গ্রুপ সেপ্টেম্বর (দ্বিতীয় কলি)

স্বপন রায়
ধারাবাহিক, ভ্রমণ
Bengali
গ্রুপ সেপ্টেম্বর (দ্বিতীয় কলি)

যা হয়েছিল

প্রণবদার  চেঁচামেচিতে ঘোর ভাঙল….
– কিরে  তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস…শালা আমি তোকে গরু খোঁজা খুঁজছি সেই কখন থেকে..চল চল…কবিতার সেশন শুরু হবে..সবাই ওয়েট করছে..

আমি এখনকার সারাহানে তখনকার শোণিতপুর দেখতে পাই, নাকি পাইনা? চারদিকে তুমুল অন্ধকার,আর একা আমি! আমিই বা কে?  আমি স্বপন নাকি আলাদিনী পিকলু বা ফেকলু, কে আমি?

সারহান ছিল বুশাহার সাম্রজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী, শীতের রাজধানী ছিল রামপুর।সারাহানে রয়েছে সতীর একান্ন পীঠের একটি পীঠ “ভীমকালী মন্দির”।এখানকার রাজবংশের উত্তরাধিকারী বীরভদ্র সিং বেশ কয়েকবার হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। শিমলা থেকে ১৭০ কিমি পার করে এসেও কিন্তু ক্লান্তি বোধ হচ্ছেনা! দলবেঁধে বেরিয়ে পড়লাম ভীমকালী মন্দির লাগোয়া রাস্তা দিয়ে সারাহানকে বুঝে নিতে।

যা হতে পারতো

ছবি-৪

আমি আর পাখিটা, ভীমকালী মন্দিরের সাম্নে যেন আমার স্তব্ধতাকে অনিবার্য জেনে পাখিটা রঙ নিচ্ছে অবসরের বৈকালিক বিস্তার থেকে। ভীমপলাশী থেকে মধুবন্তী পর্যন্ত এই পাখিভরানো রাগ, আমি থমকে আছি। সদ্য বিকেলের থেকে প্রাক-সন্ধ্যা এমন পাখিনীহারে কেটে গেল!

জুজুরাণা! দাদা ইয়ে জুজুরাণা হ্যায়!

আমার পাশে একেবারে টিপিক্যাল হিমাচলী পোষাকে না হলেও প্রায় সে রকমই একটি যুবক, মুখের হাসি চোখে ভরিয়ে ব’লছে!

ট্র্যাপোগান!  দ্য গ্রেট ওয়েস্টার্ন ট্র্যাপোগান !! এই হল সেই মোনাল প্রজাতির পাখি, যার এত গল্প  শুনেছি! সারাহানে ফেজান্ট ব্রিডিং সেন্টারে এই প্রায় নিশ্চিহ্ণ হতে যাওয়া এই পাখিদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ট্র্যাপোগানকেই এরা জুজুরাণা বলে….

আমি যুবকটিকে বলি, আপলোগ খুশনসিব হো… রোজ দেখ পাতে হো…

– নহি দাদা, ইয়ে তো উপ্পরওয়ালে কি দেন হ্যায়! রোজ কাহাঁ নসিব হোতা হ্যায়?

সারাহানে সন্ধ্যা নামার মুখে স্থানীয় এই যুবক লাখন সিং আমায় জানায় যে ঈশ্বর সব রকমের প্রাণ সৃষ্টি করে ভাবলেন যে এত প্রাণ এত রং, কিন্তু সব রঙ মিলিয়ে একটি প্রান কই?

জুজুরাণা সেই প্রাণ!

লাখন চলে যায়। রঞ্জন, সৌমিত্র, বারীনদা, ধীমান  ভীমকালী মন্দিরের ভেতরে যে রাস্তা চলে গেছে রাজপ্রাসাদের দিকে, সেই রাস্তায় এগোচ্ছে, আমি পাখির সারাংশ বুকে নিয়ে এগিয়ে যাই ওদের দিকে। কিন্তু যাবো কোথায়? আমার সব রাস্তাই রিয়া থেকে আর রিয়া অব্দি….

– কী,  এবার পাখিটাকে নিয়ে কবিতা লিখবে?

– জানিনা

– তুমি এমন একজন খুনী যে নির্জন রঙ পছন্দ করে, অথচ নির্জনতার রঙ হয়না

– হয়, আমি একবার অনেক রাতে রাউরকেলায় দেখেছিলাম

– ঢপ

– তুমিও দেখেছো, মনে নেই কোয়েল পেরিয়ে যে পাহাড় তাকে আমরা কি বলতাম?

– বুরুয়া… সেতো বুরু থেকে

– হ্যাঁ.. রংটা ভাবো

– একটু পাটকিলে… আঁধারিয়া…মনপাওয়াসি…. ধ্রুতিম…বেশ ঘোরালো… একা রং… বেশ একা

– নির্জনতার রঙ

–  নির্জনতা! কবিদের বানানো সব… খুনী হওয়ার আগে ওটা হল কবিদের শান দেয়ার  জায়গা…

–  শান দেয়া? কিসে শান দিতাম আমি?

–  জানোনা?

রিয়া প্রায় লজ্জাই পেলো… আহ… রাউরকেলায় তখন অনুরোধের আসর রোজ পাটায় বসছে…

‘দেখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ
সারারাত আকাশে সলমাজরি
এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে
এসোনা গল্প করি…’

আরতি মুখোপাধ্যায় সেই মুহূর্তে ভেসে যেত  এক ফালি সুরঈত্ত্বর হয়ে… ঈত্ত্বর মানে আতর… আর কোয়েল ভাসিয়ে দিতো ইস্পাত কারখানার যাবতীয় স্ল্যাগ… ভোঁ…. কোকওভেনের আগুন… লজ্জা ছুঁয়ে যেত তারপরে…

রিয়ার দিকে তাকাতেই মনে হলো আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি.. এতো সারাহান.. ওই তো সন্ধ্যার স্টক শট নিচ্ছে প্রণব দা… ভীমকালী মন্দিরের ওপর আলোফুরিয়েরা আসঙ্গ করছে রাতের পা ফেলা  হিমের চোরামীতে… রিয়া কেন থাকবে এখানে? রিয়াকে আমি খুন করেছি… রিয়া এসবই  তো বলে… ও আমায় ভয় পায়না কেন… জুজুরাণা হাসছে… ‘খুদা গবাহ’ ব’লছে নাতো?

আমি গ্লাভস খুঁজি…. .কবেকার রক্তের দাগ ঢেকে দেওয়ার ইচ্ছে এঁকে দেয় এক পাখির গড়ন… আমি এগোতে থাকি, আমার ভয় আমার ছায়া তো সেই কবে থেকেই..

যা হয়েছিল

আমরা সারাহানের মন্দির লাগোয়া বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজপ্রাসাদের কাছে পৌঁছলাম, কোন প্রহরা নেই, তবু বিনানুমতিতে ঢোকাটা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম! এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলার সময় অচেনা মহিলা কন্ঠ আলোআঁধারির ভেতর থেকে জানালো, কোন অসুবিধে নেই, নিশ্চিন্তে চলে যান! দেখলাম তিনটি মেয়ে (মেমসাহেব)! তাদের একজনই আমাদের জানিয়েছে, আমি হেসে বললাম, আপনারা? তিনজন চেক মেয়ে, বয়স পঁচিশের নিচে, বাংলা ভাষার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। বাংলা নিয়ে গবেষণা করছে। কিন্তু বাংলা জানতে হলে তো বাঙালিদেরও জানা দরকার! তাই ঢাকা,কলকাতার ফাঁকে একটু হিমালয় চেখে নেওয়া! দেখতে অসামান্যা আর সাহসে অতুলনীয়া। আমরা কবিতা লিখি জেনে আড্ডা জমে গেল। পাহাড়ি শীতের ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে অনেক কথা চালাচালি হল, অনেক কবিতা! আমি বন্ধুদের সঙ্গে ফেরার সময় ভাবছিলাম, কি জাদু বাংলাভাষার, কিভাবে  সবকিছুই মধুর করে দেয়…..

যা হতে পারতো

জিরের গুঁড়ো, বাতাসা, ফুলকপি, বেগুন, ঝাঁটা,সরষের তেল, ময়শ্চারাইজার, নুন, আটা, মশারি,সূঁচ, লিকুইড সোপ, নারকোল, চাল,বিন্দি…

এই ফর্দটাকে পণ্য অনুযায়ি সাজালে অন্য ছাঁচ, আবার মুল্য অনুযায়ি সাজালে অন্যরকম!

কেউ কেউ এর সঙ্গে সেই পাতাটার বর্ণনা জুড়ে দিতে পারেন। পাতাটার একদিকে ছিলো

নিরুদ্দেশের প্রতি আবেদনঃ খোকন ফিরে এসো। মা অসুস্থ। তোমায় ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না,তুমি যা হতে চাও তাই হবে। সত্ত্বর ফিরে এসো, আশীর্বাদক বাবা! উল্টোদিকে অভিনেত্রী কাজলের ছবি। কাজল হাসছে। বাজারের ফর্দ কাজলের হাস্যরতা ঠোঁটের ওপোর দিয়ে শুরু হয়েছে। হাতের লেখাটা মেয়েলি, ঈর্ষা?

বাজার করার পরে ফর্দটি ফেলে দেয় সেই তরুণ। সে গান গায়। দূরে দেখতে পায় মেঘ জমেছে। সে তার বাড়িতে আসে।

তরুণী জিজ্ঞেস করে, ফর্দটা?

তরুণ বলে ফেলে দিয়েছে, বলার সময় একটু ভীত দেখায় তাকে!

তরুণী হেসে ফেলে এবং বলে, বেশ করেছো!

আমি কিভাবে যেন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম এই ফর্দটা, হাতে পেয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম এক সাংসারিক কথপোকথন!তখন আমি আর রিয়া ফাঁক পেলেই ছিঁড়ি আকাশচোরা রোদ, গঙ্গার গা, ট্রামের লাইফলাইনে থমকানো মিয়াঁ-কি-মল্লার,ঘাস!

তো সেই ছেঁড়াপর্যায়ে ওর হাতে ফর্দটা ধরিয়ে দিই!

রিয়া  পড়লো পুরোটা। বললো, এ সব কি?

– কেন কবিতা!

– কবিতা?

– ও তুমি নিতে পারবে না

– দিতে পারলে নিতে পারবো না কেনো… তুমি আমায় যা দিয়েছো আমি তো নিয়েছি,  নাকি? কিন্তু কবিতাকে ধংস করার অধিকার একজন কবিকে কে দিয়েছে?

– আমার বাবা দেয়নি এটা জানি, তুমি জানো কে দিয়েছে?

– সেই ছ্যাবলামো… তুমি নিজে নিজের এ সবে বোর হওনা?

আমি বরাবরই রিয়ার সামনে ভেবলে যাই! এই সারাহানে রিয়ার সঙ্গে ঊষাও! তো এ সব থেকে বেরোতে আমি কাল রাতে আমি এই ভাবনাটা লিখে প্রদীপকুমারকে দিয়ে দিলাম! একটি তরুণ আর সদ্যবিবাহিতা তরুণী, এদের বাজারের ফর্দে কি ভাবে ঈর্ষা ঢুকে যায়,  অভিনেত্রী কাজলের নাম বিজ্ঞাপনে দেখতে পেয়ে তরুণী তার মুখ ঢেকে দেয় বাজারের ফর্দ দিয়ে, আবার  রেগে যাওয়ার বদলে খুশি হয়ে ওঠে সেই তরুণ ফর্দটিকে ফেলে দেওয়ায়! কেন হয় এরকম, কোন মানসিকতায় এ সব হতে পারে, এর ফলে দাম্পত্যে প্রভাব পড়ে কিনা..এসবই  যখন লিখছি তখন পাশে কন্ডিশনড রিফ্লেক্সের ওপর একটা বই ছিল আর গান ভেসে আসছিলো,

ম্যয়নে পুছা চাঁদ সে
ফলক হো ইয়া জমি
এয়সা ফুল হ্যায় কোই
ফুল নে কহা
হর কলি কি কসম
নহী নহী নহী…

প্রদীপকুমার ভাবনাসূত্রগুলো পড়ে বললো, এটা অন্য কেস, পরে কোনদিন লেখা যাবে!আমি গদ্যে বরাবরই অপারঙ্গম, প্রদীপকুমারকে বললাম,ঠিক আছে সময় মত লিখো, তবে রিয়া আর পিকলুকে এর ভেতরে রেখোনা।

প্রদীপকুমার হেসে বললো, ওদের নিয়ে আমি অন্যকিছু ভাবছি, মেরে আকা, তুমি শুধু দেখে যাও!

যা হয়েছিল

ছবি-৫

ম্যয়নে পুছা চাঁদ সে…বারীন দা এই গানটাই  আজ জীপের ভেতরে শুনতে পেয়ে বলেছিলো, বাঃ এই গানটা তো শুনিনি!

ধীমান বলেছিলো, আরে এ তো পুরনো গান..

– আর.ডি’র সুর, রফির গলা, রঞ্জন বললো।

বারীনদা মাথা নাড়লো! বললো, আমি অশ্রাব্যকে শ্রাব্য করি…. শ্রাব্যকে শুনতে পাইনা..

আমরা হেসে উঠেছিলাম! কিন্তু আজ কি পাহাড়’কে এই গানটাই পেয়েছে, পাহাড় বোর হয়না নাকি শুনতেই পায়না কালাপাহাড়!

সন্ধ্যায় প্রথম কবিতার আড্ডা শুরু হলো। সৌমিত্র রঞ্জনকে বললো, তোর কেউটে সাপটা বের কর!

রঞ্জন হেসে বলে, যদি ফণা তোলে?

ধীমান দাড়িতে চিরুনি চালিয়ে বলে, বিষ আছে এখনো?

রঞ্জন কাটিসার নামের দারুটি বের করতে করতে বলে, বিষ আছে তবে ছোবলটা দেবো কাকে?

তো হৈ হৈ করে কেউটে সাপ বা কাটিসার খোলা হয়। উল্লাস হয়!

কবিতা পড়া শুরু হয়। বাইরে পারদ নামছে, তবে আমাদের ডরমিটরিতে ঢোকার আগে ভাবছে একটু, কবিরা শীতকে চিনতে পারবে তো, নাকি নেশার ঘোরে ডেকে উঠবে, সীতে..সীতে…

রঞ্জন কবিতা পড়েঃ প্রকৃতি রচনা – ৩৩

জল আগমের মধ্যে একটা কি জলন্তিকা
সাদা হয়ে ঘরতে ঘুরতে ব্রেকফেল হাঁস
সমার্থক মরলেও ভাইজান কার্ডিয়াক এরেস্ট থেকে গেল
আগাম জামিন জলে ছাড়ো পোলাপান ছাড়ো
মীন ছাড়ে কিরণময়
এভাবে মীনিংফুল হয়ে গেলে ভেজা তো হবেনা
হবেনা তো বুক ভাঙা গম থেকে রুটি খুঁজে পাওয়া
কি আগুন
পারিনা রে
এই ঐশ্বর্য ছিলো ফট করে রাণী
তবু জানি লিখতেই মেঘে রাগারাগি করে নীরেনবাবুটি
চেরা আলো আর হাঁস
কেউ কারো না চিনেও জেটল্যাগে পৃথিবী বানায়
মাঝে এক ভীষণ গতর অভিধান
তাকে কি আমন ভাববো,রামগিরি!
অশোক গিরিও কিছু কম নয়
হুলুস্থুল বডিকাট
ট্রাক দু’নম্বরি করে বাচ্চা করে
আষাঢ় ঘোচাতে তার বর্ষা করা দেখে
ভাল খিদে হয়

প্রণবদা  বলল, আলোটা ঠিক পাচ্ছিনা… রঞ্জন একটু সরে আয়

আমরা সবাই আটকে গেছি এই জায়গায়ঃ  “জল আগমের মধ্যে একটা কি জলন্তিকা, সাদা হয়ে ঘরতে ঘুরতে ব্রেকফেল হাঁস

বারীনদা বলল, কবিতা নতুন করা মানে এলেবেলে কিছু একটা লিখে দেওয়া নয়, নতুন কবিতা এখন পরিণত হয়েছে…. এই গঠন পুরনো কবিতায় ছিলনা…

সৌমিত্র বলে, ব্রেকফেল হাঁস! কেন বে হাঁসের ব্রেকফেল হল কেন?

হাসি ছড়ায়, হাসিটাও এরকম,  “এই ঐশ্বর্য ছিলো ফট করে রানী..” রাতের আগে অন্ধকার তরল তো হবেই, একটু সাবলাইম…

আর হয়তো আলাদীনের প্রদীপ বিরচিত পিকলুকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে ঊষা আর রিয়া। ওর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলবে, আমিও সে আলোটার কাছাকাছি মৃদু হয়ে যাবো, যে আলোর নামে কোন মোম নেই, শ্রীময় নেই…

আর সারাহানে আমাদের কবিতা কফির অপেক্ষায় ঘন হতে থাকে, অপেক্ষাটা আমার!

কফি আর কে খাবে?  আমি এক্ষেত্রে একা! আমার বাবাও কি এরকমই কোন কারণে প্রায়শই গেয়ে উঠতেন, ”আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে…”

যা হতে পারতো

আমি পাঁচিলের ওপর প্রায় নীরবতা হয়ে বসে আছি! আমার যে সব গুণ আছে, গুণগুন আছে এবং অপগুণ কবিদের যে কেন সে সব একটু আধটু থাকেনা। কিন্নৌর হলো তন্বী, কলাবতী নারীর দেশ! আমি তো ওদের গ্রামেও গিয়েছি, ওদের গান, ওদের আমিষ তাকানো, আহা! একটু আগেই তো ভিনীতা এসেছিলো, ফাইনাল ইয়ার, পল সায়েন্স, শিমলায়। ছুটিতে এসেছিল, আজ ফিরে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে সারাহানের বাজারে আলাপ। আমি কি যেন খুঁজছিলাম, ভিনীতা সেটা খুঁজে দিয়েছিলো। আমার তো সেঁটে যাওয়া অভ্যাস, তো গেলাম! না ইয়ে পর্যন্ত যাইনি।  তবে অন্ত্যাক্ষরি খেলেছি, লুডো ছিল না,  তাই খেলা হয়নি!  কিন্তু আপেলের সদ্য পেকে ওঠা উদ্ভাস ছিলো, আর স্বাদ!

যাওয়ার আগে বলে গেল, আজ ফির জিনেকা তমান্না হ্যায়, আজ ফির মরনেকা ইরাদা হ্যায়!

আমি ওর হাত ধরে প্রায় গেয়ে উঠেছিলাম, ‘না যা ও মেরে হমদম…’ ‘যাত্রা” হয়ে যাবে ভেবে চেপে গেছি, শুধু  হাতের ওপরে একটু  হাতের চাপ আর হাসিকে বিষন্ন করে তোলা! এটা আমার আকা আমায় শিখিয়েছে , “আকা”ও বোঝাতে হবে?  ওই যে আলাদিনের প্রদীপ- দৈত্যটি আলাদিনকে বলতো! আমিও বলি, কারণ দৈত্যের মত আমিও আমার ‘আকা’র সৃষ্টি! আর ওই যে আসছে আমার আকা! ওই যে হোঁৎকা মত, একটু লাল্টু, পুলওভার গায়ে, লাল পুলওভার ,আমার আকা, স্বপন রায়! বলে তো কবিতা লেখে, ওই আমায় বলেছে নাটক আর যাত্রা জীবনের অঙ্গ করে নিওনা, সারাজীবন ডায়ালোগ মেরে যেতে হবে! ভিনীতাকে তাই কোন গান শোনাতে পারলাম না…. কত যে মাপমত গান ছিল!

স্বপন রায়,  আমার আকা এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, কতটা এগোলে?

মনে মনে বলি, তাতে তোমার কি বাপ?

মুখে বলি, বর্ডার লাইন কেস… চলেই তো গেল!

স্বপন বলল, এদের চেহারায় ভূমধ্যসাগরীয় ছাপ আছে.. কিছু মঙ্গোল ছাপ নেই তা নয়… তবে কাল থেকে মঙ্গোলরা ডমিনেট করবে.. কল্পা থেকে বেড়ে যাবে বৌদ্ধদের সংখ্যাও…

আমি জানি এখন আমায় চেটে যাবে স্বপন, এ তার অধিকার! তার বদলে আমায় দিয়েছে লেখার অধিকার… এই পাহাড়… তাদের সমাজ… নারী..ফুল আর প্রাণ.. .আমি নোট নিচ্ছি। নামিয়ে দেবো একদিন…

তবে একটা জিনিস আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার আকা স্বপনের কবিতা কারা পড়ে আর কারা বোঝে কে জানে!

যেমন এই অংশটা –

“ ভেসে যাওয়ার সময়
চিৎকারের সময় কিছু পড়লো
গো গো আনমনা
পড়লো
হয়তো কোন রঙ
রঙ তো রঙ নয়
কেউ পরেছে তাই রঙ হলো
কিছুই পরেনি বেরং হলো না
পড়লে
সুদূরও এলো এতো অপেক্ষা তার
এতো শীত এতো ক্ষীর

আলাদা খুব চলছে
আলাদা মনের বাটিও গভীর
ডুববে
ভাসবে ওরে মন মনরে আমার
সেই তরঙ্গে রাখা
জল তরঙ্গে রাখা …”

জানিনা আমার আঁকা এসব লেখে কেন? তার চেয়ে  “তোমার চোখে পাতা / আমার মৃদু আঁকা…” টাইপের লেখা লিখলে কত ইয়ে হয়ে যেত.. .বুঝলো না.. আমি বলেছি কয়েকবার…. হেসে বলেছে, গান আর কবিতা এক নয় রে পাগল!

তো, আমার আকা আমার ঈশ্বর! আমি মেনে নিয়েছি!

এখন এই বিকেলেও স্বপন ওর মুচকি দিয়ে আমায় বলল, সাংলার আপেল? কল্পার আপেল খেয়ে দেখো, আরো মিষ্টি!

তারপর হঠাতই ভীমকালী মন্দিরের রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো

– আরে যাচ্ছ কোথায়?

– জুজুরাণা জানিস? ট্রাপোগান… দি গ্রেট হিমালয়ান ট্রাপোগান.. ওই গাছটার আড়ালে আমি এই মাত্র দেখলাম.. কি দেখতে রে… চলে এসো যদি দেখতে চাও!

পাগল!  আমার পাখি উড়ে গেছে ,মেরে আকা তুমি জুজুরাণা দেখো, ওই সব দুর্বোধ্য কবিতা লেখো..  যা ইচ্ছে করো…  আমি নেই!

রবীন্দ্রনাথ তো কবেই বলে গেছেন,  “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়!”

 

(চলবে… )

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..