিপোর্ট দেখালে আস্তে আস্তে ভীড় খালি হয়।
সব নিজেদের মধ্যে তমসার ব্যবহারের নিন্দা করতে করতে চলে যায়। তমসা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে খাঁচা খুলে পঞ্চুকে বের করে দেয়।বলে পঞ্চু তোকে সারাজীবনে আর কোয়ারেন্টাইনে রাখবনা। আজ থেকে তুই উড়বি খোলা আকাশে। তারপর তমসা ঘরে কম্পিউটার টেবিলের সামনে বসে মেইল চেক করতে। পঞ্চু টুকটুক করে এসে টেবিলে বসে তমসার হাতে ঠোট ঘষতে থাকে। বলে তামাচা কোয়ান্তাইন কোয়ান্তাইন। তমসা পঞ্চুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে কোয়ারেন্টাইনের সমাপ্তি ঘোষনা করে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..