দীর্ঘশ্বাস
ভালো নেই ভালো নেই ধূসর সন্ধ্যা বিষণ্ন বিকেল, চারিপাশ ভালো নেই কফির কাপ পথের ধুলো…..
সকল রং এক সরল রেখায় এসে সাদা হয়ে যায়
এসব কথা লাশের কাফনে-বাতাসের রঙে লেখা আছে।
বাতাস রঙের লেখা পাঠ করতে পারে এক ডোম
অথচ সে বলতে পারে না, মানুষ কেন মরে গেলে সাদা হয়ে যায়।
যদিও তার পূর্ব পুরুষ মৃত মানুষের হাতের রেখা দেখে প্রথম ভেবেছিলো-
পৃথিবীর একটি মানচিত্র দরকার
সেই থেকে পৃথিবীর মানচিত্র হলো হাতের রেখার মতো।
তোমার ও আমার রক্তের ভেতর এসব ইতিহাস লেখা আছে
তাই মানুষ মারা গেলে মৃতদেহ সাদা হয়ে যায়,
রজনীগন্ধার পাপড়ির মতো সাদা ও সুগন্ধ ছড়ায় আমাদের মৃতদেহ থেকে।
যদিও এসব গন্ধ জীবিত মানুষের খুবই অসহ্য
তাই জীবিতরা মৃতদের ভাসায় অগ্নিস্নানে কিংবা পুতে রাখে কবরে।
নিঝুম নদীতীরের সাথে ঢেউ-এর অভিমান বেজেই চলে
তীর প্রায়ই বলে : ঢেউ-তুমি আমাকে অভিমানে স্পর্শ করো না।
আমরা সেই শান্ত নদীতে হাঁসের মতো ভেসে চলি-ধীরে ধীরে।
আমাদের ভেসে যেতে হয় তের টানে-ভাটির পানে ফেরার ক্ষমতা নাই।
তবুও সন্ধ্যা হলেই নিঝুম দ্বীপের শ্মশান থেকে শব্দ আসে
চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
আর আমরা সেই শব্দে প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক করে ডেকে উঠি।
আমরা ডাকতে ডাকতে দূরে বহুদূরে ভেসে যাই
যেখান থেকে চৈ-চৈ ধ্বনি আর শোনা যায় না।
চতুর্দিকে অবারিত রক্তমেঘ আর ধূ-ধূ জলরাশি
আমরা এই জলরাশির গভীরে কেন অনন্ত নিঃসঙ্গতায় ডুবতে পারি না!
আমরা কেন নবলব্ধ আকাশে মানুষের মতো উড়তে পারি না!
তাই আমার এই হাঁস জনমের বেদনা-ফাঁস করে গেলাম কবিতায়
যে কবিতা পাঠ করলেই শুনতে পাবেন : চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
একজন কবি তার কবিতায় চিতার কাঠ জ্বালাতেই
হঠাৎ অনুভব হলো চিতার কাঠ যেন তার শরীরের হাড়।
চিতার কাঠ যখন কবিতায় দাউ দাউ করে জ্বলছে
তখন কবিও পুড়ে যাচ্ছে, টগবগ করে ফুটছে রক্ত ও মাংস
সেই থেকে পৃথিবীর সকল কবির রক্ত ও মাংস থেকে পোড়া গন্ধ।
অথচ আমার রক্ত ও মাংসে পোড়া কোনো গন্ধ নেই-
যদিও আমি গল্পের নামে কবিতা লিখি-কবিতার নামে গল্প।
একদিন আমার একটি কবিতার মাঝে এক রমণীকে হত্যা করেছিলাম
সেই থেকে ওই রমণী আমার স্বপ্নঘরে এসে বসে থাকে
এবং তার হত্যার বিচার চায় আর আমায় অভিশাপ দিয়ে বলে-
‘একজন খুনি কীভাবে কবি হতে পারে’।
তারপর, কচুপাতায় আমার চোখের জল জমে জমে নদী হয়ে যায়
আর আমি হয়ে যাই সকল মৃতকবিতার ডোম।
আমার ধাত্রীমা, বিধবা ও নিঃসন্তান ছিলেন
পৃথিবীতে তিনিই প্রথম আমাকে স্পর্শ করেছিলেন রক্তমাখা হাতে
মাতৃগর্ভ থেকে মায়ের মুখোমুখি করেছিলেন আমাকে।
তারপর কোনো দিন তার স্পর্শ পাইনি
বিস্মৃত সময়ের অন্তরালে তাকে ভুলে গিয়েছি-অকৃতজ্ঞতায়।
অনেক পরে ধানলিপি থেকে জেনেছি তার গল্প-
তিনি অন্তঃসত্ত্বা হতে হতে স্বামী হারিয়েছিলেন-বোবা পৃথিবীতে
এক মৃতশিশুর জননী হয়েছিলেন-গম্বুজীয় অন্ধকারে।
তারপর সেই মৃতশিশুকে চুমু খেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন-
তুই কি জানিস, একফোঁটা চোখের জলে কতটুকু বেদনা ঝরে?
আপনারা কেউ কি আমাকে বলবেন?
কোনো মৃতশিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মা মনে মনে কী কী ভাবে?
আমার মা এক মৃন্ময়ীবৃক্ষ
তার জীবিত শরীর জুড়ে উইপোকার বসবাস।
আমি সেই বৃক্ষে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে গেঁথে আছি
আর টের পাচ্ছি বিষাক্ত কামড়ের জ্বালা।
অথচ! উইপোকারা জানে না-
আমাদের কাঠ থেকে তৈরি হবে ম্যাচবাক্সের কাঠি।
শহরের বাড়িগুলো খুব পাশাপাশি
অথচ, ভেতরের মানুষগুলো অনেক দূরে দূরে বসবাস করে।
তাই আমার মা কোনোদিন শহরের অধিবাসী হতে পারেনি।
সে এখন গ্রামে বসে-প্রতিভোরে গোবর দিয়ে উঠান পবিত্র করেন;
পূজায় বসেন
পূজা শেষ করে খোঁজ নেন-হাঁসমুরগিগুলো কোথায় কেমন আছে।
লাউয়ের ডগা আর কতো বড় হলে-মাচাটা কতোটুকু করতে হবে।
আমি শত শত পথ দূরে থেকেও মায়ের এসব কাজ দেখতে পাই
আর শুনতে পাই-মা আমাকে কখন কী বলছেন।
যেমন করে শত শব্দের ভিড়েও বাসের ড্রাইভার-
হেলপারের কথা শুনতে পায়।
আমার মা যখন বালিকা ছিলেন
যখন তার একবারও ঋতুস্রাব হয়নি
তখন তাকে আমি প্রথম দেখি-
সে হেমন্তের সন্ধ্যায় লেবুফুলে স্নান সেরেছে মাত্র
মা তখন নগ্ন ছিল-ঠিক আমারই মতো
কেননা আমরা দু’জনেই সমবয়সী-সময়ের অন্ধ জোনাকি।
হেমন্তের সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি-
মাকড়সার জালে ধরা পড়েছে ভোরের শিশিরবিন্দু,
এ যেন আমার মায়ের অশ্র“বিন্দু-মাকড়সা জালে।
প্রতিটি অশ্র“বিন্দুর মাঝে লুকিয়ে আছে-এক একটি সূর্য
আমি এতগুলো সূর্য-একসঙ্গে কখনো দেখিনি।
অথচ হেমন্তের অশ্র“বিন্দু কেন যে বোঝে না?
যাকে সে বুকে ধারণ করে-সেই তাকে শুষে নেবে।
হায় সূর্য-যে তোমাকে বুকে ধারণ করে।
তুমি তাকেই শুষে নাও।
মা, তুমি নগ্ন হলে
তোমার সমস্ত শরীর আয়না হয়ে যায়
তখন তোমার দিকে তাকালে
শুধু আমাকেই দেখি।
এখনও শরীরের একটা বিশেষ অঙ্গ
মানুষের কাছে অনেক কিছু।
তবুও আমি যখন কবিতা পাঠে নিমগ্ন থাকি
কিংবা মায়ের নান্দনিক নগ্নতা নিয়ে ভাবি
তখন আমার ওই বিশেষ অঙ্গের কথা মনে থাকে না।
অথচ, এই আধুনিক সভ্যতার মানুষ কেন ভাবে না
পোশাক আবিষ্কারের পূর্বে কোটি কোটি বছর ধরে
মা ও সন্তান নগ্ন হয়ে বাস করেছে স্নেহের হৃদয়তলে।
ভালো নেই ভালো নেই ধূসর সন্ধ্যা বিষণ্ন বিকেল, চারিপাশ ভালো নেই কফির কাপ পথের ধুলো…..
প্রেমের কবিতা যা কিছু পাষাণ, মনে হয় আঁশ বটিতে কুচি-কুচি করে কাটি পালানো ঘাতক সময়…..
তর্জমা স্নানে শুচি হবার পর বেকসুর সন্ধ্যাগুলো শুধুমাত্র নিজস্ব অন্ধকারের নিচে দোলনাচেয়ারে ছড়িয়ে বসা কিছুটা…..
হয়তো একদিন অস্তিত্বে খুঁজে আত্মপরিচয় নিভৃতে অপেক্ষার প্রহরে এ মন ভালোবাসার রূপালী আলোয় রাঙা মুখ…..