প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
এক
তোমাগো একটা কতা কই, মোন দিয়া হুনবা। হুনবাতো?
মাওলানা খবিরউদ্দিনকে এলাকার ছেলে মেয়েরা ভালোভাবেই চেনে। খবিরউদ্দিন উজানগাও গ্রামের পাশের গ্রাম উদয়পুরের মানুষ। গায়ের রঙ কালো। দশাসই শরীর। মুখে চাপ দাড়ি। গভীরভাবে তাকালে দেখা যায় মুখের চামড়ার উপর গোটা গোটা দাগ। কোনো এক কালে বসন্ত হয়েছিল। সেই বসন্ত মুখের উপর চিহ্ন রেখে গেছে। ইকড়ি বাজারের মসজিদে ইমামতি করে মাওলানা খবিরউদ্দিন। মাহফিল হলে ওয়াজও করে দরাজ গলায়।
উজানগাও গ্রামের বুক চিড়ে একটা খাল উঠে এসেছে কচানদী থেকে। খালটায় যেমন চওড়া তেমন স্রােত। বোথলার খাল। বোথলার খালেই ভুবন মাঝির ঘাট। এপার থেকে ওপারের, ওপার থেকে এপারের মানুষ আসা যাওয়া করে খেয়ায়। যদিও এখন খেয়া চালায় সেকান্দার আলী কিন্তু খেয়াঘাটের নাম ভুবন মাঝির ঘাট। আশপাশের দশ বারো গ্রামের মানুষ ভুবন মাঝির ঘাট বললেই চেনে। ঘাটের দুই পারে দুটো ঘর। বৃষ্টি কিংবা রোদ হলে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা ঘরে বসে বিশ্রাম নেয়।
পূর্ব পারের ঘাটঘরে বসে উজানগাও প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাওলানা খবিরউদ্দিন ডাকে। কাছে এলে মাওলানা পকেট থেকে চকলেট বের করে হাত বাড়ায়, নেও। তোমাগো লই¹া আনছি।
অবাক ওরা। মাওলানাতো কখনো কাউকে কিছু খেতে দিয়েছে, আগে দেখেনি। ছেলেমেয়েরা একটু অবাক হলেও হাত পেতে নেয়। চকলেট সবাই পছন্দ করে। হাতে নিয়ে কেউ কেউ চকলেটের উপরের পলিথিনের খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিয়ে চুষতে শুরু করে। চকলেট দিয়ে মাওলানা ছেলেমেয়েদর সঙ্গে একটা সম্পর্ক বা বোঝাপাড়া তৈরী করে নেয়। কেউ কেউ চকলেট খুলে মুখে দিয়ে চকলেটের রস পান করতে শুরু করে। মাওলানার মুখে মৃদু হাসি। হাসতে হাসতে মাওলানা ছেলে মেয়েদের বাবার নাম কি, কোন বাড়ির মেয়ে তুমি- সব জেনে নেয়।
দুপুরের সূর্য মাথার উপর। স্কুলে ওরা সকালে পান্তাভাত খেয়ে এসেছে। এখন পেটে ভয়ানক খিদে। স্কুল ছুটির ঘন্টার পর যাদের বাড়ি খালের অপর পারে, ওরা এক দৌড়ে ঘাটে এসে দাঁড়ায়। খেয়া ঐ পারে। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মাওলানা খবিরউদ্দিন।
মাওলানার কথায় ছেলেমেয়েরা ঘাড় নারে।
একটু কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে মাওলানা বলে, তোমাগো একটা কতা জিগাই। কও দেহি এ্যাই খেয়াঘাটের নামডা কি?
ওরা নিশ্চুপ। এটা কোনো প্রশ্ন হলো? উজানগাও গ্রামের কে না জানে, এই খেয়াঘাটের নাম? জন্মের পর থেকে শুনে এনেছে ভুবন মাঝির ঘাট। ছেলেমেয়েদের চুপ থাকার সুযোগটা নেয় মাওলানা খবিরউদ্দিন, হোনো আমার আব্বারা, আমার আম্মারা। আমাগো দেশ মোসলমানের। আমরা মোসলমান। আমাগো দেশে যা কিছু অইবে সব অইবে মোছলমানের নামে, কী কও? তামাশাডা দেহো, মাঝখান দিয়া কোন এক হিন্দু মালাউনের নামে অইচে এই ঘাটের নাম ভুবন মাঝির ঘাট। ক্যান নাম অইচে ভুবন মাঝির ঘাট, জানো?
পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা ধর্ম বিষয়ে চিন্তা না করলেও তারা যে মুসলামান, সেটা বোঝে। সুতরাং মুসলমনাদের দেশে একটা ঘাটের নাম মুসলমানের নামে না হয়ে একজন হিন্দুর নামে কেনো হলো, এতোদিন এই ধারনা বা প্রশ্ন মাথায় না ঢুকলেও মাওলানা খবিরউদ্দিনের কথায় একটু একটু করে ছুরির ফলার মতো ঢুকে যাচ্ছে। এবং ছেলেমেয়েদের অস্তিত্বের ভেতরে ঢুকে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে ঝেঁকে বসতে শুরু করেছে।
ক্যামনে জানবা? একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্¦াস ছাড়ে খবিরউদ্দিন, হোনো এই দেশে একটা গন্ডগোল হইছিল একাত্তর সালে। আহারে কী যে দুঃখের দিন আছিল, তোমাগো কেমনে বোঝাই। হেই যুদ্ধটা অইছিল হিন্দুগো লগে মোসলমানের যুদ্ধ। আমাগো দ্যাশের পাশের দ্যাশ হিন্দুস্থান দিয়া হিন্দু সৈন্যরা আইয়া দখল করতে চাইছিল। সেইকালে পেয়ারা পাকিস্তান দিয়া আমাগো দ্যাশ রক্ষা করার জন্য মোসলমান সৈন্য পাঠাইছিল। শুরু অইলো দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ। এই ঘাটের মাঝি ছিল তপন নামে একজন হিন্দু। তপনের অনেক বয়স। নৌকা চালাইতে পারতো না। একটু নৌকা বাইলেই শ^াসকষ্ট অইতো। বাপরে সাহায্য করতে তপনের পোলা ভুবন নৌকায় থাকতো। হেই ভুবন মাঝি এক রাইতে পেয়ারা পাকিস্তানের পনেরো ষোলোজন মোসলমান সৈন্যগো খাল পারনের সমায় ডুবাইয়া মারে….।
মাওলানা খবিরউদ্দিনের গলা বুঝে আসে, আহারে…. চোখে পানি। সামনের বারোতেরোজন ছেলেমেয়ের মন একেবারে মোমের মতো গলে যায়। দু একজনের চোখে পানি চলে আসে। ডান হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে মাওলানা খবিরউদ্দিন বলে, এহন তোমরাই কও, এই ঘাটের নাম কি হেই জালেম মালাউনের নামে অইতে পারে? এতোদিন চোখ বুইজ্জা রইচি। আমার বয়স অইচে। একটা ঈমানের দায়িত্ব আইসা পড়ছে। কবে মইরা যাই কেডা কইতে পারে? হের লাইগা তোমাগো কইলাম। তোমরা ছোট। তোমাগো কলিজার মইধ্যে আল্লার ইশক আছে। বড়গো কাছে গেলে হেরা নানান কতা কইবে কিন্ত তোমরা নিস্পাপ। কোনো পাপ করো নাই। তোমরা আল্লার এক একটা ফেরেস্তা। আমি হের লাইগা তোমাগো কইলাম। এহন তোমরাই কও এই ঘাটের নাম কী হেই মালাউনের নামে হওয়া উচিৎ?
ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা মানসিক পীড়নের স্ট্রীম জ¦লতে থাকে। মাওলানা বাচ্চাদের হৃদয়ে ধর্মীয় সাঁতারের ক্ষেত্র প্রস্তত করার আরও সুযোগ দেয়। গুন গুন শব্দে মাওলানা মিলাদ পড়তে আরম্ভ করে। বাচ্চারা গলে গলে মোম হয়ে যায়, কেউ একজন মিলাদে গলা মিলায় মাওলানার সঙ্গে।
তাইলে আমি যাই! চট করে দাঁড়ায় মাওলানা, তোমাগো মইধ্যে মোসলমানগো দরদ নাই। দিলে আল্লার ভয় নাই। থাকলে তোমরা এই ঘাটের নাম বদলাইতে চাইতা। কও, তোমরা এই মালাউনের নামে রাহা ঘাট পরিবর্তন কইরা মোসলমানের নামে রাকতে চাও?
চাই, কোনো দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দেয় সবাই।
আলহামদুল্লিহ, এক্কেবারে কলব থেকে উচ্চারণ করে মাওলানা খবিরউদ্দিন- তোমাগো নাম এহন ফেরেস্তরা আরবী ভাষায় লেকতে আছে। রোজ কেয়ামতের মাঠে তোমারা বিনা হিসাবে বেহেস্তে যাইবা। কও আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই উচ্চারণ করে, আলহামদুলিল্লাহ।
এহন তোমরাই কও কি নাম দেওয়া যাইতে পারে? বসে আগের জায়গায়।
ছেলে মেয়েরা একজন আর একজনের দিকে তাকায়। কি নাম দেবে ওরা? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। পেটের মধ্যে খিদেটা জাগর দিয়ে উঠছে। মাওলানা ওদের এই অসয়ত্ব দেখে হাসে, আমি একটা নাম কই? কমু?
ওরা সবাই ঘাড় কাৎ করে, কন।
মোসলমানের ঘাট।
ক্ষুধার্ত ছেলে মেয়েরা একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকায়। চোখের মুখের ভাষায় বোঝা যায়, নামটা ওরা পছন্দ করেছে। কিন্তু দ্বিধা ভেঙ্গে সরাসরি বলতে পারছে না। বাচ্চাদের মনোজগতের দুর্বলতা নেয় মাওলানা, কেমন নামটা তোমাগো পছন্দ অইচে?
ছেলেমেয়েদের মুখে এব ধরনের হাসি, অইচে। খুব পছন্দ অইচে।
হোনো এই যে নামটা রাকলাম, এইটাতো সবাইরে জানাইতে অইবে। এহন কতায় কতায় মাইনষেরে কইবা এই খেওয়া ঘাটের নাম মোসোলমানের ঘাট। এইভাবে কইতে কইতে একসমায় এলাকার মানুষে ভুবন মাঝির ঘাট নামটা ভুইলা যাইবে। বোঝতে পারছো?
আবার মাথা নাড়ায় ওরা, পারছি।
আর হোনো ঘরে গিয়ে বাপ মাগো বুঝাইয়া কইবা। আর একটা কতা কইবা, হিন্দু নামের ঘাট দিয়া যারা পারাপার অইবে হেরা কইলো বেহেস্তে যাইতে পারবে না। এহন যাও…।
ছেলেমেয়েরা হালকা মাথার মধ্যে বড় একটা বোঝা নিয়ে দৌড়ে খালের পারে নাম। ওপার থেকে নৌকা নিয়ে এসে অপেক্ষা করছে সেকান্দার।
দুই
ঘটনার দিনে ভুবন মাঝি খেয়াঘাটের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল মাওলানা মহিউদ্দিনের ছেলে আবুল হাসান। হাসান পড়ে ক্লাস ফাইভে। ছেলেটা গড় ছেলেমেয়েদের তুলনায় একটু মেধাবী। উজানগাওয়ের সরকারী প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। আর মাওলানা মহিউদ্দিন উজানগাও থেকে প্রায় আট নয় কিলোমিটার দূরের এক হাই স্কুলের ধর্মের শিক্ষক। হাসানের মুখে ভুবন মাঝির ঘাটের নতুন নাম শুনে অবাক।
বাজান এই নাম কই পাইলা?
খবিরউদ্দিন চাচায় এই নতুন নাম দিছে, ছেলের মুখ থেকে সব ঘটনা শুনে থম মেরে গেলো মাওলানা মহিউদ্দিন। শুধু হাসানকে বলেন, বাজান তুমি ওই মাওলানার দেওয়া নাম কইয়ো না। তুমি আগের নামই কইবা।
হাসান কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাওলানা মহিউদ্দিন ছেলেকে মাথায় হাত রাখে, বাপের কতার উপর বিশ^াস নাই?
ঘাড় নাড়ে, আছে বাজান।
তাইলে? আইজ আমার একটা জরুরী কাম আছে। যাইতে পারমু না। কিন্তু কাইল আমি হেই ভুবন মাঝির ঘাটে যাইয়া তোমাগো লগে কতা কমু।
কি কইবা?
হাসে মহিউদ্দিন, যহন কমু তহন হুনবা।
আইচ্চা।
পরের দিন ভুবন মাঝির খেয়া ঘাটে বসে থাকে মাওলানা মহিউদ্দিন। দুপুরের পর পর স্কুল ছুটি হলে ছেলে মেয়েরা ছুটে আসে ভুবন মাঝির ঘাটে। ছোট ছনের ঘরে বসে ছেলেমেয়েদের ডেকে পাশে বসায়। ওরা অনুমান করেছে, একদিন আগে পাশের গ্রামের মাওলানা খবিরউদ্দিন যে বয়ান দিয়েছিল, সেই রকম বয়ান দেবে হাসানের বাবা মাওলানা মহিউদ্দিনও। ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে, কখন বয়ান দেবে? বয়ান শুনে খেয়া পার হয়ে বাড়ি যাবে। খিদে লেগেছে। কেউ কেউ একটু বিরক্তও।
আমার আম্মা ও আব্বারা. আপনাগো আমি একটা ঘটনা কওয়ার লাইগা এইহানে বইয়া রইচি। বেশি সোমায় লাগবে না। পনারো মিনিটের মধ্যে আমার ঘটনা শেষ হইবে। আপনারা অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুনছেন? শুনছেন না?
হ শুনছি তো, সাড়া দেয় আবির।
আমিতো হেই সমায় বড়। তোমরা তহন জন্মাও নাই। আগে কও, আমাগো বাংলাদেশ থেইকা পাকিস্তানের দূরত্ব কতো মাইল? জানো না, দূরত্ব পনেরোশো মাইল। হেই দেশের মানুষেরা যে জামা কাপুড় পরে মোরা হেইডা পরি না। হ্যারা যে ভাষায় কতা কয়, মোরা হেই ভাষায় কতা কই না। হেরা যা খায়, এই দ্যাশের মানুষ হেইয়া খায় না। তাইলে কও হেগো লগে কী মোগো কোনো আত্মীয় অইতে পারে?
দোটনায় পরে যায় বাচ্চারা। বুঝতে পারতেছে না, হাসানের বাবা মহিউদ্দিন চাচা কী কইতে চায়? একদিন আগে কী কইলো হেই মাওলানা?
আমরাও মোসলমান। হেরাও মোসলমান। কিন্ত হেরা মনে করতো, মোরা গরীব, মোগো ভাষা বাংলা, মোরা ভাত খাই, মোগো উপর জুলুম করার অধিকার আচে। সবার আগে হেরা মোগো মুহের এই ভাষা বাংলা ভাষা, হেই ভাষা কাইরা নিতে চাইলো। আমাগো প্রিয় বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে উরদু ভাষায় কতা কইতে কইছিল। এইডা কী সম্ভাব? জন্ম লইয়া মোরো যে ভাষায় কতা কই হেই ভাষা ছাইরা বিদেশী ভাষায় ক্যান কতা কমু? তোমরা কী মুহের ভাষা ছাড়তে চাও?
না, মোরা মোগো মোহের ভাষা ছাড়মু ক্যা? জবাব দেয় হানিফ।
এইসব জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন শেখ মুজিবুর রহমান । হে আওয়ামী লীগের নেতা। ইলিকশন অইলো, হেই ইলিকশনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের নেতা জিতলো। হ্যার মার্কা আছিল নৌকা। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা দলে দলে নৌকায় ভোট দিলাম। জিতলো নৌকা। নেতা অইলো শেখ মুজিব। কিন্তু হের আতে ক্ষমতা দেবে না। কও এইডা অন্যায় না?
হ, ঘাড় নাড়ে বাবলু। মুই নানার মোহে হুনছি। মজিবর ভাষণ দিছিলো ঢাকায়।
গাল টিপে আদর করে মাওলানা মহিউদ্দিন, মেয়া দেহি একটু একটু জানে। হয়, যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা মোগো আতে শাসন ক্ষেমতা দেবে না, বাঙালিরাও ছাড়বে না। মুইতো গেরামে, ঢাকায় দিন রাইত মিছিল অইতো। মিছিলের মানুষেরা শ্লোগান দিতো, তোমার আমার ঠিকানা.. পদ্মা মেঘনা যমুনা। আমার নেতা তোমার নেতা.. শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলদেশ স্বাধীন করো। শেষে শেখ মুজিব সাতই মার্চ ঢাকায় ভাষণ দিলেন ঢাকায়। কইলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আক্রমন করলো আমাগো উপর। এক রাইতেই ঢাকার প্রায় লাখ খানেক মানুষ মাইরা হালাইলো। আর হারা দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই দেশের কিচু হারামখোর গো লইয়া রাজাকার বাহিনী বানাইলো।
হেই রাজাকাররা আমার বড় চাচারে মাইরা হালাইচে। হেই চাচার লাইগা মোর দাদী এহনও কান্দে আর কয়, ওরে মোর এসমাইল বাজান তুই কোতায় গেলি… মাওলানা মহিউদ্দিনের কথার মধ্যে ঢুুকে যায় আবির হোসেন। উজানগাও গ্রামের মমিনউদ্দিনের ছেলে।
হ, তোমার চাচায় মুক্তিযোদ্ধা আছিল। এক রাইতে তোমার দাদীরে দেখতে আইছিল, হেই সোমায় এই মাওলানা খবিরউদ্দিন তোমার চাচারে পকিস্তান আর্মীর আতে ধরাইয়া দেয়। আর্মীরা তোমার চাচা এসমাইলরে কচা গাঙ্গের পারে দাড় করাইয়া গুল্লি কইরা মারে। আহারে গুল্লি করার আগে এসমাইলরে খুব মারছে বোতলা আটে হালাইয়া। পরে হনুছিচ, মাইরের চোটে তোমার চাচা হাগু কইরা দিছিলো কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার কতা শিকার করে নাই।
বলতে বলতে গলা ধরে আসে মাওলানা মহিউদ্দিনের। সেই সুযোগে মাশুরা বলে, আমাগো নানাবাড়ি রাজাকাররা জ¦ালাইয়া দিছিলো, মার কাছে হনুচি।
হ হেই সমায় রাজাকারেরা কতো বাড়িঘর যে জ¦ালাইয়া দেচে, কতো মানুষ মানুষ মারছে হিসাব নাই। আর এই যে ভুবন মাঝির ঘাট, সেই ভুবন ছিল তপনের ছেলে। ভুবনের বয়স দশ বারো বছর। তপন বুড়া। প্যাডে গ্যাসটিক, খাইতে পারতো না। শরীরে শক্তি নাই। বাপরে সাহায্য করার লাইগা ভুবন বাপের লগে নৌকা চালাইতো। এই ঘাট দিয়া অনেক মিলিটারি, রাজাকার পার অইতো। একদিন নৌকা বোঝাই কইরা পারাপারের সমায় পারের ধাক্কা লাইগা একজন পাকিস্তনী আর্মী খালের পারে পইরা যায়। লগে লগে পাকিস্তানী আর্মীরা তপনরে গুলি কইরা মাইরা হালায়। তপনের লাশ লাতি দিয়া খালে হালাইয়া দেয় এই মাওলানা খবিরউদ্দিন।
হাচাই? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কাকলী।
তোমাগো লগে মিত্যা কমু ক্যা মা জননী?
হে যে কইলো..
মাগো, রাজাকারেরা একাত্তর সালে নিজের দেশের মানুষগো মারছে, কাটছে, অপমান করছে, ওরা কী ভালো মানুষ? ওরা আমাগো পবিত্র ধর্ম ইসলামরে নষ্ট করছে। ইসলামের নামে মানুষ মারছে। হোনো আসল ঘটনা কই। তপন মাঝি মইরা গেছে, ছোট্ট ভুবন তো নৌকা চালাইতে পারে না। চোহের সামনে দেকছে বাপের লাশ ভাইসা যায়। কিচ্ছু করতে পারে নাই। কিন্তু নৌকাতো পার অইতে অইবে মিলিটরী আর রাজাকারগো। বাড়ি দিয়া ধইরা আনে ভুবনরে। ছোট্ট মানুষ ভুবন, বড় নৌকাতো চালাইতে পারে না। খুব কষ্ট অয়। তয় ওর মাতায় অনেক বুদ্ধি। করে কী, নৌকার তল দিয়া একটা তক্তা ছুডাইয়া শক্ত মাডি দিয়া আটকাইয়া রাহে। রাজাকার আর মিলিটারীরা নৌকা পার হওনের সমায় আগে পার অইতো মিলিটারিরা। এক নৌকা মিলিটারি পার হওনের সমায় নৌকা লইয়া খালের মাঝখানে যাইয়া ভবন ঝাপ দিয়া খালে পইরা যায় ইচ্ছা কইরা। ডুব দিয়া নৌকার তলে যাইয়া মাডি ছুডাইয়া দেয়। লগে লগে নৌকার মধ্যে গল গল কইরা পানি ঢোকতে থাহে। পাকিস্তানে তো খালবিল নাই। মরুভূুমি। ওরাতো হাতর জানে না। পানিরে এমনেই ভয় পায়। নৌকার মইধ্যে পানি ঢোকতে দেইখা পাকিস্তানী মিলিটারীরা ভয়ে চিৎকার করতে থাহে, নৌকাও দুলতে থাহে। নৌকার মইধ্যে পানিও উঠতে থাহে। ঘাটের এই পারে খারাইয়া থাহা রাজাকারেরা কী অইচে বোঝতে পারে না। খালে ছিল মারাত্মক হোত। নৌকা যাইতেছে ভাইসা। ভয়ে আধমরা অইয়া মিলিটারির কয়েকজন খালের পানিতে লাফাইয়া পরে। পইরাতো হাবুডুবু খাইতে থাহে, লগে খাইতে থাহে পানি। আর যারা নৌকায় আছিল, হেরাও ডুবতে ডুবতে ভাইসা গেছে পানির হোতে।
আর ভুবন? ভুবনের কী অইচে? জানতে চায় প্রায় সবাই একসঙ্গে।
ভুবন এক ডুব দিয়া চরের এলি পাতার ভিতরে ঢুকে যায়। হের পর দৌড় আর দৌড় আর দৌড়। হেই যে দৌড়াইয়া ভুবন গেলো আর ফিইরা আইলো না।
আইলো না? বিস্ময়মাখা প্রশ্ন রাখালের।
নাহ, আইলো না। দ্যাশ স্বাধীন হওয়ার পর এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা মিইল্লা এই ঘাডের নাম রাহে ভুবন মাঝির ঘাট। তোমরা আমরা স্বাধীন দেশের মানু অইয়া এই ঘাটের নাম কী পরিবর্তন করতে পারি? যদি হরি তাইলে যারা ন্যায়ের লাইগা, দ্যাশের স্বাধীনতার লাইগা জীবন দিলো, হেগো উপর অন্যায় করা অইবে না?
ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে জানায়, আমরা এই অন্যায় অইতে দিমু না।
হাসে মাওলানা মহিউদ্দিন, আলহাদুলিল্লাহ। আমি জানতাম, তোমাগো বুঝাইয়া আসল ঘটনা কইলে তোমরা সব বুঝবা। তোমাগো উপর দ্যাশের ভবিষৎ। আমার দায়িত্ব আমি পালন করলাম। এহন দায়িত্ব তোমাগো। বাড়ি যাও…।
তিন
দুই তিন পর দুপুরের দিকে আবার ঘাটে আসে মাওলানা খবিরউদ্দিন। বসে আছে ঘাটে। মুখে হাসি। আজ পকেট ভরে এনেছে বাতাসা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা দলবেধে ঘাটঘরের সামনে দাঁড়ালে, খবিরউদ্দিন পকেট থেকে বাতাসা বের করে, খাও। তোমাগো লাইগা আনছি।
ছেলেমেয়েরা দরজায় স্থির। নড়ে না। তাকিয়ে থাকে খবিরউদ্দিনের দিকে। অবাক খবিরউদ্দিন, কী অইলো তোমরা বাতাসা খাও না?
খবিরউদ্দিনের মুখের কথা শেষ হতে পারে না, পায়ের কাছের বালি আর ধুলো মুঠি ভুরে ছুড়ে মারে হাসান। হাসানের দেখাদেখি মারে রাখাল। রাখালের পাশের নজিরন, নজিরনের পাশের মাসুদ, মাসুদের পাশের আলেয়া, আলেয়ার পাশে দাঁড়ানো কাকলী- একের পর এক ছুঁড়ে মারতে থাকে বালি আর ধুলো। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে বালি আর ধুলোতে একাকার হয়ে বাতাসা ফেলে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় মাওলানা খবিরউদ্দিন।
এ্যাই তোমরা আমার লগে এ রহক করো ক্যা? আমি তোমাগো মুরাব্বী না?
তুই মুরাব্বী না, তুই রাজাকার..হিস হিস গলায় বলে হাসান। তোরে আইজ মাইরা হালামু, একটু দূরে পরে থাকা একটা সিরিজ গাছের ডাল দৌড়ে হাতে নেয় হাসান। হাসানকে দেখে সব ছেলেমেয়েরা একটা কিছু কুড়িয়ে হাতে নেয়। অনেক বছর পর, মাওলানা খবিরউদ্দিন বুঝতে পারে, সত্য কতো কঠিনরে…। সে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করে। পিছনে এক দল ছেলে মেয়ে, হাতে লাঠি…। ছুটে বেশীদূর যেতে পারে না, ঝাঁপিয়ে পরে বোথলার খালে। আপাদমস্তক জোব্বা পরিহিত খবিরউদ্দিন ভেসে যেতে থাকে খালের প্রবল স্রােতের সঙ্গে, কচানদীর দিকে।
অনেক বছর পর উজানগাও গ্রামের ছেলেমেয়েরা খবিরউদ্দিনের ভেসে যাওয়া দেখে, অনুমান করতে পারে, এইভাবে একদিন ভেসে গিয়েছিল পাকিস্তানের আর্মীরাও এই স্রােতে…। ওদের চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা বিজয়ের পতাকার মতো জেগে ওঠে…।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..