ক্যারোলিনা

জাকিয়া শিমু
ছোটগল্প
Bengali
ক্যারোলিনা

ভেনেজুয়েলার শান্ত শ্যামল ছোট্ট গ্রাম- কঙ্গো মিরাডর। গ্রামের একধারে বয়ে চলেছে শান্তধারায় স্বচ্ছজলের হ্রদ। বাকি তিনধারে বিস্তীর্ণ সবুজ খোলাপ্রান্তর। উন্মুক্ত খোলা আসমানজুড়ে ক্ষণে ক্ষণে মেঘমালাদের রঙ বদলের হিরিক। গ্রামের মানুষগুলোর জীবনধারণ সহজ – সরল – শান্ত বয়ে চলা শান্তজলের হ্রদের মতো। সেই ছবির মতো গ্রামে আমার জন্ম। বাবা আদর করে নাম রাখলেন- ক্যারোলিনা। আমার শৈশবের বেড়ে ওঠাও সেই ছবির গ্রাম কঙ্গো মিরাডরে। শান্ত জলের ধারে নিরিবিলিতে কাটছিল আমাদের জীবন। আমার বয়েস তখন পাঁচ-ছয়ের মাঝামাঝি। হটাতই রূপ পরিবর্তন হয়ে যায় জলের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর ভ্যানিসখ্যাত আমার গ্রামটির। ধীর গতিতে সবুজ সোনার গ্রামটি আমার তলিয়ে যেতে শুরু করে কাদামাটির গহীন গহ্বরে !

 আস্তে ধীরে কাতাতুম্বা নদীর স্রোতের সাথে বয়ে আসা কাদামাটিতে ঢাকা পড়ে যায় গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ স্থান। একান্নবর্তী পরিবারের মতো বিশাল একবৃক্ষ হয়ে বাস করা একেকটি পরিবার, বৃক্ষের শাখা ছিন্ন করে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। মাত্র গোটাদশেক পরিবার মাটি কামড়ে পড়ে থাকে চোখেমুখে একপাহাড় আতঙ্ক নিয়ে। তারপরও বুকজুড়ে আশার স্বপ্নরা রয়ে যায়। এক সময় আবার ফিরে পাবো আমাদের সবুজগ্রাম, গ্রামের প্রাণচাঞ্চল্য, স্বচ্ছ হ্রদের জলধারা। সবুজ সমুদ্রে বসত গড়বে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মরা। কিন্তু ক্রমশ সে স্বপ্নগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়। স্রোতের ধারার তীব্রতা বাড়ে শতগুনে। চলে যায় গ্যাস, বিদ্যুত ব্যবস্থা। এমনকি একমাত্র স্বাস্থ্যসেবার ক্লিনিকটিও তলিয়ে যায় কাদামাটির স্তূপে।

আমার জীবনের সবচাইতে কষ্টের দিন ২০১৬ সালের ২১ জুন। আমরা আমাদের উত্তর প্রজন্মের শত শত বছরের নাড়ির বাঁধন ছিন্ন করে চলে আসি পুয়েত্রো কোঞ্চায়, আমার নানার বাড়ি। আমার ৬২ বছর বয়সী দাদু অবশ্য কোনোভাবেই বাস্তুভিটা ছেড়ে আসতে রাজি নন। তার সাতপুরুষের পদচিহ্ন পড়ে আছে এই গ্রামে। শত বাঁধায় তা ছিন্ন হবার নয়। দাদুসহ হাতেগোনা গুটিকতক মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রইলেন কঙ্গো- মিরাডরে। দাদু দিনরাত পরিশ্রম করে কাদামাটি সরিয়ে ছোট্ট একটা সরু পথ তৈরি করেন, যাতে থেকে যাওয়া মানুষগুলো নৌকো দিয়ে কোনোমতে যাতায়াত করতে পারে। মৃত্যুর শেষক্ষণ পর্যন্ত নিজের গ্রামকে শেষ হতে, হেরে যেতে দিতে রাজি নন দাদু।

নানাবাড়ির দিনগুলোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেও সুখকর নয়। ধীরে ধীরে আমার কাঁছে অসহনীয় দুর্বিষহ হয়ে উঠে। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশে আমি হাঁপিয়ে ওঠি। বাবা মাসদুয়েক পর পাড়ি জমান উত্তর আমেরিকায়। দাদুর জন্য আমার মন কেমন কেমন করত। কঙ্গো মিরাডর ছেড়ে চলে আসার সময় দাদুর চোখে জল দেখিনি। তার দৃঢ়চেতা মনোবল ফুঁসে উঠেছিল সেদিন, চোখজোড়া ভরা এক আসমান স্বপ্ন ঝলমল করছিল। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে ভরসা দিয়ে বলেছেন, শীঘ্রই আমাদের আবার দেখা হবে শান্ত সবুজ কঙ্গো মিরাডরে। জলপথে মাত্র ঘণ্টা চারেকের পথ নানা বাড়ি থেকে দাদুর কঙ্গো মিরাডর। তারপরও আমাদের আর কখনও সাক্ষাত হয় নাই।

বাবা চলে আসার বছরদুয়েক পর মা, আমি আর আমার ছোটো ভাই অবৈধ পথ ধরে উত্তর আমেরিকায় চলে আসি। ভেনেজুয়েলা থেকে আমরা মৃত্যুপথে বিশাল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে টেক্সাসে, বাবার কাঁছে ফিরি। বাবা ! আমার জীবনের প্রায় পুরো অংশটাই জুড়ে আছেন। দু’বছর বাবাকে ছেড়ে ভীষণ কষ্টের সময়গুলো বয়ে নিয়েছি। বাবাকে আবার খুব কাছের করে, একান্ত করে পাবো- এমন কতশত ভাবনা আর অনুরণে বুঁদ হয়ে আছে আমার মানসজগত। অনিশ্চিত সেই যাত্রা পথের আতঙ্ক এবং কষ্টটা বাবাকে ছুঁতে পারব এই স্বপ্ন ছিল বলেই বোধহয় সইতে পেরেছি। কিন্তু সব স্বপ্নতো সুখের হয় না, দুঃস্বপ্নও হয়, তা মেনে নেয়ার বয়েসে অবশ্য তখন অবধি পৌঁছাতে পারিনি। যদিও আমি খুব অল্প বয়েসে জীবনের অযাচিত ভাঙ্গাগড়ার খেলা দেখেছি। একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে আরেকটা স্বপ্নে খুঁজে বেরিয়েছি জীবনবোধের স্বাদ। স্থায়িত্ব যদিও খুব কম ছিলো কিন্তু স্বপ্ন দেখার শক্তি ঢের বেশি ছিল। একটা মানুষ যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সে ভিন্ন মানুষ হয়ে  ঘরে ফিরে আসে। আগের সে মানুষটা সময়ের ফেরে হারিয়ে যায়। বাবার কাঁছে ফিরে এসে এ চরম সত্যের সাক্ষাত পেলাম শতভাগ !

অধিক বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাসকে গলাটিপে হত্যা করে। মায়ের ছিলো বাবার প্রতি অগাধবিশ্বাস। মায়ের, তার নিজের চেয়েও বাবার প্রতি বিশ্বাস এবং ভরসা ছিল বেশি। কঙ্গো মিরাডরের দু’কামরার সেই সংসারটার মতো শান্ত শ্রান্ত নির্ঝঞ্ঝাট একটা সংসার উত্তর আমেরিকায় সাঁজিয়ে আমাদের জন্য অধীর অপেক্ষায় বাবা বসে আছেন, মায়ের ভাবনায় এমনটাই ছিল। মা বিশ্বাস করতে পারেন না, সাপের পুরানো খোলসের মতো সেই জীবনটা বাবা কবর দিয়ে এসেছেন কঙ্গো মিরাডরের কাদামাটির স্তূপে। বাবার সে জীবন সেখানেই সমাধিস্থ হয়েছে। শুধু মা নয়, আমাদেরও সেই একই বিশ্বাস এবং স্বপ্ন ছিল। দুবছর সময়ের ব্যবধানে আমাদের সুখের স্বপ্নগুলো শ্যাওলার মতো ভেসে গেছে অজানা অচেনায়, তারপর আমরাও বাবার কাছে অপাংক্তেয় হয়েছি।

বাবার ঘরে যখন পৌছি, তখন বাবার আরেক সংসারের মানুষগুলো ঘরে ছিল না। কিন্তু তাঁদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আমাদের জানিয়ে দেয়, আমরা এখানে স্থায়ী নই, ভাসমান কচুরিপানার মতো ! আমাদের শতকোটি সুখ ভাবনারা মুহূর্তে ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়। জলমগ্ন মানুষ যেমন ডুবে যাওয়ার সময় হাতের কাঁছে খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, আমরা ঠিক তেমন করে একটু আশ্রয় পেতে বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি। মা, ঘরে ঢুকে নির্বাক হয়ে যান। মা হয়তো সংসারের কূটচালটা সব হারিয়ে শেষমেশ ঠিক-ই তখনই বুঝতে পারেন; সংসার টিকিয়ে রাখতে বিদ্যাবুদ্ধি রূপগুনের চাইতে ঘ্রানশক্তিটা বড়ো বেশি প্রয়োজন হয় ! কিন্তু ততক্ষণে বেলা বয়ে গেছে বহুদূর।

বাবা খুব স্বাভাবিক এবং আয়েশি ভাবভঙ্গি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো। আমাদের মনের আকাশে তোলপাড় করা ভাবাবেগ তৈরি হলেও বাবাকে কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করি না। নতুন দেশ, অজানা পাহাড়। ভাষা বুঝি না, পথঘাট চিনি না। আমাদের ফিরে যাওয়ার পথ খোলা থাকে না। দেশে আমাদের ঠিকানা নেই। আমরা বাস্তুহারা, আমাদের বসতবাড়ি, সুখস্বপ্ন সবটাই দখল করেছে দূর দেশের কাদামাটির ঢল। আমরা খুব সহজে ভাসমান কচুরিপানা হয়ে ভেসে বেড়াই। সময়ে-অসময়ে যিনি আমাদের স্বস্তির, শক্তির, সাহসের আশ্রয় ছিলেন তিনি আমাদের বাবা কিন্তু সময়ের ফেরে ভিনদেশে এসে তিনিই এখন আমাদের দুঃখকষ্টের মূলকেন্দ্র হয়ে উঠেন।

বাবা খুব ভোরে কাজে চলে যান। আমি সারাদিন ছোটোভাইকে নিয়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরেফিরে দিন পাড়ি দিই। মা জানালার পাঁশে বসে আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মায়ের এমন বিধ্বস্ত দশা আমাদের কাছে বড়ো অচেনা ঠেকে। মায়ের হরিণীর মতোন চঞ্চল চোখজোড়ায় রাজ্যের ঘনকালো মেঘের ছাইবর্ণ ভর করে। বড়ো বিষণ্ণ অচেনা লাগে মায়ের সদা হাসিখুশি মুখটা । বাবা খুব কম সময়ের জন্যে রাতে বাড়ি ফিরেন। আমাদের অবশ্য থাকা খাওয়ার অব্যবস্থায় রাখেন না। নানা বাড়ির সময়গুলোতে আমরা খুব কষ্টে ছিলাম। খাওয়াপরার অভাব ছিলো কিন্তু এতোটা অনিশ্চিয়তা,অসহায়বোধ করিনি কখনও।

সময়ের ঝড়কে ঠেকাবার আশ্চর্য কৌশল সৃষ্টিকর্তা মানুষের হাতে দেননি। ঝড়ের তাণ্ডবে বাবা পুরোটাই বদলে গেছেন। কেউ বদলে গেলে তাঁকে আগলে রাখা যায় না, সে চেষ্টা করার ফল অবশ্যই বৃথা। একটা সময় পর আমি ভাগ হয়ে গেলাম। মা আমাকে একলা করে আমার একমাত্র খেলার সাথী ছোটো ভাইটিকে নিয়ে নিউইয়র্ক চলে গেলেন। মায়ের কাছের পরিচিত কেউ এদেশে নেই। মায়ের দেশ পুয়েত্রো কোঞ্চার এক প্রতিবেশী অনেককাল আগে এদেশে মাথা গুঁজেছেন, তার সামান্য ভরসায় মা একদিন আমাকে রেখে চলে যেতে বাধ্য হলেন। একটা সময় পর উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে তার কাঁছে নিয়ে যাবেন। সে আশ্বাসে আমি বাধ্য হয়ে থেকে গেলাম বাবার সংসারে।

বাবার সংসারে আমার সৎ মা এবং তার দুসন্তান যুক্ত হলো কিংবা আমি তাঁদের সংসারে বাড়তি যোগ হলাম। স্থানীয় স্কুলে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্বপ্নহীন একটা জীবনকে আমি টেনেটুনে বয়ে নিতে শুরু করলাম। বাবা খুব ব্যস্ত থাকেন। রাতে বাড়ি ফিরলে স্কুল বিষয়ে দু চারটে আলাপ হয়। মায়ের সাথে আমার মাসে দু একবার বাবার ফোনে কথা হয়, সৌজন্যমূলক এবং সবার সামনে। আমি মন খুলে মায়ের সাথে কথা বলতে ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে যাই। বাসার বাদবাকিরা খুব দরকার না হলে আমার সাথে কথা বলে না। স্কুলেও একই অবস্থা। আমার ইংলিশ তেমন যুতসই না তাই অন্যরা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমাকে নিয়ে আড়ালে আবডালে কৌতুক করে। আমি লজ্জা অপমানে ব্যথিত হই, ছটফট করি। আমার মনের গহীনে ফুলের স্তবকের মতো না-বলা কথারা স্তরে স্তরে স্তূপ হয়ে জমে থাকে।

অবহেলা আর অবজ্ঞায় আমার মধ্যে নির্বাকতার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে আমার কাঁছে মানুষের উপস্থিতিও কাঁছে অসহ্য ঠেকে। কোনোকিছুতে আকর্ষণ বোধ করি না। ক্রমশ আমার মধ্যে নিস্পৃহ নিরাসক্তির একটা আবরণ গড়ে উঠে। আমার ক্লাশ টিচার আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হোন। তার নির্দেশে স্কুলের কাউন্সিলর, মিস পার্কলারের এর সাথে আমার বেশ কবার বসতে হয়। মিস পার্কলারকে অবশ্য আমি বেশ পছন্দ করি। স্বল্পভাষী, মার্জিত। যে কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ভেতররের সমস্তটা পড়ে ফেলার আশ্চর্যরকম শক্তি তার মধ্যে রয়েছে।

খুব চমৎকার করে হাসেন। আত্মপ্রসাদপূর্ণ হাসি। তিনি যখন হাসেন শুধু মুখ নয়, সর্বাঙ্গ হেসে দুলে ওঠে। আমার মাও এভাবে হাসতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে পার্কলারের দিকে তাকিয়ে মাকে খুঁজি। তার হাসি আমাকে প্রশ্রয় দেয়। পার্কলারের আন্তরিকতার প্রাবল্যে আমাদের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা  ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে দাঁড়িয়ে যায়। সে আমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠে। আমি আমাকে পুরোটাই তার কাঁছে মেলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। জীবনের বাস্তব টুকরো টুকরো নির্মম সত্যকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার কৌশল রপ্ত করতে আমাকে সে বিশেষভাবে সাহায্য করে। জীবনের সেই চরমক্ষণে বাস্তবতার সাথে আমার সখ্যতা গড়তে সহজ হয়। আমি স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ফিরে পাই। জীবন আসলেই আনন্দময় চরম এ- সত্যের সাথে আমি নতুন করে জড়িয়ে পড়ি।

পার্কলারের মাধ্যমে আমার মায়ের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আমি মনভরে মায়ের সাথে গল্প করি। মা নিউইয়র্কের একটা হোটেলে হাউজকিপিং করেন। কঠিন কষ্টের কাজ। মা জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছেন। আমাকে আরও বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে বলেন। আমি মায়ের সানিধ্য পেতে, ছোটো ভাইটাকে আদর করতে তীব্রভাবে অপেক্ষা করি। কতোকাল ওদের সাথে সাক্ষাত নেই। ওদের কাছে চলে যাওয়ার ক্ষণ গুণতে শুরু করি। কিন্তু বাবাকে রেখে মায়ের কাঁছে চলে যাওয়ার ভাবনা মাথায় এলে সমস্ত স্বপ্নরা সহসাই এলোমেলো হয়ে যায়। বাবাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া কিংবা মায়ের ভালোবাসার আঁচল উপেক্ষা করা আমার জন্যে বড্ডো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি নিজের সাথে নিজে অবিরত যুদ্ধ করি। সুতোর টানাবিহীন ঘুড়ির মতো দিকশূন্য হয়ে ঘুরে বেড়াই।

এরপর… বছরের পর বছর গড়ায়, বেশ কতক বছর বয়ে চলে যায়। আমার কষ্টগুলোর পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় বহুগুন। আমার মনের রুদ্ধদ্বারের বেলাভুমিতে সমুদ্রতরঙ্গের মতো অবিরত আছড়ে পড়ে বিশুদ্ধ একাকীত্ব ! মা, নতুন করে ঘর বাঁধেন। তাও বেশ কবছর হয়। আমার সাথে বারকয়েক তাঁদের দেখাও হয়েছে। অবশ্য আমার আর মায়ের কাঁছে পুরোপুরি ফেরা হয় নাই। বাবার মতো মায়ের পৃথিবীতেও হরেক রকম রঙের খেলা চলে। মায়ের বর্তমান স্বামীর তিন সন্তান, আমার ভাই এবং মায়ের নতুন আরকজন সন্তান নিয়ে তাঁদের সংসার। বাবার সে সংসার এখন অবশ্য আগের মতো নেই। এরই মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমার সৎ মা, বছর সাতেক বাবার সাথে ঘর করার পর সুখের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। সাথে বাবার ঔরসের দুসন্তান রয়ে গেছে বাবার বর্তমান সংসারে। এখন অবশ্য বাবার এক নতুন বান্ধবীকে হরহামেশা বাবার বাড়িতে দেখা যায়। অচিরেই হয়তো বাবা আবার আরেক সংসারে ঢুকে অযথা সুখের সন্ধান করে যাবেন।

আর আমি, একা, একলা সংসার পেতেছি। সে সংসারে আমি মাঝে মাঝে ভরা পূর্ণিমার সাদা জোসনার ফুল হয়ে সুখের সমুদ্রে ভেসে বেড়াই, কখনও বা সুতীব্র দহনে অন্তঃপুরে পুড়ে যাওয়া বাল্যকালের অপূর্ণ ইচ্ছের কান্নাগুলোর সাথে রাত্রি জাগি। তারপরও সময় বয়ে যায়, সময় তো বয়েই যায় !

জাকিয়া শিমু। পেশায় শিক্ষক। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরেই। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা, যাকে বিক্রমপুরও বলা হয় সেখানে জন্ম তার। এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ