ঘষা-কাচের ভেতর দিয়ে

শৌভ চট্টোপাধ্যায়
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
ঘষা-কাচের ভেতর দিয়ে

ক্লাস সিক্সে, ইশকুলের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন কথাটা। তখন অতটা তলিয়ে ভাবিনি, ফলে বুঝতেও পারিনি। কিন্তু এখন টের পাই, কী মোক্ষম একটি কথা, কত অনায়াসে বলে ফেলেছিলেন তিনি। পাঠ্যবইয়ের কোনো একটি কবিতা পড়াতে গিয়ে, তিনি বলেছিলেন,

“ধর, তুই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছিস। গরমের দুপুর। ঘরের পর্দা উড়ছে হাওয়ায়। আর ভেতরে, খাটের ওপর, কেউ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিস না, পর্দা উড়লে শরীরের আদলটা শুধু চোখে পড়ছে। আবার,পরক্ষণেই, পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সবটুকু। কিন্তু একটা মা-মা গন্ধ পাচ্ছিস তার মধ্যেও। ওইটাই কবিতা। পুরোটা স্পষ্ট করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া নয়, আভাসে-ইঙ্গিতে একটা ছবি ফুটিয়ে তোলা। কবিতা ওইরকম।“

উপন্যাস বা ছোটগল্পের সঙ্গে কবিতার পার্থক্যও সেখানেই। গল্প-উপন্যাসের জগৎটা, মোটামুটি, আমাদের চারপাশের জগতের মতোই—চতুর্মাত্রিক দেশ-কালের সীমায় আটকা পড়ে-যাওয়া একটা নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু, কবিতা যেন এই জগৎটাকে দেখতে চায় একটা ঘষা-কাচের ভেতর দিয়ে, যাতে ধরা পড়ে আমাদের ব্যক্তিগত চেতনার মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে পড়া বাহ্যজগতের সারাৎসারটুকু। গল্প-উপন্যাসের মতো, কোনো নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যরচনার দায় কবিতার নেই, বরং, প্রাতিস্বিকতার মধ্যেই তার মুক্তি ও আনন্দ। ফলত, নিজস্ব বোধ ও অনুভূতিমালাকে, ভাষার মাধ্যমে অসঙ্কোচে উজাড় করে দেওয়ার তৃপ্তি একমাত্র কবিতাই দিতে পারে।

কিন্তু, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা বড় বেশি নৈর্ব্যক্তিক। এবং, নৈর্ব্যক্তিক বলেই, আমরা একে-অপরের কথা বুঝতে পারি। অন্যথায়, শুধুমাত্র স্বগতোক্তি ছাড়া, আর কোনোরকম যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে মানুষের, সম্ভব হত কি? আবার, একইসঙ্গে, একথাও ঠিক যে, ভাষার এই নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রের কারণেই, খুব ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ধরো ওই সূর্যাস্ত, আকাশের কমলা রঙ, বিচিত্র আকারের মেঘ, গাছের ছায়া—এই সবকিছু, আমি যেভাবে দেখছি, অন্য কারোর পক্ষে ঠিক একইভাবে দেখা কি আদৌ সম্ভব, কোনোদিন? এমনকী, আমি চাইলেও, আমার সেই নিজস্ব দেখাটাকে, অন্য কারোর কাছে হুবহু বর্ণনা করতে পারব না। যদি তা করার চেষ্টা করি, তবে আমাদের আটপৌরে ভাষার সঙ্গে একটি দস্তুরমতো বোঝাপড়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। প্রয়োজন হয়, শব্দের প্রচলিত অর্থ ও অভিঘাতকে সম্প্রসারিত করে, একটি নিজস্ব বাগবিধি রচনার। আর এই জন্যেই, কবিতার ভাষা, গোপন মুদ্রাদোষের মতো, ক্রমশ আরো বিমূর্ত ও ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে, এমনকী অপ্রত্যাশিতও।

এমন তো ঘটেই থাকে, কোনো একটি উপন্যাসের কিয়দংশ পড়ে, আমরা তার ‘কাব্যিক’ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই; অথবা, আঞ্জেলোপুলোস বা তারকোভস্কির সিনেমাকে ‘কবিতার মতো’ বলে মনে হয়। আসলে, এখানেও, কোনো এক ব্যক্তিগত অনুভূতির শীর্ষদেশ ছুঁয়ে ফেলার আনন্দ আমাদের বিহ্বল করে। পাঠক-হিসেবে আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি, তখন, ভাষার ভেতর দিয়ে, হয়তো আমরা ছুঁয়ে ফেলি কবির অন্তঃসত্তাকে। অথবা, নিজের ভেতরেই ধারণ করি, নিজের মতো করে, অন্য কারোর সৌন্দর্যবোধ এবং বেদনা। হয়তো, নিজের থেকে খানিকটা দূরে সরে, নিজেকে দেখাও সম্ভবপর হয়, কবিতায়। এই প্রাতিস্বিক যোগাযোগ, চেতনার সঙ্গে চেতনার এই স্পর্শসুখ, একান্তভাবেই কবিতার অবদান, কবিতার নিজস্ব অর্জন।

শৌভ চট্টোপাধ্যায়। কবি। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতা। প্রকাশিত বই:

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

তর্জমা

তর্জমা

তর্জমা স্নানে শুচি হবার পর বেকসুর সন্ধ্যাগুলো শুধুমাত্র নিজস্ব অন্ধকারের নিচে দোলনাচেয়ারে ছড়িয়ে বসা কিছুটা…..