ঘুরে এলাম অষ্টমীর চর

আজমত রানা
ভ্রমণ
Bengali
ঘুরে এলাম অষ্টমীর চর

গত তিন বছর বন্ধু রাজু চরে ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। পাশের দেশ ভারতে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য বশতঃ ভিসা পেলাম না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ক্ষোভে দুঃখে অনেকক্ষন ভিসা অফিসের সামনে বসে ছিলাম। ঠিক এসময়েই রাজুর ফোন – “চলেন চরে ঘুরে আসি”। এবার আর না করলাম না।

যাত্র হলো শুরু……

২নভেম্বর’১৮ সকাল সাড়ে ৬ টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বাহন রাজুর পুরনো গাড়িটা। ওর গাড়িটার বয়স অনেক হলেও বেশ আরামদায়ক, দ্রুত গতিসম্পন্ন এবং তাপানুকুল।

শুরুতেই বিভ্রাট…..

আমাদের সাথে সৈয়দপুর ওয়াপদা মোড়ে যোগ দেবেন লিটলম্যাগ সম্পাদক, প্রখ্যাত আলোকচিত্রি, লেখক, উপস্থাপক রাজা সহিদুল আসলাম। আমরা যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম তখনও রাজা এসে পৌঁছেননি। আমি আর রাজু দু কাপ চায়ের জন্য এ দোকান সে দোকান ঘুরলাম, পেলাম না। অবশেষে রাজা এলেন। তিনজনে যখন গাড়ির কাছে গেলাম তখন তিনজনের মুখ দেখার মতো আকৃতি ধারণ করলো। এ কী অবস্থা ! গাড়ির সামনের বাম পাশের চাকায় বাতাস নেই। কোথায়, কীভাবে কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। রাজু আমাদের নামিয়ে দিয়ে ওভাবেই একটানে চলে গেল টার্মিনালে। শুক্রবার থাকায় কোন গ্যারেজই খোলেনি সেদিন। দোকানের সাটারে লেখা নাম্বার দেখে তিনজনকে ফোন দিলাম, অবশেষে তাদের একজন এলেন। সেখানে গাড়ির চাকা ঠিক করাতেই দেড় ঘন্টা লেগে গেল।

আবার যাত্র শুরু …

রংপুর-কুড়িগ্রাম হয়ে এলাম চিলমারী।

এখানে থানায় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হলো। থানার ওসি সাহেব চকলেট দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। থানা থেকে বের হয়ে ইজি বাইকে চিলমারী বন্দর জোড়গাছ বাজারে এলাম।রাজু বলল, কোন একসময় এ বন্দরে শ খানেক বড় নৌকা আর স্পিডবোড থাকতো। বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। এখান থেকে নানা প্রকার পণ্য, বিশেষ করে পাট নিয়ে যাওয়া হতো দেশের বিভিন্ন পাটকলে।সে বন্দর এখন খা খা করছে। আমরা যখন ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাটে এলাম তখন ১৫টি বড় নৌকা বাধা ঘাটে।এর অর্ধেকই পণ্য ওঠা নামা করছে। আমাদের জন্য আগে থেকেই একটা ইঞ্জিন চালিত ছোট নৌকা ঘাটে বাঁধাই ছিল।আমাদের দেখেই আমিন মামা বাদশা মামা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাজা ভাই নিজ মনে ছবি তুলেই যাচ্ছেন। কখনও মানুষের মুখ কখনও নৌকা আবার কখনও প্রকৃতি। বাদশা মামা তাড়া দিলেন “এবার নৌকায় ওঠো”। নৌকায় ওঠার আগে বাদশা মামা (যিনি নিজ এলাকায় বাদশা বি ডি আর বলে পরিচিত) আমাদের তিনজনকে ডেকে কাছে এনে বললেন “নৌকায় ওঠার পর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তোমাদের সব ক্ষমতা রেখে যেতে হবে, আমি যা বলবো তাই করতে হবে। আমি যা হুকুম করবো তাই মানতে হবে। যদি তোমরা এটা মানতে রাজি থাকো তবেই নৌকায় ওঠো নইলে ফেরত যেতে পারো”। অগত্যা আমরা তাঁর কথা মানতে রাজি হলাম। নৌকা চলতে শুরু করলো।

ত্রিশ মিনিট যাওয়ার পর বাদশা মামাকে জিজ্ঞেস করলাম “মামা আর কতদূর?” মামা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই যে চরটা দেখা যায় ওটাই।

চর আমাদের চোখে পড়েনা। চর চোখে না পড়লেও একটা জিনিস দেখে রাজা ভাই চিৎকার করে উঠলেন “সাপ সাপ”, সবাই সেদিকে তাকালাম। প্রায় ১০হাত লম্বা বিশাল আকৃতির একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে পানিতে ভাসছে। শাহানশাহ (ওর পরিচয়টা পরের কোন পর্বে দেব) নৌকাটা কাছ দিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই বাদশা মামা চিৎকার করে উঠলেন – সাবধান, নৌকা সরাও। নৌকা সরে গেল। মামা বললেন এটা ভারত থেকে ভেসে আসা সাপ। এটার কাছ দিয়ে নৌকা যাওয়ার চেষ্টা করলেই ওটা এক লাফে নৌকায় উঠে যেত। এ সাপ লাফ মারতে পারে। আরো ত্রিশ মিনিট চলার পর একটা রেখা স্পষ্ট হলো। নৌকা সেদিকেই এগুতে শুরু করলো।

আমাদের যারা স্বাগত জানাল

নৌকা থেকে খেয়াল করে দেখলাম একদল শিশু আমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত। শাহানশাহ’র ভাষায় ওরা হল বাহিনী। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সাথে থাকা ব্যাগ নিয়ে যে যার মত হাঁটা দিল। আমরা খালি হাত পায়ে হাঁটছি। আমাদের সামনে বাদশা মামা। কিছুদূর এগুতেই একটা বাড়ির সামনে কিছু নারী শিশুর জটলা চোখে পড়ল। কাছে আসতেই বুঝলাম এঁরা অভ্যর্থনা জানানোর দ্বিতীয় দল। এ দলে আছেন তিন মামী,তাঁদের মেয়ে,ছেলে বৌ। মামীদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হতেই নিয়ে গেলেন ছোট মামা আমিন’র ঘরে। সেখানেই দুপুরের খাবার খেলাম।

অষ্টমীর চর……

কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী থানাধীন একটি ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে অষ্টমীর চর। এর সঠিক আকার বলা মুস্কিল কারণ প্রতিবছরই নতুন চর জেগে এর আয়তন বাড়ছে। আমাদের কুড়িগ্রাম নামের একটি ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে জানা যায়, অষ্টমীর চর ইউনিয়নের আয়তন- ২৮.৯৪ বর্গ কি: মি.মোট ওয়ার্ড ৯টি, মোট জনসংখ্যা= ২৫৮২০ জন নারী: ১২৮১০ জন পুরুষ: ১৩০১০ গ্রামঃ ২৩ টি মোট পরিবার: ৪৮০০ মাদ্রাসা: ৩ টি মসজিদ: ৩১ টি, কবরস্থান: ৬০ টি কমিউনিটি ক্লিনিক ১ টি ,সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ টি, রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫ টি।

আপাততঃ মাইজবাড়ি, ভাসার পাড়া, খামার বাশপাতার, খোর্দ বাশপাতার, খারুভাঞ্জ, গাটিয়ার চর, পূর্ব নয়ার কান্দি, গোয়ালের চর, বড় চর ও নাওমোলা মৌজা নিয়েই এ চর। আমরা ছিলাম মাইজবাড়ি মৌজায়। এ চরটি জেগে ওঠে এখন থেকে আট বছর আগে আর বসতির শুরু হয়েছে ৫ বছর আগে। এ মৌজায় ৯০ ঘর মানুষের বসবাস। এখানকার সবাই মুসলমান। চরে প্রতিটি পরিবারই সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। এখানে একটি স্কুল আছে (নওশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)। স্কুলে ৩জন শিক্ষক আর ১৫০জন শিক্ষার্থী থাকলেও লেখাপড়ার মান নিয়ে কেউ সন্তুষ্ট নন। অনেক শিশুই নৌকায় পাশের চরে কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়, কোদালকাটি গার্লস স্কুল ও কড়াই বরিশাল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যায়। কিছু কিছু শিশু ফ্রেন্ডসিপ স্কুলেও পড়তে যায়। এখানে বাল্য বিয়ের হার খুব বেশি। কোন চিকিৎসা কেন্দ্র বা ওষুধের দোকানও নেই। এলাকার কৃষকদের তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বা কেনাকাটা করতে যেতে হয় চিলমারী অথবা রাজিবপুর। সপ্তাহে দু দিন অর্থাৎ রবি ও বুধবার দুটো বড় নৌকা চিলমারীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সে দুটোই আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এর আগে পারে কেউ কোন দরকারে চিলমারী যেতে চাইলে নিজ নৌকা ব্যবহার করতে হবে।

সারা বছরই বিভিন্ন প্রকার মাছ খুব কম দামে পাওয়া গেলেও মাংস এখানে পাওয়া যায়না। নিজ বাড়িতে পোশা মুরগিই মাংসের ভরসা। সবচে অবাক করা ঘটনা হলো এ চরে কোন মশা নেই! মাইজবাড়ির লোকেরা কখনও মামলা মোকদ্দমায় জড়ায়না। কোন সমস্যা থাকলে তা নিজেরাই বসে মিটিয়ে নেন। তারা ইউনিয়ন পরিষদেও কখনও যান না। কোন রাজনৈতিক বাক বিতন্ডা কিংবা হানাহানি নেই। যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কেউ কাউকে কোন ব্যাপারে বাধ্য করেন না। চরের ভেতরে যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনের একমাত্র বাহন ঘোড়া।

এখানে কোন পাকা বাড়ি অথবা সড়ক নেই। মানুষ হেঁটে যে পথ তৈরি করেন সেটাই রাস্তা।প্রধান উৎপাদিত কৃষিপণ্য হচ্ছে ধান, পাট, ডাল, কাউন, তিল তিশি, ভুট্টা ও বাদাম।ওরা মজা করে বলেন “ আমাদের বারো মাসে তের ফসল”। পুরো চরেই প্রচুর কলাগাছ। কোন যত্ন ছাড়াই প্রচুর ফল দিচ্ছে সেসব গাছ। দু চারটা ছোট আমগাছ চোখে পড়লেও কাঁঠাল বা লিচু গাছ চোখে পড়েনি।

চরের শাহানশাহ (ছবি-৬)

রাজত্ব নেই, সিংহাসন নেই, সভাসদ নেই, এমনকি নেই কোন সেনাপতি কিংবা পাইক বরকন্দাজ তবু সে শাহানশাহ। তার পরিচয় অষ্টমীর চরের শাহানশাহ। এমন এক শাহানশাহ’র কথাই আজ শোনাবো আপনাদের।

তারসাথে আমার প্রথম দেখা,পরিচয় চিলমারীর বন্দরে। ও নৌকা নিয়ে এসেছিল আমাদের এগিয়ে নিতে। আমাদের দেখেই এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে অনেকটা জোর করেই আমাদের ব্যাগ নিজের কাধে উঠিয়ে নিল। মাথাটা ঘুরিয়ে বলল – আমি শাহানশাহ।

ছেলেটার বয়স কত হবে, খুব জোর ২৫/২৬। টকটকে ফর্সা ছেলেটা রোদে পুড়ে যে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে তা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। অষ্টমীর চরের মাইজবাড়ি মৌজার মজনু মিয়ার ছেলে এই শাহানশাহ। চরের প্রতিকুল পরিবেশে লেখাপড়াটা এগুতে পারেনি বেশিদূর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা কাগুজে শিক্ষা কম থাকলেও শাহানশাহ’র গুণের কোন অভাব নেই। সারা অষ্টমীর চর এক নামেই ওকে চেনে।

মাইজবাড়িতে আমার থাকার জায়গা হয়েছিল শাহানশাহর কক্ষে।ঘরে ঢুকেই প্রথমে একটা ধাক্কা খেলাম। বিছানার পাশেই টেবিলে রাখা একটা কিবোর্ড। এমন দুর্গম চরের ভাঙ্গা ঘরে আধুনিক যন্ত্র কে বাজায়? মনের প্রশ্ন মনেই রাখলাম। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শুতে যাবো ঠিক তখনি শাহানশাহ বলে উঠলো “রাতে তো ঘুমোতে দিবনা, পিঠা খাবেন আর গান শুনবেন”। ওর কথায় আমি এবং রাজা ভাই কিছুটা অবাকই হলাম। রাজু শুধু মুখ টিপে হাসছে (রাজু আগেও যেহেতু এসেছে তাই তার সব জানা)। আমি বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম কে গান গাইবে ? শাহানশাহ লাজুক ভঙ্গিতে বললো “ আমি এক আধটু গাওয়ার চেষ্টা করি”।

ঘরে সৌর বিদ্যুতের আলো। আমরা আধাশোয়া অবস্থায়। শাহানশাহ কীবোর্ডে হাত দিল। নিজ মনে একের পর এক লোকগীতি গেয়েই চলছে। আমাদের চোখ থেকে সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেছে। ঘুম চলে গেছে দূরে কোথাও। গানের বিরতিতে ঘরে ঢুকলেন শাহানশাহ’র মা (আমরা যাঁকে মামী বলে ডাকি)। হাতের থালায় অনেকগুলো তেল পিঠা। আমার এবং রাজুর মিষ্টি খাওয়া নিষেধ,তবু এদিন কিছুই মানলাম না। পিঠা পর্ব শেষ হতেই আবার গান শুরু হলো। এবার আমাদের পছন্দের গান। রাত আরও গভীর হলে শাহানশাহ বললো এখন ঘুমোন।

শাহানশাহ আজমেরি, এটাই ওর পুরো নাম।মজনু মিয়ার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় শাহানশাহ। ওর ছোট আরো দুটো ভাই আছে। ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য স্বভাবের। চাষাবাদ কিংবা সংসারের প্রতি অন্য দশ জনের মতো তেমন ঝোঁক নেই। কিছুটা বাউন্ডুলে স্বভাব বলা যায়। যেখানেই গান বাজনা,নাটক যাত্রা সেখানেই ছুটে যায় এজন্যই আর দশজনের চে একটু আলাদা করেই চেনা যায়। তার পরিবার শাহানশাহর এমন স্বভাবকে কখনই খারাপ চোখে দেখেনি বরং বরাবরই উৎসাহ দিয়ে গেছেন। দেবেই না বা কেন;স্বভাবটা তো পুরোপুরি পরিবার থেকেই পেয়েছে। ওর দাদা,বাবা,চাচা সবাই গান গাইতেন। নিজেদের বাড়িতেই বসতো গানের আসর। তাই দেখে শাহানশাহ সেই ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি আগ্রহ জন্মে। উলিপুর গিয়ে ওস্তাদ আবুল কালাম আযাদ’র কাছে প্রথম আনুষ্ঠানিক

গান শেখা শুরু করেন। এরপর বাড়িতে বাবা মজনু মিয়া আর চাচা বাদশা মিয়ার কাছে গান শেখেন। সবশেষ ওস্তাদ মনিরুজ্জামানের কাছেও গান শেখেন। লোক সংগীতের প্রতি ঝোঁক থাকলেও স্টেজ প্রোগ্রামে আধুনিক গানও গান। চিলমারী কমিউনিটি রেডিওতে নিয়মিতই গানের প্রোগ্রাম করেন। এখানেই শেষ নয়। আরো অবাক হই তখন, যখন দেখি ওই চর থেকেই সে একটি ইউ টিউব চ্যানেল চালান। “শিখা ভিশন” নামের ওই চ্যানেলে গ্রাম বাংলার অবহেলিত সংগীত শিল্পী, নানা রকম প্রতিভা, নিজেদের করা সমাজ সেবা ও সচেতনতা মূলক ভিডিও ধারণ করে তা ওই চ্যানেলে আপলোড দিয়ে থাকেন। চ্যনেলটির ভিউয়ার ইতোমধ্যে লাখ ছাড়িয়ে গেছে। শাহানশাহ কথা বললে ও জানায়, “আমি মনে প্রাণে একজন শিল্পী। গান আমাকে মোহাবিষ্ঠ করে রাখে। আমি শুধু গান গাওয়ার জন্য সুযোগ চাই”।

আগেই লেখাতেই উল্লেখ করেছিলাম যে, অষ্টমীর চরের অনেকগুলো মৌজাতেই ডাক্তার নেই,ওষুধের দোকান নেই,হাসপাতাল নেই। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে স্রষ্টাকে ডাকা আর নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয় ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। শাহানশাহর এক বোন এমনি ভাবে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে চিলমারী আনার সময় নদীতেই মারা যায় সে। ব্যাপারটা শাহানশাহর পরিবারে এখনও দগদগে ঘায়ের মতো কষ্ট দিয়ে চলে। শহরে ছয়মাস থেকে ধাত্রী বিদ্যা শিখেছে। ওর হাত দিয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন চরের প্রায় ৩শ ৫০জন শিশু আলোর মুখ দেখেছে। ও নিজ বাড়ির পাশেই একটা ওষুধের দোকান দিয়েছে। খুব সাধারণ কিন্তু জরুরী কিছু ওষুধ রাখা আছে। রক্তচাপ মাপার একটা যন্ত্র কিনে নিজের কাছে রেখেছে। যখন যেখানে ডাক আসে অমনি ছুটে যায়। কেউ কেউ ওর বাড়িতে আসে রক্তচাপ মাপাতে। কেউ কেউ দু চার টাকা দেন কেউ এমনিতেই চলে যায়,তা নিয়ে অবশ্য শাহানশাহর কোন আক্ষেপ নেই। কারো উপকার হচ্ছে এটাই বড় কথা।

আমাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে অনগ্রসর চরাঞ্চলের এক তরুণ সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায় যতটুকু উঠে এসেছেন, মানুষের জন্য যা করছেন তা আমাদের এই আলো ঝলমলে শহুরে পরিবেশে অনেকের দ্বারাই করা অসম্ভব। শাহানশাহর মতো তরুণদের উঠিয়ে এনে সামান্য একটু পরিচর্যা করতে পারলেই শেকড়ের সাথে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সুদৃঢ় হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ফিরে আসার পালা…..

এ চরে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। যেন সবাই মিলে একটা পরিবার। বাদশা মামা বললেন এভাবেইতো আমরা সব বিপদ মোকাবেলা করে টিকে থাকি। দুটো দিন ছিলাম এখানে,বাদশা মামার পরিবার এবং চরের মানুষেরা এতটাই আপন করে নিয়েছিল যে, ফিরে আসার সময় চোখ ভিজেছিল তাদের এবং আমাদের।

(ছবি-৭)

রবিবার, আজ দুটো ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা ছেড়ে যাবে চর। আমরা নৌকায় গিয়ে উঠলাম। একঘন্টায় পৌঁছলাম চিলমারী। সেখান থেকে থানায় গিয়ে গাড়ি নিয়ে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। কুড়িগ্রামে রফিকুল ইসলাম সেলিম সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। তিনি সদ্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক থেকে ডি ডি এল জি হয়েছেন। সেলিম সাহেব ঠাকুরগাঁওয়েই লেখাপড়া করেছেন। তাঁর ঘরে আমাদের ঠাকুরগাঁওয়েরই এক বোন কাকলী আছে। ভাইদের অনেকদিন পর কাছে পেয়ে কাকলী আমাদের গলা পর্যন্ত খাইয়ে ছেড়েছে। সেলিম সাহেব এবং কাকলীর আতিথিয়তার স্মৃতি ওদের ভুলতে দেবেনা। রওয়ানা হলাম ঠাকুরগাঁওয়ের উদ্দেশে…

দেশ দেখুন…

(ছবি -৮)

সময় সুযোগ পেলে অবশ্যই দেশের বাইরে যাবেন। তবে অনুরোধ থাকবে কর্মব্যস্ত সময়ের মধ্যে একটু সময় যদি বের করতে পারেন তবে বাংলাদেশটাই আগে দেখুন। হর্ন, ভেঁপু, কোলাহল আর কৃত্তিমতার বাইরে এক বাংলাদেশ আছে যা আমাদের অনেকের নজরেই পড়েনি। সে বাংলাদেশের মানুষেরা দলবদ্ধ, কঠোর সংগ্রামী, মাটির মত হৃদয়। কৃত্তিম রঙ রুপ নেই। যা আছে তা হলে অপরূপ এক প্রকৃতি। একবার সে রূপ দেখলে আর কখনই চোখ ফেরাতে পারবেন না।

আজমত রানা। লেখক ও সাংবাদিক। নিম্নবিত্ত ঘরে জন্ম বলে জন্মের সঠিক দিন তারিখটা তাঁর জানা নেই। লেখাপড়াটাও এগোয়নি ইচ্ছের কমতি আর অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে উত্তরের প্রান্ত শহর ঠাকুরগাঁওয়ে শ্রমিক বাবার ঘরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বয়স আঠার হতেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..