গ্রুপ সেপ্টেম্বর (শেষ কলি)

স্বপন রায়
ধারামুক্ত কবিতা
Bengali
গ্রুপ সেপ্টেম্বর (শেষ কলি)

যা হতে পারতো

#

 

ফুলেইছ শুরু হবে আর একটু পরেই, ব্রহ্মকমল পিঠের ঝোলায় নিয়ে নেমে আসছে তরুণ অভিযাত্রীরা! পাহাড় কেটে বানানো এক আধা-স্টেডিয়ামে চলে এসেছেন স্থানীয় দেবতা। আরম্ভ হল যৌথ নাচ!আমার আকা স্বপন রায় আর তার বন্ধুরা গিয়েছিল ছিটকুল, ফিরে এসেই ফুলেইছ দেখতে এসে গেছে। এরা পারেও, কবিদের এই এনার্জি কোন কাজে আসে কিনা জানিনা, তবে সময় এদের কাছে হমসফর ছাড়া কিছু নয়, অন্তত এই নতুনপাগল কবিদের কাছে। যাইহোক আমি আর ভিনীতা স্টেডিয়ামের একটু ওপরে এক নির্জন পাইনসিরিজে  হ্যাঁ হ্যাঁ না না করছি! আমাদের খেলা চলছে অতিরিক্ত সময়ে, প্রেম খুবই সারপ্লাস ভ্যালুর দিকে এখন, কারণ ভিনীতা ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে কোন এক প্রীতি জিন্টার কথা বলছে, যার গালে ট্যাক্সনিল টোল পড়ে, স্কিটিং স্কিনে সব ফনকারি, সব লিখিত আন্দাজ গুমরাহ হতে থাকে, সেই প্রীতি’র সঙ্গে নাকি ভিনীতা’র অনেক মিল.. আমি বলি, আচ্ছা সবকিছুই মিলে যায়?

-মতলব?

-নহি নহি গলত মতলব নহি নিকালনা!

-মারুঙ্গি আপকো!

হেসে বলি, মারো না….

ভিনীতা লজ্জা পায়, হাত ওঠায় অতীন্দ্রিয় শাখার নরম আস্কারা নিয়ে…. ”অঙ্গরাই ভি ও লে না পাই উঠাকে হাত/ দেখা জো মুঝকো ছোড় দিয়ে মুস্কুরাকে হাত…” নিজাম রামপুরী’র থেকে উইথ থ্যাঙ্কস নিয়ে ভিনীতাকে আমি শোনালাম আমার দিল-এ-তমান্না… পাইনের ছায়ায় বিস্তারিত হয়ে আসে ফুলেইছের উল্লাস…. নাচ গানের আবেশ আমাদের জড়িয়ে নেয়… ভিনীতাও আজ হিমাচলী সাজে সেজেছে… কি অবাক করা শরীর ওর, অলঙ্কারের ভার যেখানে হয়ে যাচ্ছে অবশ্যপাঠ্য সিলেবাস.. আমি পড়তে থাকি ওকে…..ও চোখ পাকায়… আলাদীনের ল্যাম্পোলা আমি(ল্যাম্প আর পোলা আর কি!), ভিনীতা জানেনা যে আমি আছি কিন্তু নেই, আমি এক প্রয়োজনীয় স্বপ্ন মাত্র, অনস্তিত্বে যার বাঁচা! ভিনীতা’কে সব জানাতে হবে। কিন্তু এখন নয়…” দিল মে এক লহর সি উঠি হ্যায় অভি/ কোই তাজা হাওয়া চলি হ্যায় অভি”… চলো “নাসির কাজমি” সাব কে সাথ চলতে হ্যায় নীচে… ভিনীতাকে বলি আমি!

-ইয়ে সাব কৌন হ্যায়?

-শায়র হ্যায় মোহতরমা!

-ঔর নীচে কৌনলোগ হ্যায়

-কবিয়াঁ হ্যায়

ভিনীতা হাসে, বলে, কবিয়োঁ কা খুসামুদি করকে আপকো ক্যা মিলতা হ্যায়?

-আপ মিলতে হো…

খুশিপ্রবণ হয়ে ভিনীতা আমার হাত ধরে, আমরা নামতে থাকি ফুলেইছের দিকে!

#

আমি পিকলু, আমি রিয়াকে খুন করিনি…. ফুলেইছের প্রথম রাতে আমি আবার লিখতে বসলাম পিকলু কা আজীব দাস্তাঁ! আমার “আকা” স্বপন রায়ের অনুরোধ, আমি লিখতে বাধ্য। আমি আলাদীনের চিরাগ, আমিও লেখক হলাম! খুব একটা কঠিন কাজ নয় কিন্তু। তবে কবিতা নয়, কবিদের আমি রিড করতে পারিনা। স্বপন রায়ের কবিতা তো একেবারেই নয়। তার চেয়ে পিকলু অনেক রিডেবল, আমি স্বপন’কে এটা বলায় আমায় বললো, আরে চিরাগবাবু আপনি হলেন ভূত, আমি ভূতেদের জন্য লিখিনা… এদিকে পিকলু রিয়া মারফৎ ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছে সময়কাড়া ঘটনাবলীতে, ঊষা আর অনিরুদ্ধ, লাতি আর নরিন্দর, পিকলু কেন যে কালছাপানো প্রেমিক হতে গেল!

#

এক বসন্তে লাতি আমায় বললো,নরিন্দর, মেরা ভাই শায়দ মুঝে আউর নহি মিলেগা, ম্যায় আউর বাপুজী কাহাঁ কাহাঁ নহি গয়ে… হমারে গানে পে লোগ তালি আউর পয়সা ভি দেনে লগে অব, যাহাঁ হম জাতেঁ হ্যায় ভীড় হি ভীড়…..লেকিন মেরি আওয়াজ কো পহচাননে ওয়ালা   মেরা ভাই উস ভীড় মে অব তক নহি মিলি মুঝে….

আমি ওকে সান্ত্বনা দিই। এ ছাড়া রাজকুমারী লাতিকে কি আর দিতে পারতাম আমি?

#

কাহিনীকে তো মোচড় দিতেই হয়, রূপ আর অরূপের মাঝে খেলা করে কথার বিভ্রম!কবিতা সেই কাহিনিসূত্রে জল মেশায়, মুছে দেয় তার শারিরীক আস্ফালন, চিহ্ণ থাকেনা আর কথাচিহ্ণে….তবে সেতো কবিদের গুহ্য ব্যাপার! লাতি আর নরিন্দর কিন্তু একদিন এক প্রকাশ্য হামলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল চিরদিনের মত….সেদিনের ব্যুহ রচনা ছিল মারাত্মক, আকাশে অশনিমুখো মেঘ, সিপাহী আর শান্ত্রীদের জমায়েত….

#

কি হয়েছিল সেইদিন?

#

লাতি  ভেবেছিল ওর গান শুনে কেউ ওকে চিনতে পারছে না, ওর দাদাও নয়, কারণ কোথাও কেউ ওকে লাতি বলে ডেকে ওঠেনি! ওর ভাবনার সঙ্গে রাজনীতির দেখা শোনা মেলেনা। দানবীর গুপ্তচরেরা পুরো কিন্নৌর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। সেদিন একাই ছিল লাতি, নরিন্দর বেরিয়ে গেল মন্দিরের দিকে, ওখানে খোদাইশিল্পীর কাজ ওর, বাপুজী কাছাকাছি কোথাও গিয়েছিল, সুযোগ বুঝে দানবীর সেপাইরা তুলে নিল লাতিকে, দানবী একদিকে রাজাকে নজরবন্দী ক’রে রেখে নিজেই রাজত্ব চালাচ্ছিল, অন্যদিকে হীনা আর লাতিকে খতম ক’রে নিষ্কন্টক হতে চাইছিল…..তো লাতি দানবীর জালে বন্দি হয়ে চললো দানবীর বাবা দানব সম্রাটের দরবারে, কারণটা পরে বলছি….. এদিকে নিরুপায় লাতি’র চিৎকার আর কান্না পাইনের পাতায় পাতায় তড়পে উঠে বিশাল আলোড়ন তুললো…ঝড়, ভয়ানক ঝড় আর বৃষ্টি নেমে এল বাসপা উপত্যকায়….

#

 যা হয়েছিল

ছবি-১১

 

কল্পা!

আমরা রেকংপিও’তে থামিনি, যদিও কিন্নৌর কৈলাসের মুখোমুখি বসে যাওয়া ওই ছোট্ট কিন্তু আধুনিক সাবডিভিশনাল শহরটিকে ভালই লেগেছিল।আর রেকংপিও’র চৌমাথার দোকানে বসে চা আর কচৌরি, ভোলা যাবেনা! একেকটা জায়গায় এসে মনে হয় না যে আহ্‌ এখানে যদি থেকে যেতে পারতাম, রেকংপিও সেরকমই এক ইচ্ছেমোড়া ছোট্ট জনপদ, সাজানো গোছানো আবেদনভরা!কল্পা শুধু আপেল, চিলেগোজা আর দেবদারু’র, দশ হাজার ফুট উঁচুতে কল্পা আর কিন্নৌর কৈলাসের চূড়া, ‘কম্বি অফার’ যাকে বলে!

#

মিঠে রোদ সকালের হিমশীতল কল্পাকে মুছে দিচ্ছিল উষ্ণতা দিয়ে!আমরা হোটেল সংলগ্ন বাগিচায় টেবিল বিছিয়ে ব্রেকফাস্ট আর কবিতায় ডুবে আছি!

ধীমান পড়ছেঃ

এই আমাদের ঠোঁট।

ভ্রমণে কোন পাঠশালা নেই বলে

নির্জনে সেলাই দাও মানচিত্র।

আজ টেবিলে বসে আলজিভ পূর্বপুরুষের

ঋণ গুনছে।দূর থেকে আসা বিষণ্ণ টের পায়,

গাছে গাছে টাঙানো ডুরে শাড়ি রঙিন,

তুমি জানো শিলাময় ঋতু

ইনট্রাভেনাস সূঁচ পাসপোর্ট পাল্টে

উঁকি দেয় স্বপ্নে,

ভাঙাচোরা মর্গ সহপাঠিনীকে নিয়ে

শিশির ও স্বরলিপিতে শ্যামলিমা।

#

তবে এসো টোকা দিয়ে দেখি

ঘুমিয়ে পড়লো কি ওয়াড্রোবে ভাঁজ করে রাখা শীত

রিক্সায় বয়ে চলা বৃদ্ধাবাস

#

আশ্চর্য আমরা আরো উঁচুতে গিয়ে,১৪৮০০ ফুট উঁচু কিব্বেরে  এক বৃদ্ধাবাস দেখেছিলাম,আবাসিকেরা ‘ওয়াড্রোবে ভাঁজ করে রাখা শীত’ বের করে গায়ে জড়াচ্ছিল,হাত নাড়ছিল নাকি ডাকছিল আমাদের,আমরা কি সাড়া দেবো? নাকি ভুলে যাবো সবকিছুই এই “ভ্রমণে কোন পাঠশালা নেই ব’লে’’….

#

আলু-কা-পরাঠা যা আমরা খাচ্ছি রায়তা আর পনিরের প্রিপেরেশন দিয়ে,জাস্ট আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড….কিগো দাদা ভুল বললাম? সৌমিত্র হাসতে হাসতে জিগগেস করলো প্রণবদাকে, প্রণবদা বললো, ফার্স্টক্লাস…কোন কথা হবেনা! কাছে দূরের আপেল বাগিচা থেকে বয়ে আসছিল হিমিহিমি রোদ, এই রোদের ছাপ গায়ে নিতে হিমালয়েই আসতে হবে, এর একমাত্র কপিরাইট হিমালয়ের!পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কিন্নৌরকৈলাস, পাশের সেই পাথরের লম্বা পিলার বা বিখ্যাত শিবলিঙ্গ   দেখা যাচ্ছে যেখানে সূর্যাস্তের সময় রামধনুর সাতটা রঙ খেলা করে!কৈলাসের আশীর্বাদ যে সৌমিত্র’র ওপরে পড়ে গেছে তার প্রমাণ ও নিজেই দিল!ডায়ালেটেড হার্ট নিয়ে যেমন নেমে এল প্রায় ৮০০ ফুট নীচে চায়ের খোঁজে, সেরকমই আমার আর রঞ্জনের ভোকাল টনিকে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে এল, এই কাজটি ও দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে করতে পারেনি, একটুতেই হাঁফ ধরে যেত, ক্লান্ত বোধ করতো….এরপরে আমাদের ভ্রমণ চলাকালীন সৌমিত্র আর উচ্চতা নিয়ে মাথা ঘামাতো না!হাসতে হাসতেই উঠে আসতো, এমনকি ওকে আমরা বলতেও শুরু করে দিলাম, গুরু বহুদিন পরে ওঠা তো হল, নামবে তো?

#

যা হতে পারতো

#

 

আমি প্রদীপ কুমার আলাদীন, আমার ওই একটাই দোষ, সময় টময় একেবারেই  গুলিয়ে যায়, যদি ভিনীতার মত কেউ হাসিতে বা দেখাতে রেখে দেয় বেতসায়িক(ব্যবসা ব্যবসায়িক, বেতস বেতসায়িক, হুঁ হুঁ কবিসঙ্গ বলে কথা!)  ছিপছিপে ঈশারাআতর…আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, সময় ফুরোতে থাকে আমার! আখতার শিরানি কি ভাবে যেন লিখে ফেলেছে আমার কথাই!”ম্যায় আরজু-এ-জাঁ লিখুঁ ইয়া জাঁ-এ-আরজু /তু হি বতা দে নাজ সে ইমান-এ-আরজু / ইমান-ও-জান নিসার তেরি এক নিগাহ পর / তু জান-এ-আরজু হ্যায়, তু ইমান-এ-আরজু”..তো যখন খেয়াল হল দেখলাম মাই টাইম ইজ অলমোস্ট আপ….আমায় চলে যেতে হবে আমার আকা স্বপন রায়’কে ছেড়ে নেদারল্যান্ডস, ওখানে অক্টোবর থেকে আমি কোয়েন জানসেনের সঙ্গে থাকবো, আমার নতুন আকা কোয়েন টিউলিপ চাষী, গতবছর খুব একটা ভাল যায়নি ওর, এবার ওকে মালামাল করে দিতে হবে…কিন্তু তার আগে রিয়া, ঊষা, লাতির জট ছাড়াতে হবে আমায়, পিকলুকেও ভাবছি নেদারল্যান্ডস নিয়ে যাবো, ওখানে নাকি উইন্ডমিল চালিয়ে ও রিয়াকে ফিরিয়ে আনবে, লিরিক্যালি….সমুদ্র সব ফিরিয়ে দেয়,তাই না?

#

নাকো, টাবো, পিনভ্যালি, কাজা, কি-গোম্পা, কিব্বের…এ এক বৃক্ষছাড়া রঙিন পাষাণের পথ!লাতিকে নিয়ে দানবীর শান্ত্রীরা চললো কিব্বের, ওখানে দানবীর জন্মদাতা দানবসম্রাট দুরারোগ্য ব্যাধিতে মরতে বসেছে, দানবদের দেবতা দানবসম্রাটের স্বপ্নে এসে জানিয়েছে একমাত্র সাংলার কুমারী রাজকন্যার রক্তে আছে সে জীবনদায়ী ওষুধ, দানবসম্রাট বেঁচে উঠবে সেই রক্ত পান করলে!লাতিকে নিয়ে দানবীর শান্ত্রীরা নাকোয় পৌঁছল।

#

লাতি এগারোশো সালে তৈরি গোম্পার দিকে তাকিয়ে ভাবে, নাকো’র হ্রদে বিলীন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে ভাবে, নির্মেঘ আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা রাতের তারা আর আকাশকে অভিশাপ দিতে দিতে ভাবে নরিন্দর নেই, নরিন্দর’কে আর ও দেখতে পাবেনা, দানবী ওকে মেরে ফেলবে….লাতি ভাবে,মেরেই ফেলুক…ওর দুঃখে হ্রদের জলে নেমে আসে অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিনী, মৃগশিরা, স্বাতী ইত্যাদি সাতাশটি তারা, চাঁদ আলো নিভিয়ে আসে, লাতি তাদের জানায় আমায় আকাশে নিয়ে চলো, আমি লাতি, আমি রাজকুমারী, আমি জানি নরিন্দরকে ওরা মেরে ফেলেছে, ও এখন আকাশেই আছে…শাদা ছায়ার মত ওই রাস্তায় আছে ও, আমায় নিয়ে চলো তোমরা…তারার দল গান গায়..চাঁদ জলতরঙ্গ বাজায়…লাতি সেই গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে!

 

#

 

হীনা এখন রাজা!অন্য জায়গায়, সাংলা আর নাকোর মাঝের বিস্তীর্ণ এলাকায় জুড়ে হীনার সাম্রাজ্য।হীনা লাতিকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছয় পাহাড়ের ঢালে বসা থিও’তে।অকৃতদার রাজার মৃত্যুতে সেদিন ছিল ওখানকার প্রথানুযায়ী রাজা’কে বেছে নেওয়ার দিন।মহামন্ত্রী প্রাসাদের খিলান থেকে রাজকীয় টিয়াপাখি উড়িয়ে দিলেন, প্রচলিত বিশ্বাসানুযায়ি এই পাখি রাজরক্ত চিহ্নিত ক’রে সঠিক উত্তরাধিকারিকে বেছে নিতে পারে, হীনার গায়ে সেই টিয়া বসতেই রাজার খোঁজ সম্পূর্ণ হল, হী্নাও নতুন উদ্যমে শুরু করলো লাতির খোঁজ!

 

#

 

নরিন্দর প্রবল  ঝড় বৃষ্টির ভেতরেই কিভাবে যেন বিপদের গন্ধ পেয়ে ফিরে আসছিল সেদিন,লাতি তখন দানবীর শান্ত্রীদের কবলে প’ড়ে চিৎকার করছিল!নরিন্দর এবার স্থানীয় লোকজনের কাছে খবর পায় যে লাতিকে অপহরণ করে নাকো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!দানবসম্রাটের অনাঘ্রাতা রাজকুমারীর রক্ত চাই। কিন্তু লাতিতো আঘ্রাতা, লাতি আর নরিন্দরের শরীরের প্রতিটি খুশির ভাব কখনো বাসপা নদিতে কখনো বা পাহাড়ি ঝর্ণার গায়ে এখনো সাক্ষ্য দিচ্ছে! নরিন্দর দৌড়তে থাকে, ও বুঝিয়ে বলবে লাতি আঘ্রাতা, লাতির রক্তে দানবসম্রাটের ওষুধ নেই, লাতি আর ও মন আর শরীর দিয়ে ভালবেসেছে এই বাসপা উপত্যকার সবকিছু….

#

 

নরিন্দর সে সুযোগ পায়নি। হাঁফাতে হাঁফাতে ও যখন শান্ত্রীদের কাছে পৌঁছল তখন ভোররাত।ও বোঝাবার চেষ্টা করলো নানাভাবে আর শান্ত্রীদের মুখিয়া দেখলো শিকার নিজেই এসে হাজির হয়েছে!ওদের কাছে সব খবরই ছিল, দানবরানীর নির্দেশ ছিল আগে লাতিকে বন্দী করতে হবে,আর নরিন্দরকে হাতে পাওয়া মাত্র হত্যা করতে হবে!

#

 

সেই ভোরে নরিন্দর আর রইলো না!

ওর ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করে ভাসিয়ে দেওয়া হল বাসপার জলে!

রক্তের দাগে এসে পড়লো সূর্যোদয়ের রঙ, মিশে গেল!

#

 

লাতি জানতেই পারলো না!লাতি নাকো হ্রদের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভাবে নরিন্দর হয়ত আসছে, এও ভাবে নরিন্দর বেঁচে আছে তো?

 

#

 

যা হয়েছিল

#

 

কল্পার দেওদার আর চিলেগোজার ছায়াসুনিবিড়ে অথবা কিব্বের-এর ১৪৮০০ ফুট উচ্চতায় আমাদের কবিতা-ট্রেক আর প্রণবদার “নতুন কবিতা”র ওপরে তথ্যচিত্র সমানতালে এগিয়ে চলেছে!কল্পা থেকে কিছুটা নেমে এক বাঁকনেয়া রাস্তার মাঝখানে থাকা বিস্তৃত জাঙ্গলিক ঈশারায় শুরু হল কবিতাপাঠ!২০০৭ সালে বাংলা কবিতায় বিশেষভাবে তরুণ কবিদের হাত ধরে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে!এর একটা বড় দায় আমাদের, এই যে আমরা যারা এসেছি বা নাআসা প্রণব পাল,অলোক বিশ্বাস সহ যে ক’জন এক অচেনা পথে পা রেখেছিলাম একদিন, আজ ফিরে দেখলে সেই পথের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়!কল্পায় তাই পড়া হল তরুণদের কবিত।অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ চক্রবর্তী,শমীক ষণ্ণীগ্রহী, শৌভিক দত্ত, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল ঘোষ, অমিতাভ প্রহরাজ, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, অরূপরতন ঘোষ, দেবাঞ্জন দাশ, অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সংঘমিত্রা হালদার, অনিমিখ পাত্র সহ আরো অনেক তরুণ কবির কবিতা আমরা পাঠ করলাম, এত ভাল লাগছিল কবিতার এমন আবহাওয়া, সময় কেটে যাচ্ছিল হু হু করে। কিব্বেরে তো বোধহয় একটা রেকর্ডই করে ফেললাম আমরা! এ রকম উচ্চতায় কবিতার প্রায় দু’ঘন্টার সেশন কি আগে হয়েছে?কোন হল টল নয়, এক রাস্তার বাঁকে টিলার ওপরে বসেছিল কবিতা পাঠের আসর!এক বছর আগে কোমায় থাকা বারীনদাও পুরোপুরি অংশ নিচ্ছে!প্রণবদা ননস্টপ ক্যমেরা হাতে নিজের কাজ করে যাচ্ছে আর দূরে তিব্বতের একটি বরফে ঢাকা চূড়া উঁকি মেরে দেখছে এসব…

 

#

 

‘নাকো’ প্রায় তেরো হাজার ফুট ওপরে থাকা লেকবিহারী ছোট্ট জনপদ আর ‘টাবো’ প্রায় একই উচ্চতায় থাকা একটি বৌদ্ধ মঠের এক্সটেনশন। টাবোয় রয়েছে প্রায় ৯০০ বছর আগেকার গুহাচিত্র যা মাটির নীচে নেমে দেখতে হয়! এরকম একটা জনবিরল দুর্গম জায়গায় অত বছর আগে বৌদ্ধ শিল্পীরা এই অবাক করা শিল্পকাজ হয়ত সাধনা মার্গের উপায় হিসেবেই করেছিল, আমরা শুধু চুপচাপ দেখে গেলাম। সব লোভ, প্রতিষ্ঠা, প্রচারের বাইরে থেকেই এমন কালজয়ী কাজ করা সম্ভব! আর এভারেজ চোদ্দহাজার ফুট ওপরে থাকা পিনভ্যালির ঝোড়ো নিষ্করুণ হাওয়ার দাপটে কখন যা আমার মোবাইল ফোনটি বিসর্জিত হল জানিনা,  পিন নদির কোন নীলাভ স্রোতের ছায়ায় সে হয়ত পিনিং করে যাচ্ছে এখনো, আমি পাপীতাপী লোক, স্বর্গের দরজায় নোকিয়াধ্বনি রেখে চলে এলাম!

 

#

 

 

যা হতে পারতো

ছবি-১২

#

 

আমি আলাদীনের প্রদীপস্য চেহারাটি বদলে আমার ‘আকা’ স্বপন রায়ের সেবা করে চলেছি! কিন্তু এখন আমার নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে আমি কি সেবার অজুহাতে স্বপন রায়’কে টুকরো টুকরো ক’রে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিলাম? স্বপনকে জিগগেস করায় বললো, আমার তো কোথাও কোন চিহ্ণ নেই, তো নিশ্চিহ্ন আমায় নিয়ে তুমি যা ইচ্ছে করো, ‘ইচ্ছেগদ্য’ নামের একটা ধারাও শুরু করে দিতে পারো, যেখানে আমি বা আমরা কেউ নই, আবার আমাদের ছাড়া তুমি এক পাও এগোতে পারবে না!আমি কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম। তবে ‘ইচ্ছেগদ্য’ ব্যাপারটা মাথায় রয়ে গেল, আরে আমি তো আদতে ম্যাজিশিয়ান, দেখাই যাকনা ‘কি কি হতে পারতো’ থেকে ‘কি কি হয়ে গেল’ এই সম্ভাবনার খেলায় আমি গোল করতে পারি কিনা!

 

#

 

হীনা লাতিকে উদ্ধার করেছিল কিব্বের অবধি ধাওয়া ক’রে!ফিরিয়ে এনেছিল বোনকে!আর চরম শাস্তি দিয়েছিল সেই দানবীকে যদিও অসুস্থ মহারাজকে বেশিদিন বাঁচাতে পারেনি!লাতি অপেক্ষায় থেকেছে নরিন্দরের,ও জেনে গিয়েছিল নরিন্দর ওকে খুঁজতে বেরিয়েছে, নরিন্দর আসবেই…. একদিন না একদিন আবার দেখা হবে বাসপা নদির ধারে…

 

#

লাতি জানতো!

#

পিকলু রিয়াকে দেখতে পেল ‘কী গোম্পা’র দেওয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায়, রিয়া ওকে দেখে ব্যঙ্গের হাসি হাসল না! পিকলু আরো কাছে গেল, রিয়া কাঁদছে!

-তুমি কাঁদছো?

-কেন আমি মানুষ নই ব’লে কাঁদতেও পারবো না!

-কান্না তোমায় মানায় না…দেখো আমি কতটা অন্যায় করেছি আমি জানিনা, শধু এটুকু জানি যে, কোন কিছুই আমার হাতে ছিলনা, আমি প্রফেশনাল নই, আমি অনিরুদ্ধ, আমি নরিন্দর, আমিই পিকলু, কিন্তু আমি প্রফেশনাল নই, আমি কারো অনুভুতিকে কখনো খুন করিনি, সময় এটা করিয়ে নিয়েছে….আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি রিয়া…আমি জানিনা তুমি কোন পাহাড়ের কোন কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছিলে….আই কুড নট রিচ ইউ…..আর দেখো আজ তুমি আমার সাম্নে অথচ আমি তোমায় ছুঁতে পারছি না! অনেক নীচে হাল্কা নীল রঙের স্পিতি নদির বিস্তারে এসে পড়েছে তুষারমাখা পাহাড়ের ছায়া, পাশেই লম্বা কালো ফিতের চেহারা নিয়ে পড়ে আছে কিব্বের যাওয়ার হাইওয়ে। হাড়কাঁপানো হাওয়ায় কেঁপে উঠছি আমি। রিয়ার শুধু জিন্স আর টপ, ওর শরীর ঠাণ্ডা আর গরমের সীমারেখা পেরিয়ে গেছে! আমি মুগ্ধ প্রেমিক ওর কোন মতে বলতে পারলাম, রিয়া আমার সঙ্গে নেদারল্যান্ড যাবে? আমরা নতুন জীবন শুরু করবো আবার, উইন্ডমিলের হাওয়ায় সমুদ্রের ফেরৎ আসা টানে আমি আর তুমি আবার শুরু করবো বেঁচে থাকা…

রিয়া হাল্কা হেসে বললো, তার আগে তোমায় যে আমার কাছে আসতে হবে পিকলুদা, পারবে আসতে?

#

 

রিয়া আর পিকলু ‘কী গোম্পা’ ছেড়ে চলে যাচ্ছে…ভেতর থেকে ভেসে আসছে ‘ওম মনিপদ্মে হুম’-এর ধ্বনিমন্ত্র, ধীরে ধীরে আলোআঁধারের খেলায় মিশে যাচ্ছে ওরা…

#

আমরা মানালিতে পৌঁছলাম! সকাল সকাল কাজা থেকে বেরিয়ে লোসার হয়ে ১৫০০০ ফুটের কুনজুম পাসে কিছুক্ষণ তারপর প্রায় ৮০ কি.মি’র বোল্ডার জোন পেরিয়ে গ্রামফু হয়ে রোতাংপাস!সেখানেও কিছুটা সময়! তারপর মানালি! এখানে দু’দিন থাকা, ঘুরে বেড়ানো, কবিতার আড্ডা…..তারপর যে যার ডেরায়…..এর মাঝে আলাদীনের প্রদীপকুমার আমায় বিপাশা নদির ধারে গোছা কাগজের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বললো, মেরে আকা, এর ভেতরে যা আছে তার কতটা কালের আর কতটা মহাকালের আমি জানিনা, তবে আমি কাউকে অমর করতে পারলাম না….পারলে কবিতা টবিতা দিয়ে অমর করে দিও…টাচউড সরি টাচবিপাশা, আমি ঊষা অনিরুদ্ধ, লাতি নরিন্দর বা রিয়া আর পিকলুর সঙ্গে কোন ম্যাজিক করতে যাইনি…ওরা স্রোতে ভেসে এসেছে…চলে গেছে…

 

#

 

যা হয়েছিল

#

 

সকালের রোদ ঠাণ্ডাছুরির চেরাইচ্ছেয় ফালাফালা ক’রে দিচ্ছে মানালির হিড়িম্বা মন্দিরের সংলগ্ন পাইনের জঙ্গলকে…ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো আমাদের প্রণবদা ডাক দিয়ে বললো, তোরা এদিকে আয়, পাশাপাশি দাঁড়া…একটা গ্রুপফটো হয়ে যাক!

 

#

আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালাম, আমি, বারীনদা, ধীমান, রঞ্জন, সৌমিত্র আর ক্যামেরায় টাইমার সেট ক’রে প্রণবদা! শব্দ হল ক্লিক, ছবি হয়ে গেল ‘গ্রুপ-সেপ্টেম্বর’!

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ