প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
– দুদিন আগে কাগজে খবরটা পড়েছিলিস?
– কোনটা বলছিস বলতো?
– কেন? মোটামুটি সব খবরের কাগজেই তো আছে!
– ও ওইটা? ওই রেল কলোনীর লাগোয়া বাজারটার ঘটনা? এক রহস্যজনক মৃত্যু….. চোদ্দ বছরের ছেলে…ঐটা তো? হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়েছি। আরে, কলকাতা শহরে এ আর নতুন কি? এতো আকছার ঘটছে। এখানে যুবকের মৃতদেহ, তো ওখানে যুবতীর। গ্যাং রেপ … শালারা শিশুকেও ছাড়েনা, না ছাড়ে বুড়িকে। কোথাও বাড়ির বউকে পুড়িয়ে মারছে, তো কোথাও ছেলে বুড়ি মাকে ঘরে আটকে ফুর্তি মারতে যাচ্ছে। কারণে অকারণে ডাক্তার পেটাচ্ছে, মাষ্টার ঘেরাও করছে। খুন খারাপি তো জল ভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শুধু তাই কেন? বড় বড় বহুতল উঠছে, ভেঙ্গে পড়ছে। কত কেরামতি করে লম্বা লম্বা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে- ধসে পড়ছে। আর মানুষ মরছে মশা মাছির মত। কিন্তু তাতে কার কি আসে যায়? এর মধ্যেই তো দিব্যি ফিটফাট জামাকাপড় পরা ভদ্দরলোকেরা… ফাটাফাটি নাইট ক্লাব, পার্টি, উৎসব, আয়োজন সব চলছে, রাম রহিম সব হচ্ছে। আজ কাল বেশি হল স্কাউন্ডরেল, আরও বেশি অ্যান্টি সোশাল, আর বেশ কিছু নির্বিকার, আর কিছু ভাল লোক…এই তোর মতো আর কি! যারা ভাবে, কাগজে- কলমে লেখালিখি করে, কিন্তু একচুয়ালী কিছুই করতে পারেনা… একটানা কথাগুলো বলে থামল ডঃ সুজয় দত্তগুপ্ত। বয়স বছর চল্লিশ, পেশায় ডাক্তার। নেশায় মানব দরদী। ভালভাবে কাজ করতে চান, উন্নতি দেখতে চান। চেষ্টাও করেছেন উনি ওনার মত করে, কিন্তু নট্ নড়ন চড়ন দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। খবরের কাগজও আর নিয়মিত পড়েন না। বলেন, ওটা পড়ে আর সময় নষ্ট করি কেন? বেশীর ভাগ সময় রুগীর পেছনে চলে যায় কারন ভাল করে নিজের কাজটা করাও খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়! বিশেষ করে আজকালকার জমানাতে।
ডঃ দত্তগুপ্তর স্কুলের বন্ধু নিতিন, নিতিন বসুমল্লিক। তিনি আজও বিবেক নিয়ে লড়ে চলেছেন, আজও বদল আনার প্রচেষ্টা ছেড়ে দেননি। আজ কাল অবশ্য বেশির ভাগ সময় এই দুই বন্ধুর মতের মিল ছেড়ে অমিলই বেশি হয়। তবে তার জন্য তাদের নিবিড় বন্ধুত্বে কোন খামতি হয়নি। আর, সত্যিই তো, ভালো বন্ধুত্বর জন্য সবসময় যে মতের মিল হতে হবে, তা তো জরুরী নয়।
তা নিতিন, তুই হঠাৎ এই একটা বেওয়ারিশ চোদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে পড়লি কেন? নতুন কি এমন দেখলি এটার মধ্যে?
কলেজে পড়াকালীন ভাল লেখে বলে নিতিন বসুমল্লিকের সুনাম ছিল। বেশ ধনী লোকের ছেলে নিতিন, কিন্তু তার আচার আচরণে কোন দিনই তার প্রকাশ ছিলনা। একরকম, বলতে গেলে, বাবা মায়ের অবাধ্য ছেলে। বেখাপ্পা, বেয়াড়া বলে তার নিজস্ব পরিবার থেকে সে খানিকটা বিছিন্নই থাকত। পরে একটা নামকরা খবরের কাগজে জার্নালিস্ট হিসেবে কাজে ঢুকেছিল। সেখানেও নাকি বসের সাথে ঠিক মিল হয়নি, এই কদিন আগে কাজে ইস্তফা দিয়েছে।
ছবিটা লক্ষ্য করে দেখেছিস? দেখেছিস, কেমন করে ছেলেটা বাঁশের খুঁটিটা জাপ্টে ধরে আছে? যেন বলছে, হারাতে কেবা গো চায় শেষ সম্বল?
জমজমাট কলেজ স্ট্রিট। রাস্তার ধারে একটা মামুলি রেস্টুরেন্ট। তারই এক ছোট্ট কেবিনে মুখোমুখি বসে চায়ের কাপে এই দুই বন্ধুর কথোপকথন।
নিতিন এখনও সেই একই রকম রয়ে গেছে। সেই একই রকম সিগারেট ফোঁকে আর মাঝে মাঝে খুকখুক করে কাশে। উইকএণ্ড-এ মাঝে মধ্যে ওদের এখানে দেখা আর কথা। তাই হয়তো বন্ধুত্বটা কারোর জীবন থেকে এখনও পিছলে যায়নি। বারন করলে নিতিন ‘স্মোকার্স কাফ’ বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। উল্টে বলে, তুই কি মদ ছেড়েছিস যে আমি সিগারেট ছাড়ব?
বুঝলি? খবরটা দেখে ওইখানে গেছিলাম। ওই বাজারটাতে।
ছেলেটাকে দেখলি ?
হ্যাঁ, ততক্ষণ চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ছেলেটা কাঠ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, ওটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে রাইগর মরটিস।
সারা গায়ের ছাল চামড়া ওঠা, বেশ মারধোরের নিশানা আছে শরীরে। লোকের ভীড়, মজা দেখছে! পুলিশ এসেছিল, তবে খুব একটা মাথা দেয়নি। তাদের হাতে অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো! ওদের আর তেমন কোন তদন্তর দরকার বলে মনে হয়নি। আমি তখনো দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে বিশৃঙ্খলা। অবশেষে বডি নিয়ে গেল ওরা। কিন্তু, কি অদ্ভুত ভাবে ছেলেটা খুঁটিটা জাপটে ধরে শক্ত হয়ে আছে, যে কি বলব। ওটা আলাদাই করা গেলনা, কিছুতেই না। খানিক টানা-হ্যাঁচড়া করে শেষে ওই খুঁটি শুদ্ধই বডিটা আপাদ-মস্তক মুড়ে ভ্যানে তুলে নিয়ে চলে গেল ওরা। রোজ এমন ঘটনা কতই না ঘটছে। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড়ভাট্টা সব কোথায় হারিয়ে গেল। আমি একটু সামনে এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। বুড়ো দোকানদার। বললেন, বাবু চা নেবেন নাকি? আমি অন্যমনস্ক হয়ে বললাম,- তা দাও। তখনো চোখে আর মনে ওই মরা ছেলেটা আর সেই খুঁটিটা। কানে এল, দোকানদার নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে চলেছে- বাবু ওরে ছোটো বেলা থেকে দেখছি। শোনা যায়, করিমচাচা জঞ্জালের ঢিপি থেকে তুলে ওরে ওই ঝুপড়ি তে এনেছিল আর সেই থেকে সে করিমের পোলা। বাবু, এই এক পা গেলেই এই বাজারের গায়ে লাগান ওদের বস্তি। করিমের ঘরে আরও একজন মেয়েছেলে থাকত, চম্পা। তাকেও নাকি এই করিমচাচা পাল পোষ করে বড় করেছিল। এই করিমচাচা কবে কোথা থেকে এসেছিল কেউ জানেনা বাবু, তবে লোকে বলে এই গোটা কয়েক ঝুপড়ি সে নিজে হাতে বানিয়ে এইরকম কিছু দীন দুঃখী অসহায় মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছিল, আর কখন যে সে নিজে সকলের করিমচাচা হয়ে গেছিল কেউই তা জানেনা…সে নিজেও না।
করিমচাচা বাইরে বাইরে কাজের ধান্দাতে ঘোরা ফেরা করে। কখনো কুলী মজুরের কাজ, কখনও বাজারে বসে সব্জি নিয়ে, কখনো লম্বা এক বস্তা কাঁধে ফেলে এই কাগজটা, ভাঙ্গা শিশিটা-বোতলটা, টুকিটাকি ফেলাঝেলা জিনিষপত্তর, কৌটো-টৌটো কুড়িয়ে ফেরে। আজ সকালে পুলিশ করিমচাচাকে জেরা করে ছেড়ে দিয়েছে। আর এই ছেলেটা বাবু সেই ল্যাংটো বয়স থেকে এখানে সেখানে ঘুরেঘুরে এ দোকান সে দোকান থেকে এই বিস্কুটটা, এই পাউরুটিটা চেয়ে চিন্তে খেতো, তখন ওর কোন নামও ছিলনা। কেউ ওকে “এই বিস্কুট” এই “পাউরুটি” বলে ডাকত। বুঝলেন বাবু, কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছিল। করিমচাচা পরে অবশ্য ওর একটা নাম দিছিল …“পয়সা”। এই বলে দোকানী কাঁধে ফেলা গামছার খুঁট দিয়ে চোখের কোনটা মুছে নিল। সেদিন দোকানীর হাতে চায়ের পয়সা গুঁজে বাস ধরে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু ওই খুঁটিটা আর ওই ওভাবে ওর জাপটে ধরাটা আমি ভুলতে পারলাম না। আর করিমচাচা, এই লোকটা, আর এই… “পয়সা”…
দিন চারেক পর আবার গেলাম। বাজারের ইউসুয়াল ছবি তখন। সেদিনের ঘটনা আর কারো মনে আছে বলে তো মনে হলনা। এবার সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বাজারের গায়ে লাগানো বস্তিতে, করিমচাচার সন্ধানে। এই বলে নিতিন হাতের আই ফোন খুলে ছবি দেখাতে সুরু করল আর বলে চলল- অবশ্য তোর দেখার কিছু হয়ত নেই রে। এই গোটা কয়েক মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কিছু অসহায় মানুষের বাস এখানে। গোটা দশেক ঝুপড়ি, সারি সারি গায়ে গায়ে লাগা, ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে, রোদ আলো ঢোকার কোন চান্স নেই। তবে প্রত্যেকটা ঝুপড়ির সামনে লম্বা লম্বা বাঁশের খুঁটি পোঁতা। আর এক খুঁটি থেকে আর এক খুঁটিতে দড়ি লাগান। মনে হল হয়ত জামা কাপড় মেলার জন্য। রোদের আশাতে। কিন্তু তার মধ্যে মনে হল কটা খুঁটি যেন মাটি থেকে কেউ উপড়ে নিয়েছে। বস্তির উপর বেশ ধকল গেছে মনে হল। খুব একটা লোকজনও তেমন চোখে পড়ল না। দু- চারটে মুরগীর বাচ্চা মাটি খুঁটে চলেছে এখানে সেখানে আর তার মধ্যে ছোট একটা ছেলে হাতে একটা ছড়ি নিয়ে ছানাগুলোর পেছনে লেগেছে। কেবল একা এক মহিলা একটা ঘরের দাওয়াতে পা ছড়িয়ে বসে আমার দিকে চেয়ে আছে। কাছে এগোতে সে নিজেই বলে উঠল, “করিম চাচাকে খুঁজতেছেন বাবু?” বলে সোজা আঙ্গুল দিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে দিল, আর বললে, যা জানতে এয়েছেন বাবু অর থেকে জেনে নিন।আমাদের মুখ খুললি বড় বিপদ!
মনে হল ও দিকের দু একটা ঝুপড়ি যেন ঝলসে গেছে। চারিদিক বিধস্ত। ওই একটা ঝলসান ঝুপড়ির সামনে একটা কুঁজো লোক নতুন করে আর একটা খুঁটি পোঁতার চেষ্টা করছে। মনে মনে বললাম, এই কি এদের করিমচাচা? ডাকলাম, “করিমচাচা?”- খুঁটি পোঁতার কাজ বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। বেশ বয়স হয়েছে। তোবড়া গালে ছোটছোট খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর অসম্ভব চকচকে কোটরে ঢোকা চোখ। বললে, কি জানতে চাইতেছেন বাবু? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম …আমি এই বস্তি সম্বন্ধে জানতে চাই, পয়সার কথা শুনতে চাই। কথাগুলো করিম চাচার ঠিক কানে গেল, কি না, বা সে শুনতে পেল কিনা, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সে নিজেই বলে উঠল,- খুঁটি হারালি চলবে কি করে বাবু? আর আমাদের কথা? কে শুনতে চায়? এই শুধু মাঝে-মধ্যে ধরপাকড়, মাইয়াদের উপর অত্যাচার…মুখ বন্ধ রাখতে হবে। মুখ খুললেই কি বিপদ যে নেমে আসবে বাবু! তাই, ভয়ে কেউ মুখ খোলেনা। আমার চম্পাকেও অরা নিল, আমার পয়সাকেও অরা নিল। কেউ এরা আমার নিজের সন্তান নয়। চম্পার মা গত হয়েছিল তিন দিনের জ্বরে তিন বচ্ছরের চম্পা কে রেখে। আর অর বাপটা ওর আগে থেকেই নিখোঁজ ছিল, আজও তার হদিশ মেলেনি।
চম্পা একদিনে আমার মাইয়া বনে গেল। আর পয়সা? সে হতভাগা কে খুঁজে পাই জঞ্জালের গাদায়। একেবারে বেওয়ারিশ। আর সেই থেকে এ হয়ে গেল আমার পোলা। এই চম্পা একটু বড় হতেই হয়ে গেল পয়সার মা। তার কাছে পয়সাকে ফেলে আমি ধান্ধায় ঘুরি ফিরি …পেট চালাতে হবে তো এগুলির। ধীরে ধীরে আমার চম্পার পরনের নোংরা শাড়ীর গন্ধ সে মায়ের গন্ধ বলে চিনতে শিখল। বাবু, গরমের সময় এই আঁচলে চম্পা তাকে বাতাস করত, শীতের সময় এই আঁচলে সে পয়সার শরীর গরম করার চেষ্টা করত। কোনদিন দেখতাম বৃষ্টি পড়লে এই আঁচলেই তার মাথা ঢেকে দৌড়ে দুজনে চালায় ঢুকত।
কিছুদিন পর চম্পাও কাজে লাগল। এটা সেটা যা পেত তাই করত। বেরুতে হত দুজনকেই। কাজে বেরুলে ছেলেটা ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত। এক রত্তি ছেলে তো! তখন বাবু এই চালার সামনে এই খুঁটি পুঁতে দিলুম, আর বল্লুম তাকে, এই তোর মা, বিপদে এরে জাপটে ধরবি। সেই থেকে ঘরে একা ভয় পেলে সে এক দৌড়ে বাইরে এসে এই খুঁটিটারে জাপটে ধরত। আশপাশের দুচার লোক তার নজরে পড়ত। এই পায়রার বকম বকম কানে আসত, এই এখানে সেখানে চড়ে বেড়ানো মুরগী দেখত, গায়ে রোদ লাগত, ধীরে ধীরে ভয় কেটে যেত। চম্পা ঘরে থাকলে সে তার মা, আর না থাকলে এই খুঁটি। এই খুঁটিই তার মা।
আমি বললাম- এই খুঁটি?
করিম চাচা বল্ল- বাবু, কাজ দেয়, কাজ দেয়। আমার মা নাকি ধান্ধা করত। বাপের কথা জম্মে শুনিওনি, কোনোদিন চোখেও দেখিনি। তখন আমি একরত্তি, আমাদের চালাও ছিলনা। রাস্তার ধারে এক ফুট জায়গায় আমাদের ঘর ছিল একেবারে খোলা আকাশের নীচে। আর আমার মা আমাকে রাস্তার ধারে একটা খুঁটি চিনিয়ে দিয়ে বলেছিল, ভয় পেলে সোজা এটারে ঝাপটে ধরবি, দেখবি সব ভয় পালিয়ে গেছে।
বাবু, এই খুঁটি না পেলে আমি কি জিন্দা থাকতাম? সবারই খুঁটির দরকার বাবু জীবনে, এক এক জনের খুঁটির ধরন ধারন আলাদা। ভেবে দেখবেন বাবু কথাটা, বলে করিম চাচা এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেল্ল।
নিতিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করল।
আমি বললাম- করিম চাচা, তবে পয়সার ওই খুঁটিটাই কি সেই খুঁটি? আর বাজারে গেলই কি করে? এই বার করিম চাচার শুকনো গালের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।
আস্তে আস্তে বলল- অরা আমার চম্পাকে বাঁচতে দেয়নি। এক রাতে অরা চম্পা কে তুলে নিয়ে গেল জোর জবরদস্তি করে। সেদিন আমার হাত-পা মুখ অরা বেঁধে দিয়েছিল। বছর চার বয়স তখন পয়সার। সেই বোধ বুদ্ধি হয়নি তখনও। ঘুম চোখে সে কি দেখেছিল আর কি বুঝেছিল জানিনা বাবু। ভয়ে সেঁটকে গেল ছেলেটা। ভাবত, তার চম্পাদিদি একদিন না একদিন ফিরে আসবে। মাঝে মাঝে আমাকে বলতও, বাপু, সেদিন আরও অনেক চম্পাদিদি থাকলে চম্পাদিদি লড়াই জিতে যেত। তবে পরে সে বুঝেছিল যে চম্পাদিদি একা নয়। এমন অনেক আছে। আর এদের যারা যায়, তাদের হদিশ পাওয়া যায়না। আর, সত্যি সত্যি তাদের খোঁজ কি কেউ করে? আমার চম্পা আর কোনদিনও ফিরে আসেনি। আমাকে বাবু কাজের তরে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। চম্পা যাবার পর পয়সার জীবনে এক রয়ে গেল এই খুঁটি। এখন পয়সার এই বছর চোদ্দ বয়স … পয়সাকেও ওরা ছেড়ে দিলনা বাবু। এইবার ভোর রাতে আবার হামলা হল। শোনা গেল চীৎকার, চ্যাঁচামেচি, অকথ্য ভাষার গালাগালি, ভাংচুর। এইবার কুন্তিকে অদের দল হেঁচড়ে বের করে নিয়ে এল পাশের ঝুপড়ি থেকে। এখন পয়সার বোধ হয়েছে। চালার ছোট্ট খুপরি জানলা থেকে উঁকি দিতেই তার মাথায় গেল আগুন জ্বলে। আগে পিছে কিচ্ছু ভাবলনা বাবু। চোখের নিমেষে চালার বাইরে দৌড়ে গিয়ে ওই রোগা শরীরে ঝাঁপিয়ে পরল কুন্তির উপর, তাকে বাঁচাবার জন্য। আমি কিছু করার আগে অরা আমাকে মুছড়ে বেঁধে দিল ওই খুপরি জানালার সাথে। চোখ বন্ধ করা আর কান বন্ধ করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার ছিল না আমার, না বস্তির অন্যদের। কিছু বলেছ তো ওরা শেষ করে দেবে, ঘর জ্বালিয়ে দেবে।
এইবার পয়সা ঝাঁপিয়ে পড়তে ওদের নজর গেল সে দিকে। তখন কুন্তিকে ছেড়ে জানোয়ারগুলি একরত্তি ছেলেটার উপর আছড়ে পরল। তাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল। এইবার পয়সা চালার সামনের সেই খুঁটিটা পেয়ে জাপটে ধরল। কিছুতেই তারা তাকে খুঁটি থেকে আলাদা করতে পারলনা। বেধড়ক লাথি মারতে মারতে শেষে খুঁটিটা শুদ্ধ উপড়ে নিয়ে মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে ওদের দুজনকে একসাথে টেনে এনে ফেলে দিলে ওই বাজারে। এ যাত্রা বেঁচে গেল কুন্তি। চলে গেল ছেলেটা। ওই টুকু পুষ্টিহীন শরীর! কত ধকল আর সইবে বাবু? মরে কাঠ হয়ে গেল।… বলতে বলতে করিম চাচার গলা কেমন বুজে এল।
আমার অজান্তে আমি বলে উঠলাম- করিম চাচা, সে কিন্তু ছাড়েনি খুঁটিটা। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি … করিম চাচা মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। তার ওই কোটরে ঢোকা দু চোখে জল, তবু যেন তার মধ্যে কিসের একটা আলো দপ করে জ্বলে উঠল। বলল- বাবু, এই খুঁটি… যে যেমন মানুষ হোক, সবার একটা শক্ত খুঁটি চাই যাকে ভরসা করে সে বাঁচতে পারে। যাকে ভরসা করে সে মরতে পারে।
নিতিন থামল।
রেস্টুরেন্ট এর বাইরে তখন অন্ধকার নেমেছে। দুজনেই চুপচাপ। সুজয় পয়সা মিটিয়ে দিল, দুজনে রাস্তায় নামল। হঠাৎ সুজয় বলে উঠল, হ্যাঁ! করিম চাচার খুঁটি চাই। পয়সার খুঁটি চাই, আমারও চাই। তোরও চাই। সবার চাই। শক্ত খুঁটি ছাড়া কে বাঁচতে পারে বলতে পারিস? এই আমাদের দেশ? তারও শক্ত খুঁটি চাই। আর নিতিন, তুই বিশ্বাস কর, সেদিন একটা শক্ত খুঁটি থাকলে ওই ছেলেটা মারা যাবার পর কি আরও তিন তিনটে দিন ভেনটিলেটরে পড়ে থাকত? আমি কি ওই মিথ্যে অর্ডারটা সাইন করতাম? আজও কি এই বিবেকের যন্ত্রণায় ভুগতাম? না নিজের রাতের ঘুম কাড়তাম? বল?
এই বলে সুজয় নিতিনের দিকে ফিরল। দেখে, তখন নিতিন বিড়বিড় করে নিজে নিজেই বকে চলেছে- হ্যাঁ। সব্বার। সব্বার একটা খুঁটির দরকার। যে বলবে, খোকা ভয় পাসনা, এগিয়ে যা, এগিয়ে যা। কিন্তু, কোথায় সে খুঁটি? কে দেবে সে খুঁটি? তার বদলে চারিদিকে শুধু জাল আর জাল। একবার যদি আটকা পড়েছ তো মরেছ। না পারবে এগোতে, না পারবে পিছতে। না পারবে এগোতে, না পারবে পিছতে।
কথাগুলো বলতে বলতে নিতিন দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। সুজয় ডাক দিল- নিতিন, এই নিতিন, শুনছিস? যাবার পথে তোকে নামিয়ে দিচ্ছি!
কিন্তু নিতিন ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..