প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
কিংশুকের কথা
সারা রাত জেগে, এতক্ষণে টিকলির রাত জাগা ক্লান্ত দু চোখে নেবেছে স্বস্তির ঘুম ।হবেই তো। কদিন ধরে যা ধকল গেল ,এই মেয়েটার ওপর দিয়ে । আমি নিজেও কি ভেবেছিলাম? প্রতি টা মুহূর্ত কেটেছে দম বন্ধ করা এক যন্ত্রণাদায়ক নিরবচ্ছিন্ন উৎকন্ঠার মধ্যে । মাঝ রাতের ক্রাইসিস সামলাতে সক্ষম হয়েছে ডাক্তাররা।এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত করেছেন ।
টিকলির ঘুমন্ত মুখে উড়ে এসে পড়ছে কগাছা চুল। আমি অবাক হয়ে দেখছি, আজ এত বছর পড়েও মুখটা আমার বুকে একই ভাবে ঢেউ তোলে।সেই মুখ, শুধু একটু সময়ের আঁকি বুঁকি, আজও সেই আষাঢ়ের মেঘের মত চুল, শুধু তাতে যেন দু চারটে রূপালী বিদ্যুতের ঝলক।
স্পষ্ট মনে পড়ে সেই যেদিন এক রাশ জুঁই ফুলের স্নিগ্ধতার নিয়ে প্রথম কোচিং ক্লাসে এল , শ্রীরঞ্জনী। আমাদের শ্যামল স্যার যখন নামের মানে জানতে চাইলেন তখন শুনি একটা রাগ এর অনুকরণে ওই নাম রাখা হয়েছে । নামেই যেন মনে “বসন্ত বাহার” তান ধরলো।মনের তানপুরাতেও রিনরিন অনুরণন ।বুঝলাম মনে পলাশের রং লেগেছে ।
যত দিন যেতে লাগল ততই ভালো লাগার নতুন নতুন দিক খুলতে লাগল ।টিকলির আমাদের একজন হতে সময় লাগল না।টিকলি নাম টা অবশ্য আমাদের দেওয়া ,ওর কোঁকড়ানো চুলের ক’ গাছা ঠিক টিকলির মত কপালে দুলতো যে।সব সময় একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকতো।আমাদের বয়সের তুলনায় বড়ই বেশি রকম স্থির আর শান্ত।শুধু একমাত্র গানের কথা হলে শান্ত লাজুক মুখচোরা মেয়েটা একদম খোলোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসতো।কত কি বোঝাতো।আস্তে আস্তে যা শুনলে “আ-‘আ–আ–আ করছে “মনে হত সে গুলো সঙ্গীত হয়ে উঠলো ।
হিন্দুস্তানি কণ্ঠসঙ্গীতের খেয়াল, ধ্রুপদ ও তারানা, ধামার, কাজরী, টপ্পা, ঠুংরি, দাদরা, গজল, ভজন ইত্যাদির তফাত বুঝতে শিখেছি ।রাগ, রাগিনী ,বন্দিশ ,স্থায়ী ,অন্তরা, সঞ্চারী, লয় ,কমড় বুঝতে পারছি ।সবাই টুকটাক গানের গুন গুন শুনতাম কিন্তু ব্যেপ্তি বুঝলাম পাড়ার দুর্গা পূজা উপলক্ষে উদ্বোধনীঅনুষ্ঠানে ।স্বয়ং সরস্বতীর বাস ওই কণ্ঠে।সবাই শুনলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো ।আমি কিছু টা সাবধানে ছিলাম , কে জানে বুকের মধ্যে যে তবলা লহরা চলছিল, পাছে কেউ শুনে ফেলে ।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখলাম । দুজনের দুদিকে ।আমি যাদবপুরে বি টেক্ আর টিকলি রবীন্দ্র ভারতী তে বি মিউজ।এদিকে একদিন না দেখলে আমি সারাক্ষণ তেলে বেগুন হয়ে থাকি। ফার্স্ট সেমেই খেলাম ধাক্কা ।তবুও পড়ার সময় মন বসে না ।আমি তখন মরিয়া।ইম্পর্টন্ট ক্লাস মিস্ করেও দেখা করতে হবে ।তাই পৌঁছে গেলাম কলেজের গেটের সামনে । তখনো মুঠো ফোন এত সহজ লব্ধ হয়ে ওঠেনি আমার মত মধ্যবিত্তের কাছ অগত্যা— উপায় একটাই, অপেক্ষা ।অন্তহীন অপেক্ষা।হঠাত্ কাঁধে একটা ছোট্ট স্পর্শ, হৃদপিন্ডটা যেন লাফিয়ে এসে পড়ল হাতে। শুধু দুটো জলের ফোঁটা চিক চিক করছে ।হাতের মুঠোয় টিকলির আঙুল জড়িয়ে নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরলাম।কোন কথা না বলেও সব যেন বলা কওয়া হয়ে গেল। দুটি মনের যুগলবন্দির মূর্চ্ছনায় ভেসে উঠলাম।মনটাও আস্তে আস্তে শান্ত হচ্ছিল , যদিও দেখা হওয়া সীমাবদ্ধ ছিল কলেজ বা গানের স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার মধ্যে আর ল্যেনড্ লাইনের দুটো রিং দিয়ে গুড নাইট জানানোর মধ্যেই ।
কিন্তু কি যে হল !! হঠাৎ টিকলি কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিল।শুনলাম পিসিমার বাড়ি গেছে।
আমি এই ব্যাপারটা কে খুব গুরুত্ব দিলাম না ।টনক নড়ল যখন একদিন পাড়া কাঁপিয়ে উলু ধ্বনি ও শাঁখ বাজিয়ে গায়ে হলুদের তত্ব এল ছেলের বাড়ি থেকে ।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার টিকলি চির দিনের জন্য অন্যের হয়ে গেল ।আমি সবে কলে কলেজ, চাকরি দূরর স্বপ্ন ।পৃথিবীটা জুড়ে এক অসীম শূন্যতা ছেয়ে গেল। মনে মনে বলতে চাইলাম— ভালো থেকো । শুধু একটাই স্বান্তনা টিকলির খুব বড় ঘরে, বড় বরে বিয়ে হয়েছে।মেয়েটা সারা জীবন সুখে শান্তিতে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকবে ।হয়তো ভুলে যাবে আমাকে।কিন্তু আমি কিছুতেই ভুলব না। তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতি টা মুহূর্ত কে বার বার ফিরে দেখে বাঁচব।
কিন্তু তাহলে কেন গাড়ির বন্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ দেখা যায়? কেন? কেন? তবে কি? হয়তো ….
আমার বলার কিছু ছিল না।
চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে …
শ্রীরঞ্জনীর কথা
নার্স যখন দরজার পাল্লা ঠেল বেড়িয়ে এল, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল বুঝি সব শেষ ।কঠিন আবেগহীন মুখে , দুধ সাদা ড্রেস পরা নার্সরা খট খট আওয়াজ তুলে আসছে যাচ্ছে ।
আবেগহীন স্বরে— বেড নাম্বার ৮০৭।এনি ওয়ান?
আমার ক্লান্ত মাথাটা নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো ট্রাক্স আর পাঞ্জাবি পরা কিংশুক — ইয়েস, সিস্টার…আমি আছি।খুব অল্প সময়েই নার্স আবার একই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ফিরে গেল।মনটা কু গাইছে ।কিন্তু উঠে গিয়ে যে শুনবো তেমন ক্ষমতা নেই ।হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, কোন সাড় নেই যেন।কিংশুক রুমালে চশমাটা মুছতে মুছতে ফিরছে, আমি মুখের ভাব পড়তে চেষ্টা করছি দেখে ইশারায় আমাকে আস্বস্ত করল ।শুনলাম বিপদ কেটে গেছে ।এখন শুধুই ৭২ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ।বুকের ভেতর থেকে পাথরটা নেবে গেল। কিংশুক হাল্কা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখটা ভারি হয়ে এল।
আনেক দিন পরে আজ বড্ড মায়ের কথা মনে পড়ছে। ফেলে আসা দিনের ছবি গুলো ছায়া ছবির মত ভেসে উঠছে । আমি খুবই রক্ষণশীল যৌথ পরিবারর মেয়ে আমি।ছোট থেকেই “না” শুনে বড় হয়েছি।এখানে যেতে নেই, ওটা করতে নেই, ওভাবে বলতে নেই, এটা শুনতে নেই, ওটা খেতে নেই ।নানান বাধা নিষেধ । আমি তাই মনের আশ্রয় খুঁজে পেলাম গানের মধ্যে ।উচ্চাঙ্গ সংগীত ।এই ধরনের গান শেখা দুটো কারণে প্রথমত, গুরু অজয় চক্রবর্তী মহাশয় আমাকে তালিম দিতে রাজি হয়েছেন ।আর দ্বিতীয়তঃ এই ধরনের সঙ্গীতে বাড়ির লোকজন এটা নয় ওটা ঠিক জাতিয় মন্তব্যের জায়গা থাকবে না।আমার বদ্ধ জীবনের আর এক ঝোড়ো হাওয়ার নাম … কিংশুক ।ওর ওই নিষ্পলক দৃষ্টির আকর্ষণে আমার নিস্তরঙ্গ জীবনের নতুন মানে খুঁজে পাওয়া ।স্কুলের বাইরে আমার জীবনের প্রথম বন্ধু, কিংশুক ।
আমার নামটা নাকি আমায় মানায় না। তাই নিজেই একটা নাম দিয়েছে, টিকলি, কি কিউট না?
কিংশুকের টানে আমি এখন যেন দামাল হাওয়া ।এক এক সময় নিজেকে তীব্র আগুনের দিকে ছুটে চলা একটা পতঙ্গ মনে হচ্ছে। যে দ্রুতগতিতে নিজের ভস্মীভূত পরিণতির দিতে ধাবমান। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, অবশেষে …নিজের মনের জানালাটা খুলতে পেরেছি ।কিন্তু যেটা ভয় পাচ্ছিলাম সেটা ই হল। জেঠুর চোখে পড়ে গেলাম ।যা হবার ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হল।পত্র পাঠ বিদায় করে দেওয়া হল ।হাজার কাকুতি মিনতিতেও কাজ হল না। সব কিছুর মত এটাও মেনে নিলাম, বিশেষতঃ মায়ের যাতে আর চোখের জলে ভাসতে না হয় ।সব অপরাধের শাস্তি হয়, তেমনি প্রেম করার অপরাধে জন্য আমার বিয়ের ঠিক করে ফেলা হয় ।বড় ঘর, প্রতিষ্ঠিত ছেলে, রুচিশিল শিক্ষিত পরিবার, এবং সব থেকে বড় কথা এরা শিল্প মনস্ক।বাড়িতে গান বাজনার চর্চা আছে।ব্যাস, আর কি চাই, সব কি মনের মত হয়?
“অপরাধী জানিল না কী তাহার অপরাধ কিন্তু বিচার হইয়া গেল”।হয়ে গেল বিয়ে। বাসর রাতেই প্রথম ধাক্কাএল ।শুনলাম ছেলের নাকি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত পছন্দ নয়।ওই গান শুধুই বাইজিদের জন্য!!! তবে যে শুনেছিলাম আমার কোন শখ শৌখিনতায় কোন রকমের বাধা নেই! পরে বুঝলাম যে শখ বলতে সিনেমা দেখা,টিভিতে চ্যানেলের ধারাবাহিক বুঝিয়ে ছিল ।
ভেবেছিলাম বিয়েতে পাওয়া টাকা গুলো দিয়ে একটা পোর্টেবল সিডি প্লেয়ার আর আমার কটা পছন্দ মত সিডি কিনব।কিন্তু শুনলাম “মেয়ে ছেলে “র হাতে নাকি টাকা পয়সা দিতে নেই । স্বভাব নষ্ট হয় ।যা দরকার চাইতে হবে ।ভাবলাম থাক।ও গান তো আমার হৃদয়ের স্পন্দনে।নাই বা শুনলাম ।
অনিয়ম টাই এখানে নিয়ম।স্বামীর কাজ,আড্ডা,কাগজ পড়া আর টিভি দেখার মধ্যে আমার জন্য সময় বরাদ্দ শুধুই বিছানায় ।উনি ছাতার জায়গায় ছাতা আর জুতোর জায়গায় জুতো নিতীতে বিশ্বাসী।
যত একটু একটু করে সংসারের যাঁতা কলে আটকে যাচ্ছি ততই এক এক করে পন্ডিত সুনিল বসু, রশিদ খান, অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র, সুনিল, জয়,শীর্ষেন্দু, সুচিত্রা হারিয়ে যেতে লাগল ।অতি সংগোপনে মীরর ভজন দু চারটে বেঁচে রইলো নিত্য পুজোর সময়। মেয়ে জন্ম হতেই কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গেল ।
আমার মেয়ে আশাবরি কে আঁকড়ে বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।কিন্তু দুধের শিশুটিকেও ছাড়ল না ওরা।”আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে “তাই আরো একবার পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদানকারী এক মা দূর থেকেই দেখতে লাগল তার বাচ্চা টা হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্কুলে ভর্তি হলো।
আমার দায়িত্ব শুধুই টিফিন বক্স আর স্কুল ড্রেস গুছিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । নতুন ক্লাসের প্রথম দিনে একটা প্রণাম অবশ্য আমি পেতাম । আস্তে আস্তে স্কুল শেষে কলেজ যেতে শুরু করল আমার আশাবরি ।মনের অনেক গভীরে একটা ক্ষীণ আশা ছিল ।যদি মেয়েটা একবার মা দাঁড়ায় ।
আশাবরির কথা
আধো ঘুমে, অচেতন শরীরের ধারে কতগুলো অচেনা অজানা মুখ।উফফফ্ কি জোরালো আলো! আআহহ্ হাত পা কেমন অসম্ভব ভারি লাগছে ।চারদিকে কত রং।আমি ডুবে যাচ্ছি ।
ঘুমাতে ইচ্ছে করছে । বহুদূর থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে ।আশাবরিইইই— আশাবরিইইইই ।মাথায় বড্ড যন্ত্রণা ।আধো ঘুমে বুঝতে পারছি কোন হসপিটালে আছি ।কি করে এলাম? উফ্ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ।চিৎকার করে বললাম ” একটু জল, একটু জল দাও।” কেউ শুনতে পাচ্ছে না !!!মা থাকলে ঠিক দিয়ে দিত।
কেউ যদি একটু আমার মাকে ডেকে দিত।প্লিজ, কল হার ।মাআআআ– আই নিড ইউ।রাগে , অভিমানে কোন দিন তোমাকে জানাই নি, বাট মা ,আই নিড ইউ।
কোন মানে হয়??এই দশকের মেয়ে- — নাম শুনলেই মনে হয় যেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভা থেকে উঠে আসা চরিত্র ।স্বাভাবিক কারণে নাম ছোট হয়ে আশা আর তারপর এ বি ।
সেই যখন ছোট্ট ছিলাম তখন খুব ইচ্ছে করতো তোমার কোলে চড়ে ঘুরতে ।স্কুলের সব বন্ধুরা তোমার দেওয়া টিফিন যখন হৈ হৈ করে খেত তখন খুব রাগ হত ।প্রতিটা “পি টি এম”এ আসতো কাকিমা বা বাবা।সবাই বাব মায়ের সঙ্গে আসতো।তাদের সফলতার বা ব্যর্থতার সে কত অভিব্যক্তি ফুটে উঠত মা বাবার চোখে মুখে ।আর আমার বেলায়? ভালো বা খারাপ যাই হোক তুমি সটান ঠাকুরঘরে ঢুকে গোপালের আরতিতে মন দিতে।অভিমান আর ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে সেটা কবে যে রাগে পরিণত হলো জানি না ।মা আর মেয়ের মাঝে অতলান্তিক দূরত্ব… তাও তুমি বাড়িতে আমার অপেক্ষায় আছ সেটাই তৃপ্তি দিত।
আচ্ছা মা, কেন তুমি তোমার বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হও নি?তোমাকে কে বলেছে নিজের প্রতি অযত্নে এর প্রতিবাদ হয়?ঈশ্বর জানেন তুমি কত দিন না খেয়ে থাকতে থাকতে সেদিন জ্ঞান হারিয়েছিলে।সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তোমাকে রাখা হল এসাইলামে।
তখন বাড়িতে ছিল দম বন্ধ করা এক যন্ত্রণার পরিবেশ ।তাই একদিন কিছুটা স্বস্তির খোঁজে ঋকের দেওয়া পুড়িয়া তুলে নিলাম ।ক্ষণিকের শান্তিতে ডুবে যাওয়া ।এমন একদিন নিরিবিলি কোণ খুঁজতে স্টেশনের এক ধারে দেখলাম এক মাঝবয়সী সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক কতগুলো বাচ্চা নিয়ে মেতে উঠেছেন। চেনা ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করতে শেখাচ্ছেন। সেদিন গা করি নি। কদিন পরে ওই পথে যেতে গিয়ে মনে হল দেখিতো আছে কি না । দেখি ভজন শেখাচ্ছেন।
খুব চেনা সুর—
“শ্যাম মনে চকর রাখো জী।
গিরিধারী লালা চাকর রাখো জী।।
যেচেই আলাপ করলাম।পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।এটাই ওনার সংসার ।এদের টানেই কাছেই একটা পিজি তে থাকেন। কোন এক টিকলির ভালবাসা ওনার এই পরার্থে জীবনের প্রেরণা । সারাক্ষণ শুধু টিকলি থাকলে এই হত,টিকলি থাকলে ওই হত করেন।কি অদ্ভুত চরিত্র!! ভদ্রলোকটির আন্তরিকতায় আমিও যেন জীবনের নতুন মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম ।
উনি বাচ্চা গুলোর কিংকাকু!!আমার ও।আমিও কেমন যেন নিজের হয়ে উঠেছিলাম ওই বাচ্চাদের ।সারাক্ষণ দিদি দিদি করে ।বেশ লাগে।ইতিমধ্যে ঋকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে ।ঋক্ ঠেস মেরে কথা বলে, নোংরা ইঙ্গিত করে ।
অথচ কতবার চেষ্টা করছি ঋক্ কে এখানে আনতে। ওর সঙ্গে যত দূরত্ব বাড়ছে ততই সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ছে।সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে একদিন কিংকাকুর সামনে ভেঙ্গে পড়লাম ।ঋকের সান্নিধ্য, উপেক্ষা…বাবা মার তিক্ততা …কৈশোরের একাকীত্ব …মায়ের অসুস্থতা…
সব বলে চলেছিলাম আর পরম মমতায় উনি সবটা শুনে যাচ্ছিলেন ।একটা অনডিফাইন্ড সম্পর্ক।এঁরাই আদর্শ শিক্ষক ” A Friend, philosopher and guide”
ওনার সঙ্গে থেকে মনটা কিছুটা শান্ত ।ঠিক করলাম মা কে দেখতে যাব।সত্যি তো!! কেউ
আমার মায়ের কথা বলে না তো। কাকুর সঙ্গে পৌঁছানোর পর অফিস থেকে জানাল পেশেন্ট প্রায় সুস্থ ।আশ্চর্য!!!বাড়িতে কেউ জানে না ।
একতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসার আগেই কানে এল ধ্রুপদী সঙ্গীতের মূর্ছনা ।
তুহি আধার সকল ত্রিভুবন কো
পালক সচরাচর ভূতন কো
তুহি বিষ্ণু, তু নারায়ণ
কারণ তু পরম ব্রহ্মা জগৎ কো।।
কন্ঠের জাদুকরী উপস্থাপনা আর ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের মেজাজী ঢং প্রতিষ্ঠিত করেছে শিল্পীর স্বকিয়তাকে।
আস্তে আস্তে এসে হাজির হলাম নির্দিষ্ট ঘরে। খোলা জানালার ধারে বসে মা, গানে মগ্ন । সবকিছু হারানোর পর রয়ে যায় শুধু স্মৃতি অন্তহীন , অজর অনুরাগে। — মা যেন এই কথাটার জীবন্ত প্রতিমূর্তি । আমাদের পা এর শব্দে ফিরে তাকাতেই আমাকে দেখে দুটো হাত বাড়িয়ে দিল ।বহু বছর পর আবার মা কে জড়িয়ে ধরতেই সব অভিযোগ অভিমান “দুচোখ বেয়ে উপচে পড়ল।
“টিকলি ” একটা ছোট্ট ডাকে মা চমকে উঠল। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর আবার কেউ ওই নামে ডাকল।পৃথিবী টা সত্যি কত ছোট্ট!!!
মা বাড়ি যেতে রাজি নয় অথচ হাসপাতালেও ফেলে রাখা যাবে না। বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি মায়ের জন্য এক পয়সাও দেবেন না। আমি সবে কলেজে, বড় জোর কোন কল সেন্টারে চাকরি পেতে পারি ।কিন্তু সেটাও সময় সাপেক্ষে ।
বাধ্য হয়ে কিংকাকুর বাড়ানো হাত ধরতে হল ।উনি মা আর আমার জন্য শহরের অপর প্রান্তে একটা স্টুডিও এপার্টমেন্ট ভাড়া করে দিলেন । শর্ত একটাই বাচ্চাদের পোড়ানোয় ফাঁকি দেওয়া চলবে না ।
একজন সত্যিকারের বন্ধুকে এইভাবে পাশে পেয়ে মা আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু বাবা এই নতুন ঠিকানার হদিশ পেয়ে এখানে এসে এমন কান্ড করলো যে লোক জড়ো হয়ে গেল ।কোন সভ্য মানুষ যে তার স্ত্রী আর সন্তান কে এই ভাবে অপমান করতে পারে তা আমি দুঃস্বপ্নও ভাবতে পারিনি। রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে যেন উলঙ্গ করে দিল নিজেরই জন্মদাতা । লজ্জা, দুঃখে ,ঘেন্নায় হাতের কাছে যত অষুধ ছিল বিনা দ্বিধায় খেয়ে ফেললাম ।মনের যন্ত্রণা জুড়ানোর অন্য কোন পথ আমার জানা ছিল না।মা আলো নিভিয়ে ঘরে এক মনে গেয়ে চলেছে—
মরণরে,
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান!
মেঘ বরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট,
রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট,
তাপ-বিমোচন কৰুণ কোর তব,
মৃত্যু অমৃত করে দান!
তুহু মম শ্যাম সমান।
এখন যন্ত্রণা কমছে । ভোর হলো কিনা কে জানে । বড্ড ঘুম পাচ্ছে । একটু ঘুমিয়ে
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..