ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভাষা (প্রথম পর্ব)

সৌরভ মিত্র
প্রবন্ধ
Bengali
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভাষা (প্রথম পর্ব)

শব্দার্থ’ এই শব্দটির দু’টি ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়, ‘শব্দ ও অর্থ’ এবং ‘শব্দের অর্থ’। ঘটনাচক্রে কোনও শব্দ নিজে কোনও অর্থ বহন করে নাকি সেই অর্থ বাইরে থেকে আরোপ করা হয়, -এই নিয়ে কম তর্ক হয় নি। ন্যায়শাস্ত্রগুলির পাতার পর পাতা সেই বিষয়ের যুক্তি আর প্রতিযুক্তিতে ছয়লাপ। এককথায়, তা এক অমীমাংসিত তর্ক হয়েই বয়ে গিয়েছে। কিন্তু, আধুনিক শব্দার্থবিদ্যায় কোনও এক ‘অজানা’ কারণে শব্দের অর্থকে একতরফা ভাবে ‘আরোপিত’-ই ধরে নেওয়া হয়েছে। কেন বা কী স্বার্থে –তা আবার আরেকটি অমীমাংসিত তর্ক! দেখে শুনে মনে হয়, যেন এদেশের ইতিহাসের মতো এদেশের ভাষার শব্দার্থতত্ত্বও ডান-বনাম-বাম অথবা পাশ্চাত্যমোহ-বনাম-প্রাচ্যদর্পের কাজিয়ায় বলিপ্রদত্ত! সেই সব হুজ্জোতি আপাতত দূরে থাকুক। বরং শব্দের ভিতরে সত্যিই অর্থ থাকার কোনও সম্ভাবনা আছে কি না –একটু খতিয়ে দেখা যাক। এই পথ প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল এতদিন, তাই সবক্ষেত্রে তা সুগম্য নয়। আর একটি কথা, ভাষা-বিষয়ক নিবন্ধে ‘হুজ্জোতি’ বা ‘কাজিয়া’ –জাতীয় শব্দের উপস্থিতিতে খটকা লাগলে গোড়াতেই বুঝে নেওয়া ভাল, (অন্তত এই বাংলাভাষায়) ‘সমার্থক শব্দ’ বলে ‘কার্য্যতঃ’ কিছু হয় না।

মানবচেতনা ও ভাষা

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও স্মৃতির সমন্বয়ে তৈরি হয় জাগতিক চেতনা। এর মধ্যে ‘স্মৃতি’র ভিত্তি মূলতঃ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা দেখা, শোনা, স্পর্শানুভূতি, ঘ্রাণ বা স্বাদগ্রহণ –যে কোনও মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে। যে কোনও রূপেই তা ‘বাস্তব জগতে’র অভিজ্ঞতা। যে বাস্তব জগৎ ‘ক্ষিতি’, ‘অপ’ ও ‘মরুৎ’-এর মধ্যে স্বরূপে অথবা বিভিন্ন বিন্যাসে বিরাজ করা শ-খানেক মৌলিক পদার্থ, পারমাণবিক ও মহাজাগতিক শূন্যতা বা ‘ব্যোম’ ও বিভিন্ন রূপভেদে শক্তি বা ‘তেজ’–এর প্রকাশ।

কিন্তু, এই সমস্তটাই আসলে বস্তুনিষ্ঠ অস্তিত্বের ধারণা। এই ধারণা নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক, তবে তা অসম্পূর্ণ। এমনকি, যাকে বস্তুবাদের জনক বলা হয়, -সেই ডেমোক্রিটাসের মতেও ‘পরমাণু আর শূন্যতা বাদে সবকিছুই শুধুমাত্র অভিমত।’ আর শুধু দার্শনিকগণই নন, আইনস্টাইন, হাইজেনবার্গ, বোর, শ্রয়েডিংগারের মতো বিজ্ঞানীও বস্তুনিষ্ঠ ধারণার এই অসম্পূর্ণতার কথা বলে গিয়েছেন।

এই অসম্পূর্ণতার মূল কারণ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও স্মৃতির সীমাবদ্ধতা। জগতের সর্বোচ্চ জ্ঞানী বা সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান মানুষেরও এই ক্ষমতাগুলি সসীম। আর সসীম বলেই তার অভিজ্ঞতা-ও সীমাবদ্ধ। গোলাপকে ‘সুন্দর ফুল’ হিসেবে গণ্য করা মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল, -কিন্তু সে একটি তৃণভোজী প্রাণীর মতো গোলাপকে ‘খাদ্য’ হিসেবে গণ্য করবে না। -তার পঞ্চেন্দ্রিয় তাকে সেই অনুমতি দেয় না। সঙ্গে-সঙ্গেই গোলাপের অস্তিত্বের সামগ্রিকতা থেকে তার ‘খাদ্য’-গুণটি বাদ পড়ে। ফলে গোলাপ নামক অস্তিত্বটির সম্পর্কে পুঞ্জীভূত যাবতীয় ধারণার আকার যা-ই হোক না কেন, সে অসম্পূর্ণ। মানুষ এই সত্যটি অনুভব করে। আর তাই প্রাচীন ঈশত্বত্ত্ব থেকে শুরু করে আধুনিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞান –মোটামুটি সকলেই নিজের নিজের পথে অস্তিত্বের অসম্পূর্ণ ধারণাকে অতিক্রম করে তার সামগ্রিকতাকে বা সম্পূর্ণ রূপকে চেনার চেষ্টা করে চলেছে।

কিন্তু, এই যে মানুষের ‘চেতনা’ নিয়ে এত কথা বলা হল, সেই চেতনার জন্ম কিভাবে হয়? –একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করা যাক। একটি লোক জনবহুল রাস্তায় এক মাইল হেঁটে আসার পর তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই হাজারখানেক মানুষের মধ্যে সে কাদের কথা মনে রেখেছে, দেখা যাবে সে উত্তরে বলছে –যে লোকটি তাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল, বা যার সাথে তার ধাক্কা লেগেছিল, বা যে লোকটি খুব জোরে হাঁটছিল/ চিৎকার করছিল, বা যে উগ্র/ অদ্ভুত পোষাক পরেছিল, ইত্যাদি।

এককথায়, ওই হাজারখানেক লোকের ভিড়ে যে যে তার সাথে কোনও ‘ক্রিয়া’য় লিপ্ত হয়েছিল বা যাদের কাজকর্ম বা তার মধ্যে কোনও ‘প্রতিক্রিয়া’ সৃষ্টি করেছিল –একমাত্র তারাই লোকটির ‘চেতনা’য় প্রবেশ করতে পেরেছে। আবার ভিড়ের সবাই যদি ঠিকানা জিজ্ঞেস করে বা জোরে হাঁটে/চিৎকার করে বা অদ্ভুত পোষাক পরে… তাহলে দেখা যাবে হয়তো কাউকেই সে বিশেষভাবে মনে করতে পারছে না। অর্থাৎ চেতনায় প্রবেশ করার শর্ত শুধুই ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ নয়, ‘বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’।

চেতনার বিকাশের এই ধাপ (তাকে শর্ত বা পদ্ধতি, যা-ই বলি না কেন) শুধু ‘এক মাইল পথ চলার’ মধ্যেই প্রযোজ্য নয়, তার প্রাসঙ্গিকতা মানুষের বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস জুড়ে। মানুষ হোমিনিড থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স্ হয়ে ওঠার পথে এবং তথাকথিত ‘সভ্য’ হয়ে ওঠার সময়ে এক দিকে তার খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, আলো, উষ্ণতা জাতীয় ‘প্রয়োজন’দের ও অন্যদিকে হিংস্র পশু, প্রাকৃতিক বিপর্য্যয়, রোগব্যাধি, বিষ জাতীয় ‘প্রতিপক্ষ’দের–কে চিনতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, এই পদ্ধতিতে সে আজও তার প্রয়োজন ও প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে।

এই বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ভিত্তি করে চিহ্নিত করার এই রীতি বিজ্ঞানী ডেভিড বোহ্‌মের ভাষ্যে ‘সাদৃশ্যের ভিন্নতা ও ভিন্নতার সাদৃশ্য’ বা ‘difference of similarities and similarities of difference’. চেতনার সাথে ভিন্নতা ও সাদৃশ্যের এই খেলা (নাকি ‘লীলা’?) একটু বিশদে বোঝার চেষ্টা করা যাক। -চারপাশের অসংখ্য অস্তিত্বের (সাদৃশ্য) মধ্যে প্রথমে দেখা হল কে জীব ও কে জড় (সাদৃশ্যের ভিন্নতা)। এবার সমস্ত জীবের (ভিন্নতার সাদৃশ্য) মধ্যে দেখা হল কে উদ্ভিদ আর কে প্রাণী (সাদৃশ্যের ভিন্নতা)। তারপর সমস্ত প্রাণীর (ভিন্নতার সাদৃশ্য) মধ্যে দেখা হল কে চতুষ্পদ আর কে দ্বিপদ (সাদৃশ্যের ভিন্নতা)। চতুষ্পদ প্রাণীদের (ভিন্নতার সাদৃশ্য) মধ্যে দেখা হল কে মাংসাশী আর কে তৃণভোজী (সাদৃশ্যের ভিন্নতা)। এই পদ্ধতির আরও কয়েক ধাপ পুনরাবৃত্তির পর এমন এক অস্তিত্বকে পেলাম, -যাকে (ধরা যাক) ‘কুকুর’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি ‘কুকুর’ নামক অস্তিত্ব-টিকে চিনলাম, নাকি চিনলাম তার একটি/ কিছু বৈশিষ্ট্যকে (যা আমাদের চেতনায় বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে)? –আসলে চিনলাম একটি/কিছু বৈশিষ্ট্যকেই, যার/যাদের ধারক হল কুকুর নামক অস্তিত্ব।

শাব্দিক আচার্য্য ভর্ত্তৃহরি এই ‘সাদৃশ্যের ভিন্নতা ও ভিন্নতার সাদৃশ্য’ বা মতো-ই এক পদ্ধতির কথা বলেছেন। –‘বক্তা বুদ্ধির দ্বারা প্রথমে কুরু-পাঞ্চালের মধ্যে একতা স্থাপন করে, পরে তাদের একে অপরের থেকে পৃথক করে প্রতীয়মান করে।’ -বোঝা গেল যে, মানুষের চেতনার জন্মের মূলে রয়েছে ‘বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’। সেই চেতনার দ্বারা সাধিত অন্যতম ফল তার মুখের ভাষা। এবার একটি সঙ্গত প্রশ্ন;- যদি চেতনা ও ভাষার সম্পর্ক পিতা-পুত্রের হয়, তাহলে পুত্রসম ভাষার ‘শরীরে’ পিতাসম চেতনার ক্রিয়া-ভিত্তিক ‘রক্ত’ বইবে না –সে কি হয়?

কুলত্যাগী আধুনিক বাংলা ভাষা

শুরুতেই বলে রাখা ভাল, বাংলা শব্দার্থের বর্তমান ‘প্রাণহীন দেহবাদিতা’র কারণ অনেকটাই রাজনৈতিক। আঠারো ও ঊনিশ শতকে বাংলা তথা প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষাকে ইংরেজ মনিবদের নির্দেশে তাদের জন্য উপযুক্ত ও সহজবোধ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে ভাষাগুলিকে ব্যাপক ভাবে ইংরেজিকরণের ‘শিকার’ হতে হয়েছিল। এর ফলে বাংলা ভাষাও আধুনিক ইংরেজীর মতো ‘যান্ত্রিক’ হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বাংলা বা সংস্কৃতে যতিচিহ্নের ব্যবহার ছিল না-ই বললে চলে। বেদ-পুরাণ-মহাভারত থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্যগুলি অবধি শুধুমাত্র ‘দাঁড়ি’ সম্বল করে ‘লেখা’ হয়েছিল। কমা, সেমিকোলন থেকে প্রশ্নচিহ্ন অবধি বাদবাকি যাবতীয় যতিচিহ্নকে আধুনিক ইংরেজীর প্রভাবে আমদানিকৃত। -সেই সময় এমন বিভিন্ন উপায়ে বাংলা ভাষাকে অ্যাংলো-বেঙ্গলী বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

সংস্কৃত ‘বর্ণন’ থেকে ‘বানান’ এসেছে, যার অর্থ শব্দের মধ্যকার বর্ণসমূহের বিশ্লেষণ বা ক্রমিক বর্ণন (বর্ণ+ অন)। শব্দের উৎপত্তি, অর্থ ও গঠন অনুসারে শব্দের লিখিতরূপকে বানান বলে। -আধুনিক ইংরেজীর spelling-এর মতো তা শুধুমাত্র ‘ধ্বনির লিখিত রূপ’ নয়। যদিও শিল্পবিপ্লবের আগে অবধি spelling-এর-ও সংজ্ঞা ছিল ‘manner of forming words with letters’. manner of forming sound of word নয়। -এই বিপর্য্যয় বা চক্রান্তের মূল কারণ ভাষাতাত্ত্বিক নয়, এর কারণ রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক। তবে সে প্রসঙ্গ অন্য, আপাতত তা মুলতুবি থাক।

আধুনিক ইংরেজী ভাষায় শব্দের বানান শুধু শব্দের ধ্বনি (উচ্চারণ) নির্দেশক, অর্থ নির্দেশক নয়। সংস্কৃত বা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কিন্তু শব্দের বানান ধ্বনির পাশাপাশি অর্থকেও নির্দেশ করে। -যে কারণে ‘ণত্ববিধান’, ‘ষত্ববিধান’ জাতীয় নিয়মগুলির উপস্থিতি। -সেগুলি নিছক বানান মুখস্থ করার মন্ত্র নয়। শব্দরূপ, ধাতুরূপ, ইত্যাদির ন্যূনতম অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায় যুবতী/রাণী ইত্যাদির অর্থ কোনওমতেই যুবতি/রাণি নয়।

স্বাধীনতার বয়স সত্তর বছর হলেও বাংলা ভাষার অ্যাংলো-বেঙ্গলী গন্ধ দূর হয় নি তো বটেই, উল্টে ভাষাতাত্ত্বিক ‘রায়বাহাদুরী’র অভ্যাসবশত ‘বানান সংস্কারে’র নামে কয়েক হাজার অশুদ্ধ ও অনর্থক শব্দ গুঁজে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরা যাক ‘আচার্য্য’ শব্দটি, -এই শব্দ থেকে য-ফলা বর্জিত হলে তার অর্থ ‘গুরু’ বা ‘শাস্ত্রবিষয়ের অধ্যাপক’ থাকে না, তা ‘আচরণীয়’ হয়ে যায়। বিচার্য, শিরোধার্য, পরিহার্য, ইত্যাদি য-ফলাহীন শব্দের অর্থের ঝোঁক খেয়াল করলে বোঝা যায় সে’গুলি বিশেষণ পদ। য-ফলা বর্জিত হলে ‘আচার্য্য’-এর মতো দশা হয় সূর্য্য, আর্য্য, মৌর্য্য, আহার্য্য ইত্যাদি শব্দেরও। -বিশেষ্য থেকে তারা বিশেষণে পরিণত হয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, আচার্য্য = আচার্য ধরে যদি ‘কাজ চলে যায়’, আর সবাই তা ‘মেনে নেয়’, তাহলে ক্ষতি কোথায়? –রসায়নশাস্ত্রে যেমন কোনও বিবেচনাধীন যৌগিক পদার্থে উপস্থিত মৌলগুলি সেই যৌগটির প্রকৃতি নির্দেশ করে, তেমনই একটি শব্দে উপস্থিত বর্ণসমূহ নির্দেশ করে শব্দটির অর্থ। এখন ওই ‘কাজ চলে যাওয়া’ বা ‘মেনে নেওয়া’র যুক্তিতে একটি শব্দ থেকে দু-একটি বর্ণ গায়েব হওয়া -একটি যৌগ থেকে দু-একটি মৌল গায়েব হওয়ার সমান! এর ফলে, প্রকৃতি বা অর্থ চিনতে যৌগিক পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণের মতো শব্দের ‘ধ্বনিগত বিশ্লেষণে’র ধারা-টিই চলে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। ফলে ‘ভাষার উৎস’কে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ বা ‘conspiracy theory’ ভেবে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

সময়ের সাথে সাথে ভাষার রূপের পরিবর্তন ঘটতেই পারে, নইলে ‘সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে’। জগতে পরিবর্তন-ই একমাত্র সত্য। কিন্তু, সে প্রাকৃতিক পরিবর্তন। সাধু থেকে চলিত, চলিত থেকে লৌকিক বা লৌকিক/ চলিতের ‘সাধুকরণ’ –এই পরিবর্তনে ভাষার সাথে চেতনার যোগ বা শব্দের বা ধ্বনির ভাব-ধারণের গুণ হারিয়ে যায় না। কিন্তু, আগের উদাহরণের খেই ধরে বলতে গেলে; যেই মুহূর্তে ভাষায় ‘আচার্য্য = আচার্য’ জাতীয় কৃত্রিম পরিবর্তন দানা বাধে, সঙ্গে সঙ্গে শব্দের বা ধ্বনির ভাব-ধারণের গুণটি হারিয়ে যায়। যদি ‘আচার্য’ বিশেষণ হয় আর ‘আচার্য্য’ বিশেষ্য, তাহলে ‘য’ ধ্বনি/ বর্ণের মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনও গুণ থাকে যা বিশেষণকে বিশেষ্যে পরিণত করতে পারে। সুতরাং, এক্ষেত্রে ‘য’ ধ্বনি/বর্ণ হল ‘যোগ্যতাবাচক’। কিন্তু, আচার্য্য = আচার্য ধরলে ‘য’ ধ্বনির/বর্ণের সেই গুণ চেনা যায় না। ‘বৈশিষ্ট্য’ ও ‘বিশিষ্ট’ শব্দদুটিকে খেয়াল করলে ‘য’- ধ্বনি/বর্ণের সেই ক্ষমতা/গুণ সহজেই বোঝা যায়।

বানান সংস্কারের প্রসঙ্গে একটি মজার উদাহরণ নেওয়া যাক। ‘ক্ষেত্র’ থেকে ‘ক্ষেত’, আধুনিক বানান অভিধানে তা হয়েছে ‘খেত’। এখন ‘চাষী একজোড়া বলদ নিয়ে খেতে যাচ্ছে’ –বাক্যটির অর্থ বুঝতে গিয়ে যদি কেউ বিভ্রান্ত হয় -আহাম্মক চাষী হতভাগা বলদজোড়াকেই গিলতে চলেছে নাকি তাদের সাথে এক পাতে খড়বিচুলি চিবোতে চলেছে? –তাহলেই গোলমাল! বাংলা ভাষাকে বাংলার সিন্দুক থেকে বিলাতি স্যুটকেসে কোনওমতে বেঁধে-ছেঁধে আঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু (রাবীন্দ্রিক উপমা ধার করে বলতে ইচ্ছে করে) –সে বাঁধন শিকলের বাঁধন, নূপুরের নয়!

ভাষার রূপের কৃত্রিম পরিবর্তন সংঙ্কীর্ণতা আলোচনা করা হয়েছে, এবার প্রাকৃতিক পরিবর্তনের (সাধু থেকে চলিত) বিস্তার চেনা যাক; – ‘বর্ণন’ শব্দ থেকে ‘বানান’ শব্দটি এসেছে। ‘বর্ণন’ শব্দটি ‘বিবরণ করা’ ক্রিয়ার ভাব বহন করে। সেখানে ‘বানান’ শব্দটি ‘বিবরণ’-এর পাশাপাশি ‘নির্মাণ’কেও নিজের অর্থে তথা ভাবে সংযুক্ত করে নিয়েছে। -স্মর্তব্য ‘বানানো’ শব্দটি। ভাবজগতে বর্ণন-এর তুলনায় ‘বানান’ শব্দটি অধিক ধনী।

রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘দেশের ইতিহাস ইংরেজ রচনা করে, আমরা তর্জমা করি, ভাষাতত্ত্ব ইংরেজ উদ্ধার করে, আমরা মুখস্থ করিয়া লই…’। আধুনিক ইংরেজীর শব্দার্থবিধি প্রতীকী। তার দেখাদেখি বাংলার শব্দার্থবিধি-ও হয়েছে প্রতীকী। ছাত্রবোধ বা বঙ্গীয় শব্দকোষের মতো কিছু প্রাচীন অভিধানে বাংলা শব্দের ‘বংশপরিচয়ে’র নিদর্শন থাকলেও আজ তার ‘বংশকৌলীন্য’ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাংলা ভাষার জন্য নিরুক্ত, মাহেশ্বর সূত্র, বাক্যপদীয়, পস্পশাহ্নিক বা শব্দশক্তিপ্রকাশিকা জাতীয় কোনও শাস্ত্র রচনা করা হয় নি। এমনকি বাংলাভাষাকে যার ‘নিকটতম বংশধর’ বলা হয়, -সেই মাগধী প্রাকৃত বা গৌড়ীয় প্রাকৃতের ভাগ্যও এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার থেকে খুব একটা ভাল নয়। ফলে বাংলার শব্দার্থবিধি খুঁজতে গিয়ে সংস্কৃতের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া খুব বেশি পথ খোলা থাকে না। তবে আশার কথা, -প্রায় পঁচানব্বই ভাগ বাংলা শব্দ-ই আদতে সংস্কৃতের তৎসম বা তদ্ভব। তাই সংস্কৃতের শব্দতত্ত্বকে অন্বেষণ করা যাক।-

শব্দে ক্রিয়ার চিহ্ন

গোড়ায় বলা হয়েছিল ‘বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ পর্যবেক্ষণের পথে কোনও অস্তিত্ব আমাদের চেতনায় প্রবেশ করে। কিন্তু, জরুরী নয় যে প্রথম দেখাতেই কোনও অস্তিত্বের সমস্ত বৈশিষ্ট্য আমরা চিনে ফেলব। তাই যেমন যেমন চিনলাম, তেমন তেমন তাদের চিহ্নিত করতে থাকলাম;

‘অস্থি ভক্ষণ’ বৈশিষ্ট্যকে চেনার পর তার আধার একটি পশু (কুকুর)-কে চিহ্নিত করলাম ‘অস্থিভক্ষ’ নাম দিয়ে।

‘জিহ্বা থেকে সর্বদা লালারস ক্ষরণে’র বৈশিষ্ট্যকে চেনার পর তাকে চিহ্নিত করলাম ‘ললজিহ্ব’ নাম দিয়ে।

তার ‘শুন্’ গতি দেখে তাকে চিহ্নিত করলাম ‘শুন’ বা ‘শুনক’ নাম দিয়ে।
ঋগ্বেদ অনুসারে সে নাকি ‘কশ্যপপত্নী সরমার অপত্য’ তাই সে ‘সারমেয়’।
তার চলার পথ বা ‘মার্গ’ গৃহে বা গ্রামে সীমাবদ্ধ বলে সে ‘গৃহমৃগ’ বা ‘গ্রাম্যমৃগ’…

এবার স্মরণ করা যাক আমাদের অস্তিত্বের সুবিধাজনক বস্তুনিষ্ঠ ধারণার প্রতি ঝোঁকের কথা। -এই ঝোঁকেই আমাদের বোধে ও স্মৃতিতে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যগুলির বদলে বৈশিষ্ট্যগুলির ধারক সত্তাটি মুখ্য হয়ে উঠল। -পরিণাম স্বরূপ অস্থিভক্ষ, শুনক, ললজিহ্ব, সারমেয়, ইত্যদি চিহ্নগুলি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টের পরিচয় হলেও তারা ‘সমার্থক শব্দে’ পরিণত হল। নির্দিষ্ট বা সীমিত ক্ষেত্রে তারা ‘সম-আধার-নির্দেশক’ হতে পারে, কিন্তু ‘সমার্থক’ নয়। হাল আমলের অভিধানগুলির এই ‘পৌত্তলিকতা’ অর্থাৎ আধারকেন্দ্রিক/বস্তুকেন্দ্রিক অর্থ নির্ধারণের প্রথা ভুল না হলেও অসম্পূর্ণ বটেই।

আরও একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। উদ্ভিদ, বৃক্ষ, পাদপ, দারু, গাছ, ইত্যাদি শব্দ দ্বারা একটি আধারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু, এই বৈশিষ্ট্য বা গুণগুলি কি শুধুমাত্র গাছগাছড়ারই একচেটিয়া? –না, আর না বলেই উদ্ভিদ-গুণ বা ‘ভেদ করে আবির্ভাবের গুণ’ (এক্ষেত্রে ভূমি ভেদ করে) থাকে বলে গাছগাছড়ার পাশাপাশি নির্ঝর বা প্রস্রবণকেও উদ্ভিদ বলা হয় (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ঘটনাচক্রে উদ্ভুত, উদ্ভাস, উদ্ভব, উদ্ভট, উদ্ভেদ –এই শব্দগুলির মধ্যেই ‘ভেদ করে আবির্ভাবের গুণ’ বা ‘আবির্ভাবের গুণ’ ঢুকে রয়েছে। অর্থের সঙ্কোচন/প্রসারণ/বিকৃতির ফলে আজ হয়তো কিছুক্ষেত্রে এই গুণ স্পষ্ট ভাবে চেনা যায় না।

এবার প্রশ্ন হল, এই অর্থের এই সঙ্কোচন/প্রসারণ/বিকৃতির ঘটে কিভাবে? –অবশ্যই রাতারাতি কোনও সঙ্কল্প গ্রহণ করে বা আইন জারি করে এই কাজ ঘটে না। কোনও শব্দের মাধ্যমে নির্দেশকৃত আধারটির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর বিস্তৃত সময় ধরে স্থায়ী পরিবর্তন হলে আধারসূচক শব্দটির অর্থের সঙ্কোচন/প্রসারণ/বিকৃতি ঘটে। যেমন ধরা যাক ‘অজুহাত’ শব্দটি। এই ফারসি শব্দটির অর্থ ‘কারণ’। এককালে ফারসি ছিল আইন আদালতের সরকারী ভাষা। অনুমান করা যায়, আদালতের প্রেক্ষাপটে মিথ্যাভাষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে এক সময়ের পর থেকে ‘অজুহাত’ শব্দটির অর্থ-ই ‘মিথ্যা কারণ’ হয়ে যায়।

উল্লেখ্য, ‘চিন্তা’ ও ‘ভাবনা’ মোটেই সমার্থক নয়। বাস্তব কোনও ‘চিহ্ন’কে নির্দেশক ধরে যে মানসিক গতির সৃষ্টি হয় তা হল চিন্তা, আর সম্পূর্ণ ‘ভাবগত’ যে মানসিক গতি -তা হল ভাবনা। কিন্তু, আধুনিকতার প্রভাবে এই তফাৎ তো আমরা পুরোপুরি বুঝিই না, বরং ‘সম্পূর্ণ ভাবগত মানসিক গতি’ বিষয়টি-ও ‘ভাবনা’র বদলে ‘চিন্তা’র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতা জন্মমুহূর্ত থেকেই লজিক-সর্বস্ব। (এখানে ‘লজিকে’র অর্থ ‘যুক্তি’ বুঝলে তা ব্যর্থ অনুবাদ/অনুভব হয়। logic-এর মূখ্য তাড়ণা ‘logos’ অর্থাৎ জ্ঞানপ্রকাশের, আর যুক্তির মূখ্য তাড়ণা ‘যুক্ত’ করার। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বর্তমানে ‘logo-centric’ হওয়া বা প্রতীককেন্দ্রিকতা-ই যুক্ত করার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ানোয় আমাদের বোধে logic = যুক্তি হয়ে গিয়েছে!)

যাই হোক, লজিক-সর্বস্ব আধুনিকতা স্বভাবতই সর্বজনীন একক ‘বাস্তবতা’ বা রিয়েলিটিকে অনুসন্ধান করতে চায়। আর বাস্তবতা ও সত্যের মধ্যে অবশ্যই ফরাক থাকে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক, যুদ্ধ যদি একটি সাধারণ সত্য হয়, তাহলে বিজয়ী, বিজিত, নিরপেক্ষ ও ‘সমপার্শ্বিক ক্ষতি’ (collateral damage) –এই চারজনের কাছে ‘যুদ্ধের বাস্তবতা’ কি এক? -অবস্থান অনুসারে একই সত্যের বাস্তবতা বা তার বাস্তব রূপের বদল হয়। অন্যকথায়, -‘অর্থের অবস্থান বোধে, অর্থের শক্তির অবস্থান-ও বোধে। বোধ ও বুদ্ধি যে চেহারা প্রকাশ করে, সেই চেহারাই পদার্থে আরোপিত হয়।’

বর্তমানে প্রচলিত শব্দার্থবিধি যদি ‘বাস্তবতা’ হয়, শব্দের ক্রিয়াগত বা ধাতুগত সংগঠন হল তার ‘সত্য’। -প্রথমটি ‘প্রতীকিবাদী’ আর দ্বিতীয়টি ‘প্রকৃতিবাদী’। প্রথমটি শব্দের দেহকেন্দ্রিকতা হলে অপরটি শব্দের প্রাণ-নির্দেশক। এই সত্য আর বাস্তবতার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু, বলাই বাহুল্য, সত্যকে বাদ দিয়ে বাস্তবকিতা সম্পূর্ণ-ও নয়। যে কোনও ব্যাকরণের শুরুতেই ভাষা-কে বলা হয় মনের ‘ভাব প্রকাশের’ মাধ্যম। -সেখানে শব্দার্থের বেলায় এমন প্রতীকিবাদিতা/দেহকেন্দ্রিকতা কিছুটা খাপছাড়া নয় কি? –এ’ যেন সেই ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’ গোছের অবস্থা।

একদল লোকের স্বরূপ চিনতে গিয়ে যদি তাদের দেহভিত্তিক পরিচয় বা রাম, রহিম, প্রতিমা, ফাতেমা-তে আটকে যাই, আর সেইটুকুকেই যথেষ্ট ভেবে বসি, তাহলে তারা যে ‘সকলেই মানুষ’ –এই সত্য অবধি আর পৌছানো যায় না। আবার ‘প্রতীকের বিভিন্নতা’কে সম্পূর্ণ এড়িয়ে শুধুমাত্র ‘প্রকৃতির সাম্য’কে অনুধাবন করলে তা বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করা হয়। আসলে এই দুটি পন্থা একে-অপরের পরিপূরক। শব্দের অর্থের স্বরূপ কিছুটা যেন হিমশৈলের মতো, যার প্রতীকী উপরিভাগ চোখে (বোধে) ধরা পড়ে, বেশিরভাগটাই (প্রকৃতি) থাকে আড়ালে। এখন প্রশ্ন হল, -এই ‘উপরিভাগ’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা কি কাজের কথা?

বর্ণ শব্দ বাক্ ও মানসিক লটবহর

‘এখানে ছাড়তে হবে সকল অবিশ্বাস। এখানে ধ্বংস হবে সমস্ত ভীরু ভাবনার।…’ কথিত আছে, মহাকবি দান্তের এই পংক্তিটি কার্ল মার্ক্‌স বিজ্ঞানের প্রবেশদ্বারে লিখে রাখার কথা বলেছিলেন। সত্যি বলতে কি, যাবতীয় জ্ঞানচর্চার প্রবেশদ্বারেই এই পংক্তিটি লিখে রাখা উচিত। বেদ, তন্ত্র, উপনিষদের নাম শুনলেই ভেবে বসি –ওগুলি ধর্ম্মগ্রন্থ। -সে ব্যক্তিগত ভাবে আমি হিন্দু, মুসলিম অথবা (প্রচলিত অর্থে) আস্তিক, নাস্তিক যা-ই হই না কেন। এর কারণ আমাদের চেতনার সীমাবদ্ধতা। আলোচনায় ঢোকার আগে আরও একবার বলে রাখা ভাল, প্রচলিত শব্দশাস্ত্রগুলি ছাড়াও যেহেতু এই আলোচনার আকরগ্রন্থ বেদ, তন্ত্র, উপনিষদ, ইত্যাদি -তাই প্রতি পদে রুদ্র, দেব, শক্তি, শিব, মহাদেব, পার্ব্বতী, ত্রিগুণ -জাতীয় শব্দের সাক্ষাৎ হবে। এই শব্দগুলির সম্মন্ধে প্রচলিত ‘প্রতীকী ধারণা’ তাদের ‘প্রকৃত অর্থে’র চেয়ে অনেকটা অধঃপতিত (ধৃষ্টতা মার্জনীয়)। চেনা পথে ভাবলে আলোচনাটি মনে হবে গোলকধাঁধা। তবে আশা করা যায়, নিবন্ধটির পরিশেষে সেই ‘প্রকৃত অর্থে’রও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।

একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে, বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত আস্তিক ও তথাকথিত নাস্তিক একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে। -দু’জনই ‘বিশ্বাসী’, শুধু তাদের বিশ্বাসের অভিমুখগুলি একে অপরের বিপরীত। কিন্তু, যন্ত্রণার কথা হল -দু’জনই ‘এমন কিছু’তে বিশ্বাসী, যার সম্মন্ধে দু’জনেরই সম্পূর্ণ ধারণা নেই! পৃথক পৃথক ‘ধী-গোষ্ঠী’ বা ‘school of thought’ থেকেও এই বিশ্বাসধারাগুলির জন্ম ও ‘সংক্রমণ’ হতে পারে, কিন্তু স্পষ্টত্ববোধহীন বিশ্বাস মনোজগতের অতি মারাত্মক ঘটনা। -তবে সে অনেক বড় প্রশ্ন এবং এই মুহূর্তে কিছুটা অন্য প্রসঙ্গ-ও বটে। সুতরাং, আপাতত স্পর্ধার জোরে স্পষ্টত্বহীন বিশ্বাসের মানসিক লটবহরগুলি সরিয়ে রেখে, শুধু ‘কৌতুহল’ সম্বল করে প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে একবার উঁকি দিয়ে দেখা যাক, -বর্ণ, শব্দ ও বাক বিষয়ে সেখানে কী পাওয়া যায়।

বাক্য বা বাক্-এর শক্তি অপিসীম। ঋগ্বেদ অনুসারে সে ‘রুদ্রগণ, বসুগণ, আদিত্যগণ ও বিশ্বদেবগণের সাথে বিচরণ করে। মিত্র-বরুণ, ইন্দ্র অগ্নি ও অশ্বিনীদ্বয়কে ধারণ করে।’ –এক কথায়, বাক্ সর্বগুণের ধারক ও সহগামী। এই বাক্-ই তন্ত্রে ‘শক্তি’ রূপে আলোচিত। মহাকবি কালিদাস-ও বিনম্র চিত্তে পার্ব্বতী-পরমেশ্বরের সম্পৃক্ত সম্পর্কের সাথে বাক্ ও অর্থের সম্পর্ক-কে তুলনা করেছেন।

কেমন এই সম্পর্ক? -আচার্য্য ভত্তৃহরি তার বাক্যপদীয়-তে (সূত্র: ২.১১৯ – ২.১৩৪) শব্দের প্রকৃত অর্থ বিষয়ে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার মতবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন। তার পূর্ববর্তী আচার্য্যদের কারো মতে শব্দের অর্থ নিরাকার, কারো মতে সাকার, কারো মতে সমুদায়, কারো মতে সংসৃষ্ট। কেউ বলেছেন ‘অসত্যোপাধি সত্য’ (শব্দের অভিদেয় পরমাত্মা)। এছাড়াও ‘অসর্বশক্তিমান’, বুদ্ধিগত বা ‘বৌদ্ধ’, ‘অনিয়ত’, প্রভৃতি তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দর্শন সত্যিই আশ্চর্য্যজনক! অবশ্য, এই তত্ত্বগুলির মধ্যে সাকারত্ব তত্ত্ব-কে ভত্তৃহরি নিজেই খারিজ করেছেন।

সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য বা Proper Noun–এ এসে এই সাকারত্বের বিলোপ অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমান ভাষায় সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য শুধুই আধার নির্দেশক। ‘সৌরভ মিত্র’ পদদ্বয় এক অধম নিবন্ধলেখককে নির্দেশ করে, ‘সুবাস’ বা ‘বন্ধুত্বে’র সাথে যার কোনও শব্দার্থগত সম্পর্ক নেই। তবে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতে ব্যবহৃত ‘আপাত’-নামপদগুলির ব্যাপার আলাদা। সেখানে জ্ঞানের ‘শিখা বহনকারী’র নাম শিব, যুদ্ধে স্থির থাকেন যিনি তিনি যুধিষ্ঠির, রাষ্ট্রশক্তির ধারণকারীর নাম ধৃতরাষ্ট্র… ইত্যাদি। -এক কথায়, নামপদ হলেও এরা গুণবাচক।…

‘সাকারত্ব-তত্ত্ব খারিজের আরেকটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। -শাব্দিকদের মতে, ক্ষেত্রবিশেষে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারিত হলে সেখানেও অন্ততঃ একটি ক্রিয়াপদ বা কারকপদ দৃশ্য/উহ্য রূপে উপস্থিত থাকে। এই দৃশ্য/উহ্য ক্রিয়া বা কারক দ্বারা শব্দের ভাব প্রকাশ পায়। ক্রিয়াপদ মানেই ক্রিয়া, আর কারক হল ‘বাক্যের ক্রিয়ার সাথে বাক্যান্তর্গত কোনও পদের সম্পর্ক।’ সুতরাং, এ’কথা বলা বোধহয় অন্যায্য নয় যে, শব্দার্থের সাথে ক্রিয়ার বা সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া-গুণের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

শব্দ উচ্চারিত এবং দৃশ্য (লিখিত), -উভয় রূপেই বিদ্যমান থাকতে পারে। শব্দকে গঠন করে বর্ণ (মৌলিক ধ্বনি), -তারও প্রকাশ দুই রকম। একটি অণুর গুণাবলী যেমন নির্দ্ধারিত হয় তাকে গঠনকারী এক বা একাধিক পরমাণুর দ্বারা, তেমন-ই একটি সংস্কৃত বা সংস্কৃতজাত ভাষার শব্দের গুণাবলী বা অর্থ নির্দ্ধারিত হয় শব্দগঠনকারী এক বা একাধিক ধ্বনির/বর্ণের দ্বারা। পাণিনির প্রত্যাহার সূত্রে একটি সহজ যুক্তির সাহায্যে ধ্বনির/বর্ণের অর্থ-ধারণ বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। মহাভাষ্য অনুসারে, -‘কূপ’ শব্দের অর্থ কূপ, ‘সূপ’ শব্দের অর্থ সূপ ও ‘যূপ’ শব্দের অর্থ যূপ। শব্দদুটি থেকে যথাক্রমে ‘ক’, ‘স’ ও ‘য’-কে প্রত্যাহার করলে কূপ, সূপ ও যূপ অর্থগুলি হারিয়ে যায়। সুতরাং, ‘ক’, ‘স’ ও ‘য’ বর্ণগুলি যথাক্রমে কূপ, সূপ ও যূপ অর্থের সম্ভাবনা বহন করে। যদি বর্ণসমূহ (শব্দ) অর্থবহ হয়, তাহলে সমূহের প্রতিটি বর্ণ-ও অর্থবহ। কিন্তু, এবার নতুন প্রশ্ন জাগে। দুটি শব্দ নেওয়া যাক, -তরী ও রতি। এই ক্ষেত্রে ওপরের সূত্র অনুসারে ‘ত’ ও ‘র’ ধ্বনি/বর্ণদুটির অর্থের সম্ভাবনা খুঁজতে গেলে মুশকিলে পড়তে হয়। দেখা যাচ্ছে -‘ত’ এবং ‘র’ উভয়েই ‘তরী’ এবং ‘রতি’ অর্থগুলি ধারণ করে! তাহলে কি ধ্বনির/ বর্ণের অর্থ পরস্পর পরিবর্তনশীল (mutually dynamic)? –তাহলে এই পরিবর্তনের ধাঁচ কেমন? …

 

চলবে…

সৌরভ মিত্র। লেখক ও বাঙলা ভাষার গবেষক। জন্ম কলকাতা, ভারত। তাঁর লেখার বিষয় বাংলা ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব, ছোটগল্প, উপন্যাস ও রম্যরচনা। প্রকাশিত বইপত্র: 'আয় বৃষ্টি' (ভাষালিপি প্রকাশনী, ২০১০), 'আদরের মরাগাঙ' (প্রতিভাস প্রকাশনী, ২০১১), 'টিপিক্যাল মিডিলক্লাস' (একুশশতক প্রকাশনী, ২০১৩), 'হুক' (সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী, ২০১৮)...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..