ঘুম

মাহবুবুর রহমান
গল্প
ঘুম

খুলনার সোনাডাঙ্গার আকাশে তখনো গোধূলীর সোনালী আভা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে পাখিরা নীড়ের দিকে ছুটে চলছে। মোয়াজ্জিনের আযানের ধ্বণির শেষ রেশটুকু এখনো কানে বাজে। মাগরিবের নামাজ শেষ করে মন্জুর আহমেদ বাসার দিকে যাচ্ছেন। তাঁর পুত্রবধূ চা বানিয়ে অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যার এই সময়টায় স্ত্রী, তাঁর কণিষ্ঠা কণ্যা, পুত্রবধূ আর একমাত্র নাতনিকে কোলে নিয়ে সংসারের টুকিটাকি, ছেলেমেয়েদের খবরাখবর নিতে নিতে লাল চা খাওয়া তাঁর অনেকদিনের অভ্যাস।

যেতে যেতে তিনি ভাবছেন বড় ছেলে মন্জিল বম্বে থেকে কবে ফিরবে? ফয়সাল কয়েক মাস হল হোস্টেলে। পড়াশুনা করে তো? হুমায়রা রোকেয়া হলে। ঢাকার রাস্তাঘাট তার জন্য কতটা নিরাপদ? বড় মেয়ে মনোয়ারার কথা মনে হতেই বুকটা একটি ভারী ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল! তাঁর দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

তিনি রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছিলেন।
এমন সময় পেছন থেকে একটি বেবী ট্যাক্সি তাঁকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল। তাঁর চোখে লেগে থাকা গোধূলীর শেষ আলোটুকু নিমিষে বিলীন হয়ে গেল!

তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছে একা একটি ঘরে। তাঁর সবকিছু ঘোলা লাগছে। কাউকে চিনতে পারছেন না। তিনি কি কোনো হাসপাতালে শুয়ে আছেন? চারিদিকে এক অদ্ভুত নিরবতা। এক অবোধ্য প্রস্তুতির আভাস। তাঁর হাত পা অবশ লাগছে কেন? আশ্চর্য তো ! তিনি কোন কথাও বলতে পারছেন না।

তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী , কণিষ্ঠা কণ্যা , পূত্রবধূ আর প্রাণপ্রিয় নাতনি তাঁর জন্য চা নিয়ে অপেক্ষা করছে। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, কিছুতেই হাত পা তাঁর কথা শুনছে না।

বাসায় একটা ফোন করা দরকার। মোবাইল ফোনটা পকেটে ছিল। কিন্তু অসাড় হাতে কিছুই করা যাচ্ছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। অসহায় হলে মায়ের কথা কেন মনে পড়ে? একবার ছোটবেলায় তীব্র জ্বরে পনের দিন শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। মা তাঁকে মুখে তুলে খাইয়ে , কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে, গা মুছিয়ে পাশে শুয়ে মাথায় বিলি কেটে গুনগুন করে গাইতেন-
‘আয় ঘুম আয়রে, খোকা ঘুম যায়রে..’

মায়ের কথা মনে পড়ায় মনটা অস্থির হয়ে পড়ল। একবার মাঘ মাসে তীব্র শীতে লেপ কাঁথায়ও শীত মানছে না। কেওড়া নদীর ঠান্ডা বাতাস খোলা পাড় দিয়ে হুহু করে তাঁদের পাঁচগাঁও এর গ্রামের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে। মা সারারাত তাওয়ার আগুন দিয়ে ঘর গরম করে রাখলেন। ভোর হতেই দেখেন মা খেজুর রসের পায়েস হাতে বলছেন, ‘খোকা ওঠ্ , গরম গরম খা।’

তখন থেকেই মাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন । বড় হয়ে মাকে নিয়ে শহরে একটি দালান ঘরে থাকবেন। বিজলি বাতির উজ্জ্বল আলোয় মা ফ্যানের বাতাস খেতে খেতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলবেন ‘আহ্ কি সুখ, আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত!’

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়ামূর্তি। এই ছায়াটি চিনতে তাঁর এক মুহূর্ত বিলম্ব হল না। মূর্তিটির বয়স যখন মাত্র ষোল তখন থেকে সে ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে। তাঁর কষ্টে আনন্দে , উত্থানে পতনে , সংকটে ভালবাসায় সর্বত্র সে আছে।

মূর্তিটি দরজা ঠেলে তাঁর বুকের উপর আছড়ে পড়ল। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ এ তুমি কি করলে ! এত বড় শাস্তি তুমি কেন দিলে! ‘
এই বলে ছায়ামূর্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

ঘষিয়াখালীর একটি সরু খালের পাড়ে রুবীদের বাড়ি। ফুলে ফলে ভরা সবুজে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় সুন্দর বাড়ি। বাড়ির পেছনে একটি ছোট্ট পুকুর। বর্ষায় সে থাকে ভরাট টইটুম্বুর । পুকুরের ডান দিক থেকে জলের বিছানায় শুয়ে পড়েছে এক ঝাঁক কলমি লতা। কলমির ডগায় মৃদুমন্দ বাতাস শিহরণ তুলে দুষ্টু মেয়ের মত খিলখিল হাসি হেসে দ্রুত পালায়।

এই অপরূপ প্রকৃতির কোলে হেসে খেলে ছোট্ট কিশোরীটি একদিন পরিপূর্ণ রুবীতে পরিণত হয়েছে।

যখন তিনি বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় গেলেন তখন এই নারীটি অসীম ধৈর্য আর সহিষ্ণু প্রতীক্ষা নিয়ে পাখির মত তাঁর বাচ্চাগুলোকে ডানার নীচে আগলে রেখেছিলেন।

প্রথম বিদেশে যাবার দিনটির কথা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন রুবী তাঁর স্যুটকেসে অতি যত্নে নিপুণ হাতে বুনানো একখানি নকসী কাঁথা দিয়ে বললেন, ‘ যেখানেই থাক না কেন সব সময় এটা ব্যবহার করবে। ভাববে এর সাথে আমার স্পর্শ লেগে আছে।’
তিনি রুবীর কথা রেখেছিলেন।

সেই থেকে রুবীনা তাঁর জীবনে চিরদিনের মত ছায়াসঙ্গী হয়ে রইলেন। হাসিখুশি এই নারী সবসময় সংসারটিকে আলোকিত করে রাখতেন। যেদিন তাঁদের আদরের মনোয়ারা তার জীবনের সিদ্ধান্তটি নিজেই নিয়ে চলে গেল সেদিন থেকে রুবীর সেই হাসিটুকু চিরদিনের মত হারিয়ে গেল। এক গভীর বেদনার তীব্র দহন অহর্নিশি দংশন করে চলল। সেই দহন দিনে দিনে পুঞ্জিভূত হয়ে তীব্র অভিমানে মনোয়ারার সাথে পার্থিব যোগাযোগের দ্বারটি চিরদিনের মত রুদ্ধ করে দিল।

‘হঠাৎ লোকজনের সমাগম বেড়ে গেল। এরা কি সবাই হাসপাতালের লোক? তারা কি আমাকে অপারেশন টেবিলে নিবে? রুবী তুমি কি আমার সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে থাকবে? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তোমার যখন অপারেশন হয়েছিল তখন থিয়েটারে ঢোকার আগে তুমি আমার হাত ধরে বলেছিলে , ‘ যদি মরে যাই, ক্ষমা করে দিও।’

‘তারা আমাকে একটা স্ট্রেচারে তুলল। আমার কি তাহলে বড় কোন অপারেশন লাগবে? কিন্তু আমার তো ব্যথা লাগছে না! শুধু হাত পা মুখ নাড়তে পারছি না। বেবী ট্যাক্সির একটি ধাক্কায় কি সব নিথর হয়ে পড়ল? আমার ছেলেটা কি এখনো বিদেশের মাটিতে? বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে। আমার এই ছেলেটা বড় চঞ্চল কিন্তু মনটা খুবই নরম। আমার বড় আদরের প্রথম সন্তান। ‘

‘কিন্তু এটা তো কোন অপারেশন থিয়েটার না! খোলা মাঠের উন্মুক্ত প্রান্তর। অসংখ্য লোকের গমগম আওয়াজ। সবাই ধবধবে শ্বেতবস্ত্র পরিহিত। তবে কি এটা আরাফাতের ময়দান? আমার চিন্তা কি অসাড় হয়ে পড়ল? কিন্তু আমি তো সব শুনতে পাচ্ছি। ‘

এমনি সময় একটি গুরুগম্ভীর কন্ঠ মাইকে ভেসে এল-
‘আজ এমন একটি লোকের জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি যিনি সারা জীবন সত্য ও ন্যায়ের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেছেন। যাঁর অন্তরের আলো আমাদেরকে অন্ধকারে সঠিক পথটি দেখিয়েছে। একটি মানুষ কিভাবে সত্যিকার মানুষে উত্তীর্ণ হয় তিনি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জীবনে কখনো তাঁকে কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে শুনিনি। হাসিমুখ ছাড়া কখনো তাঁকে কথা বলতে দেখিনি। যাঁর কথা ছিল আরো অনেকদিন ধরে মানুষকে শিক্ষার আলো ছড়াবেন কিন্তু একটি নিষ্ঠুর বেবী ট্যাক্সি সব কিছু তছনছ করে ফেলল। ‘

মন্জুর আহমেদ বুকের ভেতর হঠাৎ এক অলৌকিক শক্তির উত্থান অনুভব করলেন। তিনি চারিদিকে এক অদ্ভুত গোলাপের গন্ধ পেলেন। ঊর্ধ্বলোকে তাঁর মায়ের সহাস্য মুখখানি ভাসতে দেখতে পেলেন!

‘আয় ঘুম আয়রে, খোকা ঘুম যায়রে..’

সমস্ত আকাশ ভেঙ্গে এক গভীর ঘুম তাঁকে আলিঙ্গন করল।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..