ঘরে ফেরা

কুম্ভকর্ণ
ছোটগল্প
Bengali
ঘরে ফেরা

মিত্তির বাড়িতে খুশীর হাওয়া, তাদের ছেলে আজ বাড়ি ফিরছে। বাড়ির কর্তা মানে রুদ্রপ্রসাদ বাবু ছেলের পছন্দের সবজি, মাছ নিজের হাতে কিনে এনেছে বাজার থেকে। বর্ষাকাল, তাই ছেলের পছন্দের ইলিশ মাছটাও পেয়েছেন মনের মতো। রুদ্রবাবুর গিন্নি মানে সুজাতা আজ অনেকদিন বাদে রান্নাঘরের দখল নিয়েছেন। বাজার থেকে ফিরে শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগছে রুদ্রবাবুর। ড্রয়িংরুমে সোফাটায় একটু গা এলিয়ে বসে আছেন, একটু তন্দ্রাও এসেছে।

-কি গো ওষুধগুলো খেলে? সুজাতার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।

-না গো এবার খাবো।

-এখন ন’টা বাজে,প্রেসারের ওষুধটা তো টাইম আটটা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কোথায় যাবো বলতো। তোমার তো হার্টের অবস্থা তো ভালো নয়।

-সেটা তো তোমার ও ভালো নেই সুজাতা। তাও তুমি এত কিছু করছো।

-করতে তো হবেই, ছেলেটা এতোদিন বাদে কাল ফিরছে।

একটু চুপ করে গেল রুদ্রবাবু,তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো

-সব আমার জন্যই হলো সুজাতা, সেদিন অতো রাগারাগি না করলেই হোতো। শুনলাম ও নাকি দারুণ ডিজাইনার। সবাইকে যে engineer হতে হবে তার তো কোনো মানে নেই।

-তুমি তো বাবা রুদ্র।তুমি তো ওর ভালোই চেয়েছো।তবে এত দুরে বাড়িটা না করলেই ভালো করতে, ছেলেটাকে আজ রাতেই দেখতে পারতো।

-এটা সত্যি।ছেলেটার জন্য বড্ড মনটা খারাপ লাগে সুজাতা। আমার জন্য সে তোমাকেও সে হারিয়েছিলো।

-ছাড়ো, ওসব পুরানো কথা, শুধু তোমার জেদটা ভাঙ্গতে পাঁচটা বছর লেগে গেল।

সন্ধ্যা থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। দুই বুড়ো-বুড়ির আপেক্ষা শুধু কালকের জন্য।

-রুদ্র এবার ছাড়ো। খোকার ঘরটা সকাল থেকে এই নিয়ে তিনবার গোছালে, এবার ছাড়ো।

-জানোতো সুজাতা ঘর গোছানো মানে পুরানো স্মৃতিটা আরো একবার ঝালিয়ে নেওয়া। তা খোকার জন্য তো এবার মেয়ে দেখতে হবে… নাকি তোমার ছেলে…।

বাড়ির ফোনটা বেজে উঠলো, বাইরে বৃষ্টির তান্ডব বেড়ে চলেছে।

-হ্যালো..বলছি..।

-কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।

-হ্যালো..এবার বলুন…

-কি বলছেন…?

বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল, ভিতর থেকে রুদ্র বলল

-সুজাতা কে এসেছে একটু দেখবে।

-খোকা তুই? তোর তো কাল আসার কথা ছিলো..। তুই কিচ্ছু কথা শুনিস না।

-মা..মা তুমি চুপ করবে..।

-আরে ওকে ঘরে ঢুকতে তো দাও। জড়িয়ে ধরলো রুদ্র তার ছেলেকে।ছেলেটাকে যে ভালো করে দেখবো সেটাও কপালে নেই আমার। দেখলে ঝুপ করে কারেন্টটা চলে গেল।

-ভালোই তো বাবা, সেই আয়েলার সময়ের মতো বাডিতেই candle নাইট ডিনার হবে।

-তোর মনে আছে খোকা? তুই তখন কতো ছোটো। নে তুই ফ্রেশ হয়ে নে, তোর মা তোর পছন্দের সর্ষে ইলিশ করেছে। তবে তুই আজ এতো রিস্ক নিয়ে না এলেই পারতিস্।

অনেক দিন পর মিত্তির বাড়িতে আজ খুশীর হাওয়া। বৃষ্টি, লোডশেডিং কিছুই আজ এর অন্তরায় নয়। ছেলেকে কাছে পেয়ে রুদ্র আর সুজাতার অনেকদিন পর ভালো ঘুম হয়েছে।

রুদ্রবাবু সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। আজকের সকালটা অন্যদিনের থেকে অনেক পরিষ্কার, অনেক ঝলমলে। একতলার ব্যালকনি থেকে বাড়ির গেটটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাড়ালো, পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে তিনজন নামলো, তাদের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।

-সেন বাবু, যে ছেলেটার কালকে রাণওভার হয়েছে তার বাড়ি কি এইটা?

-হ্যা স্যার কালকে ফোন করি সব বলি ভিক্টিমের বাড়িতে। তারপর থেকে আর ফোনেও পাচ্ছি না।

রুদ্র বিশ্বাস করতে পারছে না, ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। পিছনে ফিরতেই সে দেখলো খোকা দাড়িয়ে আছে, মুখে স্মিত হাসি, সাথে সুজাতা সেও হাসছে।

-সুজাতা চলে এসো আমার কাছে, খোকা আর নেই, ও মারা গেছে কাল রাতে।

-বাবা তুমি শোনো..

রুদ্র ভয়ে তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কোনোক্রমে সে পাশ কাটিয়ে নীচে ড্রয়িংরুমে নামলো। পুলিশদের সব জানাতে হবে তো।

ড্রয়িংরুমে নেমে সে দেখলো

ফোনের রিসিভারটা মাটিতে পড়ে আছে..।

আর সোফায় ওরা কারা জড়িয়ে শুয়ে? সুজাতা আর ওটা কে?রুদ্রর গলা বন্ধ হয়ে আসছে..

-আমি ওটা তো আমি…।

বাইরে দরজার ধাক্কার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে..।

-কেউ আছেন? মিস্টার মিত্র..।

কুম্ভকর্ণ (ছদ্মনাম)। লেখক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় প্রকৌশলী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ