গ্রুপ সেপ্টেম্বর (৪র্থ কলি)

স্বপন রায়
ধারামুক্ত কবিতা
Bengali
গ্রুপ সেপ্টেম্বর (৪র্থ কলি)

যা হয়েছিল

“চশমা ভিজিয়ে দিলো এবারের বেড়াতে আসা
জল বিজলের মধ্যে বাছাই করা
মরণ ইকোতে গোছানো
রক্তচন্দন # গোঠের মালা# মতি সূঁচ আর পানির ব্যাগ

তুমি সিড়ি খুঁজছো কেন

পর্দাফাই দিয়ে এখনো আসছে বিজনের আলো
বিছানার সঙ্গে মিশে কোথায় চলেছে সে পেন তুলে

সমান্তরাল দৃশ্যগুলো আমাদের আড়াল দিয়ে যাচ্ছে
আধখানা রাত # তাইরে না
রূপ অরূপ হচ্ছে দেখতে পাই আকারে আকারে

টেবিলে চাপা রোশন
হিম পোকার থ প্রেসকৃপশনের ওপর
কবিতারা অঙ্কুর ছেড়েছে বড় হয়ে বেড়াতে যাবার
একলা মাদল # এলোমেলো ধিম
দূরে কোথাও দূরের দূষণ্ণতায়

শব্দে,ওই শব্দে লাগে নিঃশব্দ সেতো সহজ নয়! এই যে পাহাড়লিপ্ত পাইনের শিবিরে আমরা এক টেন্টহীনা পশমিনি আবহাওয়ায় বসে আছি, এই বিরতিক্রিয়ায় বারীনদা কবিতা পড়লো,বাতাসে কি অবিসম্বাদি নিরালা ছিল, আর আর আর কবিতালিপিত দূরে কোথাও দূরের দূষণ্ণতা… নতুন কবিতা নিয়ে যে বিরোধীতা আছে তার একটা দিক এরকম যে বড্ড বাড়াবাড়ি করেছে এরা, হামাগুড়ি অব্দি ঠিক কিন্তু হাঁটতে যাওয়া কেন? বাংলা বাজারে “নিরবধি শ্রম/হাতে পমেটম” বা কিন্তু’র সঙ্গে ‘অচ্ছুৎ’ মিলিয়ে একটা বিপ্লব তো সত্তর দশকের কবিদের একটি পরাক্রান্ত অংশ করেই ফেলেছে আর বাকি যা ছিল নব্বইয়ের গানে এসে সিদ্ধি পেয়েছে, ”নতুন কবিতা”র এই স্পর্ধা কেন তবে?

সাংলায় বিদ্যাকরণ নেগী’র বাড়ি’র টেরাসে চলছে আড্ডা! নিচে বাসপা বইছে, খুব আদর দিচ্ছে তাকে স্তোকনম্রা আপেল গাছেরা! অনেকদূরে বরফ বাসছে পাহাড়কে, স্পর্ধিত নয় কোন কিছুই, তবে বজ্রে বীণা বাজানো, সেকি সহজ কাজ! কে এই বিদ্যাকরণ? ২০০৭ সালের কথা এসব, বিদ্যাকরণ নেগী দু’বার এভারেস্ট সামিট করেছে, ৮০০০ মিটারের ওপরে থাকা অনেক চূড়াকেই আপন করে নিয়েছে, সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে ভারতের মিলিটারি বেস বানাবার কাজে রুট ওপেন ক’রে ক্যাম্প বসানোয় অন্যান্য ফৌজীদের সঙ্গে সফল হয়েছে… আর এই হিমালয়ান পারসোনালিটি বারেবারে অবনত হচ্ছে আমাদের কাছে, তার মেহমান-নওয়াজিতে বিব্রত হ’তে হ’তে মিশে যাছিলাম আমি, আমরা!আরে কে আমরা? কিসের স্পর্ধা আমাদের? তুমি পদ্য লেখো, জানো তাই লেখো! আমিও বাপ দাদাদের কাছে পদ্য জেনেছি, কিন্তু পরে আর লিখিনি! তুমি ঘরের কোন আর মনের কোনে ঘোরাফেরা করবে ঠিক করেছো, আমি এট্টু ঘরের বাইরে , মনের বাইরে গিয়ে নতুন আশ্রয় চেয়েছি, তো কি এমন করলাম আমরা যে পা পড়বে না মাটিতে? যার পড়ার কথা ছিল না, সে অতিথিকে নারায়ণ সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসিমুখে! কবিদের আড্ডায় বসে শুনছে এক অজানা ভাষার উচ্চারণ আর বাড়িয়ে দিচ্ছে গৃহসুধা মাখা আপেলের আজব মদিরা! কোন বিরক্তি নেই, কোন অভিযোগ নেই, শুধু প্রেম সে থাকার অবিচল হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছে আমাদের, কম তো নই আমরা!বিদ্যাকরণের জিগরি দোস্ত প্রণব দে, আমি, রঞ্জন, ধীমান, সৌমিত্র আর বারীনদা!

কবিতা ভেসে যায়, যদি না ভাসে তো ফেঁসেই যায়! কবিতা নাম্নী এই চঞ্চলাকে আটকে না রেখে ছেড়ে দিয়েছি! এর ফলে কি হয়েছে জানিনা! কেউ বলে, নেচার হয়েছে! কারো মতে, গিমিক! কেউ কেউ শব্দের খেলা ইত্যাদি! কিন্তু কথা তো আছেই এর ভেতরে, কবিতা কিভাবে দৃশ্য হয়, ফ্রেমে আটকে না ফ্রেমের বাইরে? কবি তো পেইন্টার নয়, তার ফ্রেম কিসের, কেন সসীম হবে সে,অসীম কেন নয়? এই আমাদের দুষ্টুমি,কবি চায় তো বাঁধা পড়ুক, আবার চাইলে বন্ধনহীন গ্রন্থিতে কায়াক চালাক বা নিদেনপক্ষে বাপসা নদিকে বলুক, শব্দ নাও ধ্বনি দাও, আরো আরো আরো….এখন যেমন উঠে আসছে এই কবিতাজেতা টেরাসে একের পর এক সমগ্রছোঁয়া তিতিরমিতির আলোরা…. আর জমছে কবিতা!

যা হতে পারতো

মনে হল রাতের পাকে পাকে রহস্য না রহ-হাস্য একটু মেপে দেখা যাক! সাংলায় রাত মাপতে বেরোলাম, সঙ্গে সেই আলাদীনের প্রদীপ কুমার! বললো, মেরে আকা, কোথায় চললে?

-রাত দেখবো, যাবে?

-রাত দেখে কি হবে? রাত-কি-রানী দেখা যাবে?

-ফুলেইছ শুরু কাল থেকে, রানী, রাজকুমারী সব দেখা যাবে!

-ফুলেইছটা কি?

-ফুলের উৎসব

– আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম কাল তোমরা প্রণব দা’র সঙ্গে তো ফুলেইছের ডকুমেন্টারি তুলবে, আমি তো বস বোর হয়ে যাবো!

-কেন বোর হবে কেন? বিদ্যাকরণ কি বললো শুনলে না, কাল শুধু ফুলের উৎসবই নয়, প্রেমেরও উৎসব, তুমি কি বিবাহিত?

-আমি প্রদীপ, বিয়ে হ’লে নিভে যাবো না?

-বিয়ে নেভায়? জ্বালায় না?

– দুটোই করে… যাইহোক, আমি তো দৈত্য, সাইজের দৈত্যানি পাবো কোথায়?

-সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার, তুমি তো এখন বেশ ইয়ে টাইপের দেখতে হয়েছ… সালমন টাইপের আর কি.. কাল ব্রহ্মকমল নিয়ে এগিয়ে যাও…

-মাইগড, ব্রহ্মকমল কোথায় পাবো?

আমি সেই হিমজটিল রাতের টানে চলতে চলতে ওকে বললাম, ওই ফুল এই সাড়ে ন’হাজার ফুটে পাবে না! যেতে হবে আরো উপরে,১৪০০০ফুট প্লাস…ব্রহ্মকমল বছরে একবার ফোটে, শুধু রাতেই কিন্তু… রাত কি রানী… যাও দম হ্যায় তো নিয়ে এসো, স্থানীয় দেবতাকে অর্ঘ দিয়ে, এক আধটা ফুল তুলে দাও কিন্নরীদের হাতে…

প্রদীপ ওরফে আলাদীনের দৈত্য একটু সময় না নিয়েই বললো, আরে এতো আমার কাছে ওয়াটারি রাইস… জলভাত!১৪০০০ফুট না কি যেন?…. চললাম আমি …তবে কিন্নরীরা পাত্তা দেবে তো?

প্রদীপ হাওয়া! আর আমি একাই সাংলার আপস অ্যান্ড ডাউনে হিমের ঝাঁক সইতে সইতে বাসপার তীর ধরে এগোতে লাগলাম! জলের স্রোতে তৈরি হচ্ছিল ছোট ছোট স্ফটিক, কারণ পাহাড় থেকে নেমে আসা অতিকায় বোল্ডারগুলো নদিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে সেই কবে থেকে! আজ এখানেই ফটোশুট করা হল ধীমানের, ওর বইয়ের জন্য! তখন সদ্য বিকেল তুলকালাম রঙ দিচ্ছে কাছে দূরের পাহাড়গুলোয়, আর একটা রামধনু ধীমানকে গ্রিট করার জন্য এঁকে ফেলেছে নিজেকেই! শাদা ইম্প্রেশনের রেওয়াজি ইজম বুলিয়ে দিচ্ছে দূর পাহাড়ের নেমে আসা জলস্রোতের দাগ, সিঁথিই যেন পাহাড়ের! প্রণবদা ননস্টপ ছবি নিচ্ছে,সৌমিত্র, রঞ্জন আর আমি বসে আছি বোল্ডারের ওপর! দেখছি বাঁক নেয়ার সময় কোন লচক রেখে যায় কিনা নদির কমরিয়া…. কোমর আরকি!

তবে এখন রাত ঘনিয়ে ওঠার সময়, কেউ কি জিগগেস করবে, হে রাত,”..হীনারে তুলনাহীনারে” ক’রে ডেকে ওঠা রাত্রি আর ঠিক কতদূরে? বেশ অদমনেয়া রাত এখন, লম্বা হিমটানা, আমি কম্প্রমান তো হবই, সেটা বড় কথা নয়, এই যে অনেক ছোট ছোট শব্দ, ফিসফিসানি আমার চারদিকে সে সবই কি চলে যাচ্ছে নিশ্বাস, দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়ে …. কবিতায়?

আপ হমারে ভলে হি কুছ নহি লাগতে
পর আপকে বিনা বিলকুল অধুরে হ্যায় হম!

ঠিক শুনলাম তো? মাথার ওপরে ঈষতিয়ানার চাঁদ, মুনস্ট্রাক হলে এ রকম আকাশবানী হয় নাকি? একটু শিরশির করে, একটু বেমিশাল ভয়ও রোমন্থিত কাঁটায় শিউরে ওঠে, সাংলার প্রতিটি বাঁকে প্রেত আর অশুভ আত্মার কাহিনি শুয়ে আছে, সেরকম কিছু জেগে উঠলো নাকি? চাঁদ থেকে চোখ নামিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই দেখি ঘাগরা চোলিতে নিমজ্জিত একটি চাঁদকাটা নারীশরীর আমার সাম্নের বোল্ডারে দাঁড়িয়ে! নিশ্চয় রিয়া, কি ঝামেলায় পড়লাম রে বাবা! চিৎকার করে বললাম, বিলিভ মি রিয়া আমি তোমায় খুন করিনি,আমি তোমায় খুন করতে পারিনা…. হোয়াই ইউ আর ডুইং দিস টু মি?

-ম্যায় রিয়া নহি, লাতি হুঁ

লাথি! বলে কি! শালা লাথাবে নাকি? কোনরকমে দাঁড়িয়ে বললাম, সি রিয়া দিস ইস টু মাচ… কখনো ঊষা,কখনো লাথি.. মাইরি এসব কি হচ্ছে?
রিন রিন হাসলো পাথরে আধারিতা মেয়েটি!

আমি রেগেই বললাম, হাসছো কেন… এ ভাবে তুমি আমায় ভয় দেখাতে পারো না… আমি বাঁচতে চাই… মরিতে চাহিনা আমি.. ইয়ে কি যেন… দুত্তোর!
হাসি এবার থামলো, মেয়েটি বললো, লাথি নহি,ম্যায় লাতি হুঁ… লাতি সারজং…মুঝে ভুল গয়ে নরিন্দর!

সেরেছে! নরিন্দরটা আবার কে?

রাতের পরতে জোলো স্ফটিক মিলেমিশে পুরো বাসপা নদিকেই জলছবি করে তুলেছে, মেয়েটি যেই হোক, তাকে বলা দরকার আমি নরিন্দর নই.. আমি পিকলু.. পাতি বাঙালি… কুত্তার পেট, ঘি খাই না… নরিন্দর এই পাঞ্জাবি নামটা আমার হতে পারেনা… চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, ম্যায় নরিন্দর নহি হুঁ..

-ঝুট না বোলো নরিন্দর!

আছা স্বামী বিবেকানন্দ’র নামও ছিল নরেন্দ্র…. তিনি তো হিমালয়ে চষে বেড়াতেন… এ তাঁর কোন হিমাচলি শিষ্যার অতৃপ্ত আত্মা নয় তো? মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার, মদ তো আমি খাইনি… এ শালা কি হচ্ছে আমার সঙ্গে…. আর আমি এ সব কি ভাবছি… অফ অল থিংস বিবেকানন্দ!… কে জানে হতেও পারে.. অমন তেজস্বী চেহারা দেখে হয়তো এই মহিলা ওঁকে ভালবেসে ফেলেছিল, স্বামীজী যেমন অনেক গুণমুগ্ধাকে বুঝিয়ে কিন্তু আমায় কোন এঙ্গেল থেকে বিবেকানন্দ মনে হতে পারে?….. শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকবার যথাসাধ্য চেঁচিয়ে ওই রিয়া বা লাতিকে বললাম, আমি মতলব ম্যায় স্বামী বিবেকানন্দজী নহি হুঁ… উনকা নিক নেম থা নরেন্দ্র… উনকা আশীর্বাদ মিল যায়েগা আপকো…. আপ চলে যাইয়ে…

-উই মা! আপ হি তো মেরে স্বামী হো! আপ হো মেরে প্রিয়তম…. কি লজ্জা ওই কথার বিভঙ্গে… শালা আমি কোথায় যাবো…. আর এ সব আমার সঙ্গেই বা কেন, রঞ্জন, কবি রঞ্জন মৈত্র বিয়ে করেনি, এই রিয়া, ঊষা, লাতি্রা ওকে ধরছে না কেন?

পাশের বোল্ডারে হাসির শব্দ হল, তাকিয়ে দেখি রিয়া! রিয়া বললো, পিকলু দা তুমি হলে জন্ম জন্মান্তরের ফেরেববাজ… ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধ হয়ে, লাতির সঙ্গে নরিন্দর হয়ে, আমার সঙ্গে আমার পিকলু দা হয়ে ফেরেববাজি করে গিয়েছো… রঞ্জনদা, ধীমানদা, সৌমিত্রদা, প্রণবদা…এঁরা সব পবিত্র মানুষ… এঁদের আত্মা পবিত্রতম আত্মা.. এদের আমি জানিয়ে দেবো, তুমি কতবড় ভন্ড! আমি ঠিক একদিন সবাইকে জানিয়ে দেবো…. আমি রিভেঞ্জ নেবোই পিকলু দা!

রিয়া কি কাঁদছে?

এই কিন্নৌরে এসে অব্দি কিছু একটা হচ্ছে! কবিতা, নতুন কবিতা’র ডকুমেন্টারি আর এই রিয়াপ্রসঙ্গে বারবার কেলাসিত সময়ে চলে যাওয়া, যেন এক প্রতিভ্রমণ ঘটে যাচ্ছে, সাজানো সময় তার প্রতিসময়ের বিস্থাপনায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়, এক অসম্পাদিত সময়গ্রন্থিতে বসে আছি আর একের পর এক কেস খেয়ে যাচ্ছি! এবার তো ‘পত্থর কে সনমে’র কেস! এদিকে রিয়া, ওদিকে লাতি! বাপসা নদির ওপরে আমি পাথরে ফুটতে দেখছি প্রাণ! আর সে কবেকার, কত পুরনো সব ময়তামাখা প্রাণ, যারা এসে বলছে, প্রেম আর নাপ্রেমের মধ্যে পড়ে আছে এক ছায়াবী সড়ক, আমি তার সংযুক্তিতে পড়ে গেছি, কোথাও কোন সিগন্যাল নেই, সব স্থির, পারাপার জমাট বেঁধে গেছে, শুধু আমি, রিয়া আর ওই লাতি! রিয়া’কে আমি বলেই উঠতে পারলাম না, রিংচেঙপং-এ আমি এক শারীরিক বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম, আর কিছু নয়, ওগো আর কিছুই তো নয়… রিয়া’কে কি এখন বলবো ওয়াসিম বরেলভি’র লব্জে যে, ”সারি দুনিয়া কে নজর মে হ্যায় মেরে এহদে ওয়াফা/ এক তেরে কহনে সে ক্যা ম্যায় বেওয়াফা হো জাউঙ্গা..” বললাম না, উর্দু শুনলে যদি আবার পারস্যের শিরিনের সঙ্গে লটকে দেয়… ফরহাদ অবশ্য বেওয়াফা ছিল না, কিন্তু রিয়া মনে হচ্ছে ঘোরতর পুরুষ বিদ্বেষি হয়ে গেছে, তো রিস্ক না নেওয়াই ভাল…

-চলিয়ে জি!

লাতি আমার পাথরে, ব্রীড়াচমক একেবারে! ওর শরীরে বুনো কিন্তু ভ্রাম্যমান হিমের গন্ধ, চোখে বাসপাবাহিতা অঞ্জন, আর অসম্ভব সম্পন্না এক তূণকে ওঠা শরীর, আমি কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছি!

-প্রিয়তম!

কিছু আর বলতেই পারছি না! হাসি আনতে গিয়ে মুখেরই হাঁপ ধরে গেল, ব্যাদিত হওয়ার আগেই আটকে যাচ্ছে গালের মাংসপেশি, গালের খাল খিঁচে যাচ্ছে যখন লাতি আমায় বললো, নরিন্দর ম্যায় রাজকুমারী লাতি হুঁ, মেরে ভাই হীনা ডান্দব অব রাজা হ্যায় কিন্নৌর কা, চলিয়ে সাজন আব কোই প্রেতনী হমে রোক নহি পায়েগা!

-এই লাথি.. সরি লাতি আমি পরিষ্কার ক’রে বোলতা হ্যায়, মেরা নাম পিকলু হ্যায়… আউর ইয়ে একুশ শতাব্দি হ্যায়.. এক্কিশ ভি সদি…
লাতি হেসে গড়িয়ে পড়লো!বললো, আঙ্গুরি পিয়ে হো ক্যা?

আঙ্গুরি, স্থানীয় মদ! আপেল, আঙুর আর এপ্রিকট ফারমেন্ট করে বানানো হয়! প্রায় প্রতিটি কিন্নৌরী ঘরেই রয়েছে ব্রিইউং ইউনিট! বানাও, পান করো, আনন্দ করো এই ঘরেলু আনন্দের হেরিটেজ এদের, আমরা আর কি ভাবে ছুঁতে পারবো এসব, আমাদের নিজস্ব মদ নেই, নাচ নেই, চেহারা নেই!
লাতি আমায় ছুঁলো এবার, আমি চমকে উঠে পড়েই যাচ্ছিলাম জলে, লাতি ধরে ফেললো! পাহাড়ি মেয়ের অনির্বচনীয় হাত…

কিন্নৌর জেলায় এখন তিনটে প্রশাসনিক অঞ্চল রয়েছে। পুহ, কল্পা আর নিচার! রয়েছে পাঁচটি তেহসিল! এখানকার ভাষাতেও এলাকাভিত্তিক বিভিন্নতা আর পারস্পরিক মিশ্রণের ছোঁয়া! সাধারণভাবে পুরো কল্পা জুড়ে চলতে থাকা ভাষাগুলো এরকমঃ জানশাং, কিন্নৌরী ভোটি, কিন্নৌরী ছিটকুলি, কিন্নৌরী পাহাড়ি, কিন্নৌরী লোহারি, শামচো, সুনাম, তুকপা!লাতি আমার সঙ্গে কিন্নৌরী ছিটকুলি’তে কথা বলছে আর আমি এখন হঠাৎই সব বুঝতে পারছি! লাতি’র হাত আমায় জলে পড়তে দেয়নি, লাতি’র শরীর জুড়ে ডোহরু ছড়ানো, আড়ালে থাকা চোলির লম্বা হাত, তাতে ময়ূরপঙ্খি রং, ডোহরু’র ওপরে নানা কারুকাজ, আহা! কথা আর রূপো মেশানো চাঁদহানা রাত লাতি’র শরীর ছুঁয়ে শর্ম আর হায়ায় পুলকিত যামিনী হয়ে যাচ্ছে, আর আমি পরে আছি পশমের চমন কুর্তি, শাদা চুড়িদার! হাতে, ও মাই গড, বাঁশি!এটা যাতা, আমি বাঁশি নিয়ে কি করবো, আমি লেকটাউনের পিকলু, আমার তো ভালমতো একটা ‘ফুঃ’ও নেই.. আচ্ছা ফুঃ না ফু… এ মাইরি বাংলা ভাষাটাও গুলিয়ে যাচ্ছে… আমি অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি ফুঃ ফু হয়ে যায়, ফুরফুরে হয়না!
লাতি বললো, বজাও না নরিন্দর, ইয়াদ হ্যায় ও পহলা দিন যব হম আউর তুম মিলে থে? ম্যায় জঙ্গলো মে ভটক রহি থি.. হীনা কো ঢুঁড রহি থি ম্যায়..

কিন্নৌর নাকি মগধ সাম্রাজ্য এবং তারপরে মৌর্যদের অধীনে ছিল, তখন কারা ছিল এখানকার বাসিন্দা, আমি পিকলু ফ্রম লেক টাউন কি ছিলাম তখন? কিরাত, কম্বোজ, পানাসিকা, ভহ্লিকা?তাহলে আমার গায়ে চমন কুর্তি আর চুড়িদার কেন?যদি কিরাত হই, আমার হাতে ধনুক, পিঠে তীর থাকবে, আমি শিকার করবো অনায়াসে, বনমোরগের ঝলসানো মাংস খাবো, তারপর এক পাথুরে চাতালে, ঝর্ণার শব্দে মিশিয়ে দেবো আমার গর্জন আর লাতির শীৎকার… নাহ, আমার হাতের বাঁশি আর পোষাকের আদল বলে দিচ্ছে আমি আরো পরের কোন এক সময়ে ভালবেসেছিলাম এই লাতিকে! ধীরে ধীরে মনে পড়লো, কিন্নৌরকে সাতটি তহসিলে ভাগ করে যখন সাতকুন্ড নাম দেয়া হল, আমি কাঠের গায়ে খোদাই-এর কাজ করতে গিয়েছিলাম কামরু দুর্গের কাছে এক নাগ মন্দিরে। সাংলা এখান থেকে কাছেই, গভীর গভীরতম জঙ্গলের সময় তখন, তো দিনের কাজ শেষ ক’রে আমি আমার নিজের বানানো বাঁশিতে সুর তুলতাম বাসপা নদির পাথুরে চাতালে বসে। একদিন এ ভাবেই লাতি এসেছিল, আমায় ছুঁয়েছিল নিসঙ্কোচে,কারণ লাতি এক পাহাড়ি তরুণী, অপাপবিদ্ধা! সে জানতো না পুরুষের এ সব ছোঁয়ায় কি কি হতে পারে! আমার সামান্য তরঙ্গ উঠেছিল, বিদ্যুৎতরঙ্গ! আমি চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম লাতি কাঁদছে… লাতি ছিল সেরকমই একজন যে এলে চরাচর স্তব্ধ হয়ে যেতো, আমিও হলাম!

হীনা আর লাতি, ভাইবোন!

রাজা আর রানীদের সময় তখন,কিন্নৌর ছোট ছোট রাজার দখলে চলে গেছে, অনেক রাজা, অনেক শত্রু, আর বেশ কিছু দানব, দানবী।দানব কি তারাই, যারা শত্রু পক্ষের হয়ে কাজ হাসিল করতো? কাজ মানে ক্ষমতা দখল!ছলে, বলে, কৌশলে রাজত্ত্বে সিঁধ কাটা, রাজাকে কুক্ষিগত করা।

লাতি আমায় এ সব বলেনি, আমি জানতাম।

শুধু জানতাম না একটা রূপকথা আমার জীবনে জড়িয়ে যাবে, বাঁশির দিব্যি, জানতাম না! তো হীনা আর লাতি’র মা, মহারানী অসুস্থ হয়ে পড়লো। মহারাজের মন খারাপ। তো, মন খারাপ হ’লে রাজারা শিকারে যায়। শিকার আর ঘন জঙ্গল, ঘন জঙ্গল আর তীব্র মদের গন্ধ, রাজা’র মনে হয় কতদিন কোন নারী শরীরে যাওয়া হয়নি। রাজা এক লুকিয়ে থাকা ঝর্নাকে বলে, ঝর্ণা জল খেতে আসা চিতাকে বলে দেয়, সাবধান রাজা মেয়ে পায়নি, রাজা তোকে চাইছে এবার, তোর রক্ত! চিতা দ্রুতি চিরে দৌড়তে থাকে। সেকি দৌড়! চীর, পাইন, আপেল, ওক অবাক! জিগগেস করে, কি হল? চিতা চিরতে চিরতে বলে, রাজার মেয়ে চাই, মেয়ে না পেলে আমাকে চাই….এই কথা ছড়িয়ে পড়ে! শুনতে পায় এক অতিরিক্ত সুন্দরী।তার সব আছে। ফুল, ফল, উপত্যকা, লুকনো ঝর্ণা, চেরা সিঁথির পাশে তৃণ তৃণা, ওকে কাঠের খিলান, পাইনের ঈশারা… সে দানবী!

রাজা পেয়ে যায় তার মন খারাপের ওষুধ, দানবী বাঁচিয়ে দেয় বেশ কিছু চিতার জীবন, রাজা দানবীকে দেখে, দানবী রাজাকে!

হীনা আর লাতি মায়ের কাছে বসে থাকে, গবাক্ষ একঘেয়ে মনে হয়। মা কাঁদে, রাত বড় হয়। সারারাত কথা হয় রাজা আর দানবীর, শুধু কথা নয়, শব্দ সৃষ্টি হয়, জোর বাড়ে শব্দের, শারিরীক জোরের কাছে হার মা্নার আগে রতি-আক্রান্ত রাজাকে দানবী বলে, নেওয়ার আগে বলো, কি দেবে?রাজা স্থাপিত হতে হতে বলে, সব! পথের কাঁটা হীনা আর লাতির জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে দেয় দানবী। রাজবৈদ্য’কে ঘুষ দিয়ে কিনে নেয়। রাজবৈদ্য রাজাকে জানায়, মহারানী’কে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে একটিমাত্র উপায় রয়েছে…

রাজা ভাবে, শিকার কি শেষ হয়না? মহারানীর অবস্থা খারাপ হয়েই চলেছে, দানবী হয়ে উঠছে অফুরন্ত আধার, ভাগ্যিস তখন কার্ড ছিল না, একেবারে জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে যেত…. রাজা ভাবতে ভাবতে দানবীর কাছে যায়… রাজাই আবার স্খলিত শরীর নিয়ে বৈদ্য’র কাছে যায়… নিদান একটাই, হীনা আর লাতি’র তাজা কলিজাই বাঁচাতে পারে মহারানীকে… পুত্র,কন্যা’র কলিজাই একমাত্র অষুধ…. রাজা ভাবে, রাজা ভাবতে ভাবতে ঠ্যাং তুলে দেয় দানবীর লা-এ, লা মানে পাস… কোমরে আর কি… তারপর নির্দেশ দেয় রাজা, হীনা আর লাতি’কে হত্যা ক’রে তাদের কলিজা রানীকে খাওয়ানো হোক…. দানবী এ কথা শুনে গান গায়… কি গান? এরকমই কোন গান হয়তো… আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই.. কলিজা, তুমি তাই গো… অন্তরায় গিয়ে কলিজাটা ও রাজা হয়ে যাবে, শেষে আবার কলিজা…রবি ঠাকুর তখনো কয়েক শতাব্দী দূরে, দূরদর্শী কবির গান নিয়ে একটু ফরোয়ার্ড ট্রেডিং তো করা যেতেই পারে….

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ