ঘুরে আসুন পানাম নগর

আজমত রানা
ভ্রমণ
Bengali
ঘুরে আসুন পানাম নগর

ঈদ মানেই ব্যস্ত শহর ঢাকার সত্তুর শতাংশ মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া। এক কথায় ঈদের আগে পিছে ছুটির সময়টাতে ঢাকা শহর একেবারেই ফাকা থাকবে। কোথাও শব্দ থাকবেনা, চিরচেনা যানজট থাকবেনা এমনটাই আমার ধারণা। এটা মাথায় রেখেই এবারের ভ্রমণ পরিকল্পনা করলাম ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ পানাম নগর আর জিন্দাপার্ক। সময় নির্ধারণ করা হলো ঈদের পরের দিন।

৬ মে সকাল ৯টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো।আগের দিনই একটা তাপানুকুল গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে সারাদিনের জন্য। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম ঢাকা শহর ফাঁকা পাবো কিন্তু রাস্তায় নেমে আমার ধারণা পাল্টে গেল। যেমন ভেবেছিলাম, আদতে তেমন কিছু নয়। দোকানপাট বন্ধ,পথচারির চাপও তেমন একটা নেই।গণপরিবহন দু চারটা চোখে পড়ে, কিন্তু রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটরসাইকেলের কমতি নেই। বরং বলা যায়, যে গাড়িগুলো রাস্তায় চলছে তার গতি ও বিচরণ বেপরোয়া।

যাত্রাবাড়ি পার হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হলো রাস্তায় যানজট। ঈদের পরদিন এমন যানজট মেনে নেয়া যায়না।সারা বছর না হয় মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তায় নেমে ছুটতে থাকেন। তাই বলে ঊদের পরের দিনও! প্রায় আধাঘন্টা আটকে থেকে বিরক্তির শেষ মাথায় গিয়ে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম কেন এ যানজট। জবাব পেতে সময় লাগলোনা। গাড়ির চাপে এ জট নয়। মানুষের হঠকারিতা আর অসভ্যতার কারণেই এ জট তৈরি হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে রাস্তায় ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রন ছিলনা বললেই চলে। এ সুযোগে কিছু অসভ্য মানুষ সড়ককে নিজেদের বাবার সম্পত্তি মনে করে ব্যবহার শুরু করেছিল ফলে হাজার মানুষকে প্রচ- গরমে রাস্তায় আটকে থাকতে হয়েছে। অনেক কষ্টে জট থেকে মুক্তি পেয়ে এগুতে শুরু করলাম।

আমাদের ট্যুর প্ল্যানে প্রথমেই ছিল রুপগঞ্জের জিন্দাপার্ক। এটা মুলতঃ একটা স্যুটিং স্পট ও বিনোদন পার্ক। আমাদের দলের কেউ এর আগে এখানে আসেনি। আমরা শুনেছি ভুলতা বাস স্ট্যা-ের কাছেই কোথাও। পথে একে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ সঠিক ঠিকানা বলতে পারলোনা। শেষে একজনকে পাওয়া গেল, যে বললো নরসিংদির দিকে এগিয়ে যান , রাস্তার পাশেই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি পার্ক আর পাইনা। প্রায় চল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর ছোটভাই রনির মাথায় আসলো “আমরা তো গুগল এর সাহায্য নিতে পারি”। তৎক্ষনাত গুগলের দারস্থ হলাম। গুগল জানালো আমরা ৫০ কিলোমিটার পথ এগিয়ে চলে এসেছি। সবার মুখ কালো হয়ে গেল। অর্থাৎ আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। তখন আমাদের সবারই মনে একটা প্রশ্ন “এত বড় নামি দামি একটা পার্ক, যেটার ঠিকানা গুগল জানে কিন্তু এখানকার লোকজন জানেনা কেন”? আমাদের তখন একটা প্রবাদ মনে আসছিল “ স্টেশনের কাছের লোক ট্রেন পায়না”।

আমরা গুগলের দেখানো পথে ভুলতা বাস স্ট্যা- থেকে রুপগঞ্জের দাউদপুরে অবস্থিত জিন্দাপার্কে চলে গেলাম।আহামরি কিছু নয়,শহরের কোলাহলের বাইরে কিছুটা নিরিবিলি সময় কাটাতে চাইলে আসতে পারেন। এলাকার নামই জিন্দা, এলাকার নামানুসারেই পার্কের নাম। অগ্রপথিক পল্লী সমিতি নামের একটি সমিতি নিজেদের প্রচেষ্টায় সমবায় ভিত্তিতে এ পার্ক গড়ে তুলেছেন। বছরের অন্য সময় প্রবেশ ফি খুব সামান্য থাকলেও ঈদ উপলক্ষে মানুষের গলাকাটা শুরু করেছে। প্রতিজনের প্রবেশ ফি এখন ১শ টাকা। কিছুটা সময় নিরিবিলি বসে কাটাবেন সেজন্যও জন প্রতি ১শটাকা নেয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি।

একঘন্টা জিন্দা পার্কে ঘুরে বসে থেকে বের হয়ে এলাম। এবার গন্তব্য সোনারগাঁ পানাম নগর।আবার এলাম ভুলতা বাসস্ট্যান্ডে। এখানে যেতেও যে আবার যানজটে পড়তে হবে সে ধারণা ছিলনা। আমরা নয়াপুর বাজারের মসজিদ রোড ধরে এগিয়ে গেলাম, সেখান থেকে আলিপুরা বাজার তারপর পঞ্চমীঘাট।এখানে ঘন্টাখানেক আটকা থাকলাম যানজটে। দুপুর গড়িয়ে গেছে , খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। দু তিনটে হোটেলে খোঁজ নিয়ে জেনেছি “ভাত নেই”।অগত্যা এগিয়ে যাওয়া । এলাম বাংলাবাজার,এখানেও ভাত নেই। আর একটু এগিয়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা। সামনেই পানাম সিটি। এখানে বেশ কিছু ভাতের হোটেল আছে। পর্যটকে গিজ গিজ করছে পুরো এলাকা। পা ফেলার জায়গা নেই কোন হোটেলে।অনেক কষ্টে ঠেলে ঠুলে জায়গা করে বসলাম একটা হোটেলে। দাম জিজ্ঞেস করার সময় হয়নি,খাওয়ার পর দেখেছি গলা কাটা কাকে বলে। তবুও খুশি পেটে কিছু দিতে পেরেছি বলে।

পানাম নগরে ঢোকার আগে এ সম্পর্কে সামান্য কিছু বলে নিই।ঐতিহাসিকগণ মনে করেন আজকের সোনারগাঁ হাজার বছরের প্রাচীন নগর সুবর্ণগ্রাম।এই সুবর্ণগ্রাম ছিল পূর্ব বাংলাম অন্যতম রাজধানী ও নদীবন্দর।এখানেই তের শতকে হিন্দুরাজা দনুজমাধব দশরথদেব তাঁর শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানী বাংলার অন্যতম রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র।ঔপনিবেশিক সময়কালে এ এলাকায় বাণিজ্যিক আবাসিক ধর্মীয় কেন্দ্রীক স্থাপত্যকর্ম নির্মিত হয়েছে।

পানাম নগরের অবস্থান ঢাকা থেকে ৩০ কি.মি. দক্ষিণ পূর্বে। ৫ মিটার প্রশস্ত একটি সড়কের দু পাশে পূর্ব দক্ষিণে ৬০০ মিটার এলাকায় ৫২ টি ভবন নিয়ে পানাম নগর। ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মুঘল শিল্পরীতির মিশ্রন এবং স্থানীয় কারিগরদের শিল্প নৈপুন্যের সংযোগ ঘটিয়ে চুন সুরকীর আস্তর দিয়ে একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত এ সকল ভবন নির্মিত হয়।বেশ কিছু পরিখা,ঘাটসহ পুকুর ও কূপ রয়েছে এখানে।

এবার আমরা পানাম নগরে ঢুকবো। জনপ্রতি ১৫ টাকা করে প্রবেশ ফি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলাম আর দু পাশের ভবনগুলো দেখলাম। ভবনগুলোর চমৎকার স্টাকো অলংকরণ ও স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে গেল সারা দেহ মনে।

এখানে এসে আর একটা ব্যাপার অনুধাবন করেছি তা হলো অসভ্যতা প্রদর্শনে আমাদের কোন তুলনা নেই তেমন সীমারেখাও নেই। আমরা আমাদের এমন এক অমূল্য পত্নসম্পদ রক্ষায় মোটেই যত্নশীল নই। সারা পানাম নগরেই অযত্ন অবহেলার ছাপ। নেষেধ সত্বেও তরুণ ছেলেরা দলবেধে ভবনগুলোর ছাদে উঠছে এবং নানা প্রকার ক্ষতি সাধন করছে। দেশি পর্যটকেরা যত্রতত্র প্রসাব করছে, ধূমপান করছে। চারিদিকে চিৎকার চেচামেচি, এমন পরিবেশে যা মোটেই মানানসই নয়। এসব দেখার কেউ নেই, বলারও কেউ নেই। পানাম নগরে একটা শৌচাগার আছে,পকেটের পয়সা ব্যয় করে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করতে হয়। এখানে যদি ভুল করেও একবার ঢোকেন তবে আমি নিশ্চিত পরের দু চারদিন আপনার নাকে গন্ধটা লেগে থাকবে।এসব ব্যাপারেও কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।

অবব্যবস্থাপনার কারণে কিছুটা মন খারাপ করেই ফিরতে হলো পানাম নগর থেকে।তবু বলছি দেশ দেখুন,দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হোন। ঘুরে আসুন পানাম নগর।

আজমত রানা। লেখক ও সাংবাদিক। নিম্নবিত্ত ঘরে জন্ম বলে জন্মের সঠিক দিন তারিখটা তাঁর জানা নেই। লেখাপড়াটাও এগোয়নি ইচ্ছের কমতি আর অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে উত্তরের প্রান্ত শহর ঠাকুরগাঁওয়ে শ্রমিক বাবার ঘরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বয়স আঠার হতেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..