গয়নার বাক্স

অনসূয়া যূথিকা
গল্প
Bengali
গয়নার বাক্স

বিয়ানীবাজার সদরের জমজমাট এলাকার একদা বনেদী চক্রবর্তী  বাড়ি, বিশাল কম্পাউন্ডে ঘেরা। বিস্তীর্ণ বাগানের পরে পুকুর, নাটমন্দির, তারপরে ত্রিতল বাড়ি। ফালগুনের পড়ন্ত দুপুরে বাতাস উঠছে পাক খেয়ে খেয়ে। ধুলোর ঘূর্ণি উঠতে উঠতেই ফের নেমে যাচ্ছে। সূর্যটা যেনো তেড়ছা চোখে আড়ে আড়ে দেখছে এই বাড়িটিকেই। কতো যুগে কতো রকমের নাটকের মহড়া চলা  বাড়িটিকে ঘিরে আজ উৎসবের ঘনঘটা। এ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী শ্রীমান বিবস্বান চক্রবর্তীর আজ গোধূলি লগ্নে বিয়ে।

একসময়কার শক্তি উপপীঠ বলে খ্যাত বাউরবাগ তথা লাউতার প্রতাপশালী চক্রবর্তী মহাশয়েরা তিনপুরুষ ধরে এই বাড়িতেই ঠাঁই গেড়েছেন। ব্রাহ্মণ্য তেজ আগের মতো আর নেই বটে, নেই সেই জমিদারী কিংবা কুলীন প্রথাও। তবুও বনেদী বংশের হাঁকডাক যথেষ্টই রয়ে গেছে এদের জীবনাচরণে।

কাজের বাড়ি যেমন হয়, সকলেই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত আছে। লগ্ন পড়েছে গোধূলিতে তাই সকলেই ত্রস্তে কাজ সারতে ব্যস্ত। বরযাত্রী হিসেবে অল্প কিছু লোকেই কেবল যাত্রা করবে কনের বাড়িতে। নিতবর আর সামান্য কিছু কাছের কুটুম যাবে বিয়ে বাড়িতে কনেকে আনতে, বাকীরা রইবে এবাড়িতেই। বাইরের বাগানে তাই মস্ত ম্যারাপ বেঁধে রান্নার তোড়জোড় চলছে সারাদিন ধরেই। সকালের জলখাবার, দুপুর রাতের খাবার একের পর এক আয়োজনে ব্যস্ত রান্নার ঠাকুরেরাও। আত্মীয় কুটুম্বে থইথই করছে সারাবাড়ি, কে নেই এই জটলায় সেটা খুঁজতে গবেষণা করতে হবে বটে। আর যদি কেউ নেহাতই না এসে থাকে তবে সেটা একান্তই তার নিজস্ব সমস্যা। বাড়ির কর্ত্রী নিজে যেচেপড়ে সকল কুটুম্বকে নিমন্ত্রণ করেছেন করজোড়ে!

দোতলার দক্ষিণ কোণের ব্যালকনিসহ সবচেয়ে বড় ঘরটাতে চলছে যেনো দক্ষযজ্ঞ। এবাড়ির দুই কন্যা আজ বড়ই ব্যস্ত, সকালের জলখাবারের পরে তাদের আর ঘর ছেড়ে বেরুতেই দেখা গেলো না। ঘন্টায় ঘন্টায় চায়ের ফরমাস আজ নেই, দিদি বোনের ঝগড়ার নামে খুনসুটিও গরহাজির আজ। কী পরবে দাদার বিয়েতে তা নিয়ে গেলো রাতেই বিস্তর হইহট্টগোল করবার পরে একদমই শান্ত দু’জনেই, যেমন শান্তি বিরাজ করে আশ্বিনের ঝড়ের পরে!

অপর্ণার হাতে আইশ্যাডো প্যালেট, ব্যস্তহাতে ব্রাশের স্ট্রোক টানছে সে চোখের পুরো পাতা জুড়ে। হালের নতুন ট্রেন্ড স্মোকি আই করতে, তার শারারার সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যাবে তাই৷পাশে তার দিদিয়া,শমীপর্ণা।অপর্ণার মতো অতো ছটফটে নয় সে, একটু ধীরস্হির আর শান্তই ৷তবে ধীরে হলেও এরিমধ্যে তার সাজগোজ প্রায় শেষের দিকে ৷নিপুণ আর অভ্যস্ত ক্ষীপ্রতায় চুল বাঁধছে সে। এযুগের মেয়েরা যেখানে কথায় কথায় আন্তাবড়ি পার্লারের দারস্হ হতে ছোটে, এই দুটি সেখানে মূর্তিমান ছন্দপতনই বটে। এদের স্যাঁলোতে ছুটতে হয়না, বডি পলিশ করতে। নানান রকম চুলের কাটাকুটিরও দরকার নেই একদমই। এরা সেই পুরনো আমলের ডাকসাইটে সুন্দরীদের মতোই রূপ ধরে রেখেছে আজো।

রূপকথার গল্প বলে শোনালেও দুই বোনেরই হাতির দাঁতের মতো উজ্জ্বল গায়ের রঙ, হাঁটু ছাপানো কোঁকড়া চুল, আর কাঁধ পর্যন্ত দুইপাশে লকস কাটা। কালো চুলের রঙ বদলাতে নেই বার্গান্ডি বা ডীপ ব্রাউনের এক্সটেনশনও। এরা ভুরু প্লাক করেনা সন্না দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, আঁকেনা ব্রক্স আইব্রো তবুও এরা সুন্দরী বটে। দীর্ঘদিনের যোগাভ্যাস দুইবোনেরই, তাদের শরীরকে একটা দারুণ সহজাতভাবেই বয়ে চলা নদীর মতোই ছন্দময়তা দিয়েছে। কৃত্রিম সৌন্দর্য তাই আরোপিত নয় তাদের রূপে। বরং সারল্যের দ্যুতি চোখ টানে, মনও! এমনিতে দুই বোন দুই সখীর মতো নয়, শমীপর্ণা নেহাতই চুপচাপ গোছের। কিন্তু একসাথেই সাজতে লেগেছে আজ দুইবোনে, নেহাত তাড়া বলেই৷

আসল বর্মাসেগুনের ড্রেসিংটেবিল, আবলুশ রঙের চকচকে পলিশ করা। এ বাড়ির আর সব আসবাবের মতোই এ্যান্টিক, এদের ঠাকুরদাদার আমলের।

একটি নয় এতে তিনটি করে পেল্লায় আয়না বসানো ৷মাঝের আয়নাটি স্হির থাকে আর আকারেও তুলনায় বড়। তার দুপাশের দুটো আয়না তারচেয়ে একটু সরুমতো । সেদু’টো নাড়িয়ে চাইলে পেছন দিকের বা পাশ থেকে বেশভুশা দেখে নেয়া যায়৷বাংলাদেশের বিখ্যাত  কাঠ খোদাই কাজ করা এই ড্রেসিং ইউনিটের আয়নার সামনে সাজতে বসলেই যে কারো মন ভালো হয়ে যাবার কথা। আপাতত,সাজতে বসা দুইবোনের চলছে মাস্তি,সঙ্গে চলছে সাজসজ্জা।

অপর্ণা বলে উঠে, অউ আয়না না তাখলে কিতা ঐতো খও দেকি দিদিয়া?

(আয়নাটা না থাকলে যে কি হতো বল দেখি দিদিয়া?)

কিতা ঐতো তে আর! চক্কোত্তি বাড়ির কেশবতী ফুরিনতের লাগি তারার ঠাকুরদাদায় বানাইলায় অউ আয়নারবাড়ি…

(কী আর! চক্কোত্তি বাড়ির কেশবতী কন্যাদিগের কল্যাণে উহাদের ঠাকুর্দা কর্তৃক প্রস্তুত…)

বলেই একটা ফিচেল হাসি দিল দিদিয়া ওরফে শমীপর্না৷

উল্টো ভ্রুভঙ্গীতে জবাব দিলো অপর্ণা, চুলটাকে ফ্রেঞ্চরোল বাঁধতে ব্যস্ত ইউপিন আটকে ৷

ভ্রুকুটি করে জবাব দিলো শমীপর্ণাও,  বুড়ো কী আর জানতো নাকি আমাদের কথা! সে মিনসে এই পেল্লায় ড্রেসিং ইউনিট করেছিল তার বউয়ের কথা ভেবে, ভোগে লাগছে আমাদের।ঠিক কীনা ভেবে বলবি একদম!

মাইগ্গো মাই কিতাকিতি ছলের ইনো? কুন মাদানে হামাইছস ইনো, এবলা মাদান গেসে গি! বার হ জলদি জলদি আনামাতিয়া! (কী অবস্হা চলছে এখানে, ও মা গো! কোন দুপুরে ঢুকেছিস ঘরে, এখনো এখানেই আছিস! কোন কথা না বলে বের হ জলদি করে)

দিদি বোনের বকবকানির মধ্যে কখন তাদের মা এসছে ঘরে, দুইজনার কেউই খেয়াল করে দেখেনি৷

অচলা চক্রবর্তী, এই বাড়ির বর্তমান কর্ত্রী। এক পুত্র আর এই দুই কন্যার মা। একসময়ে দারুণ সুন্দরী ছিলেন বটে, তবে এখন একেবারে নির্লিপ্ত চেহারা।নিয়ম মেনে চলা নিষ্ঠাবান বিধবার সাদামাটা বেশ, ধারাবাহিক কৃচ্ছসাধনের ছাপ স্পষ্ট চেহারায়।

সাদা নরুন পেড়ে ধুতি পরে আছেন, ঢালা শাড়ির মতো করে, এই বেশ কাজের বাড়িতে একটু বেমানান কিন্তু অচলা উপায়হীন ৷ ছেলের বিয়ের সমস্ত রকম ঝক্কি সামলাতে জেরবার, কিন্তু সবদিকে তার সমান নজর।

সাজগোজ দ্রুত সেরে নীচে নামতে তাড়া দিলেন দুইবোনকে।তারপর যেমন হঠাৎই এসছিলেন তেমনি হঠাৎই চলে যেতে যেতে চেস্ট অব ড্রয়ারের উপরে রেখে গেলেন একটা ভারি বাক্স,গহনার বাক্স! সঙ্গে বলে গেলেন, এগুলো তোদের দিয়ে যাচ্ছি আজ কনের বাড়ি যেতে পরিস। কেমন?

মায়ের তাড়া খেয়ে দুবোনই দ্রুত সারতে থাকে হাতের কাজ।সত্যিই আর সময় নেই,এক্ষুনি বাড়ি ভরে যাবে।জ্ঞাতি আর আত্মিয়দের ভীড়ে ভীড়াক্কার হবে গোটা বাড়িটা৷কিন্তু মা যা বলে গেলেন যেতে যেতে তা শুনে যেনো সময় থমকে গেলো একদমই। শমীপর্ণা তো বটেই তার দস্যি বোনটার মতো মহা হুল্লোড়বাজ মেয়েও কেমন মিইয়ে গেছে৷

বাক্সটা চন্দনকাঠের,গল্প নয় সত্যি সত্যি চন্দনকাঠের গয়নার বাক্স! তাতে ডালার উপরে হাতির দাঁতের অপূর্ব কারুকাজ করা৷এতে আছে অপর্ণা আর শমীপর্ণার ঠাকুরমা শ্রীময়ী চক্রবর্তীর যাবতীয় গহনা,তার স্ত্রীধন৷ শ্রীময়ীর বাপের বাড়ি ছিল আসামের শিলচর। বাপ মায়ের আদরের ভূবনেশ্বরী দাসী এই চক্কোত্তি বাড়ির কূলবধু হয়ে এসে নাম গেলো পাল্টে। অমন খটোমটো ঠাকুর দেবতার নাম ধরে কে ডাকতে যাবে অষ্টপ্রহর? এই বলে তার নাম ভুবনেশ্বরী থেকে পাল্টে শ্রীময়ী করে দিলেন তার শ্বাশুড়ি বিন্দুবালা দেবী। সেই সময় আকছার এমন ঘটনা ঘটতো কমবেশি প্রায় সব গৃহস্থ বাড়িতেই, শ্রীময়ীও মেনে নিয়েছিলেন এই নাম বদল আরো বহু কিছুর মতো করে। অনেকে অবশ্য বুদ্ধি দিয়েছিলো যে শ্রীময়ী না রেখে শ্রীমতী রাখতে, নামটা সহজে মুখে আসবে৷ কিন্তু কট্টর শাক্ত চক্রবর্তীরা, বাড়িতে ঈশানীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে আর শ্রীমতী হলো শ্রীরাধার নাম! তাছাড়া মুখে স্বীকার না করলেও রাধার নাম রাখবার মতো স্বদিচ্ছা তিনি রাখবেন না এও জানা কথা। মনে মনে গজরে উঠেছিলেন বটে, রাই বেটিনতর কপাল কিলা হক্কলেউ জানইন!  (রাইবেটিদের কপাল কেমন সবাই জানে)

প্রকাশ্যে অবশ্য বলেছিলেন, বাড়ির বউয়ের নাম অমন রাধারাণীর নামে রাখবার কী দরকার বাপু? যা রেখেছি তাই ঠিকাছে!

নয় নয় করেও গহনা বড় কম নেই বাক্সে৷ শ্রীময়ীর বাপের বাড়ি থেকে দেয়া গহনা তো আছেই, আছে তার বিয়েয় পাওয়া গহনাও। বিয়ের সময় এই বাড়ি থেকে নেহাত কম গহনা তো দেয়া হয় নাই তাকে। কলকাতা থেকে বানানো ফিলিগ্রি ছাঁদের গহনা যেমন আছে তেমনি আছে বর্মা মুলুক থেকে আনা মোটা মোটা চূড়। আছে গালা ভরা হাতের বালা। জয়পুর রাজস্হানের আসল জহরত বসানো কুন্দন আর মিনাকারী গহনাও।

সঙ্গে আছে শ্রীময়ীর ঠাকুরমার দেয়া আসামের লালচে স্বর্ণের নিখাঁদ গহনাও, এতে কোন খাঁদ মেশানো নেই বলে বেশ নরোম হয় গহনাগুলো। এই বাক্সে আছে শ্রীময়ীর এক কঢ়ে রাঢ়ী বা বাল বিধবা ননদের গহনাও। ননদ সেই যুগের নিয়ম মেনে কাশীবাসী হলো আর তার গহনা চলে এলো শ্রীময়ীর কাছে। যেমন পেয়েছে সে নিজের শ্বাশুড়ি আর দিদিশ্বাশুড়ির গহনাও।

তাছাড়া সারাজীবন বাড়ির বউ হিসেবে বহু গহনা তিনি গড়িয়েছেন!

শ্রীময়ী চক্কোত্তি আদ্যন্ত শৌখিন নারী ছিলেন৷আর ভয়ানক জেদিও,তাই তার অবর্তমানে এতে যে কেবল এই দুইবোনেরই অধিকার এও জানা কথাই৷ অপর্ণা আর শমীপর্ণা জন্মইস্তকই জানে এই গহনার বাক্সটার কথা! এক আধবার বাড়ির কোন শুভানুষ্ঠানে শ্রীময়ী তার আদরের দুই নাতনীকে পরতেও দিয়েছেন এসব গহনার কোন কোনটা।

তবুও যেন কিছুতেই মানা যায়না, মানতে পারেনা অপা আর শমী। আসলে মানুষের মন বড় বিচিত্র, জেনে বুঝেও তাই মানতে পারেনা বহু কিছুই।

যেমন মেনে নিতে পারেননি শ্রীময়ী তার একমাত্র পুত্র এবং একমাত্র সন্তান,সৌম্যকান্তি চক্রবর্তী’র অসবর্ণ বিয়ে৷লাউতায় স্কুল শেষ করে সিলেট শহরে এসছিল সৌম্য জুনিয়র হাইস্কুলে পড়তে, সেই থেকে সে বাড়ি তথা ভিটাছাড়া বলা চলে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে  ঢাকায় যাওয়া ডাক্তারি পড়তে। সেখানেই পরিচয় হয় অচলার সাথে, মেডিকেল কলেজের সহপাঠী থেকে সহধর্মিণী। সৌম্য জানতো যে তার পরিবার কায়স্থ কন্যা অচলাকে বউমা হিসেবে সহজে মেনে নেবে না কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সেটা তার পুরোপুরি জানা ছিল না। শাস্ত্রে বলে বটে স্ত্রী দূষ্কুলজাত হতে পারে।বলে বটে স্ত্রীলোকের আবার জাত কী, তাদের জাত নাই। এটুকুই সম্বল করে নিজের মনের মিতাকে স্ত্রী করেছিল সৌম্য।

কিন্তু সৌম্যর মা শ্রীময়ী দেবীর মনোভাব সে বোঝে নাই।

বউ নিয়ে বাড়িতে যখন পৌঁছায় তখন বাবা থমথমে মুখে ভিতর বাড়িতে চলে গেলেন। আর মা গর্জে উঠলেন এই বলে,  তোরে ফড়বার লাগি ফাঠাইসলাম, বিয়া খরার লাগি নায়। যুগ বদলি গেসে জানি আমি, আমি অজাত বেজাত খমজাতর ফুরি নায়৷

লোকে ভিন্ন জাতের মেয়ে বউ করে আনে, নিয়ম প্রথা না মেনে  অসবর্ণ বিয়ে করে বটে আমি জানি।

তাবলে এটা এই বাড়িতেই হতে হবে?

আর তাও কীনা আচারনিষ্ঠা ব্রাহ্মণীর জীবদ্দশাতেই।এ তিনি একদমই মানতে পারেন নি। তার স্বামী সংসারের কোন কিছুতে থাকতেন না। নিজের ব্যবসাপত্র আর চাষবাসের কাজ দেখা নিয়ে যথেষ্ট রকম ব্যস্ততা থাকতো সারা বছর জুড়েই। নিজেদের এস্টেটের কাজকর্ম দেখাশোনা করবার জন্য লোক বড় কম ছিল না কিন্তু আরো অনেক বনেদী পরিবারের পুরুষদের মতো বসে খাওয়া তার ধাতে ছিল না। তিনি কর্মী পুরুষ ছিলেন তাই নিজের বাপ ঠাকুরদার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি নিজের কর্মনিষ্ঠ স্বভাবের গুনে বাড়িয়ে তুলেছিলেন। লাউতা আর বিয়ানীবাজার সদরের মতো দেশের আরো বহুস্হানে ব্যবসার কাজে তাকে ঘুরাঘুরি করতে হতো, এসবেই তার সময় চলে যেতো। সংসার সামলানোর জন্য শ্রীময়ী আর তার বিধবা বোনই যথেষ্ট ছিল। এবাড়িতে শ্রীময়ীর শ্বাশুড়ি থাকাকালীন সময়েই শ্রীময়ী যথেষ্ট রকম কর্তৃত্ব পেয়ে যান বস্তুত তার কর্মঠ স্বভাবের কারণ।

এহেন দৌর্দন্ডপ্রতাপ নারীর একমাত্র সন্তান এবং পুত্র হয়ে সৌম্য তার মতের বাইরে বিয়ে কর।শ্রীময়ী নেহাত বাৎসল্য প্রেমে এবং  নেহাতই  নিয়মের কারণে তাকে ত্যাজ্যপুত্রও করতে পারেননি বটে, তবে এর শোধ তিনি তুলেছেন ছেলের বৌয়ের উপর।কায়স্থ কন্যা অচলা এবাড়িতে পুত্রবধূর মর্যাদা পেলো না, কেবলমাত্র স্ত্রী হয়ে রইলো ডাক্তার সৌম্যকান্তি চক্রবর্তীর। আর এবাড়িতে থাকার প্রধান শর্ত, অচলাকে স্রেফ বাড়ির বউ হয়ে থাকতে হবে, তার ডাক্তারি করা চলবেনা।

সৌম্য আর তার নীচকূলের বৌ অচলাকে শ্রীময়ী এই চক্রবর্তী বাড়িতে স্থান তো দিয়েছেন, তবে নেহাত দায়ে পড়েই। মৃতবৎসা শ্রীময়ীর বেশ বয়সের এই একটাই জীবিত সন্তান সমু। মা অন্ত প্রাণ সেই সমুর দোষ তার কাছে যতোটা তারচাইতে বেশি দোষী অচলা। তাই তারা এ বাড়িতেই থাকবে সত্যি কিন্তু সমুর বৌ ব্রাহ্মনকূল সম্মূত নয়,এই অযুহাতে কোন শুভ কাজে অচলাকে ডাকা হতোনা। এ বাড়ির কোন শুভকাজে কী আচারে তার থাকার অধিকারই নেই৷ শ্রীময়ী বাড়ির সকল এয়োস্ত্রীদের ডেকে এনে ঘোষনা করেছিলেন, আমরার বাড়ির নয়া কইন্যাবেটি যেন উন্দালো না হামায় খেয়াল খরবা। ইখটা হকলে মনো রাখবায়, তাই আমরার লাখান ব্রাহ্মণ কইন্যা নায়৷ আমি হকলের সামনে ইখান খইরাম! ই বাড়ির কুনো ঠাকুরর আসন যেন তাই না ছুইতো ফারে।খমজাতর বেটিরে গরো তাকতে খইসি, আনামাতিয়া রইবো আর খাইবো।

একান্নবর্তী রান্নাঘরেও অচলার প্রবেশ নিষেধ, কুটনো কোটা বা বাটনা বাটার জন্য কখনো হয়তো তাকে ডাকা হতো, সেটাও উঠানে বসে হেঁশেলে নয়।

এবাড়িতে সিংহবাহিনী প্রতিষ্ঠিতা,রোজ পূজো হয়৷ মন্দিরের ভোগ রান্নার জন্য শ্রীময়ীর দাদাশ্বশুরে আমল থেকে আলাদা উন্দাল মানে হেঁশেল আছে।

যথারীতি সেখানেও সৌম্য আর তার বৌয়ের প্রবেশাধিকার নেই৷

অধিকার নেই এমন কি সৌম্যর কোন পূজোয় বসারও।বাড়ির নিত্যপুজা করে দিয়ে যান বেতনভুক্ত ভট্টাচার্য মশাই ।শ্রীময়ীর স্বামী জীবিত থাকতেই তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, যেন সমু তার মুখাগ্নি না করে।

শ্রীময়ীকে তার আত্মীয় স্বজন বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, যুগের ধরন পাল্টে গেছে বলে বহু রকম করে বোঝাতে চেয়েছেন কমবেশি সকলেই৷

কিন্তু ভবি ভুলবার নয়।যুগ পাল্টেছে কিন্তু সেটা এ বাড়ির জন্য প্রোযোজ্য নয়। শ্রীময়ীর আচরণে মনে হতেই পারে যেন দ্বেব-দ্বিজে একমাত্র অধিকারী কেবল ব্রাহ্মনকুল, আর কেউ নয়। তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই যে শক্তির সে আরাধনা করে, তিনি কী জাত!  যে শিবের তিনি শক্তি তাঁর কী জাত ছিল!?

অপর্ণা আর শমীপর্ণার ঠাকুরমা শ্রীময়ী বেঁচে থাকতে যেমন, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পরও তাদের মা অচলার র ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি একদমই ৷ এই বাড়ীর কোন জিনিসে তার কিছুমাত্র অধিকার নেই এটা তিনি মেনেই নিয়েছেন। তিনি যেন এবাড়িতে আশ্রিতা,চক্রবর্তী বাড়ির কূলবধূ নন৷

জানালা লাগোয়া ডিভানে বসে আছে তারা দুই সহোদরা, দুই বোন। অপর্ণা আর তার দিদি শমীপর্ণা৷ভাবনার ঢেউ উঠছে-পড়ছে৷বুঝতেই পারছেনা তারা দুজন কীকরে একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?

তাদের ঠাকুরমার এই গহনাগুলো আদতে তাদের মায়েরই প্রাপ্য ছিল৷তাকে বঞ্চিত করে দিয়ে গেলেন কীনা তারই মেয়েদের! তাও আবার উইল করে! কিন্তু কিভাবে পরবে তারা আজ এই জড়োয়া,উৎসবের বাড়িতে কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে?? সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য৷সবাই তো খুঁজছে তাদেরকেই৷আজ তাদের দাদাইয়ের বিয়ে যে… শ্রীমান বিবস্বান চক্রবর্তী ৷অপর্ণা আর শমীপর্নার অনার্য মায়ের তো বটেই পুরো বাড়ির একমাত্র পুত্রধন।

বরাগমনের সময় নির্দিষ্ট করা আছে, সেইমতো বেরুতে হবে অথচ এদিকে দুই বোনের কারুর দেখা নেই দেখে বিবস্বান বোনেদের ঘরে এসে ঢোকে। দুই ভগ্নি দুই সখীর মতো একসাথে বসে আছে পাশাপাশি দেখে খানিক চমকায় বটে বিবস্বান!  দুইজনারই চোখ ছলোছলো, যেনোবা টোকা দিলেই গড়িয়ে পড়বে স্রোতধারা। হাতে ধরে আছে শমী তাদের ডাকসাইটে  ঠাকুরমার  চন্দ্রহার! রুবি আর পান্নাখচিত সেই রত্নহারের ছটা পড়ছে তার মুখে। মূহুর্তে যা বোঝার বুঝে গেলো বিবস্বান চক্রবর্তী, আবারো একটা জটিল নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে বুঝে নিয়ে সে তড়িৎ গতিতে করণীয় নকশে নিলো। ঝটিতি দুই ভগ্নির মাঝখানটিতে বসে, জড়িয়ে ধরলো দুইহাতে বুকের সঙ্গে শক্ত করে।

এই এত্তবড় চক্রবর্তী বাড়ীটা লোকে যাকে ঠাকুর বাড়ী বলে তার কূলপ্রদ্বীপ৷শিবরাত্রির একমাত্র সলতে… ম্যানচেষ্টার নিবাসী পেশায় ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, অঙ্কোলজিস্ট বিবস্বান চক্রবর্তী।

এক সময়কার গোঁড়া পরিবার প্রথা, পেশাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্হা আজ বিলুপ্তপ্রায়।

বংশ পরম্পরা পুরিতগিরি করা হবেনা বিবস্বানের, তাতে সে ভীত নয়। প্রায়শ্চিত্ত করে জাতে উঠারও তার অভিলাষ নেই মোটেই।

সে জানে তার বাবার কপালেও বংশের পুরুতগিরি জোটেনি, তার ভাগ্যেও জুটবেনা কখনোই। কিন্তু সে আজ প্রতিষ্ঠিত, লাউতার চক্রবর্তী বাড়ির তকমা ছাড়াও তার দিন বেশ চলে যাবে।বরং লোকে এখন সিলেট সদরের বিয়ানীবাজারউপজেলার এই চক্রবর্তী বাড়িকে তো বটেই লাউতার বাড়িকেও চেনে তারই নামে।ঠাকুর বাড়ি না বলে, বলে ডাক্তার সাবর বাড়ি।আমরার বিদেশি ডাক্তর যে বালা!

বিবস্বানের বাবা সৌম্যকান্তি যা পারেন নাই সে তা পেরেছে। এই চক্রবর্তী বাড়ির সন্তান আজ গোধূলি লগ্নে আরেক কায়স্থ কন্যার পাণিগ্রহণ করবে এবং চক্রবর্তী বাড়ির সকল এয়োস্ত্রী উলুধ্বনি দিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে সাদরে গ্রহণ করবে এবাড়ির নতুন বউ ডাক্তার নবনীতা চন্দকে। দেরীতে হলেও বিবস্বান জানে আজ জয়টা তার মায়েই। আজ এতো এতো বছর পরে বাড়ির আশ্রিতার ছায়া থেকে বেরিয়ে বাড়ির কর্ত্রী হিসেবে বধূবরণ করতে থাকবেন অচলাও। নতুন পুত্রবধূর হাতে তুলে দেবেন তার শ্বাশুড়ি মায়ের রেখে যাওয়া গহনার বাক্স। যা অচলা এইবাড়ির বউ হয়ে এসে পান নাই যে অধিকার তাকে কেউ দেয় নাই যে স্ত্রীধনে তার কখনোই কোন অধিকার ছিল না তাই আজ তার হাত দিয়ে যাবে পরের প্রজন্মের কাছে। চক্রবর্তী বাড়ির এক বধুর স্ত্রীধন পাবে নতুন প্রজন্মের আরেক বউ। অচলার পুত্রবধূ নবনীতার কাছে যদিও এসব গয়নাগাটির কোন আলাদা অর্থ নাই কিন্তু বিবস্বানের ফোন পেয়ে সে একরকম রাজি হয়েছে শ্বশুরকূলে যক্ষেরধনের মতো আগলে রাখা এই গয়নার বাক্স নিতে।

নবনীতার বিয়ের পর থেকে কারুকাজ করা কাঠের ভারি সিন্দুকের বদলে সরকারের কোষাগারে জমা করা আছে সেই বিরল হাতির দাঁতের কাজ করা গহনার বাক্সটা। কবে কোনদিন কোন লগ্নে কার তা কাজে লাগবে কেইবা তা জানে!

অনসূয়া যূথিকা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

লিফট

লিফট

গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাওয়ার পথে চৌরাস্তার পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে পঁচিশতলা আর্কেডিয়া টাওয়ারের তেরতলায়…..

উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার

কাঁটায় কাঁটায় বিকেল চারটা পঞ্চান্নতে ডাইনিং রুমের উত্তরের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ফুলদানিতে বর্ণিল…..