খণ্ডিত মুক্তগদ্য

শাহীদ লোটাস
মুক্তগদ্য
Bengali
খণ্ডিত মুক্তগদ্য

ফালতু লোকের প্রতি ভাবনা

আপনি দেখবেন যে আপনার পরিবার বা আত্মীয়দের মাঝে এমন কেউ আছেন যিনি অধিকাংশ সময় আপনকে বা অন্য কাউকে একের পর এক উপহাস করেই যাচ্ছে।  কার কোন ভুল হলো, কার কোন কোন ক্রুটি আছে তা সে নিংড়েয়ে নিং-রিয়ে বের করতে করতে মুখ টিপে হাসছে। আর যখন তার আপনার প্রতি বলা সেই উপহাস জনিত ঠাট্টা মশকরার কথা গুলোর বিরোধিতা করে আপনি যুক্তি-দিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছেন তখন সে আপনার কথা না শুনেই বিজয়ীর ভঙ্গিতে উঠে চলে যাচ্ছে, হেলে দুলে হাটতে হাটতে। আপনার কথার কোন দামেই দিচ্ছে না সে। তখন আপনার ইচ্ছে হচ্ছে আপনার জুতা খোলে তাকে পেটাতে, সবার সামনে তাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে, কিন্তু আপনি কিছুই করতে পারছেন না।

এমন মন-মানসিকতার লোক আপনার যতটা ক্ষতি করবে এতটা ক্ষতি বাইরেই কেউ করতে পারবেনা, এই ধরনের লোক আপনার মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ রূপে নষ্ট করে দিতেও সক্ষম, আপনার কোন ভালো কাজ মহত কাজকে এই ধরনের লোক উপহাস করে থামিয়ে দিতে পারে নির্দ্বিধায়, আপনার জীবনের উন্নতির সিঁড়ি এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুড়ে খান খান করে দিতে পারে সে। কারণ এই লোক আপনার আত্মীয় আর আপনি কখনো কখনো ভাবছেন এই লোক হলেন জ্ঞানী। এমন ব্যক্তি আপনার মানুষিক যন্ত্রণার কারণ হওয়ার সব চেয়ে বেশী ব্যাপারটি হলো, এই ব্যক্তিকে মুখ ফুটে আপনি কিছু বলতে পারছেন না, আপনার রাগ হলেও আপনাকে চুপ করেই থাকতে হচ্ছে তিনি আপনার কথায় রেগে যান কি না, কষ্ট পান কি না এই ভেবে। অথচ আপনার প্রতি তার উপহাস তার ধরিয়ে দেওয়া মিথ্যে ভুল গুলো, তার উল্লেখিত আপনার অযোগ্যতাগুলো আপনার মাথার ভেতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে, ভন ভন করছে, এই কারণে কোন কিছুতেই আপনি মন বসাতে পারছেন না, ঘুরে ফিরে শুধু সেই কথা গুলোই মনে হচ্ছে আপনার।

এই নিজে ভাবা পণ্ডিত লোকটি আপনার কোন ভালো দিকেই সে দেখবে না বা দেখলেও তা কখনই কারো সামনে বলবে না, খুঁজে বের করারও চেষ্টাও করবে না, এ লোকে শুধু আপনার অক্ষমতা খুঁজে খুঁজে বের করবে, আর কোন না কোন ভাবে আপনাকে উপহাসের যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে চাইবে, আর তার সঙ্গে মিশে যাবে আপনারে আরও কিছু নির্বোধ আত্মীয় স্বজন যারা তার কথাগুলো দাঁত বের করে করে শুনবে আর একটু পর পর হেসে যাবে। কিন্তু কখনই এই ঠাট্টা কারীরা বলবে না যে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সব কিছু থাকে না, কেউ সংয় সম্পূর্ণ হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়, এই নির্বোধ লোক গুলোকে আপনি যতই বলবেন যে কোন এক মানুষের যদি কেউ ভুল ধরতে চায়, তাহলে তার যে কোন বা সব কাজ গুলোর ভুল ধরা সম্ভব, তার প্রতিটি কাজেরেই খারাপ দিক বের করতে চাইলে কোন না কোন ভাবে প্রমাণ করা সম্ভব যে সেই কাজ মন্দ, পক্ষান্তরে প্রতিটি কাজের যদি কেউ ভালো-দিক প্রমাণ করতে চায় তাহলে কোন না কোন বিষয় থাকে সব সময় যে সেই কাজটি ভালো এবং সঠিক তা প্রমাণ করবার, কিন্তু এই ঠাট্টা উপহাস কারীরা এমন ধারনা কখনই করবে না এমনি করতে চাইবেই না, এদের দৃষ্টি থাকবে মন্দের দিকে, কারণ এদের মন মানসিকতা হীন এবং নিচু, এরাই হলো সমাজের বোজা পরিবারের ক্ষতিকারক ব্যক্তি। এমন লোকের উদ্দেশ্য হলো আপনাকে মানুষিক ভাবে দুর্বল করে আপনার জীবনের উন্নতি ও বড় হওয়ার সবল স্বপ্ন ও ইচ্ছা থেকে আপনাকে দুরে রাখা। আপনি আরও একটু খেয়াল করলে দেখবেন এমন লোকের দ্বারায় কেউ কখনো উপকৃতও হয় না, কাউকে এমন লোক উৎসাহ বা মানসিক সাহস দিয়ে এমন কিছু করায় না যার জন্য অন্যে কেউ উপরে উঠে যায়। শিক্ষিতের এমন লেবাস ধারী নিন্দুক মানুষটি আপনার এত ক্ষতি করে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

কিন্তু আপসোসের বিষয় হলো আমরা কখনই মুখ ফুটে বলতে পারি না যে আপনি যথেষ্ট পরিমাণের মুখ্য, দুনিয়ার ভালো কোন কাজেই আপনার দ্বারা সম্ভব নয়, আপনি কোন যোগ্যতায় শিক্ষিতের লেবাস পরে থাকেন?

নিজেকে চেনা

তার মানে, আমি আমার সময়ের  এক উদ্ভট আবিষ্কার। আমার মাঝেই আমি জেনেছি আমাকে, আমি মনস্তাত্ত্বিক জীবনের এক অবান্তর শ্রমিক, আমার চারপাশে কীটের-মতো কিলবিল করে বিফল প্রত্যাশা, এই সব প্রত্যাশার গলি পারি দিয়ে আবার নতুন করে হাটতে চাই আমি, হাতছানি দিয়ে দুরের আলো  ছুতে গিয়েও ছুতে পারিনা। প্রিয়তমার শরীরের ঘ্রাণের তৃষ্ণায় আমার আমি যখন ছারখার হই, বুঝতে পারি তখন এক ক্ষুধার্ত পশু আমার মাঝে জেগে উঠে খুব স্বেচ্ছাচারী হয়ে। সবচেয়ে গভীরতম উপলব্ধিটুকু আমার জীবনে কখনই জাগাতে পারিনি বোধহয়, হয়তবা জাগাতে পেরেছিলাম, বুঝতে পারিনি। শহরের ধূলি, বালি, কণা, শতাব্দীর পরিবর্তনে বিবর্তিত হয় ঠিক, কিন্তু ঘৃণা থেকে যায় ঠিক আগের মতই, এই সব ধূলি,বালি এই সব দরিদ্রতা দিনের আলোর মতো আমাকে পথ দেখায় আর সহবাস করে প্রতিনিয়ত গণিকার মতো। জীবন থেকে পালাবার প্রত্যাশায়  কখনো ইচ্ছাকৃত ঘুমিয়ে পড়ি, কখনো বা তন্দ্রার অভিনয় নিয়ে পালিয়ে থাকি নিজেরই দৃষ্টি থেকে। নিরুপায় হয়ে অসংখ্যবার দেখেছি হাসিমুখে ধনাঢ্যদের কি নির্মম কপটতা, তাদের স্নেহ-মাখা হাসির আড়ালে কতটা স্বার্থ, তাদের হাত বুলানোর আড়ালে আমাকে দাশে রূপান্তরিত করার কতটা-সূক্ষ্ম কৌশল।  ধনাঢ্য শব্দটি অবশ্যই লোভনীয়, কিন্তু আমি বুঝেছি এই শব্দের অন্তরেই পাপ লুকিয়ে আছে, থাকে আবার শ্রদ্ধা, ভয়, তোষামোদ। ধনাঢ্য আর শিক্ষিত দু শ্রেণীর লোকেরাই আজ সমাজের নীতি নির্ধারক।  নিরক্ষর পৃথিবীতে যে অক্ষরজ্ঞান এনেছিলেন তিনি নিশ্চয়  কপট ছিলেন না, কিন্তু সাক্ষরতার মাঝেই আমরা কপটতা খুঁজে পাই বার বার। যারা ক্ষমতার যৌগিক কোন অংশ তারাই আজ কপটতা লালন করেন। যে কারণে আমি এখনো এই পৃথিবীর অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।

কপটাচরণ

আমি ভেবে পাইনা, কেন তারা সামান্য করণেই নিজেকে এতো ছোট করে। সামান্য খাবারেও তারা  এই কৃপণতা বাদ রাখে না, যদিও তাদের অতোটুকুর প্রয়োজন নেই। এটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে, তোমাকে আমরা করুণা করি মাত্র, তোমাকে ভালোবাসা বা সম্মান দেখানোর কোন কারণ নেই। এমতাবস্থায় যখন তারা পারিবারিক অলোচনা মেতে উঠে তখন নিজেকে তারা মহান করে উপস্থাপন করে কতো নানা ভাবে, বলে ‘তারা  খুবেই নিরপেক্ষ আর তাদের মতো মহান ব্যক্তি সচরাচর পাইয়াই যায় না। তখন আমার খুব হাসি পায়, তাদের ভণ্ড না বলে কিছুতেই যেন আমার ভেতরের শব্দহীন প্রতিবাদ গুলো থামে না।

শ্রমিক হয়ে বাঁচা

আমাকে ফিরে যেতে হয় অপ্রিয় সেই কাজে, যে কাজগুলো থেকে আমি মুক্তি চাই, ঘাম, তৈলাক্ত শরীর, বিশ্রী গন্ধ, আর খিটখিটে মেজাজে সেই সব মুহূর্তগুলো। আমি জানি কিছুতেই আমি সহজে মুক্তি পাবো না, যতই পালাতে চাই, দুরে যাই বা কাছেই থাকি। অন্য,বস্ত্র, বাসস্থানের প্রয়োজনে নিজেকে আবার কৃতদাস হিসেবে প্রভুদের এড়ো চেখের সামনে আমাকে দাড়াতেই হবে। যুগে যুগে শতাব্দীতে সভ্যতা পরিবর্তনকারী হয়ে অঞ্চল, দেশ, দ্বীপ নতুন নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটায় নতুন স্বপ্নের, মানুষ মানুষ থেকে প্রভু হয়, কিন্তু মানুষ প্রভুদের সেই লোভের ঘৃণার এড়ো দৃষ্টি ঠিক থেকে যায় এভাবেই, হয়ত পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে। পরিশ্রম করে যারা খেয়ে পরে বাচে তাদের মানুষ না ভেবে শ্রমিক ভাবা, অসহায়ত্বের সুযোগে শ্রমিকের স্বপ্নগুলো উপর তলার পায়ে পিষ্ট করার ফন্দি-ফিকির রয়ে গেছে সেই আগের মতই। শ্রমিক হয়ে বাচা যেন পশুদের জীবনেরেই এক অঘোষিত অংশ, এই অঘোষিত জীবন থেকে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন যাত্রায় আমি হেটে চলেছি।

অপরিচিতের প্রতি ভাবনা

আমরা যখন কোন অপরিচিতকে নিয়ে ভাবি তখন কত কিছুই না ঘটে যায় আমাদের চিন্তা জগতে। মানুষটি যদি আমাদের খানিকটা পরিচিত অথবা সম্পূর্ণ অপরিচিতও হয় তবোও তাকে নিয়ে আমরা অনেক কিছুই ভাবতে থাকি নিজের মত করে। যেমন ধরুন, সে কি ভাবে হাটে? হাটার সময় তার পা কতো খানি ফাকা করে রাখে? তার মাথা সামনে ঝুঁকে থাকে কি না? তার হাসি কতটুকু লাবণ্য প্রকাশ করতে পারছে অথবা সে কি নির্বোধ শ্রেণীর কেউ কি না? আমরা তার দিকে যদিও সরাসরি হা করে তাকিয়ে থাকি না কিন্তু দুই এক পলকের যে সময়টুকু তাকে ভদ্র ভাবে দেখি নিই সেই সময়টুকুতেই আমরা বুঝার চেষ্টা করি এই সব কিছু। আমরা হয়ত অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু সবটুকু মনোযোগ থাকে তার প্রতি আর আমরা বিশ্লেষণ করতে থাকি, তার কথা বলার ধরুন, সে যা বলছে তা কি সত্যিই যুক্তিযুক্ত কি না, না কি অহেতুক বকবক ছাড়া আর কিছুই করছে না সে।

তাকে নিয়ে যদি কোন কফিসব অথবা রেস্টুরেন্টে বসা হয় তখন সে কি করবে? কি ভাবে খাবে? আরো আরো অনেক কিছু ভাবতে থাকি সে যতটা সময় আমাদের সামনে থাকে অথবা চলে যাবার পরেও। এমন ভাবতে ভাবতে এক সময় তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গও খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে শুরু করি আমরা। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনো হয় যে এমন অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত মানুষটিকে নিয়ে আমরা কল্পনায় যৌন সম্ভোগেও মেতে উঠি খুব উত্তেজনা নিয়ে।

সিন্স ১৯৯৪: কোন এক দুপুর বেলা

সামনের পথ দিয়ে এখন যিনি হেঁটে যাচ্ছেন তিনি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যাগ ভর্তি আনন্দ, অনেকটা সময় পর ফাঁকা পথের তিনিই প্রথম পথচারী, তার পেছনে পেছনে আসছেন আরো দুজন, তাদের উদাস চাউনিতে লেগে আছে কিছু হারিয়ে ফেলার প্রতিচ্ছবি। এই পিচ-ডালা পথ মূলত রেললাইনের পাশ দিয়ে গেছে, আর রেল লাইনটি আমাদের বারান্দার ঠিক সামনে, মাঝখানে একটু যায়গা সেখানে সবজি চাষাবাদ হয়।

রেললাইনের কাঠগুলো আলকাতরার সুঘ্রাণ নিয়ে আমাকে বিমোহিত করে যাচ্ছে! আমার কোন কাজ নেই বলে আমি বারান্দায় বসে আছি একা একা। পাশের বাসার মহিলাটি কাউকে ধমকাচ্ছেন, আমি স্পট শুনতে পাচ্ছি তার কণ্ঠে নিজের প্রতি শ্লাঘা, মনে হয় তার ছেলের উদ্দেশ্যেই তিনি বলে যাচ্ছেন এখন, এমন তিনি মাঝে মধ্যেই করে থাকেন। রেল লাইনের পাথর, লৌহ, কাঠ আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছি, আমার ভালো লাগছে দেখতে, অন্তত যখন একা থাকি, আমি অবশ্য একাই থাকি অধিকাংশ সময়, আর যখন ঝকঝক ঝংকার তুলে লৌহপথের উপর দিয়ে দ্রুত রেলগাড়ি চলে আমি ভেতর থেকে দৌড়ে হাজির হই রেলের খুব কাছাকাছি, চলন্ত রেলের যাত্রীদের সংখ্যা হিসেব করতে চেষ্টা করি, কিন্তু তার আগেই চলে যায় রেল, মাঝে মধ্যে যাত্রীবাহী রেলের এক একটি স্বতন্ত্র অংশের হিসেব রাখতে পারি। রেল চলে যাবার পর প্রকৃতি ঝিম ধরে থাকে বেশ অনেকক্ষণ, চলন্ত রেলের দৃশ্য মাথায় খেলা করে, প্রতিধ্বনি হয়, তখন খুব ইচ্ছে করে আমিও যাত্রীদের মতো যাত্রী হই।

বারান্দার কাছাকাছি কেউ নেই বলে আমি আমার মনের মতো তাকিয়ে থাকতে পারছি রেললাইনের পাশ দিয়ে ঘেঁষে চলা পিচ-ঢালা পথের দিকে, বসে থাকা কয়েক জনকে নিয়ে ক্রিংক্রিং শব্দে একটি রিক্সা চলে গেলো এখন, তারপর যে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি অন্য কোন দিকে তাকাচ্ছেন না, মনে হয় খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরতে হবে তাকে।

এবার আমি আমার আম্মার গলা শুনতে পেলাম, বাবাকে তিনি বকছেন, তার কথার প্রতিটি শব্দ এতো জোড়ালে ভাবে বলছেন যে, মনে রাখার মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি বাক্য। আমার বাবা বিছানায় লম্বা হয়ে শোয়ে আছেন, বাবার মুখে টু শব্দ পর্যন্ত নেই, এই গরমের মাঝেও তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মোটা কাঁথায় দিয়ে ঢাকা, তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে পড়েছের ঠিক বুঝা যাচ্ছে না, মূলত তিনি ঋণদাতাদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন, এমনকী নিজের কাছ থেকে নিজেকেও।

সকালে বেলাতেই আজকাল খুব রোদ উঠে, সময় যখন দুপুরে গাড়ায় এই রোদে রেললাইনের থাকা পাথর, লৌহ, আলকাতরা মিশ্রিত কাঠ সব চিকচিক করে। এখানের বসতি গুলো খুব নিরিবিলি, প্রতিটি বাসার সামনেই খোলা যায়গা আছে সেখানে আছে গাছ গাছালী। আমাদের বাসার উত্তর দিকের দু বাসা পরের বাসার সামনের গাছগাছালি এত যে তা দেখে ঝোপঝাড়েই বলা যাবে, সেখানে বড় বড় আম গাছ আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি একটি বড় গাছের ছায়ায় আরামকেদারায় আয়েশ করে শোয়ে আছেন সৌরভের দাদা। সৌরভ আমার সম বয়সী বন্ধু, ওর দাদাকে প্রায় সময় দেখি ঐ ভাবে শোয়ে বসে থাকতে।

আমার কিছু করার নেই বলে আমি এখন বসে আছি আমাদের ভাড়া বাসার ঠিক বারান্দায়। হতাশা নিয়ে গভীর বেদনা নিয়ে তাকিয়ে আছি রেললাইনের দিকে, রেললাইন আমাকে দেখছে না, শূন্যতা নিয়ে চলে গেছে বহুদূর।

আমার ভেতরের আমি

আমার ভেতরের আমিটা সব সময় কল্পনায় বিভোর থাকি, দুনিয়ার কত শত কাজের মাঝে ব্যস্ত থাকি অবিরত। আমার ভেতরের আমি খুব বড় এক সাহিত্যিক, কবিতার দুর্লভ পঙ্ক-ক্তি আবিষ্কারের চিন্তাধারায় মেতে থাকি সব সময়, আমি কখনো কখনো বৈজ্ঞানিক হয়ে থিসিস এনালাইসিস নিয়ে মগ্ন থাকি অনুমানের ল্যাবরেটরিতে, কখনো বা হয়ে যাই খুব বিখ্যাত নায়ক অথবা গায়ক। আমার চারদিকে থাকে অগণিত শত লক্ষ ভক্ত, যারা আমাকে এক পলক দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকে দিনের পর দিন, আমি তাদের সামনে হাজির হলেই তারা বিমূঢ় মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, আমি যেন কোন দেবদূত। কি অদ্ভুত জাগ্রত স্বপ্ন আমাকে বিভোর করে রাখে সব সময়, যেন সত্যি সত্যিই আমি তাই যা ভাবছি। কখনো কখনো এমন হয় যে নিজের এই মানস রচনা আর বাস্তবতার মাঝে আমি কোন দূরত্বই পাইনা, আমি আসলে কোনটি ঠিক নির্দিষ্ট করে বলতেও পারিনা তখন। আমার এই মনগড়া বিষয় গুলোই সত্যি বলতে আমাকে সব চেয়ে বেশী সুখী রাখে, এই অসম্ভব সব জীবন সৃষ্টির ক্ষমতা যদি আমার চিন্তাজগতে খুব শক্তি আর নিপুণ দক্ষতা নিয়ে না আসতো তবে হয়ত আমার বাচাটাই খুব দর্বিসহ হয়ে উঠতো পৃথিবীতে। মূলত আমার এক সীমাবদ্ধতার জীবন নিয়ে এসেছি এই পৃথিবীতে, প্রাচুর্য, বুদ্ধি, দক্ষতা বা অন্যান্য যে কোন শক্তির সক্রিয় চৌহদ্দির ভেতরেই যা পাওয়া সম্ভব তাই পেয়ে থাকি আমি, অথচ আমার স্বপ্ন এই চৌহদ্দির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে না, সে তার ইচ্ছে অনুযায়ী প্রত্যাশা করে, আর পেয়েও যায়, তার সীমানা অসীমের মাঝে, আমি সেই অসীম ইচ্ছার সার্থকতা পাই আমার কল্পনাতেই। আমি যখন হারানো প্রেমিকার বিরহে খুব বিষণ্ণ মনে নিঃসঙ্গ হই তখন সেই প্রেমিকাকে নিয়ে হাজির হয় আমার ভাবনা, সংসার হয়, হয় মান অভিমান, হয় আরো কত কি। আমি যা হতে চেয়ে হতেই পারিনি সেই না হওয়াটাই হয়ে যাই এই চিন্তাজগতে। আমি যেই সংসারের প্রত্যাশায় দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকেছি, প্রার্থনা করেছি স্রষ্টার কাছে সেই সংসারও আমি ঠিক ঠিক পেয়ে যাই আমার জাগ্রত স্বপ্নে। সত্যি বলতে আমার অপূর্ণতা গুলোর পূর্ণতা এনে দেয় আমার কল্পনা শক্তি, যদিও তা আমি অন্যদের কখনো দেখাতে পারি না, বলতেও পারি না যে আমি আজ আমার ভাবনায় এটা পেলাম,ওটা পেলাম, একে নিয়ে এই করেছি, সেই করেছি। আমার এই ব্যাপার গুলো কাউকে কখনো বলিও না, এই সুখের ব্যাপার গুলো আমি যত দক্ষতা নিয়ে, যত সুমধুর কণ্ঠেই অন্যদের বলি না কেন শোনার পর শ্রোতা আমাকে পাগল ভাবতে বিন্দু মাত্র অপেক্ষা করবে না। কিন্তু আমরা সবাই কল্পনা প্রবণ, ভাবনা প্রবণ। বলুন-তো এত কঠিন বাস্তবতা নিয়ে কি কখনো কারো বাচা সম্ভব হয়?

ইচ্ছে সুখ

আমি যদি কখনো বিয়ে করি, স্ত্রীকে নিয়ে কিছু কাজ করার খুব ইচ্ছে আছে আমার।  যেমন এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আমরা দু-জন (স্ত্রী) এক সঙ্গে বসে  ফুঁকবো, দরজা জানালা বন্ধ থাকবে আমাদের, ধোঁয়ায় বুদ হয়ে যাবে যখন ঘরের ভেতর তখন গভীর চিন্তায় তাকিয়ে থাকবো একে অন্যের দিকে। অথবা আমরা সেই সিগারেট  ফুঁকবো দূরে এমন কোথাও, যেখানে আমাদের তেমন কেউ চিনে না আমরা হলাম অপরিচিত সবার কাছে। খোলা আকাশের নিচে ধূয়া উড়াতে উড়াতে সিগারেট খাওয়ার প্রতিযোগিতা মত্ত-থাকবো আমরা দুজন, সিগারেটের অদ্ভুত অপরিচিত নেশা আমাদের বুদ করে রাখবে, ধোঁয়ার গন্ধযুক্ত বাতাস বার বার আমাদের গায়ে এসে পড়বে, আমরা তবোও সিগারেট খেতেই থাকবো।

আমার আরো খুব ইচ্ছে, কোন এক রাতে ভালো কোন ব্র্যান্ডের মদ এনে আমার দুজন চিয়ার্স বলে পান করতে থাকবো মনের সুখে, প্রতিটি প্যাকে মত্ততাযুক্ত তিক্ততায় নিজেদের ভুলে নতুন করে কিছু পাওয়াতে যতোটা আত্মহারা ভাব আছে তা উপলব্ধি করে খুব মাতাল হবো আমার, মদ খেতে খেতে আমরা যখন খুব মাতাল হবো তখন নেশায় বিভোর হয়ে শুয়ে থাকবো একে অন্যের উপর।

শুধু নিষিদ্ধ কাজ নয় কিছু শুদ্ধ কাজও তাকে নিয়ে করার খুব ইচ্ছে আছে আমার, যা আমি একা একা করে আসছি শৈশব থেকেই তেমন কাজ তাকে নিয়ে করতে চাই।

পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্না মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে রবো আমরা দুজন, কেউ কোন কথা বলবো না, শুধু তাকিয়ে থাকা হবে আমাদের কাজ, আমাদের উপরে থাকবে নক্ষত্র ভরা বিশাল আকাশ, ঝলমলে চাঁদ, আর কিছু মেঘ, মাঝে মাঝে প্রকৃতিকে অন্ধকার করে যাবে হালকা মেঘ রাশি। এমন রাতের আকাশ তলায় আমরা দু-জন ঘাসের উপর শুয়ে রবো খুব নীরবে।

আমার খুব ইচ্ছে জ্যোৎস্না রাতে গহীন বনে তাকে নিয়ে হেটে যাবো মধ্য রাতে, আমরা অচেনা প্রাণীদের সঙ্গে মিশে যাবো খুব সহজেই।

আমার খুব ইচ্ছে মুশলধারার বৃষ্টিতে আমার স্ত্রীকে নিয়ে স্নান করবার, আকাশ কালো করা মেঘের বৃষ্টি, যেই বৃষ্টিতে থাকবে ঝড়ো বাতাস কিছুটা, গাছের পাতা দুল খেতে থাকবে নিজেদের ছন্দে, আমরা তখন হাত প্রসারিত করে দাড়িয়ে থাকবো অনেকক্ষণ, বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে যাবে স্রোতের মত, একজন আরেকজনের গায়ে বৃষ্টি ছেটাবো খুব সহজেই।

ইচ্ছে আছে একদিন তাকে নিয়ে হেটে যাবো অচেনা কোন মেঠো পথ ধরে, যে পথে আমরা কখনো হাটি-নি, সেই অচেনা পথ কোন অচেনা গায়ের বুক দিয়ে চলে গেছে অজানা কোথাও। আমরা যখন হেটে হেটে ক্লান্ত হবো তখন পথের পাশে কোন হিজল গাছে হেলান দিয়ে জিরবো দুজন, রোদের জলকে দূরের অস্পষ্ট কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকবো খুব নিবির ভাবে।

আমার খুব ইচ্ছে বর্ষার থই থই জলে তাকে নিয়ে নৌকা করে নিয়ে যাবার বহু দূর, আমি নৌকা বাইতে থাকবো আর সে বসে রবে খুব মুগ্ধ হয়ে।

রাতের ট্রেন

শৈশবের বহুবার ট্রেনে উঠার অভিজ্ঞতা আছে আমার। মোহনগঞ্জ থেকে মুক্তাগাছা যখন আসতাম, তখন  মোহনগঞ্জ স্টেশন থেকে ময়মনসিংহ জংশন পর্যন্ত ট্রেনে আসতে হত আমাদের। আমরা সাধারণত রাতের ট্রেনেই যাতায়াত করতাম বেশী, রাতের ট্রেনে যাত্রী থাকে কম, হট্টগোল নেই, এই সব বিবেচনা সহ আরো কিছু বিবেচনায় হয়ত থাকতো আমার বাবার মনে। আমরা উঠতাম রাত বারোটার অথবা রাত নয়টার ট্রেনে। দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি আসছি, এই ভাবনাটাই আমাকে সীমাহীন আনন্দ এনে দিতো তখন, তখন ট্রেনে উঠতাম তখন আমার মন থাকতো খুব উৎফুল্ল। আমরা যখন ট্রেনে উঠতাম তখন সত্যি সত্যিই ট্রেনের ভেতরে চাপ থাকতো খুব কম। কিন্তু স্টেশনে থাকতো অনেক কোলাহল, হট্টগোল, বিশেষ করে মাছের পাইকারদের ব্যস্ততা যেন স্টেশনকে কলরব মুখর করে রাখতো যতটুকু সময় স্টেশনে ট্রেন থাকে তার সবটুকু সময়ে। ট্রেন কোনদিন সঠিক সময়ে আসতো না, তখনকার দিনে মোহনগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ আসার একমাত্র মাধ্যম ছিলো ট্রেন, নেত্রকোনা বারহাট্টা বা এই লাইনে যত গুলো থানা শহর আছে সব গুলোতেই একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো ট্রেন। ট্রেনের লাইন খুব উন্নত না থাকায় ট্রেন ততটা গতি নিয়ে তখন চলতেও পারতো না।

ট্রেন কখন ছাড়বে কখন ছাড়বে এমন অপেক্ষায় আমাকে যেন অস্থির করে তুলত যখন ট্রেনের ভেতরে আমরা বসে থাকতাম। ট্রেন ছাড়ার পরেই ঝগঝগ..ঝগঝগ..ঝগঝগ… শব্দে যখন ট্রেনটি চলতে শুরু করতো তখন মনে হতো সত্যি সত্যি এবার যাত্রা শুরু হলো আমাদের, স্টেশন ফেলে এগোতে থাকতো যখন ট্রেনটি তখনেই মনে হতো এইতো নানার বাড়ি চলে গেছি। ট্রেন চলতো কতটা গতি নিয়ে তা বুঝতে পারতাম না আমরা। জালনা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখতে পেতাম রাতের অন্ধকারে সব কিছু একাকার হয়ে আছে, যখন ঝোপঝাড় বাঁশবন পাশ কাটিয়ে ট্রেন যেত তখন ট্রেনের শব্দটি উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে উঠত, ট্রেনের গতি বাড়লে ঝগঝগ ঝগঝগ শব্দটি খুব দূতই উঠা নামা করতে থাকতো এটা বুঝতে পারতাম আমি। ট্রেনের ভেতরে কোলাহল না থাকলেও মাঝে মাঝে ‘এই বাদাম, এই বাদাম ’ এই চানাচুর, ঝাল মুড়ি চানাচুর ‘ বড়ই, বড়ই,’ বলতে বলতে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতো বেশ কয়েকজন হকার। গভীর রাত ট্রেনের ভেতরেই অনেকেই ঘুমিয়ে থাকতো লুঙ্গি পড়ে অথবা পেন্ট সার্ট পরে। বাইরে তাকালেও সব কিছু মনে হতো ঘুমন্ত, আমার কাছে মনে হতো যেন সমস্ত পৃথিবীই ঘুমিয়ে আছে তখন শুধু মাত্র আমরা ট্রেনে থাকা কয়েকজন জেগে আছি পৃথিবীতে। ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে এক সময় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, তখন নেমে পড়তে ইচ্ছে হতো ট্রেন থেকে, মনে হতো যারা নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে তারাই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী, তাদের মতো আরামে ঘুমাতে পারলে সত্যিই জীবনটা অনেক আনন্দের, সেই ঘুমন্ত জীবনেরেই সব সার্থকতা। রাতের যখন শেষ ভাব তখন আম্মাকে আমি জিজ্ঞাসা করতাম, আর কত দুর ন? আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? কখন নানার বাড়ি পৌঁছবো আমরা? আম্মা আমাকে আদর করে হাসি মুখে বলতো, এইতো এসে পরেছি, আর একটু সময় লাগবে, এখন ঘুমাও। আমার ঘুম আসতো না, আমি ঘুমাতে পারতাম না, এই অবস্থাতেই চলতে থাকতো ট্রেন, কখনো ঝিমুনি কখনো বা তন্দ্রা-ঘোরে আমি আম্মার কোলে মাথা রাখতাম। এই ক্লান্তিকর অবস্থার মাঝে যখন দেখতাম অন্ধকার পাড়াগাঁয়ের পর বিদ্যুৎ লাইট জ্বলছে, মিটি মিটি আলো ছড়াচ্ছে, তখন বুঝতাম এটা শহর, শহর পাড় হবার পরেই আবার অন্ধকারে ডেকে ফেলতো আমাদের। রাতের শেষ ভাগ তবোও আমাদের ট্রেন ময়মনসিংহ জংশনে পৌঁছাত না। চারদিক অন্ধকার, এই অন্ধকারের মাঝেই ঝগঝগ-ঝগঝগ শব্দে ট্রেন চলছে তো চলছেই, এই অন্ধকারে চলন্ত অবস্থার মাঝেই হঠাৎ দেখতে পেতাম, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষের মতো কেই দাড়িয়ে আছে বা অজু করছে, মূহুর্তের মাঝেই ট্রেন তাকে চোখের আড়াল করে আমাদের নিয়ে যেতো গন্তব্যের দিকে, আমি এই সাদা পোশাক পরিহিত মানুষের মত কাউকে ধরে নিতাম জীন জাতীয় কিছু। রাতের আধারে নামাজ পড়তে অজু করছে সে। অনেক সময় অনেক কল্পনার পর ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের উপর যখন ট্রেন আসতো তখন কি সুন্দর তারকা রাশির মতো অসংখ্য বৈদ্যুতিক লাইট দেখতে পেতাম চারদিকে, তখন বুঝেতে পেতাম আমরা গন্তব্যে এসে গেছি। আমি বিষময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম জালনা দিয়ে বাইরে, ট্রেনের গতি তখন কেমন যেন বেড়ে যেতো বেশ, সারি সারি দালান, বিদ্যুতের খুঁটি, দুরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং সব কিছু দেখতে পেতাম, শহর জুরেই আলো আর আলো, সবাই ঘুমি য়ে আছে তবোও যেন কি এক বিনোদনে জেগে আছে শহরে। আমার কাছে মনে হতো এই শহরে যারা আছে তারাই আধুনিক তাদের বাচাই বাচার মতো বাচা।

নিজেকে লুকানো

বিধাতা আমার সঙ্গে যতটুক উপহাস করেছেন মনে হয়না এতটা উপহাস আর করো সঙ্গেই করা হয়েছে। চারদিকে থাকা মহামূল্য মণিমুক্তা থাকার পরেও একজন মানুষ যেমন ভিখারি হয়ে জীবন ধারণ করেন ঠিক তেমনি যেন বেচে আছি আমি। আছি বললেও ভুল হবে আমাকে যেন জোর করে এমন জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়েছে। মগজে যে ভাবনা গুলো সর্বদা হামাগুড়ি দিয়ে প্রকাশ হতে চায় তা প্রকাশ করতেও আমি ব্যর্থ বা আমাকে ব্যর্থ করা হয় জোর করেই। আমি জানি ভেতরের আমির সঙ্গে বাইরের আমির অনেক দূরত্ব, এই কারণেই আমি আমার কাছেই অনেক অচেনা এক মানুষ। এক কথায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর মতই যেন জীবিত হয়ে আছি সেই শৈশব থেকে, তারপরেও আমাকে সুখী ভেবে কি আফসোসেই না করে আমাকে দেখা মানুষ সকল, আমি তাদের আপসোস বুঝতে পেরে মনে মনে বেশ হাসি আর তাদের বুঝাতে চাই আমার জীবন নিয়ে সত্যিই আমি বেশ পরিতৃপ্ত।

আমার প্রতি আমার এই কপটতায় আমি যেন আমাকেই ঠকাচ্ছি প্রতিনিয়ত বার বার।

আমাদের ঘর

কেমন যেন বেচে থাকার প্রেরণা পাই না আর, চারদিক কেমন বিষাদ বিষাদ লাগে, কোথাও যেন আমার কোন কেন্দ্র নেই। আমার একটি ঘর আছে , রঙ্গিন টিনের ঘর, যেখানে আম্মা থাকতো, আম্মা সেই ঘরেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। প্রতিটি মানুষের নিজের ঘর খুব শান্তির যায়গা, আমারো খুব শান্তির যায়গা ছিলো আমাদের ঘর। এখন সেই ঘর অবহেলায় পরে আছে, ঘরে সব সময় তালা লাগানো থাকো, দিনের পর দির পার হয়, সেই ঘরে কেউ থাকে না, থাকার মানুষ নেই। অযত্নে অবহেলায় ঘরে ধুলোবালি জমা হয়। আম্মা যখন ছিলো তখন বাড়ি যাওয়ার তাড়া ছিলো আমার, যেতেই হতো, সেই যাওয়াটা ছিলো আমার সব চেয়ে বড় কাজ। এখন আর আগের মতো বাড়িতে যাওয়া হয় না আমার, যেতে ইচ্ছে হলেও যাই না। যদিও কখনো কখনো যাই, বাড়িতে পোছাতে পৌছাতে অনেক রাত হয়ে যায়, বাড়ির চারপাশ খুব নির্জন থাকে, চাদের আলো না থাকলে সারা বাড়ি থাকে অন্ধকার। অন্ধকারেই তালা খুলি, রুমের ভেতরে প্রবেশ করি, আলো জালাই। চারদিক শূন্যতা খা খা করে। একা একা শুয়ে থাকি। নির্জন রাতে মনে হয় আম্মা এই বুঝি আমাকে ডাকছে , কথা বলছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরি, যখন সকাল হয় তখন, শূন্য বাড়ি শূন্য করে চলে আসি। আমি যখন বাড়ি থেকে বের হতাম তখন আম্মা সুরা পড়ে আমার শরীর বন্ধ করে দিতো, যেন কোন অশুভ কিছু আমার ক্ষতি করতে না পারে, এখন আর কেউ দোয়া পরে আমার শরীর বন্ধ করে দেয় না, ঘরের প্রতিটি দরজায় তালা ঝুলানো থাকে।

শাহীদ লোটাস। বাংলা ভাষার লেখক, বাংলাদেশ-এর নেত্রকোনা জেলায় মোহনগঞ্জ থানায় ৩০ মে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে শাহীদ লোটাস-এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহবোধ করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ