করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
আমরা আলো বা তাপ ‘দেখতে’ পাই না। কিন্তু, সে আলো বা তাপ যখন সোনা, রূপা, পাথর, মাটি, ইত্যাদিতে প্রযুক্ত হয় তখন সোনা, রূপা, পাথর, মাটি, ইত্যাদির ‘আলোকিত’ বা ‘উত্তপ্ত’ রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু, বস্তু ভেদে সেই রূপের পরিবর্তন হয়। আলো বা তাপ হল ‘শক্তি’। ধ্বনির/বর্ণের অর্থের পরস্পর পরিবর্তনশীল রূপ কিছুটা এমন-ই। ধ্বনির/বর্ণের অর্থ শক্তিস্বরূপা। সেই কারণে তন্ত্রশাস্ত্রে ধ্বনির লিখিত রূপ বর্ণকে ‘মাতৃকাবর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। -বলা হয়েছে মুণ্ডমালা আসলে ‘পঞ্চাশৎ মাতৃকাবর্ণের প্রতিকৃতি’! ‘বাজ্যতে ইতি বর্ণঃ’ –যা প্রকাশ করে তাই বর্ণ। সাধক রামপ্রসাদের গানে ‘কালী-পঞ্চাশদ্বর্ণময়ী, (তুমি) বর্ণে বর্ণে নাম ধর’। এই বর্ণতত্ত্ব বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা দেখা যায় ‘মুণ্ডমালাতন্ত্রম্’, ‘কামধেনুতন্ত্রম্’, ‘বর্ণোদ্ধারতন্ত্রম্’, ইত্যাদি শাস্ত্রে। এমনকি শিখ ধর্ম্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’-এও রয়েছে বর্ণের অভিব্যক্তির পরিচয়।
তথাকথিত ধর্ম্মগ্রন্থ বা আচারগ্রন্থগুলিতে বর্ণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা বিস্ময়কর লাগতে পারে। এর প্রধান কারণ, এই গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু যতটা ‘তথাকথিত’, ততটা ‘তথাপঠিত’ নয়। গ্রন্থগুলির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সৃষ্টিরহস্য ও জীবনরহস্যের (আপাত-ভিন্ন পথে) উন্মোচন। তারা ভারতীয় দর্শনের অংশ ও অঙ্গ। -যে দর্শন বলে, ‘যদি শব্দ নামক জ্যোতিঃ এই সংসারকে দীপিত না করত, তাহলে সমগ্র পৃথিবী অজ্ঞানের অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকত’।
অর্থ-শক্তির সন্ধান
কথিত আছে, নৃত্যের অবসান হলে মহেশ্বর শিব নাকি চোদ্দ বার ঢক্কানিনাদ করেছিলেন। ঢাকের সেই চোদ্দটি বোল থেকে চতুর্দশ মাহেশ্বর (মহেশ্বর হইতে জাত) সূত্রের বা চতুর্দশ শিবসূত্রের উদ্ভব। এই সূত্রগুলি থেকেই পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। কিন্তু, তালবাদ্য থেকে বর্ণের সৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব? আর শিবের ঢাক বাজানো!? –’বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে, ‘ঢ’-এর অর্থই হল ‘ধ্বনি’। খুব সম্ভবতঃ শব্দের কম্পাঙ্কের ধারণাকে এখানে ঢাকের তালবাদ্য রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়, ছাত্রাবস্থার পাণিনি দুর্মেধা ছিলেন। পরে তিনি শিবের তপস্যা করে শব্দশাস্ত্রে পারঙ্গম হন। সুতরাং, এই ‘শিব’ প্রচলিত অর্থের শিব নন।
এই মাহেশ্বর সূত্রগুলি হল,
(১) অ ই উ ণ্,
(২) ঋ ৯ ক্,
(৩) এ ও ঙ্,
(৪) ঐ ঔ চ্,
(৫) হ য ব র ট্,
(৬) ল ণ্,
(৭) ঞ ম ঙ ণ ন ম্,
(৮) ঝ ভ ঞ্,
(৯) ঘ ঢ ধ ষ্,
(১০) জ ব গ ড দ শ্,
(১১) খ ফ ছ ঠ থ চ ট ত ব্,
(১২) ক প য়্,
(১৩) শ ষ স র্ এবং
(১৪) হ ল্।
প্রতিটি সূত্রের শেষ হসন্ত–যুক্ত বর্ণগুলি মূল বর্ণ হিসেবে গৃহীত হয় না, ও’গুলির দ্বারা প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে। -বাকি বর্ণগুলি নিয়ে গঠিত হয়েছে আদি ‘বর্ণমালা’। আ, ঈ, ঔ, ঐ, ৠ(দীর্ঘ-ঋ) এবং ৡ(দীর্ঘ-৯) –এই বর্ণগুলি ‘স্বর-শঙ্কর’ (যেমন, অ+অ=আ)। সম্ভবতঃ সেই কারণেই তারা শিবসূত্রে অনুপস্থিত।
অর্থ-শক্তির সন্ধানে আরও গভীরে ঢোকার আগে ‘প্রত্যাহার সূত্র’ বিষয়টি খুব সংক্ষেপে বোঝা যাক। -এক বা একাধিক সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণটি জুড়ে যে শব্দটি তৈরী হয় তাকে প্রত্যাহার বলে। এই প্রথম ও শেষ বর্ণের মধ্যবর্তী সবগুলি বর্ণ সেই প্রত্যাহারের অংশ (বা অর্থভুক্ত) হয়। যেমন, ‘অণ্’ প্রত্যাহারের অর্থ ‘অ ই উ’, বা ‘অক্’ প্রত্যাহারের অর্থ অ ই উ ঋ ৯। একই ভাবে, ‘অচ্’ প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমস্ত স্বরবর্ণ-কে, ‘হল্’ প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ-কে ও ‘অল্’ প্রত্যাহারের মাধ্যমে ‘সম্পূর্ণ বর্ণমালা’-কে প্রকাশ করা হয়। (লক্ষণীয়: ‘হণ্’ প্রত্যাহারটি হল রায়বংশীয় সুকুমার-খ্যাত ‘হ য ব র ল’!) এই রকম মোট ৪৩টি (মতভেদে ৪৪টি) প্রত্যাহার সূত্র আছে। প্রথম প্রত্যাহারটি ‘অণ্’ হওয়ার কারণে মাহেশ্বরসূত্র বা শিবসূত্রকে অণাদি (অণ্-আদি) সূত্র বলা হয়।
যাই হোক, কামধেনুতন্ত্রের শুরুতেই দেখা যায় ‘পার্ব্বতী’ ‘মহাদেবে’র কাছে বাহান্নটি ধ্বনির/বর্ণের তত্ত্ব জানতে চাইছেন। এরপর আটটি অধ্যায় (পটল:) জুড়ে রয়েছে বাহান্নটি মাতৃকাবর্ণের তত্ত্বকথন। -সে বিস্তৃত বিষয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে আপাতত শুধু ‘অ’ বর্ণটির বিচার করা হবে।
কামধেনুতন্ত্রে ‘অ’ বর্ণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘…শক্তি সমন্বিত, ত্রিগুণাতীত, বিন্দুতত্ত্বময়, প্রকৃতিরূপিনী…।’
‘শক্তি সমন্বিত’-এর অর্থ ‘মাত্রাযুক্ত’। কারণ, মাত্রা শব্দের একটি অর্থ ‘শক্তি’। ‘মাত্রা’ শব্দের বুৎপত্তি হল {√মা + ত্র (ত্রন্)-ণ + স্ত্রী আ}, -অর্থাৎ, ‘সীমায়নের দ্বারা ত্রাণ করে যে/ যা’।
বিন্দুতত্ত্ব সৃষ্টিরহস্যের প্রতিনিধি। এক কথায়, সময়ের সাথে সাথে পদার্থ জটিলতর রূপ ধারণ ও অধিকতর সচেতন অবস্থায় উপনীত হওয়ার রহস্য। -যাকে পাশ্চাত্যদর্শনের ‘ওমেগা পয়েন্ট’ বা ‘ক্রান্তি বিন্দু’র সাথে তুলনা করা যায়। এই বর্ণ ‘প্রকৃতিরূপিনী’, অর্থাৎ সে ‘অস্তিত্বের কারণ ও লক্ষণ’।
ত্রিগুণ হল সত্ত্ব, রজ ও তম। পুরাণ অনুসারে এই তিন গুণ পরস্পরের অনুকূলেও অধিষ্ঠিত। সৃষ্টিকালে এই গুণের সাহায্যে সৃষ্টিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে প্রধান তত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে মহত্তত্ত্বকে (মহৎ-তত্ত্ব) আবৃত করে। এই মহত্তত্ত্ব থেকে ‘অহঙ্কার’ সৃষ্টি হয়। এই অহঙ্কার মহত্তত্ত্বে আবৃত ও তার প্রভাবে শব্দতন্মাত্রের সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে ‘অহঙ্কার’ শব্দের অর্থ ‘আত্মসম্ভাবনা’। ‘মহত্তত্ত্ব’ বলতে সৃষ্টির আরম্ভে প্রকৃতির সাম্যভঙ্গ হলে তার প্রাথমিক ফলাফলকে বোঝানো হয়েছে। আধুনিক সাংখ্যকারদের মতে একেই বুদ্ধিতত্ত্ব বলে।…
‘অ’ বর্ণ (এবং ধ্বনি) অস্তি-ভাব বা বিদ্যমানতা প্রদানকারী। এমনকি ক্, খ্, গ্, ইত্যাদি ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যাঞ্জনধ্বনিও ‘অ’ বর্ণ বা ধ্বনির দ্বারা অস্তিত্বপ্রাপ্ত হয়। ‘অ’-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘অস্তিত্বন’।
[ ঠিক এই মুহূর্তে ওপরে বর্ণিত দর্শনের পূর্ণতা, সীমাবদ্ধতা, বা তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক ভিত্তি’র বিচার করতে উদ্যোগী হলে আমরা মূল উদ্দেশ্য থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হব। এ’কথা ভুললে চলবে না, যে ভাষা-শব্দ-বর্ণের উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি, তার উৎস এই প্রাচীন দর্শন। -ঠিক হোক, ভুল হোক, এই দর্শনকে সম্বল করে ও একেই আকর ধরে শব্দ-ধ্বনি-বর্ণের অর্থ নিষ্কাশনের প্রচেষ্টাটি চালিয়ে যেতে হবে। -ব্যাপারটিতে determinism বা নিয়তিবাদের আভাস পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু আদি-অন্তহীন ক্রিয়ার সামনে দাঁড়ানোর জন্য একফালি জমির প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি আদ্যস্থল বা starting point-এর। ]
উল্লেখিত পদ্ধতি সহ ‘শব্দকল্পদ্রুম’, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’, ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’, ‘তন্ত্রাভিধান’, ‘ছাত্রবোধ’, ইত্যাদি অভিধান ও মূল ধ্বনি বা বর্ণগুলির সামগ্রিক ব্যবহার যথাসম্ভব নিরীক্ষা করে মোটামুটি ভাবে যে ‘ক্রিয়াভিত্তিক’ অর্থগুলি আহরণ করা যায়, তা নিচের তালিকায় দেওয়া হল। আকারে উপন্যাসতুল্য ব্যাখ্যা ও বিবৃতির প্রয়োজন, তাই সচেতন ভাবেই ‘৯’, ‘ৠ’, ‘ৡ’, ও ‘ঃ’ -কে এ’যাত্রা পরিহার করা হয়েছে। (এই তালিকাটি হয়তো সম্পূর্ণ অব্যর্থ নয়। নিরীক্ষণের পরিসীমা যত বৃদ্ধি করা যাবে, তালিকাটি তত বেশি পূর্ণাঙ্গ, সঠিক ও প্রামাণ্য হবে।)
ধ্বনি / বর্ণ
ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ
ধ্বনি / বর্ণ
ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ
ধ্বনি / বর্ণ
ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ
অ
অস্তিত্বন
ঙ্
কারীরহস্যন
দ্
দানন
আ
অস্তিত্ব/ আধার
চ্
চয়ন
ধ্
ধারণ
ই
সক্রিয়ন
ছ্
চয়নস্থিতি
ন্
নাকরণ-অনকরণ রহস্য
ঈ
সক্রিয়
জ্
জনন
প্
পালন/ পান/ প্রাপণ
উ
নবরূপে উত্তীর্ণন
ঝ্
জননস্থিতি
ফ্
পালনাদিস্থিতি
ঊ
নবরূপে উত্তীর্ণ
ঞ্
চায়ীরহস্যন
ব্
বর্ধন/ বহন
ঋ
আবর্তন
ট্
টঙ্কারন
ভ্
বর্ধনস্থিতি/ ভরণ/ ভক্ষণ
এ
দিশাগ্রস্তন
ঠ্
টঙ্কারস্থিতি
ম্
সীমায়ন রহস্যন
ঐ
দিশাগ্রস্ত
ড্
গড়ান
য্/ য়্
_যায়ী/ যোগ্য হওয়ন
ও
অস্তিত্বাদিকরণ
ড়্
উড়ান
র্
রহন/ রক্ষণ/ ভক্ষণ
ঔ
অস্তিত্বাদিকৃত
ঢ্
গড়ানস্থিতি
ল্
লালন/ লোপন
ক্
করণ
ঢ়্
উড়ানস্থিতি
শ্
শক্তিযোজন
খ্
করণস্থিতি
ণ্
টঙ্কাররহস্যন
ষ্
দিশাপ্রাপ্ত শক্তিযোজন
গ্
গমন
ত্
তারণ
স্
একরৈখিক শক্তিযোজন
ঘ্
গমনস্থিতি
থ্
তারণস্থিতি
হ্
হওয়ন
আগেই জেনেছি যে, ‘মহাভাষ্য’ অনুসারে ‘যদি বর্ণসমূহ বা শব্দ অর্থবহ হয়, তাহলে সমূহের প্রতিটি বর্ণ-ও অর্থবহ’। এই ভাষ্যের প্রতিসিদ্ধান্ত হল, -শব্দে উপস্থিত প্রতিটি বর্ণ শব্দের অর্থকে নির্দেশ করে। বর্ণ হল শব্দ-বীজ। আচার্য্য ভর্ত্তৃহরির কথায় –একটি ডিমের মধ্যের তরল উপাদানে যেমন সূক্ষ্ম ভাবে প্রলীন হয়ে থাকে পাখির সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ও ক্রিয়াকারিত্ব, তেমনই বুদ্ধিস্থ এই শব্দবীজে প্রলীন হয়ে থাকে শব্দ-বাক্যের বিবর্তনধর্ম্মের গঠন ও পরম্পরা।
ব্যাকরণে বর্ণ-বিক্রিয়া
রসায়নের পরিভাষায়, কোনও যৌগিক পদার্থে তার উপাদানগুলি ‘আয়ন’ রূপে থাকে। শব্দ নির্মাণের সময় শব্দবীজের (বর্ণগুলির) ঝোঁক থাকে অনেকটা তেমনই। রসায়নে দুই প্রকার আয়ন হয়; -‘মৌলিক’ (অক্সাইড, ক্লোরাইড, ইত্যাদি) ও ‘যৌগিক’ (সালফেট, হাইড্রক্সিল, নাইট্রেট, ইত্যাদি)। বর্ণ-ও তেমন কখনও ঐকিক, কখনও সমবায় রূপে শব্দ গঠনে উদ্যোগী হয়। এই ‘বর্ণ সমবায়’কে ব্যাকরণ চিহ্নিত করে ‘ধাতু’ পরিচয়ে। আগে যেমন বলা হয়েছিল, ধ্বনির/ বর্ণের অর্থের সেই ‘পরস্পর পরিবর্তনশীলতা’ বা ‘mutual dynamism’ -এ ভর করে একটি ধাতু-তে উপস্থিত বর্ণগুলি ‘ধাতু’-টির অর্থ নির্মাণ করে। যেমন;
দ্ = দানন ও ম্ = সীমায়ন রহস্যন, দুই ধ্বনির/বর্ণের মিলনে ‘দম্’ ধাতু, -প্রতীকী অর্থ ‘দমন’ বা ‘দাননের সীমায়নের মাধ্যমে যা সম্পন্ন করা হয়’।
অ = অস্তিত্বন ও দ্ = দানন, এই দুই বর্ণ মিলে নির্মিত হয় ‘অদ্’ ধাতু, -যার প্রতীকী অর্থ ‘ভোজন’ বা ‘যে ক্রিয়া অস্তিত্ব দান করে’।
অ = অস্তিত্বন ও শ্ = শক্তিযোজন, এই দুই বর্ণ মিলে নির্মিত হয় ‘অশ্’ ধাতু, -যারও প্রতীকী অর্থ ‘ভোজন’ বা ‘যে ক্রিয়া অস্তিত্বে শক্তিযোজনা করে’।
‘অদ্’ ও ‘অশ্’ -ধাতুদ্বয় একই ‘কর্ম্মকে’ নির্দেশ করলেও কর্ম্মের উদ্দেশ্যে ভিন্নতার কারণে তারা ‘সমার্থক’ নয়।
যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম্মের প্রতি মানুষের মনোভাব ও দর্শন সন্ধির নিয়মাবলির মাধ্যমেও অমর হয়ে রয়েছে!-
পূর্ণেন্দু, দেবেন্দ্র, স্বেচ্ছা প্রভৃতি শব্দে যে সন্ধির নিয়ম-টি পাওয়া যায়, তা হল –‘অ+ই=এ’। অর্থাৎ, ‘অস্তিত্বন বা অস্তিত্ব দান (অ) প্রক্রিয়া সক্রিয়তা প্রাপ্ত (ই) হওয়ার পরিণাম সেই প্রক্রিয়াটির দিশাগ্রস্তন (এ) প্রাপ্তি’।…
দেবর্ষি, উত্তমর্ণ, প্রভৃতি শব্দে সন্ধির নিয়ম ‘অ+ঋ=অর্’। ‘অস্তিত্বন বা অস্তিত্ব দান (অ) প্রক্রিয়ার আবর্তন (ঋ) হওয়ার পরিণাম অস্তিত্বনের রহন/ রক্ষণ (অর্)’।
‘ত্’ হল ‘তারণ’, ‘খণ্ডিত ত’ বা ‘ৎ’ হল ‘তারণের (impulsion) খণ্ডিত রূপ’ (sudden impulsion)। এক কথায়, -মানসিক ‘উল্লম্ফন’। এই উল্লম্ফন (ৎ) সীমায়িত (ম) হলে সেই উল্লম্ফনের ‘না-করণ’ (ন) ঘটে। -এই দর্শন থেকে উদ্ভূত সূত্র হল ‘ত্/ৎ+ম=ন্ম’ (চিৎ+ময়=চিন্ময়, মৃৎ+ময়=মৃন্ময়, ইত্যাদি)।
করণ (ক) সীমায়িত (ম) হলে তা অসম্পূর্ণতা বা রহস্যময়তা (ঙ/ w) প্রাপ্ত হয় (বাক্+ময়=বাঙ্ময়)।…
‘না’করণে বা অনকরণে (ন্) একরৈখিক শক্তিযোজনা (স) ঘটলে সেই নাকরণ বা অনকরণ (ফলাফল অজানা বলে) রহস্যময়তা (w) প্রাপ্ত হয়। উদাহরণ: হিন্+সা=হিংসা, প্রশন্+সা’=প্রশংসা, ইত্যাদি।…
ক্রিয়া-কর্ম্মের প্রতি এই মনোভাব বোধহয় কিছুটা কট্টরপন্থী। তাই দর্শনের সামান্যতম বিচ্যুতি-কে বিনাশের/নিপাতের লক্ষণ বা ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ নাম দেওয়া হয়েছিল।
দুটি ক্রিয়ার সমন্বয়ে তৃতীয় ক্রিয়ার উদ্ভব বা ক্রিয়ার অভিমুখের পরিবর্তনের দুটি বাহ্যিক ও সহজবোধ্য উদাহরণ নীচের ছবিতে বোঝানোর চেষ্টা করা হল।
ভারতীয় ভাষাগুলিতে প্রায় সমস্ত স্ত্রী/ নারী/ প্রকৃতি বাচক শব্দের (নারী, নদী, পূর্বা, বন্যা, বাণী, সোমা, চন্দ্রা, মা, রাখী, সখী, দূর্গা, ইত্যাদি) সর্বশেষ ধ্বনি/ বর্ণ ‘আ’, ‘ঈ’ অথবা ‘ই’। আসলে নারী বা প্রকৃতির গর্ভেই তো সমস্ত সৃষ্টি, -অর্থাৎ যাবতীয় ‘অস্তিত্ব’ ও যাবতীয় ‘সক্রিয়তা’!…
একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ মিলে যুক্তাক্ষর বা ‘যুক্তবর্ণ’ সৃষ্টি করে, কিন্তু যুক্তবর্ণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবাই সবার উপযুক্ত নয়। যেমন;
‘ক-এ ত-এ ‘ক্ত’ হয়, কিন্তু ‘খ-এ ত-এ’র কোনও যুক্তবর্ণ হয় না। -এর কারণ প্রতিটি বর্ণ কোনও না কোনও ক্রিয়ার প্রতিনিধি। তাই অনুমান করা যায়, -এই ক্রিয়াগুলি যে-যে বিন্যাসে অর্থবহ অসমাপিকা-সমাপিকা ক্রিয়া-সমবায় গঠন করতে পারে, সেই-সেই বিন্যাসেই সংশ্লিষ্ট বর্ণগুলির যুক্তবর্ণ হওয়া সম্ভব। ‘করণের তাড়ণ’ অর্থবহ বলে ক্রিয়া-সমবায় ‘ক্ত’ হয়। কিন্তু, ‘করণস্থিতির তাড়ণ’ অর্থবহ নয় বলে ‘খ-এ ত-এ’র যুক্তবর্ণ হয় না।
‘তাড়ণ’ একপ্রকার মানসিক গতি। ‘স্থিতির গতি’ -অযৌক্তিক। কারণ, ‘গতিপ্রাপ্ত’ হলেই স্থিতি আর স্থিত থাকতে পারে না। তাই দেখা যায় শুধু ‘খ’-ই নয়, ‘ঘ’, ‘ছ’, ‘ঝ’, ইত্যাদি যাবতীয় ‘-স্থিতি’ বাচক ধ্বনির/বর্ণের সাথে ‘ত’ যুক্তবর্ণ গঠন করে না।
‘যোগ্য হওয়ন’ বা ‘যায়ী হওয়ন’ প্রায় সমস্ত ক্রিয়ার সমাপিকা ক্রিয়া হিসেবে অর্থবহ ক্রিয়া-সমবায় গঠন করতে পারে। তাই ‘য’ বর্ণ ‘য-ফলা’ রূপে প্রায় সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হতে পারে। ‘যোগ্য হওয়ন’ বা ‘যায়ী হওয়ন’ স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্রিয়া নয়, উচ্চারণের সময় তার নিজস্বতা লোপ পায় ও আগের ধ্বনির অনুনাদ সৃষ্টি করে। ‘বাক্য’, ‘ভাষ্য’ প্রভৃতি শব্দগুলি উচ্চারণ করলেই এই ‘অনুনাদে’র বিষয়টি বোঝা যাবে।…
এককথায়, ধ্বনির/ বর্ণের এই ক্রিয়াভিত্তিকতার সামনে এলে ব্যাকরণ-বর্ণিত নিয়ম-কানুনগুলির ভিত্তি ও তাৎপর্য্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা – শক্তি ও সম্ভাবনা
‘ধন্যবাদ’-শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ নিষ্কাশন করা যাক;-
ধন্য = ধন্ + য। য = -যায়ী/ যোগ্য (যুজ্ ধাতু)।
ধন্ = ধ্ [(তেজ বা শক্তি) ধারণ] + অন্ (সক্রিয়রূপ)।
অথবা ধন্ = ধ [(তেজ বা শক্তি) ধারক/ধারণকারী/ধারী) + ন্ (অনাকরণ রহস্যন)।
সুতরাং, ‘ধন্য’ = ‘তেজ বা শক্তির ধারক গিয়া থাকে যাহাতে’ = যে তেজধারী/ তেজধারককে পেলে মানুষ ভাগ্যবান/ধনলব্ধা (মানসিক বা বাহ্যিক)/ প্রশংসাপ্রাপ্ত হয়।
বাদ = ‘বদ’ (কথন) হইতে জাত।
বদ = ব (বর্ধক/ বাহক) + দ (দাতা) = (ভাব-কে) বর্দ্ধনকারী ও/অথবা বাহক দান করে যে/যা = ভাষণ, কথন, কীর্ত্তণ, ধ্বনি…।
ভাষণ, কথন, কীর্ত্তণ বা ধ্বনি হইতে জাত হয় তাদের ‘স্মৃতি’, ‘উপলব্ধি’, ‘সিদ্ধান্ত’, ‘প্রতিক্রিয়া’ ইত্যাদি।
সুতরাং, ‘ধন্যবাদ’ শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল ‘মানসিক বা বাহ্যিক ধনপ্রাপ্তির স্মৃতি/ উপলব্ধি/ সিদ্ধান্ত/ প্রতিক্রিয়া’।
শব্দটির প্রতীকী অর্থ ‘প্রশংসাবাদ’ বা ‘কৃতজ্ঞতা’। -তুলনায় ক্রিয়াভিত্তিক অর্থের গভীরতা লক্ষনীয়।
এবার ধরা যাক, একটি প্রাচীন বাক্য আমাদের সামনে এল, -‘পার্ব্বতী মহাদেব শিবের তাপ ধারণ করিলেন।’ বাক্যটির অর্থ বুঝলাম, ‘Parvathi (the daughter of mountain king) has contained the heat of lord/god Shiva’ -এমন কথা শুনে একজন ভক্তিবান মানুষের চোখ মুদে আসতেই পারে, কিন্তু একজন যুক্তিমতি মানুষের নাক না হলেও কপাল তো কুঁচকোবেই। [ ভক্তি বনাম যুক্তির এই দ্বন্দ্ব লোকসম্মুখে এলে যে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি-ও সৃষ্টি হতে পারে, -সে’কথা না তোলাই মঙ্গল! ]। মোটের ওপর বাক্যটির অর্থ যা বুঝলাম, -তা অলৌকিক, অবাস্তব না হলেও পরাবাস্তব। কিন্তু, এছাড়া কি বাক্যটির অন্য কোনও অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই? -অর্থ বলতে এখানে নতুন কোনও ‘ধার্ম্মিক ব্যাখ্যা’র কথা বলা হচ্ছে না, অর্থ বলতে এখানে ‘ভাষাতাত্ত্বিক অর্থ’। তবে বলে রাখা ভাল, অর্থের এই বিনির্মাণ শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যই।
‘পর্ব্বত’ হইতে যা জাত হয় তা ‘পার্ব্বত’ (সম্বন্ধ তৎপুরুষ)। ‘পার্ব্বত’ এর স্ত্রীলিঙ্গ বা প্রকৃতিবাচক শব্দ হল ‘পার্ব্বতী’। বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে, ‘পর্ব্বত’-এর অর্থ ‘পর্ব্ব যুক্ত’ বা যা পর্ব্বে পর্ব্বে বিন্যস্ত। ‘পর্ব্ব’ শব্দের অর্থ (বঙ্গীয় শব্দকোষ) যেখানে গ্রন্থি (বাঁশ জাতীয় উদ্ভিদের), দেহসন্ধি, বৎসরের বিশেষ কাল, গ্রন্থ/পুস্তকের অংশ, প্রস্তাব, অবসর, বিভাগ, ইত্যাদি। সেখানে বিশ্বভুবনে একমাত্র mountain-কেই ‘পর্ব্বে পর্ব্বে বিন্যস্ততা’ গুণের ধারক ধরে নেওয়া হবে কেন? –হয়তো উত্তর আসবে -‘প্রাসঙ্গিকতা’ বা context-এর কারণে। তাহলে বাক্যটির অন্যান্য শব্দগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক অন্য কোনও প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা;-
মহান যে দেব = মহাদেব (সাধারণ কর্ম্মধারয়)। নিরুক্তে ‘দেব’ শব্দের তিনটি তিনটি অর্থ এবং চারটি ব্যুৎপত্তি দেখানো হয়েছে – (১) ‘দা’ ধাতু থেকে, (২) ণিজন্ত (কারণসূচক/কার্যোৎপাদী/‘causative’) ‘দীপ’ ধাতু থেকে, (৩) ণিজন্ত ‘দ্যুৎ’ ধাতু থেকে, (৪) ‘দিব’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ দেব বা দেবতা ঐশ্বর্য ও ঈপ্সিত বস্তু দান করেন, তেজোময় বলে পদার্থকে প্রকাশিত করেন, সাধারণত দ্যুলোকে অবস্থান করেন, ইত্যাদি। ‘দ্যুলোক’ = দিব্য লোক (কর্ম্মধারয়) বা স্বর্গ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩.১.১০)। ‘দেব’ বা ‘দেবতা’র লৌকিকতাকে বিবেচনায় ধরলে ‘স্বর্গে’র-ও নিখাদ পরলৌকিকতার প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগে। যাই হোক, ওপরে উল্লেখিত সমস্ত গুণধারিগণ শুধু অলৌকিক বা পরাবাস্তব শুধু নয়, রক্তমাংসের বাস্তব চরিত্র-ও হতে পারে। স্মর্তব্য: পিতৃদেব, পতিদেব, গুরুদেব, ইত্যাদি। এমনকি বেদের দেবতত্ত্বেরও বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেকজন তথাকথিত ‘দেবতা’ই কোনও না কোনও প্রাকৃতিক বা সামাজিক শক্তি থেকে কল্পিত।
‘শিব’ শব্দের অর্থ (অমরকোষ, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ছাত্রবোধ, ইত্যাদি) হিসেবে পাওয়া যায় মঙ্গল, শুদ্ধ, হিতকর, অনুকূল, পশুগণের পতি (‘পশু’ = যারা অবিশেষে দেখে -বঙ্গীয় শব্দকোষ), শূলধারী, নীলকন্ঠ, ইত্যাদি। ভাবতে কি খুব কষ্ট হয় যে এই সমস্ত গুণের ধারক কোনও লৌকিক সত্ত্বাও হতে পারে? মনে রাখা উচিত ‘শিবির’ (শিবগণের নিবাস) বা ‘শিবিকা’ (শিবগণের পরিবহন) কিন্তু বাস্তব মানুষও ব্যবহার করে/ করত। (যা ছিল ‘শিব’গণের পরিবহন, সামাজিক পট পরিবর্তনের ফলে তা দলপতিগণের বা ‘পাল’-গণকে বহন করতে শুরু করলে শিবিকা ‘পালকি’ হয়ে যায়!)… যাই হোক, ‘শিব’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘জ্ঞানের শিখা বহনকারী’ বা ‘উদ্ভাবক জ্ঞানবাদী’।
‘তাপ = heat’ -এ হল শব্দার্থের হিমশৈলের চূড়াটুকু। -একরৈখিক, শুধুমাত্র আধারবাচক, অসম্পূর্ণ। ‘পার্ব্বত’ যেমন ‘পর্ব্বত’ হইতে যা জাত, তেমনই ‘তাপ’ = ‘তপঃ হইতে জাত’ (সম্বন্ধ তৎপুরুষ)। তপঃ-এর অর্থ নিয়ম, ব্রত, সাধনা, দৈহিক বা মানসিক ক্রিয়া বা শ্রম, ইত্যাদি। এই পক্রিয়ার ‘অন্যতম’ ফল heat হতেই পারে, কিন্তু তা ‘একমাত্র’ ফল নয়।
এবার পূর্বকল্পিত ধারণাগুলি কিছুক্ষণের জন্য দূরে রেখে পার্ব্বতী, মহাদেব, শিব, তাপ –শব্দগুলির প্রতীকীবাদী অর্থের বদলে প্রকৃতিবাদী বিভিন্ন সম্ভাবনাকে বিবেচনা করলে এই আপাত-অলৈকিক বাক্যটির লৌকিকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। -সেই সাথে সম্ভব কোনও অজানা লৈকিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া-ও। এই ভাবেই ‘সতীর্থে’র ‘তীর্থ’, ‘কেশবে’র ‘কেশ’, ‘পরমানিকে’র ‘মানিক’, ‘নাগরিকে’র ‘নাগ’, ‘মেধা’র ‘মেধ’, ‘অম্বরে’র ‘অম্ব’, ‘দশরথে’র ‘রথ’, ‘ধৃষ্টদ্যুম্নে’র ‘ধৃষ্ট’ ও ‘দ্যুম্ন’, ‘গোবর্ধনে’র ‘গো’, ‘পারিজাতে’র ‘পারি’ ও ‘জাত’, ‘উত্তরা’র ‘উত্তর’, ‘বাসুকি’র ‘বসু’, ‘সুভদ্রা’র ‘ভদ্র’… ইত্যাদিকে চেনা সম্ভব হলে যে মহাভারতীয় সভ্যতার বিবেচনাসমূহের দরজা খুলে যায়। আর তার দ্বারস্থ হলে -আধুনিক মানবসমাজ যে সকল সমস্যার ‘সমাধান’ খুঁজতে গিয়ে নিত্যনতুন ‘সমস্যা’র নির্মাণ করে চলেছে, –হয়তো তার-ও কিছুটা সুরাহা পাওয়া সম্ভব।
শেষ।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..