ক্যাথরিন গ্রোস-এর এপিটাফ

সৈয়দ মাহমুদ
ছোটগল্প
Bengali
ক্যাথরিন গ্রোস-এর এপিটাফ

ক্যাথরিন গ্রোস-এর গল্পটা তোমাকে বলা হয়নি আগে। সহসা গতকাল রাতে ওর ফোন কলে আমার আধো ঘুম-আধো জাগরণ টুটে গেল। ক্যাথরিন এখন আটলান্টায় তার নিজের বাড়ীর আঙ্গিনায় কত গুলো ম্যাপল গাছ, হলি ফুল আর পাখি দেখে সময় কাটিয়ে দেয়। প্রকৃতির প্রাণ প্রাচুর্য্যে ভরা ওর বাগান বাড়ীর আঙ্গিনা উইন্টারে ৯ সেঃ মিঃ তুষার আবৃত হয়ে যায়। স্নো-ফলের অলস দিন গুলোতে সে নাকি আমাকে ফোন করে সান্নিধ্য নেবার কথা ভাবে। কিন্তু তোমার সাথে আমার বন্ধনের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিয়েও যোগাযোগে বিরত থাকে, ক্যাথরিন এমনই। ও বাংলাকে ভাল বেসেছিল, জীবনানন্দকে ভাল বেসেছিল।

প্রিয় কবির জন্মভূমি-শিক্ষালয় সব খানেই ক্যাথরিন ঘুরে বেড়িয়েছে। আপন চোখে সে দেখতে চেয়েছে অশত্থের ছায়া, জলসিড়ি নদীর কল্লোল, মালয় সাগরের ঢেউয়ের মমতা আর নির্জন অঘ্রাণের বিষন্ন রূপ।বলতে গেলে কবির কবিতার প্রেমেই ছুটে এসেছিল সে। ক্যাথরিন নিজেকে বনলতা সেন ভাবতে ভালবাসত। ককেশীয় শাদা নারী তার গায়ের রংটা রোদে পুড়ে তামাটে করতে সচেষ্ট ছিল আর লম্বাটে পিঙ্গল চুল নিমিশেই কালো করে ফেলেছিল। ওর নীলাভ চোখ জোড়া পাখির নীড়ের মতোই ছিল নিরাপদ আশ্রয়। তবুও গভীর কালো চোখের অধিকারী নয় বলে তার আক্ষেপের সীমা ছিল না।

ক্যাথরিন আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল কিংবা তার’চে কিছু বেশী। তোমার সাথে আমার বন্ধনের কথাটা সে জানত না বলে তার সেই ভাবনার জন্য ভীষণ লজ্জিত হয়েছিল। আমার কাছে ক্ষমা চাইতেও এতটুকু দ্বিধা করেনি, ক্যাথরিন এমনই। চলে যাওয়ার সময় বলে গেছে অনেক দূরে থেকেও শুধু বন্ধুত্বের অনুভব নিয়েই জীবন পাড়ি দিতে চায় সে। গত সামারে তার বাড়ীর ছাদের উপর থেকে এক পূর্ণিমা রাতে চাঁদের কিছু ছবি পাঠিয়ে বলেছিল, “দেখ তো ধানসিড়ি নদীর উপরের চাঁদের মতো মনে হয় কি না!” ক্যাথেরিনের নিঃসঙ্গতার বিকেল গুলো দীর্ঘশ্বাসের মতোই দীর্ঘ, আর রাত- সে তো গহীণ বনের ভিতর নিরন্তর হেঁটে চলা, শেষটা জানা নেই। তবুও সে একাকীত্বকেই বরণ করে নিয়েছে।

কাল রাতে ফোনটা রিসিভ করার আগে ভেবেছিলাম এটা নিশ্চয়ই তুমি, যে কিনা আমার আধো ঘুমন্ত রাত শেষের স্নিগ্ধ ভোর। ভেবেছিলাম, যে শব্দ যুগল ইথারে ভেসে বেড়ায়, সে বুঝি আজ মুঠো ফোনে বন্দী হয়ে তোমার কন্ঠস্বর হবে-জানতে চাইবে, “ভাল আছ?” কিন্তু মুঠোফোনে ওদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থেকেই গেল। কত বার মনে মনে ভেবেছি হয়ত কোনো একদিন এভাবেই তুমি আমার সমগ্র সত্বাকে নাড়িয়ে দেবে। তুমি তো আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছ, যা ছিন্ন করবার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। তবে কেন আমার আধো ঘুম-আধো জাগরণের মাঝে ক্যাথরিনের মতো করে একটি বার জাগালেনা!

বন্ধুত্বের চেয়ে বেশী কিছু চাইলে কেন পাবে না, তা জানার পর থেকে এই নীল নয়না তোমাকে ঈর্ষা করতো। তাই কখনো তোমার কথা জানতে চায়নি, কিন্ত কাল জানতে চাইল। আমি কিন্তু এবার তোমার কথা বলেছি। বলেছি, তুমি সব সময় ভাল থাক, শুভ্রতা নষ্ট হবে ভেবে তোমাকে কখনো স্পর্শ করিনি আমি। ক্যাথরিনের কন্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে, জানতে চায়, “সেও কি সম্ভব?“ আমি বলেছি, তুমি যে আমার যন্ত্রণা ক্লিষ্ট নিশি অবসানের পর বিন্দু বিন্দু ভোরের শিশির, যাকে স্পর্শ করতে নেই।

ক্যাথরিন গ্রোস-এর গল্পের শেষটা এবার তোমাকে বলব। সে বলতে চেয়েছে জর্জিয়ার আটলান্টা এয়ারপোর্ট থেকে সোয়াইন্সবরোতে গামলগ রোডে তার বাড়ীর রাস্তাটা বেশ সহজে চেনা যাবে। ফোনে আরও সহজ করে সে আমাকে চিনিয়ে দিল। আমি যেন এখান থেকেই সারি সারি হিকোরী গাছের ছায়া ঘেরা ওর বাড়ীর রাস্তাটা ঠিক চিনতে পাচ্ছি। ক্যাথরিন বলছিল ওর কফিনে পেরেক ঠোকার আগেই যদি আমি উপস্থিত হতে পারি তবে সে নাকি ওপারে গিয়ে পরম শান্তিতে বসবাস করবে। আর যদি আমার পক্ষে এটি করা সম্ভব না হয়, তবে যেন জীবনে কোনো একদিন তার সমাধির উপর একটি আধ ফোটা কুঁড়ি রেখে আসি। সমাধিটা তার নিজ বাড়ীতেই হবে। যদি আমার যাওয়ার সময়টা স্নো-ফলের সময় হয়, তুষারে যদি সমাধিটা ঢেকে যায় তাই এপিটাফটাকে সে একটু উঁচু করতে বলবে। আর জীবনানন্দের লেখা আমার প্রিয় একটি কবিতার চারটে লাইন তাকে জানাতে বলেছে, যা তার এপিটাফে লিখতে বলে যাবে। অমি এখন সেই চারটে লাইন খুঁজে ফিরছি।

সৈয়দ মাহমুদ। কবি ও গল্পকার। উত্তর জনপদের এক ছোট শহর গাইবান্ধায় জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে। ছোট বেলা থেকেই কিছুটা বোহেমিয়ান সৈয়দ মাহমুদ বেড়ে ওঠেন অনেকটা রক্ষণশীল পরিবারে। শৈশব থেকেই প্রকৃতি তাকে টানতো। বিরাণ প্রান্তরে, সারি সারি বৃক্ষের ছায়ায় হাঁটতে কিংবা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ