খিদে

পার্থ রায়
ছোটগল্প
Bengali
খিদে

ভবা পাগলার চাল ফুটো ঘরে,
আধখানা চাঁদ উঁকি মারে,
ঈদের নাম করে–

কদিন ধরে ভবার শরীরটা ঠিক চলছে না, ভিক্ষে জোটেনি, তাই হাওয়া খেয়ে চাঁদখানা খইতে দেখেছে হাঁ করে ফুটো চাল দিয়ে। খইতে খইতে চাঁদটা কেমন যেন কুমড়োর ফালি হয়ে উঠলো। সাথে সাথে জিভের তলা কেমন যেন করে উঠে মুখটা ভরে উঠল লালায়। আহা; কতদিন এরকম একটুকরো কুমড়ো জোটেনি গরম ভাতে একপলা তেল আর কাঁচালঙ্কা চটকে। ঘরে কি নুন আছে? ছিল তো সেদিন কাকে চাইতে যেন দিয়েছিল একমুঠ। তাহলে আছে। আর থেকেই বা কি ঘরে চাল ও নেই কুমড়ো ও নেই। লালা টা শুরুৎ করে গলায় টেনে গরম ভাত, নুন লঙ্কা তেলের ঝাঁজে মাখা কুমড়োর স্বাদ নিয়ে আবার চাঁদ দেখতে শুরু করলো। ভাবতে লাগলো গতর খানা আজ তিনদিন নড়লো না কাল নড়াতেই হবে। কাল আবার কোরবানি, মোচলমান পাড়ায় দু একটুকরো মাংস ঠিক জুটে যাবে তিন আঙুলে কপাল, চাইলে হাতা কয়েক বিরিয়ানি খান কতক পরোটাও জুটতে পারে। শরীর যেন কেমন ঝিমঝিমিয়ে উঠলো, নাকে বিরিয়ানির বাসে ভরে ওঠে যেন…..উফফ জীবনটা কি সুন্দর। কাল বেরোতেই হবে।

ভবা ভাবতে লাগলো সে কি, জন্ম ইস্তক বাপ মাকে দেখেনি, জ্ঞান হওয়া থেকে দেখেছে জুগনি বুড়িকে।যে ওকে ড্রেন থেকে কুড়িয়ে বাঁচিয়ে ছিল। সেই বুড়ি মানুষ করেছিল ভবা কে। বুড়ি মরার পর বুড়ির জাগতিক সম্পত্তি এই ভাঙা ঝোপড়াটার মালিক ভবাই হয়েছে। বুড়ি মরার পর সবাই চাঁদা তুলে বুড়িকে পোড়ানোর সময় বুড়ির মুখে আগুনটাও ভবাই দিয়েছিল,কিন্তু কেউই জানতো না বুড়ির জাত কি ছিল হিন্দু না মুসলমান। বুড়ি নিজেও কিছু বলতো না। শুধু ভবাকে বলতো আমরা জাতে ভিখারি। আর পেটের জ্বালা আমার ধর্ম,চেয়ে পেট ভরানো আমার পুজো,বা নামাজ। ভবাও সেইভাবেই বাড়তে থাকে। পেট ভরলেই ধর্ম রক্ষা হয়।

কোরবানির দিন বেশ পাড়ায়,পাড়ায় বাস ছাড়ছে কাবাব এর, মহল্লা ঘুরে আমদানি নেহাত খারাপ হলো না। একটা লুঙ্গি, একটা গেঞ্জি, রাত পর্যন্ত ভরপেট খাবার, আবার পরের দিনের জন্য কিছু জুটেছে।ভবা নিজের প্রাসাদে ফেরার সময় গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে দেখলো পতাকা লাগানো হচ্ছে, হিন্দু পাড়ার ক্লাব এ খুব জোরে বোম ভোলে বাজছে,শ্রাবনের শেষ সোমবার, কলকের ধোঁয়ায় চারিপাশ অন্ধকার প্রায়। সঙ্গে সবাই খুব আনন্দে বলছে 15 ই আগস্ট এবারে সত্যিকার স্বাধীনতা দিবস, হই চই খুব করতে হবে। ফিস্টি হবে। হোক হোক আমার পেট ভরবে ভাবতে ভাবতে নিজের প্রাসাদে ফিরে এলো ভবা। নিজের রাজ পালঙে শুয়ে ভাবে আহা দিনগুলো বেশ কাটছে। যা খাবার আছে তা কাল চলে যাবে, পরশু ইচ্ছে হলে ভিখ মাঙতে বেরোবে, নাইলে ঠ্যাং এর ওপর ঠ্যাং তুলে আয়েশ করবে। সেটাই ভালো। রোজ ভরপেট খেলে অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। হঠাৎ একটা মুচকি হাসি দিয়ে ভবা ভাবে পরশুও জুটবে ভালো কিছু, স্বাধীনতা দিবস। হেব্বি ফূর্তি হবে দিকে দিকে। হয়তো এক চুমুক মাল ও জুটে যাবে স্বাধীন হবার আনন্দে।হু হু মনের ভিতর বেশ একটা ভরপেট ভরপেট আনন্দ হচ্ছে। বেশি না ভেবে টেনে ঘুমিয়ে যায় ভবা। পরের দিনটা চলে বেশ জাহাংগীরি মেজাজে, বিড়ি টানতে টানতে। খাবার যখন চিন্তা নেই কি হবে আর মাথাভারী করে। অলস রাতে চালভাঙ্গা ঘুলঘুলি দিয়ে দেখে অবাক হয়, কেমন ফালি কুমড়ো ঈদের চাঁদখানা আস্তে আস্তে পুরো গোল থালা হয়ে রাখি পূর্ণিমা হয়ে গেল। ধুস শালা!! এত পেট ভরা থাকলেই দেখি চিত্তির…… শালা কুমড়ো থেকে চাঁদ হয়ে যায়। শালা বেহায়া মন কোথাকার, দুদিন পেটে ফাঁকা জায়গা নেই তো শালা কুমড়ো কে চাঁদ দেখছো, পরের দিন সাতেক না জুটলে ওই চাঁদ তোর নামের সামনে বসবে রে ভবা ঢেমনা। সকালে উঠে ঝোলা হাতে বেরোস না হলে চাঁদ বসবে।

বেশ সকাল সকাল মাইকের শব্দে ঘুমটা ভাঙলো ভবার।” কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট…..” আহা কি গান শিরাগুলো ফাটিয়ে দিয়ে যেন রক্ত ছুটছে। ঘুম ভেঙেই আবার দুটো লাড্ডু আর খানিক বোঁদে ও ঢুকে গেলো পেটে। আহা দিনটা বড় ভালো, রোজ স্বাধীনতা হয় না কেনে যে…..
এক খাবলা তেল মেখে ঝপাঝপ চান সেরে বার হয়ে পড়লো ভবা, পরনে নতুন লুঙ্গি আর গেঞ্জি। আহা নতুন জামার কি দারুন বাস রে ভাই!! কদিন একেবারে রাজার জেবন কাটসে। সেজে গুজে ভবা ঘাড়ে নিজের ঢাউস ঝোলাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্বাধীনতার ভিখ মাঙতে। বেশ কয়েক ঘরে খুঁদকুড়ো আর শুকনো আলু মিললো খানিক। আহা মানুষ আর কত দিবে যা মাগগী গন্ডার বাজার, এ ভাবে মিললেই পুরো নবাবী জীবন কাটবে।

নিশ্চিন্ত মনে একটা দাওয়াতে বসে বিড়ি ফুঁকছিল ভবা, বিচিত্র তাপ্পির ঝোলাখানা পাশে রেখে, পাড়ার ছানাপোনাগুলোর চিরদিনের একটা কৌতূহল ঝোলাখানা নিয়ে। বেশ মজা লাগে, কচি কাঁচা গুলোর ভয় মেশানো মুখে ঝোলার দিকে তাকানো গুলোতে। হঠাৎ করে যেমন কালবশেখীর ঝড় উঠে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চায় সবকিছু, ভবার ঝোপড়া,চরাচর, দুনিয়া ঠিক তেমনি হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে এলো এই মোচলমান ভিখিরিটার এত সাহস, ঝোলায় গরুর মাংস ভরে ভটচাজ বাড়ির চাতালে বসে বিড়ি মারছে। খুব বেড়েছে শুয়োরগুলো, আজ উচিত শিক্ষে দিতেই হবে। বাঁধ শালাকে মার শালা কে।
দুটো হাত কোথা থেকে যেন নড়া তুলে সামনের ইলেক্ট্রিক খুটিতে বেঁধে দিলো। ভবা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো তার কোন ধম্ম নেই, তার ধম্ম সে জানে না। জনতার বিচার হলো শালা ঈদের নতুন লুঙ্গি গেঞ্জি পরে তোর কোনো ধম্ম নেই……তুই শালা গরু খাস না……. মার শালাকে…….

ধীরে ধীরে ভবার নাকের পাশ আর কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে এলো রক্ত, যদিও সেটা লাল ই ছিল রঙে, আর তখন ভবার সৃষ্টিকর্তা নবী আর দেবী ব্যাস্ত নতুন সৃষ্টি করতে। সূর্য্য তখন গেরুয়া রঙে যাচ্ছিল পাটে। হঠাৎ একটা গম্ভীর গলায় ভেসে এই কে আছিস পতাকা টা নামা। সন্ধ্যে হলো।
তিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা নতুন ভারতবর্ষ।

পার্থ রায়। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের বর্ধমানে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ