গ্রামবাসীর প্রতি

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
গ্রামবাসীর প্রতি

অন্ততঃ একটা কিছু 

অন্ততঃ একটা কিছু দাও
হে সূর্য ,নিরন্ন নিঃসহায় আমাদের বাঁচাও ।
হয় দাও —এক কাপ লালচে চা’য়ের মতো মূল্যবান
রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল—যাতে শীতের কবলে জড়োসড়ো প্রাণ
একটুখানি বাঁচার ভরসা পায় তপ্ত উষ্ণতায় ,
আমরা (তৃতীয় বিশ্বের ) ঘিঞ্জি বস্তির দরিদ্র মানুষ ,উপযুক্ত শীতবস্ত্র নাই ।
মুছে দাও এই অকাল মেঘলা দিন
বড়ো ভয়ানক কনকনে শীতের সঙীন ।
অথবা দাও—-একখণ্ড আধপোড়া রুটির মতো মূল্যবান
সোনালি ভবিষ্যতের ফরমান—
ফুটি-ফাটা মাটির পরিতৃপ্তির পরিচ্ছন্ন দিন ,
যাতে মৃত-প্রায় মাঠ মেতে উঠে প্রাণোচ্ছ্বল ফসলে রঙীন ।
আমরা প্রস্তুত বৃষ্টির জন্য আরো জাড় বুক পেতে নিতে ,
ওতে আছে তবু উদর-পূর্তির স্বপ্নের সুখ নিরন্ন পৃথিবীতে ।
আজ হিংসা-মত্ত দামামার হুমকিতে পৃথিবীটা জরোজরো ,
অস্তিত্ত্ব-বিপন্ন-করা সভ্যতার দ্বারে আমরা হয়েছি জড়ো
আমরা ধুঁকছি বুকে নিয়ে প্রাণ ধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনের আকুতি ,
আমরা চাই না—-সম্পদ ও শক্তির অপচয়ে-চলা ধ্বংসের ভয়ংকর প্রস্তুতি ।
তাই,হে সূর্য,অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি ছড়ানো
নিরাপদ শান্তির দিন আনো ,
সহ্য হয়না ঠাণ্ডা গুমোট —এতে মানুষের দুর্দশা বাড়ে আরো ;
আমাদের দুখ একমাত্র তুমিই ঘুচাতে পারো ।।

পরিণতি তবে কি?

যতোদিন এই দেহটায় প্রাণ আছে—আছে বল
জীবিকার পরিশ্রমে অনায়াস সক্রিয় সচল
ততোদিন আমরা বইবো মোট , টানবো পাথর
ঠেলবো লাঙল ঠেলাগাড়ি, খাটবো ঠিকা, দাদন
কাটবো মাটি,বাঁধবো সড়ক ; খুঁজে পেতে গ্রাসাচ্ছাদন
ফেলবো মাথার ঘাম পায়ে চিরকাল রোদে জলে জাড়ে উদোম গতর ।
আমরা তো গ্রীষ্ম বর্ষা জাড় হাড়-ভাঙা মেহনত
ক’রে চালাই এ জীবনের দিন,আর সভ্যতার অবিরাম গতি ।
আমাদের ভাগ্যে তবু সমাজের নীচু-চোখ দৃষ্টির লানত
এসে জুটে চিরকাল, যেমন পুরুষ দ্যাখে নারীকে অসতী ।
মাঝে মাঝে নেতাদের আহ্বানে মিছিলে যাই,স্লোগান উঠাই,
জমা দিই দফাওয়াড়ী দাবির তালিকা,
কিংবা কখনো পোড়াই শোষকের কুশপুত্তলিকা;
তারপর–আগের মতোই যে যার খোরাক  জুটাই ।
ভাঙা চুলো,ফুটো হাঁড়ি,শানকি ,ক’পটে কাঁথা—এই আমাদের সব ।
আর আজীবন স্বপ্ন ঘিরে রয় : উষ্ণ সাদা ভাতের সৌরভ ।
অঘ্রাণেও হাভাতের শূণ্য পেট করে শুধু স্বপ্নকে বিদ্রূপ ।
দ্যাখো আমাদের প্রতিরূপ :
ষ্টেশনের পাটাতনে পরিশ্রান্ত ঘুমানো নিঃসাড়
রঙ-চটা লাল কুর্তা-পরা কুলি ,নগর-ভাগাড়
হাত্ড়ে-হন্যে-হওয়া কদাকার জীবিত কঙ্কাল
প্রেতাত্মার কপি মানুষ,আবাল্য অনলস খাটনে বেহাল
অভুক্ত চৈত্র-বেকার দিন-মজুর তোরাব,গাঁর শেষে ভাঙা-ঘর লক্ষ্মণ মিস্তিরি
নিজের ঘরটা যার ভালমতো ছাওয়ার সামর্থ্য হয়না কোনোদিন
অবশেষে সকলের পরিণতি শুধু সহায় সম্বলহীন
সমাজের গলগ্রহ অথর্ব ভিখিরি ।
কিছু কিছু দুরাশার শব্দ শুনি কখনো সখনো —
অনুদান ,পেনশন ,অনুরূপ আরো কিছু ; তারপর আর কোনো
সাড়া নাই কোনো দিক থেকে ;সমস্ত তলিয়ে যায় ;
দিন যায়, ভোট হয়, রাজা হয়, রাজা বদলায়,
আর চলে আমাদের উপর দিয়েই পুরাতন নিয়মের যাঁতাকল ।
যতোদিন এই দেহটায় প্রাণ আছে—আছে বল
আমরা তো বাঁচবার ন্যূনতম চাল তেল নুন সালুন আটার
জন্য ব’য়ে যাই বলদের মতো জীবনের দুর্বহ জোয়াল ,
তারপর ,আমাদের অস্তিত্ত্ব তবে কি — জঙলা নির্জন নিস্পন্দ ভয়াল
পলেস্তারা খ’সে-পড়া পরিত্যক্ত রেলের কোয়ার্টার ?

গ্রামবাসীর প্রতি

মুখ তুলে তাকায় জিজ্ঞাসু  চোখে পথচারী নিরীহ ছাগল
গাঁর মুখে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠে গুটিকয় বেজন্মা কুকুর
চারিদিকে পরিচিত প্রতিধ্বনি আর শিষ্ট স্বরগ্রাম উঠে ।
ওরা কি বলতে চায় ‘চিনি চিনি , আমাদের-ই গাঁয়ের মানুষ
আমাদের-ই ছেলে বটে , একদিন এইখানে মানুষ হয়েছে
এখন বিদেশী । বহুদিন পরে দেখা ; কী খবর ? কুশল তো ?
শহর-সংবাদ দাও গাঁয়ের নগরবাসী প্রবাদ-পুরুষ ।’
বয়স্ক স্বজন আর সমবয়সী বন্ধুরা সব একে একে
এসে জুটে , কতো কী জানতে চায় , আমি যেন সদ্যঃ-প্রকাশিত
নগর-গেজেট ; এবং উচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ , আকাঙ্ক্ষিত
শহরের জীবনকে কৌতুহলে ক্যামন্ সোনালি চোখে দ্যাখে ।
খড়ের গাদার মতো নগর-সুখের রম্য গম্বুজ বানায়
ওরা কল্পনার পটে (যেহেতু ওদের খড়ের গাদার নির্মাণ-শৈলীই শুধু
গ্রাম্য-দৃশ্যে ইতস্ততঃ নাগরিক নজরে আসার মতো কিছু )
আসাম পঞ্জাব রাজীব গান্ধী থেকে জ্যোতি বসুর সরকার
ইত্যাকার রহস্যের আরো নানাবিধ ওরা ঔৎসুক্য জানায় ।
হে আমার গ্রামবাসী অজ্ঞ চাষী ঋজু-হাসি দুঃখী অভাজন ,
শহুরে বৈশিষ্ট্য শুধু শৌখিন কায়দা-দুষ্ট মৌখিক ভদ্রতা ,
শকুনের তীব্র ছোঁ-য়ে স্বভাব-দুরস্ত সভ্য চোখ , বিজ্ঞাপনী
রূপের বেলেল্লাপনা , প্রেসের ভাগাড়ে হৃদয়-বৃত্তির শব্দ ,
নাটমঞ্চে রাখালী কিংবা দেহাতী দুর্দশার জ্ঞাতব্য পালিশ ,
কিন্তু কোনোখানে নাই পাড়াগাঁর প্রাণধর্ম প্রতিবেশী আত্মীয়তা , মন ।।

ধরা যাক, আমি নেই

ধরা যাক, আমি নেই ।
ধরা যাক পৃথিবীর কোনোখানে আমি আর নেই ।
অর্থাৎ মহাকালের অমোঘ নিয়মে
পার হ’য়ে গেছি আমি দুনিয়ার মায়ার বাঁধন
লোকাচার ধর্মাধর্ম জাতপাত উঁচুনীচু সম্পন্ন-নির্ধন
মুরুক্ষ-পণ্ডিত অসৎ বা সচ্চরিত্র কিংবা স্বদেশী বিদেশী ইত্যাকার
পরিচয়-পত্র-আঁটা প্রাত্যহিক বিভেদের বেড়া ।
ধরা যাক , জাগতিক ক্রিয়াকর্ম যথারীতি যথাসাধ্য পালন করেই
আমি নিয়েছি বিদায় পুতুল নাচের
নাট-মঞ্চ থেকে ; ধরা যাক ,আমার জন্যও
 কিছু
লোকজন ,আত্মীয়-স্বজন কিছু জুটেছিল আপাদমস্তক শোকাবহ
কাফন-পরানো লাশ সদ্গতির জন্য আর বিদেহী আত্মার
শান্তি-কামনায় । তারপর বিংশ শতাব্দীর খোঁচে
জীবাশ্ম হওয়ার মতো জীবনের কিছু বাকি নেই , ধরা যাক ।
পরিত্যক্ত আস্তানায় প’ড়ে আছে প্রিয়পাত্র বই
খাতাপত্র পেন্সিল কলম ,
জুতো জামা ,ঝোলাঝুলি,সেফটি রেজর
টুথব্রাশ,চিরুণী, রুমাল ; দেশ-বিদেশের
রেডিওর চিঠি ; সুদর্শন কার্ড ; স্মৃতির মাধবী ছবির বাণ্ডিল ;
শিক্ষার সার্টিফিকেট— মূল্যবান , সযত্ন-রক্ষিত ;
প’ড়ে আছে দাদের মলম , যৌবন-বর্ধক স্বাস্থ্যের টনিক ,
টুকিটাকি কবিতার পাণ্ডুলিপি , বা শখের
হারমোনিয়াম । প’ড়ে আছে ।
প’ড়ে আছে কবিতার দুঃস্থ পাণ্ডুলিপি —
মনের সোনালি কল্পনার প্রজাপতি
অস্তিত্ত্বের আশা-নিরাশার শব্দ-চিত্র
হৃদয়ের বর্ণময় বিশ্বাসের শিল্পিত বাগান
মানবিক বক্তব্যের স্বতঃস্ফূর্ত নির্দল তাগিদ ।
খরস্রোতা সময়ের দুই তীরে জীবনের সেতুবন্ধবৎ নির্মিত বালির বাঁধ
প’ড়ে আছে ভাঙাচুরা , বিষণ্ণ শ্রীহীন , ব্যর্থ ।
ডজন ডজন
মাকড়সা আরশোলা নিবিড় নিশ্চিন্তে পরম সুখাদ্য ভেবে
খুঁটে খাচ্ছে তার সব কমা দাঁড়ি অক্ষর পয়ার ।
কবিতা নামক এই মস্ত উজবুক
ভাবুক ফালতু বস্তু ছাড়া আর সব
নিশ্চিতই জানি , যে-কেউ-না-কেউ করবে দখল
অচিরেই হুটোপাটি ক’রে , লুঠের মালের মতো ।
তবু রক্ষে , হে ঈশ্বর , কথা-চোর কেউ
কবিতা হরণ না করার মতো যদি হন করুণা-নিধান !
পাণ্ডুলিপি অন্ধকারে হৃদয়ের অজস্র শব্দের ঝিলিমিলি
এঁকে যায় নিবু -নিবু জোনাকি জীবন ,
সমস্ত আমার চোখে হ’য়ে যায় একান্নটি বর্ণের বাহার অধ্যূষিত
নক্ষত্র-খচিত দূর চাঁদোয়া আকাশ ; তার সাথে
শুদ্ধ বাংলায় বিবিসির ক্ষিপ্র ভাষ্য আর  অপাঙ্ক্তেয় দেহাতের লোকভাষা
অরোরার অপূর্ব আভায় দ্রবীভূত ।।

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..