ঘুরে এলাম বার্লিন

গোলাম কবির
ভ্রমণ
ঘুরে এলাম বার্লিন

বাংলাদেশের ‘তেল গ্যাস জাতীয় সম্পদ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ যুক্তরাজ্য শাখার উদ্যোগে ‘সুন্দরবন বাঁচাও, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ কর‘ শিরোনামে গত ১৯ আগস্ট ২০১৭ জার্মানির বার্লিন শহরের কেন্দ্রস্থলে গ্রেইফসওয়াল্ডে স্ট্রিটে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কেন্দ্র’তে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ২ দিন ব্যাপি এক সেমিনার।

যুক্তরাজ্য কমিটির সদস্য হিসেবে সেই সেমিনারে অংশগ্রহণের উদ্দেশে আমি লন্ডন থেকে দু’দিন আগেই ১৭ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটায় বার্লিনের পথে যাত্রা করি।

প্রায় দুই মাস আগেই অনলাইনে রায়ান এয়ারের টিকেট করেছিলাম ১৭ থেকে ২৪ আগস্ট ৮ দিনের সফরের জন্য। তাতে মাত্র ৬৭ পাউন্ড লেগেছিলো রিটার্ন টিকেটে।

আমার বাসা ইস্ট লন্ডনের বো চার্চের পাশেই। পূর্বে কেটে নেয়া ন্যাশনাল এক্সপ্রেস বাসের অনলাইন টিকেট নিয়ে ৫:৪০ এ আমার বাসার পাশেই বোচার্চ স্টপেজ থেকে উঠেছিলাম স্টানস্টেড এয়ারপোর্টের বাসে।

ইতোমধ্যে বার্লিন প্রবাসি নির্বাসিত কবি ব্লগার লেখক জোবায়েন সন্ধির সাথেই এই সেমিনার নিয়ে নানাবিধ যোগাযোগের প্রেক্ষিতে আমার সন্ধি হয়েছিল যে, আমার এবং বাংলাদেশ থেকে আগত সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের অভ্যর্থনা ও দেখশোনের দায়িত্ব তিনি নেবেন। যদিও সেমিনার উদ্যোক্তাদের অন্যতম বাবুল সৈয়দ আমাকে অনলাইনে আস্বস্ত করেছিলেন যে তারা আমার থাকার ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন।

আমি এর আগে জার্মানিতে আরেকবার গিয়েছিলাম ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেটা ছিলো বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ইউরোপিয় কাউন্সিল অধিবেশন। উদীচী যুক্তরাজ্য থেকে আমি ও উদীচী সভাপতি গোলাম মোস্তফা সেই কাউন্সিলে গিয়েছিলাম ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরে লিখেছিলাম ‘ঘুরে এলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট ‘।  তখন আমার সঙ্গি ছিলেন লন্ডনের লেখক সাংবাদিক ইসহাক কাজল এবং ভাষা গবেষক লেখক শওকত আলী খন্দকার। আমাদের অনলাইন টিকেট করা ছিল রায়ান এয়ারে। শ্রদ্ধেয় লেখক সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং লন্ডনের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মোস্তফা গিয়েছিলেন ব্রিটিশ এয়ারে। তাই সফরসঙ্গি হতে পারিনি। তবে পরদিন অন্য হোটেলে গিয়ে তাদের সাথেই গিয়েছিলাম অনুষ্ঠান কেন্দ্রে। সে সময় বুঝেছিলাম জার্মানিরা ইংরেজি জানেনা, তাদের ভাষা বুঝে সফর তাই খুব মসৃণ নয়। সেকারণেই সন্ধির সাথে সন্ধি করা আরো গরজের। কিন্তু- তা পরে বলছি!

৫০ মিনিটের মধ্যেই স্টানস্টেড বিমানবন্দরে পৌছুলাম। চেক ইন, বোর্ডিং পাস আগেভাগেই করে নেয়া, তাই নিশ্চিন্তে সাথে নেয়া নাস্তা সেরে নিলাম।

ব্রেক্সিট (ব্রিটেনের ইউরোপিয় ইউনিয়ন ত্যাগ) এর পর এই প্রথম ইউরোপের অন্য দেশে যাওয়া, তাই ভিসার বিষয়ে দোদুল্যমানতায় ছিলাম। কিন্তু না, যেহেতু ব্রেক্সিট কার্যকরী হতে আরো লম্বা সময় বাকি সেহেতু আমাদের ব্রিটিশ পাসপোর্টে ভিসার প্রয়োজন পড়েনি। তবে ইমিগ্রেশন পার হতে যথানিয়মিত বিশাল দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে জ্যাকেট, বেল্ট, ক্যাপ এবং লাগেজ নিরাপত্তা চেকিং-এর ট্রেতে দিয়ে নিরাপত্তা ব্যুহ পার হয়ে রায়ান বিমানে উঠলাম অবশেষে।

রায়ান এয়ার প্রায়ই বিলম্ব করে। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। কাজেই বিলম্বে পৌছুলাম বার্লিনের সোনেফিল্ড বিমানবন্দরে। ল্যান্ড করার সাথে সাথেই মোবাইল ফোনের রোমিং অন করলাম। কিন্তু জটিলতা দেখা দিল যদিও ফোন কোম্পানি ইই’র সাথে আমি পূর্বাহ্নেই চুক্তি করে রেখেছিলাম। যোগাযোগ হচ্ছিলনা সন্ধির সাথে। তবে ইমিগ্রেসন পেরিয়ে বেরুনোর সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম জোবায়েন সন্ধিকে। সে খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো বিলম্বের কারণে। যেহেতু বেলা ২টার সময় বাংলাদেশ থেকে কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স এসে নামবেন অন্য আরেকটি এয়ারপোর্ট ‘টেগেল’-এ।

আমরা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সাড়ে সাত ইউরো দিয়ে আমার জন্য সারাদিনের একটি ট্রান্সপোর্টেসন টিকেট কিনে সিটি ট্রেনে (জার্মান ভাষায় এস বান, S-Bahn) চড়ে সন্ধির বাড়ি গেজুন্ডব্রুনেন স্টেশনে নামলাম। ঐ স্টেশনের পাশেই ৫ মিনিটের হাটা পথ জোবায়েন সন্ধির এপার্টমেন্ট।

সন্ধি মাত্র ১০ মাস হলো ইন্ডিয়া (২০১৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল) থেকে এসেছে বার্লিন। কাজেই এখনও জার্মান ভাষা আয়ত্ব করতে পারেনি। তবুও ইতোমধ্যে যেটুকু মোটামুটি প্রয়োজন ততটুকু জেনেছে। তাই দিয়ে খুব দ্রুতই সে চলাচল করতে পারছে।

সন্ধির বাসায় পরিচয় হলো তার স্ত্রী, ছেলে অথৈ এবং মেয়ে অপূর্বর সাথে। আমরা দ্রুত নাস্তা সেরেই আবার বেরিয়ে পড়লাম ট্যাগেল এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। অল্প সময়েই পৌছে গেলাম সেখানে। ততক্ষণে কমরেড প্রিন্সের বিমান ল্যান্ড করেছে।

অবশেষে কমরেড প্রিন্সকে নিতে গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে এলো মামুন আহসান খান। জানতাম তার নাম। যুক্ত আছে ফেইসবুকে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন সভাপতি কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খানের ছোট ভাই সে। তার গাড়িতে উঠলাম আমরা ৩ জন। প্রিন্সের জন্য নির্ধারিত থাকার জায়গা ছিলো বার্লিন প্রবাসি রেস্টুরারিয়ান, এক বাম নেতার রেস্টুরেন্ট।  তিনি তার রেস্টুরেন্ট কুক্কুস এর উপরের তালায় থাকেন। যেখানে আরো উঠেছেন বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যেই বার্লিনে আসা প্রখ্যাত বাম নেতা গণতান্ত্রিক সংহতি আন্দোলনের প্রধান জুনায়েদ সাকি। সেদিনই তার সাথে হলো প্রথম পরিচয়। কমরেড প্রিন্সকে সেখানে তুলে দিয়ে আমি এবং সন্ধি বেরিয়ে আসলাম শহরে। আলেকজান্ডার প্লাজ নামে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি চমৎকার জায়গায় কাটালাম অনেকক্ষণ, যেটাকে অনেকটা আমাদের লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারের পরিবেশের সাথে তুলনা করা যায়। ঐ স্থানের সকল স্থাপত্য রাশিয়ান সময়ের গড়া। তাই মূল বার্লিনের থেকে একটু ব্যতিক্রমি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী যদিও আমাদের মূল অনুষ্ঠান ১৯ ও ২০ তারিখ কিন্তু সংগঠনের যুক্তরাজ্য আহ্বায়ক ডা: মোকলেসুর রহমান মুকুল ভাই এবং তাঁর স্ত্রী জাহানারা রহমান জলি ভাবি ১৬ তারিখেই বার্লিনে যান এবং একটি হোটেলে উঠেন তাঁদের পরিকল্পনানুযায়ি। ১৮ তারিখে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসার আনু মোহাম্মদ এবং তাঁর টিম এসে ওঠেন কুক্কুস রেষ্টুরেন্টের উপর তালায়। যুক্তরাজ্য কমিটির সদস্য সচিব মোস্তফা ফারুক এবং প্রাক্তন সদস্য সচিব আকতার সোবাহান মাসরুর সস্ত্রীক ওঠেন পৃথক আরেকটি হোটেলে।

সারাদিন পর ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে আবার সন্ধির সাথে ফিরলাম গেজুন্ডব্রুনেন সেন্টারে তার এাপার্টমেন্টে। দুই বেড এবং বিশাল ড্রয়িং রুম। আমাদের লন্ডনের তুলনায় রুমগুলো অনেক বড়। কিচেন কাম ডাইনিং রুমে ডিনার সেরে সে রাতের মতো এলিয়ে পড়লাম নিদ্রার কোলে।

দুই

পরদিন ১৮ জুলাই ২০১৭ শুক্রবার।  পরিকল্পনা মতো বার্লিন শহরের প্রায় ৫০ মাইল দূর মোগেলহাইম থেকে ড্রাইভ করে আসলেন বার্লিন প্রবাসী লেখক সাংবাদিক মির মোনাজ হক। তার গাড়িতে উঠলাম আমি এবং সন্ধি। সেখান থেকে সেই কুক্কুস রেস্টুরেন্টে গিয়ে তুলে নিলাম কমরেড প্রিন্সকে। সেদিন আমরা প্রথমেই দেখতে গেলাম বার্লিন প্রাচীরের অংশবিশেষ। পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনকে বিভক্ত করার জন্য সেই সোভিয়েত সময়ে তোলা হয়েছিলো যে প্রাচীর তা বিভক্ত করেছিলো পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনকে।  স্প্রে নদীর তীর ঘেঁষে স্থাপিত হয়েছিলো সেই ঐতিহাসিক প্রাচীর। সোভিয়েতের পতনের পূর্ব মূহুর্তে আশির দশকের শেষ প্রান্তে দুই জার্মানীর একত্রিকরণে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো প্রাচীর। ঐ প্রাচীরের গায়ে পশ্চিম্মুখী দিকে বড় বড় শিল্পীদের আঁকা চিত্র ছিলো। প্রাচীর ভাঙ্গার সময় সে সব চিত্রকর্ম রক্ষণের জন্য দেয়ালের কিছু কিছু অংশ তখন না ভেঙ্গে রেখে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই অংশগুলোকে তুলে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল পূর্বমুখী করে এবং একালের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পী অংকন করেছিলেন বিখ্যাত কিছু দেয়াল-চিত্র।

নদীর পাশেই সেই দেয়াল দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। আমি, কমরেড প্রিন্স, লেখক সাংবাদিক মীর মোনাজ হক এবং ব্লগার লেখক জোবায়েন সন্ধি। বেশ কিছু ছবি তুললাম আমরা। ঐ সমগ্র এলাকাটি বার্লিনের তথা জার্মানীর ঐতিহ্য ঘোষণা করে এখন যা পর্যটকদের আকর্ষণের এক প্রসিদ্ধ স্থান।

১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মান (জিডিআর) ঘোষণার পর যাতে পশ্চিম জার্মানের মানুষ পূর্ব বার্লিনে না ঢুকতে পারে সেই লক্ষ্যেই পূর্ব বার্লিন ঐ প্রাচীর তুলেছিল। সোভিয়েতের পতন প্রাক্কালে ১৯৮৯ এর ৯ নভেম্বর মধ্য রাতে হ্যামার, বুলড্রজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিলো সেই ঐতিহাসিক দেয়াল। লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমেছিলো রাস্তায় সেই প্রাচীর ভাঙার আনন্দে উল্লাসে। সেই সাথে সমাপ্ত হয়েছিলো দুই জার্মানের দীর্ঘ দিনের ঠান্ডা লড়াইয়ের। কাঠঠোকরার মত দেয়াল ভঙ্গকারিদের তখন উপাধি হয়ে গিয়েছিল ওয়ালপ্যাকার্স নামে (জার্মান ভাষায় মোয়ার্স্পেসতে)।

দেয়াল ভাঙার পরপরই কিন্তু পূর্ব জার্মানের মানুষ পশ্চিম জার্মানে অবাধ যাতায়ত শুরু করেনি। কারন অফিসিয়ালি দলিল দস্তাবেজ আইন কানুন ইত্যাদি চূড়ান্ত করতে  প্রায় এক বছর সময় লেগেছিল। ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর হয়েছিলো মূল মিলন উৎসব। মনে পড়ে গেলো ব্রেক্সিট এর কারণে ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে আমাদের (বৃটেনের) বিচ্ছিন্ন হতে সময় লেগে যাবে ৩ বছর! একত্রিত হতে সময় লাগেনি এক বছরও, কিন্তু বিযুক্তিতে লাগবে দীর্ঘ সময়!

যাই হোক, তার পর থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার দেশী বিদেশী দর্শনার্থীদের সমাগম হয় দুই বার্লিনের এই দেয়ালের সাক্ষী ভগ্নাবশেষ দেখার জন্য, যা রক্ষণ করা হয়েছে সেই সমান জায়গাতেই। তার পাশেই বইছে শান্ত নদি স্প্রে। আরেক পাশে পূর্ববার্লিন ট্রেন স্টেশন এবং তার পাশেই স্প্রে নদিবক্ষে নির্মিত বিশাল কারুকার্যময় ব্রিজ। এসবই কালের সাক্ষী হয়ে জার্মান ইতিহাসের নির্দেশন দিচ্ছে উৎসুক দর্শনার্থীদের। আমরাও উপভোগ করেছিলাম মন ভরে।

মীর মোনাজ হক দীর্ঘকাল থেকে জার্মানে আছেন, তাই তার অভিজ্ঞতার আলোকে একরকম প্রায় ধারা বিবরণীর মতোই তিনি বলে যাচ্ছিলেন এ’সব ইতিহাস। ফলে আমাদের যেমন হচ্ছিলো দেখা, তেমনি হচ্ছিলো জানা।

দুপুরে অন্যত্র এক টার্কিশ ডোনারের দোকানে হলো আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজ। গরুর মাংসের ডোনার তান্দুর রুটিতে ভরে চমৎকার সাদের ডোনার বার্গার তার সাথে বার্লিনের জনপ্রিয় ইয়াগট ড্রিং। অতুলনীয়। লন্ডনে আমরা যে ডোনার খেয়ে থাকি এটা তার চাইতেও মজাদার।

এরপর আমরা আবার মোনাজ ভাইয়ের কারে চেপে চলে গেলাম আলেকজান্ড্রা প্লাজে। সেখানে হেটে হেটে এটা ওটা দেখার এক পর্যায়ে মোনাজ হকের স্মরণে এলো যে পাশেই কোথাও পার্কের এক স্থানে পাশাপাশি আছে কার্ল মার্ক্স এবং ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বড় দুটি ভাস্কর্য। বেশ খানিকটা খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলো। আমরা ভাস্কর্য দুটির সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি উঠাচ্ছিলাম যখন তখন এক দল চৈনিক টুরিস্ট এলেন সেখানে। তারাও উঠলেন ছবি। কথায় কথায় জানা গেলো ওরা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক।

ইতোমধ্যেই অনেকটা কাকতালিয়ভাবে ওখানে এসে গেলেন ডা: মোকলেছুর রহমান এবং তার স্ত্রী মিসেস জাহানারা রহমান জলি ভাবি। উনারা ওখানেই কাছাকাছি একটা হোটেলে উঠেছেন। কাজেই আরো জমে উঠলো আমাদের হৈচৈ। সকলে মিলে যখন গ্রুপ ছবি উঠছিলাম তখন লম্বামত এক দাড়ি মোচ ওয়ালা সাদা আদমি আমাদের উদ্দেশ্য করে বকাবকি শুরু করে দিল! তার বকাবকির কারণ হলো ঐ মার্ক্স লেনিনরা লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে, তোমরা তাকে নিয়ে ছবি উঠছো। তার ইংরেজি আমি পুরোপুরি বুঝে উঠার আগেই ড. মোকলেছুর রহমমান মুকুলভাই ক্ষেপে গেলেন তার উপর। বকাবকির এক পর্যায়ে জানা গেলো লোকটি আমেরিকান জুইস এবং সে তার বুকের ভিতর থেকে চেইন বের করে ক্রুশটি দেখিয়ে বলেওছিল যে সে জুইস, এটা তার গর্ব!

মিসেস মুকুল অর্থাৎ জাহানারা রহমান জলি ভাবি তখন ধমক দিয়েই বললেন – তাহলেতো হিটলার ভালোই করেছিলো, তোমাকে দেখে আমার অন্তত: তাই মনে হচ্ছে এখন। নিশ্চয়ই তোমরা তখন তেমন কিছু খারাপ করেছিলে, তাই তোমাদের লোকদের হিটলার ওভাবে মেরেছিলো। আই স্যালুট হিটলার। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন ঐ আমেরিকান জুইস এক বাঙালি রমণীর এমন কথা শুনে।

সেই সাথে মোনাজ ভাই যখন বললেন: আমি জার্মান, দীর্ঘদিন থেকেই আছি এই দেশে। তুমি রেসিস্ট মানসিকতায় এখানে এখন যে’সব কথা বলছো তাতে পুলিশকে জানালে এখনই পুলিশ ছুটে আসবে।

সম্ভবত: জুইস ঐ লোকটি বুঝতে পারছিলেন মোনাজ হকের উষ্মা। তাই পরাজিত কুকুরের মত তিনি লেজ গুটিয়ে সরে গেলেন সেখান থেকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। এর মধ্যে আমি ভাবছিলাম আমার লাগেজতো মোনাজ ভাইয়ের গাড়িতে। রাতে কনফারেন্স হলে যাবার পর সিদ্ধান্ত হবে আমার থাকার জায়গা। সেমিনার উদ্যোক্তাদের অন্যতম একজন বাবুল সৈয়দ সে’রকমই বলে আসছিলেন পূর্ব থেকেই। অবশ্য মনে মনে ভরসাও ছিলো কিছু ব্যবস্থা না হলে অবশেষে মোনাজ ভাইয়ের বাসাতো আছেই, যদিও উনার বাসা বার্লিন শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে প্রায়।

মুকুল ভাই এবং ভাবি বললেন তাদের হোটেল পাশেই, আপাতত: আমরা ওখানেই যাই। সেখান থেকে পরে সেমিনার স্থলে যাওয়া যাবে। তাই হলো। ওদিকে আকাশে খানিকটা মেঘ দেখা গেল। হোটেলটি একটি সুরম্য ইউনিভার্সিটির পাশেই। আন্তর্জাতিক মানের তারকা হোটেল। দেড়মাস আগেই মুকুল ভাই হোটেলকক্ষ বুক করিয়ে রেখেছিলেন। ইউরোপে এটা একটা মজার ব্যাপার। কিছুদিন আগে বুক করে রাখলে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। আমি যে’বার ফ্রাঙ্কফুর্ট গিয়েছিলাম সেবার অনেক কম দামে ৫ দিনের হোটেল বুক করেছিলাম প্রিমিয়ার ইন-এ। এমনকি সকালের নাস্তাও পেয়েছিলাম, যদিও শর্তে তা ছিলনা! ইউনিভার্সিটির পাশে আসতেই হালকা বৃষ্টি পড়া শুরু হলে আমরা হোটেলের লাউঞ্জে গিয়ে উঠলাম।

পরে সেমিনার যে হলে হবার কথা সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেলোনা। পাশেই একটি চাইনিজ রেষ্টুরেন্টের সম্মুখ থেকে বাবুল সৈয়দ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

রেষ্টুরেন্টে ঢুকেই দেখলাম প্রফেসার আনু মোহাম্মদ এবং তার সাথে আগতদের। মামুনও ছিল সেখানে। আরো ছিলেন উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ। উদ্যোক্তারা আমাদের ডিনার ওখানেই আয়োজন করেছেন। ডিনারের মাঝখানে এক ফাঁকে বুঝতে পারলাম আমার থাকার বিষয়টা খানিকটা জটিলতায় আছে। অবশেষে মির মোনাজের গ্রামের বাড়ীতেই থাকতে হবে বুঝতে পারলাম।

সকালে সেমিনারে যোগ দিতে হলে আমাদের আর বিলম্ব করা ঠিক হবেনা, তাই রুহিন হোসেন প্রিন্সকে নিয়ে আমরা কুক্কুস রেস্টুরেন্টে গিয়ে তাকে নামিয়ে যাত্রা করলাম মোনাজ ভাইয়ের গ্রাম মোগেলহাইমে। আলো ঝলমল মটরওয়ে পার হয়ে আমরা যখন মোগেলহাইম এলাকায় পড়লাম তখন বেশ অন্ধকারেও বুঝতেছিলাম রাস্তার দু’পাশে আকাশ ছোঁয়া সেগুনের বন। একসময় একটা শিয়ালকে দেখলাম সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেলো ডান থেকে বামে।

প্রায় ৫০ কিলোমিটার ড্রাইভের পর পৌছুলাম মোনাজ হকের বাড়িতে। রাত হয়ে গিয়েছিলো বেশ। তবুও যেটুকু বুঝেছিলাম তখন মনে হয়েছিল জায়গাটা বাংলাদেশের শহরতলির মতো। বেশ নির্জন। থমথমে। রাস্তায় লাইট পোস্ট আছে ঘন ঘন। তথাপি কেমন যেন আলো আঁধারী!

চমৎকার একটি বাড়ি। বাঁ পাশে একটা দ্বিতল বাসা। ওটা পেরিয়ে একটি বাংলো টাইপ দোতালার পাশ দিয়ে যখন অনেকটা পা টিপে টিপে হাটছিলাম তখন বেশ অন্ধকার। কিন্তু না। হঠাৎ বাতি জ্বলে উঠলো। ঐ বাংলোটাতে থাকেন বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা এবং তাঁর স্ত্রী। গেট দিয়ে যখন ঢুকেছিলাম তখন আমার হুইল সূটকেসটা নিজের হাতে নিলেন মোনাজ ভাই এবং হিশ হিশ করে বলেছিলেন যেহেতু রাত বেশি হয়েছে ওদের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে, তাই উচ্চ কন্ঠে যেনো কথা না বলি।

বাংলোটার ওপাশেই বাংলো সংলগ্ন একটি সুন্দর স্টুডিও ফ্লাট, যেটাতে মির মোনাজ হক একাই বাস করছেন বেশ কিছুদিন যাবত। সামনেই রয়েছে ফুলের বাগান। বাগানের মধ্যে স্থানে স্থানে আছে সাদা সাদা পরীর ভাস্কর্য। মাঝখানে আছে একটা টেবিল যার চার পাশে আছে চেয়ার। বাগানের শেষ প্রান্তে ঘন সেগুন বন। সেই বন অনেক বিস্তৃত। সোজা কথায় বলা যায় মোনাজ ভাই বনবাসেই আছেন যেনো!

চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে আমার খাওয়াটা তখন সুবিধার হয়নি। মোনাজ ভাই দুটো বন রুটি দিলেন ওভেনে। বাটার পনির জেলি দিয়ে খেলাম। তারপর নিয়মিত ঔষধ খাবার পালা। দুটো মেটফরমিন গেলার পর বদ অভ্যাসটা মাথাচারা দিলো। ধুমপান। কিন্তু যখন ভাবলাম বাইরে দরজার ওপারে যাওয়া মানেই থমথমে নির্জনতা, অন্ধকার এবং একেবারেই নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা। রাত গভীর। মনে পড়ে গেল শিয়ালের সন্ত্রস্ত ছুটছুটি। তার চেয়েও হিংস্র জন্তু থাকতেই পারে। মোনাজ হক অধুমপায়ি। তাই খানিকটা জড়তাও লাগছিলো। তবু জিজ্ঞেস করলাম দরোজার ওপাশে বাগানে দাঁড়িয়ে ধুমপানটা সারা যায় কিনা। তিনি সায় দিলেন। দরোজা খুলতেই হালকা শিত এবং ভারি অন্ধকারে আক্রান্ত হলাম। সিগারেট ধরিয়ে ভাবিছিলাম ২০১৪ তে ফ্রাংকফুর্ট যাবার পূর্বে প্রিয় নাতি ইশালকে কথা দিয়েছিলাম জার্মান থেকে ফেরার পর আর স্মোক করবোনা। কিন্তু আদরের নানাভাইয়ের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমি রাখতে পারিনি।

অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় গা ছম ছম করছিলো। হঠাৎ মোনাজ ভাই দরোজা খুলতেই আঁতকে উঠলাম।

: সেকি, অন্ধকারে কেনো, বাতি জালিয়ে দিন। ঐ যে আপনার পাশে পিলারটাতে সুইচ আছে। ওটাতে টিপুন।

সুইচে টিপ দিতেই আলোকিত হয়ে গেলো মনোরম লনটি। পুষ্পাচ্ছাদিত বৃক্ষগুলি যেন সচকিত হলো নতুন এক আগন্তকের আবির্ভাবে। সাদা সাদা পরিগুলো যেন এক মায়াবী অথচ রহস্যময়তায় উদ্ভাসিত হলো।

পাশেই সেগুন বৃক্ষাচ্ছাদিত ঘন বন। ভুত প্রেতে আমার কোনোই বিশ্বাস নেই। কিন্তু অতর্কিতে কোনো পশু যদি লাফ দিয়ে এসে ঘাড় মটকিয়ে দেয়, এমন একটা হালকা ভীতি ইতোমধ্যেই ছেয়ে ফেলিছিলো আমাকে। অবশ্য সিগারেটের শরীরও ততোক্ষনে নি:শেষিত হয়ে এসেছিলো।

কক্ষে প্রবেশ করলাম। মোনাজ ভাই ততোক্ষণে লেপটপের আন্তজালে আন্তরিক হয়ে পড়েছিলেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি লেখক সাংবাদিক। ঘরে যতক্ষণ থাকেন অধিকাংশ সময়ই থাকেন ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র কাজে ঐ লেপটপে। কিন্তু ততোক্ষণে আমার কিন্তু লেপের ভেতর যাবার টান পড়ে গিয়েছিলো।

একা মানুষ মোনাজ হক ঐ স্টুডিও ফ্লাটে। মাঝে মধ্যে সুইডেন থেকে তাঁর স্ত্রী কবি মালিহা হক এবং কন্যারা আসেন বেড়াতে। কিন্তু বেড একটাই। তবে ডাবল মেট্রেস।

দুজনে মিলে একটা মেট্রেস নামালাম কাঠের মেঝেতে। “অতিথি লক্ষী” তাই তিনিই শুলেন সেখানে। বাকি ঔষধগুলো খেয়ে আমি শুলাম বেডে। বার্লিনে আমার দ্বিতীয় নিদ্রা রজনী শুরু হলো মোগেলহাইমে।

তিন

১৯ আগস্ট। শনিবার। এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। যেহেতু সকাল সকাল ঘুম ভাঙতে হবে। শহরে পৌছাতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগে যাবে। সাড়ে ন’টার আগেই পৌছতে হবে সেন্ট্রাল বার্লিনে ৪ নং গ্রেইফসওয়াল্ডার স্ট্রিটে ডেমোক্রেটি হাউসে সেই সেমিনার কক্ষে, যার পাশেই রাতে চাইনিজে ডিনার হয়েছিলো আমাদের।

যত রাতেই ঘুমাই আমার ঘুম ভেঙে যায় সকালেই। তাড়া দিলাম মোনাজ ভাইকে।  ঝটপট প্রাত:কালীন কার্যাদি শেষ করে নাস্তা সেরে যখন বেরুলাম তখন একটু দেরি হয়ে গেছে। বাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার পাশে রাখা মোনাজ হকের কারে চাপলাম। সকালের আলোতে এবার ভালো ভাবেই দেখে নিলাম রাস্তার এদিক ওদিক। ঢাকার গুলশান বনানীর মতোই, যেনো ব্যতিক্রম এই বাড়িঘরগুলো সেই তুলনায় একটু ছোট ছোট।

রাতে এদিকে ঢোকার পথে যা অন্ধকারের জন্য দেখতে পারিনি তখন দেখতে লাগলাম নয়ন মেলে। সেই সেগুন বনের মাঝখান দিয়ে বার্লিনমুখি রাস্তায় ছুটে চললো গাড়ি। ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিলো চালক মোনাজ ভাইয়ের সাথে।

সেন্ট্রাল বার্লিনের সেই ডেমোক্রেটি হাউজে সেমিনার স্থলে যখন পৌছলাম তখন সেমিনার শুরু হয়ে গেছে। রেজিস্ট্রেশন কাউন্টার থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে নামাংকিত কাগুজি বেজটা নিয়ে বুকে গেঁথে চট করে পাশেই ব্যবস্থা রাখা চা কফির টেবিল থেকে চা বিস্কুট খেয়ে বসে গেলাম সেমিনারে।

তখন সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে সুন্দর বনের রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বার্লিন গ্রিনপিস সংগঠনের লিখিত বক্তব্যের অংশবিশেষ পড়ছিলেন সংঠনের মুখপাত্র মিসেস ক্রেস্টিন ডুরেনব্রুখ। মঞ্চ সঞ্চালনে ছিলেন জিএফজি পোটসডাম এর রিসার্চ ফেলো ড. অনিমেষ গাইন।

ইতোমধ্যে লন্ডন থেকে আগত জাতিয় কমিটি যুক্তরাজ্যের আহবায়ক ড. মোকলেসুর রহমান মুকুল, সদস্য সচিব মোস্তফা ফারুক, প্রাক্তন সদস্য সচিব আখতার সোবাহান মাসরুর, সদস্য ডা: রফিকুল হাসান,  জাহানারা রহমান জলি, ডা: সেলিম ভুইয়া, ড: আয়েশা সিদ্দিকা, আনিসুর রহমান, নাসরিন সুলতানা, রহিমা খাতুন, ডা: শাহিদা সুলতানা পূণ্যা, ঢাকা থেকে জাতিয় কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসার আনু মোহাম্মদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি, জার্মানের বাবুল সৈয়দ, দেবাশীষ,  জোবায়েন সন্ধি প্রমুখদের দেখলাম সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেনের প্রতিনিধি সহ মোট  ৮০ জন উপস্থিত ছিলেন ঐ সেমিনারে।

আমার জন্য খুবই উল্লেখ্যোগ্য দিন ছিলো সেইদিন এইজন্য যে আমার পরোনো বন্ধু কবি দাউদ হায়দারকে পেলাম সেমিনারে।

বেলা ২টায় বিরতি হলো। আয়োজকদের আয়োজিত বুফে লাঞ্চের একটি ভরা প্লেট নিয়ে একপাশে বসে লাঞ্চ সারলাম দাউদ হায়দার পাশে। সেই ফাঁকে ঢাকার সেই পুরোনো দিনের অর্থাৎ সত্তরের দশকের স্মৃতি রোমন্থন হলো।

পুনরায় ২:৩০ এ সেমিনার শুরু হলো। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগঠনের নেতা কর্মীরাই গান, কবিতা আবৃত্তি করলেন। দাউদ হায়দারও তার কবিতা পড়লো। আমি পড়ে শোনালাম আমার দুটো ছড়া। অনুষ্ঠান শেষে বুফে ডিনার খেলাম। তারপর সেই পঞ্চাশ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম মোগেলহাইমে মোনাজ হকের বাড়িতে।  কেটে গেলো বার্লিনে তৃতীয় দিন।

চার

২০ আগস্ট বার্লিনে চতুর্থ দিনের শুরুটাও গত দিনের মতোই। চা নাস্তা সেরে মোগেলহাইম থেকে চলে গেলাম বার্লিন শহরের সেই সেমিনার হল ডেমোক্রেটি হাউজে। যথারীতি চা-পর্ব সেরে সেমিনারে ঢুকলাম। তখন ভিডিও কনফারেন্স মাধ্যমে ভারতের মানবতাবাদী লেখক গবেষক শম্ভু দত্ত বক্তব্য রাখছিলেন। এদিনও বন্ধু দাউদ হায়দার উপস্থিত ছিলো। তবে দুপুরের লাঞ্চের পর সেমিনারের সমাপ্তি সূচিত হয়ে যাওয়ায় ঘুরাঘুরির সুযোগ পেয়ে গেলাম। মোনাজ ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে ব্রান্ডিংবুর্গ পার্লামেন্ট ভবনে।

ক্লান্তিতে পরদিন ২১ আগস্ট পুরোদিনই মোগেলহামে কাটালাম মোনাজ হকের গ্রামের বাড়িতে। তবে সেই সুযোগে সারাদিনই গল্প হলো লেখক সাংবাদিক মোনজ হকের সাথে।

মির মোনাজ হক মুক্তিযুদ্ধের একজন যোদ্ধা ছিলেন। তার কাছ থেকে জানলাম তার দু’একটি অপারেশনের কাহিনী। তিনি পশ্চিম দিনাজপুর সীমান্ত পথে ১৯৭১ এর জুন মাসে ভারতে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলেন ভারতীয় আর্মির গোর্খা রেজিমেন্টে। কার্সিয়াং-এর পানিঘাটায় ছিলেন ২ মাস। সে সময় সাপের কামড়ে  দুজনের মৃত্যু হলে সেক্টর কমান্ডার তাকে কর্নেল নুরুজ্জামানের সেক্টরে পাঠিয়ে দেন। গ্রুপ কমান্ডার রাজ্জাক তাকে ট্রেনিং করান। পরে তিনি গেলেন তরঙ্গপুর। ভারত সীমান্ত থেকে  বাংলাদেশে ঢুকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অপারেশনে গিয়ে আবার ফিরে আসতেন। তিনি সরিয়াকান্দি থানা ঘেরাও, ভেলুরপাড়ায় ট্রেন ডিরেইল্ড ইত্যাদি ভয়ংকর অপারেশনে গিয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। ভেলুর পাড়া স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পারলেন যে প্রতি শুক্রবার ভেলুরপাড়া হয়ে পাকিস্তান আর্মির গুডস ট্রেইন বগুড়া যাতায়ত করে। সময়টা ছিল রমজান। আগের দিন তদারকি করে পরদিন সেই ট্রেন লাইনচ্যুত করেছিলেন মোনাজ হক এবং তার সঙ্গিরা। পাট বোঝাই নৌকাতে করে তরঙ্গপুর থেকে ওরা ১১ জন মাইনকার চরের দিকে যেতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা পাঠানো হয়।

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি দুর্ধর্ষ ঢাকা- খুলনার দৌলতদিয়া ফেরীঘাট অপারেশনে যুক্ত ছিলেন। নভেম্বরের শেষের দিকে তিনি যখন চোখের পীড়ায় ভুগছিলেন তখন গ্রুপ লিডার তাকে সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল নুরজ্জামানের কাছে পাঠালেন। নুরুজ্জামান তাকে ৪ দিন বিশ্রামে থাকতে বলেন। তিনি তাকে কিছু হাতখরচ দিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠালেন। সেই তখন কলকাতায় তিনি থিয়েটার রোডে প্রথম দেখেছিলেন তাজ উদ্দীন, শেখ কামাল এবং আরো একজন নেতাকে। ভাল একজন ডাক্তার ( বাংলাদেশের ননি গোপাল) তার চিকিৎসা করলেন।

সুস্থ হলে কমান্ডার তাকে এক বিশেষ অপারেশনে দৌলতদিয়া ফেরীঘাট এলাকায় প্রেরণ করেন। এর আগে পর্যন্তও তিনি দেশের ভিতরে থেকেই যুদ্ধ করছিলেন। সেখানে সেলিম নামের একজন এবং অন্য আরেকজন যোদ্ধার সাথে তাকে এসাইনমেন্টে পাঠানো হয়েছিলো ঢাকা থেকে আসা শের আফগান ফেরী জাহাজ ডোবানোর অপারেশনে। ওরা দুজন কি করে দীর্ঘক্ষণ পানিতে সাতার দিয়ে থাকা যায়, কি করে জাহাজের নিচে হাতড়িয়ে বোমা ফিক্সড করা যায় ইত্যাদি ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিল।

 সেলিম এবং অন্যজন ফেরিওয়ালা সেজে কলার ডালার নীচে অস্ত্র রেখে জাহাজে উঠেছিল,  মোনাজ উঠেছিলেন ছাত্র সেজে। সান্তাহারে তারা আর্মির মুখোমুখী হলেন। সেলিম কলা বিক্রয় না করে বিপদ বুঝে সরে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে সেলিম সেই অপারেশনে কৃতকার্য হয়েছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা মির মোনাজ হক। সারিয়াকান্দিতে থেকেই বিভিন্ন অপারেশনে যুক্ত ছিলেন অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। নভেম্বরে পাক- বাহিনী সারিয়াকান্দি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মির মোনাজ হকের নাম ছাপেনি গ্যাজেটে! ২০১৪ সালে তাকে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে হয়েছিলো।

বার্লিনের মোগেলহাইমে মোনাজ ভাইয়ের ছোট্ট বাসাটিতে বসে বসে শুয়ে শুয়ে শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা বিপদসংকুল দিনগুলির কথা। আর তখন ভেসে উঠছিলো আমার সে সময়ের নির্যাতন জর্জরিত ভয়ংকর সময়ের কথা।

পাঁচ

পরদিন বেশ বেলা করেই বেরুলাম প্রিয় মোনাজ ভাইয়ের সাথে। সেদিন গিয়েছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসী কন্সেন্টেশন ল্যান্ড সারফুল সিটিতে। বার্লিন শহর থেকে বেশ দূরে অনেকটা নির্জন এলাকায় হিটলারের নাৎসি বাহিনী বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরী করেছিলো কনসেনট্রেসন ক্যাম্প, যেখানে প্রত্যেক রাতে শত শত নিরিহ সৈন্যদের নিয়ে গিয়ে করা হতো অমানুষিক নির্যাতন। এগুলোকে বলা হয় সাকশেন হাউজেন। সারফেল সিটি মেমোরিয়াল হয়ে বিশাল রাস্তাটি গিয়ে প্রবেশ করেছে সেই নির্যাতনী ব্যুহ সাকশেন হাউজেন-এ। এখনো সেই বিশাল কালো লৌহ ফটকটি সেভাবেই আছে। আমি, কমরেড প্রিন্স এবং মির মোনাজ হক ঐ গেটে ছবি নিয়ে স্মৃতি গেঁথে প্রবেশ করলাম সেই মৃত্যুপুরীতে, যেখানে নৃশংস হিটলার বাহিনী হাজার হাজার সেনা ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করেছিলো আর লোমহর্ষক নির্যাতন করে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়েছিল।

প্রায় ১০০ ব্যারাক তৈরী করেছিলো বন্দি সৈনিকদের রাখার জন্য, তার কিছু আছে এখনো। বাকিগুলির নিদর্শন রয়েছে ছোট ছোট পাথর বিছিয়ে। বিশাল স্মৃতি স্তম্ভ আছে মাঝামাঝি স্থানে। রয়েছে হাসপাতাল, যেখানে মূলত: আর্মি অফিসারদের রাখা হতো নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করার জন্য। অনেক সৈন্যদের বানিয়েছিলো গিনিপিগ, এদের রক্ত, বায়াপসি, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ  ইত্যাদি দিয়ে চালানো হতো বিভিন্ন মানবধ্বংসী গবেষণা। হয়তো সেখান থেকেই সূচিত হয়ে থাকবে ঘৃণ্য মাদক “ইয়াবা”র!

বিশেষভাবে রুশ সৈন্যদের জন্য আলাদা নির্ধারিত স্থানে রয়েছে বেশ কিছু ব্যারাক। আমরা সেই ব্যারাকগুলোর দু’একটিতে প্রবেশ করেও দেখেছিলাম। আবার কোথাও যেখানে ব্যারাক এখন নেই সেখানে সেই স্থানে পাথরকুচি দিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকজন রুশ আর্মি অফিসারের বড় বড় পোট্রেট।

হিটলারের সেই কুখ্যাত গ্যাস চেম্বারে ঢুকে খুব খারাপ লেগেছিলো সেইসব স্মৃতির ছবি এবং প্রতিকৃতি দেখে। সে যে কী নির্মম ছিলো তা আজ আর সম্যক বুঝার নয়। গ্যাস চেম্বারে ছুড়ে দেয়া হতো লাশ আর লাশ। সেগুলো ভশ্ম হয়ে গভীর নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়তো বিশাল বিশাল ট্যাংকিতে!

প্রায় সারাদিনই আমাদের কেটে গিয়েছিল সেদিন সেই মৃত্যুপুরি সাকশেন হাউজেনে।

সন্ধায় আবার এক বিষাদমাখা মন নিয়ে ফিরেছিলাম মোগেলহাইমের বার্লিনী পল্লিতে।

ছয়

তারপরদিন ২৩ আগস্ট সম্ভবত: মোনাজ ভাইয়ের সাথে একবারেই বেরিয়েছিলেম বার্লিনের উদ্দেশে। শহরেই কিছু ঘোরাঘুরি করে দিন শেষে জোবায়েন সন্ধির বাসার পাশে এক হোটেলে উঠেছিলাম প্রিয় বন্ধু মোনাজ ভাইকে বিদায় জানিয়ে।

যেহেতু পরদিন প্রিয় সন্ধিকে নিয়েই সোনেফিল্ড এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে লন্ডন ফিরতে হবে সে জন্যই সন্ধির পাশে ঐ হোটেলে উঠতে হলো কেবল রাতটা পার করার জন্য, কারণ সন্ধির বাসায় সেদিন ছিল অতিথি ভরপুর। এদিন ট্রলি সুটকেসটা নিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরতে হয়েছিল বলে সুটকেসের একটা চাকা ভেঙে গিয়েছিল।

রাতের খাবার খেয়েছিলাম সন্ধির বাসায়। সন্ধির বৌ সেই রাতে রেঁধেছিল সুস্বাদু পোলাও এবং চিকেন। খুব ভালো লেগেছিলো তার দুটো ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর আপ্যায়ন, যা স্মৃতি হয়ে থাকবে আমার বাকি জীবনের।

ছোট্ট অথচ চমৎকার হোস্টেলটিতে মাত্র একুশ ইউরোতে রাতটা কেটে গেলো। সন্ধি বেশ খানিকটা রাত অবধি আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলো।

সকালে পাশের বিশাল সপিং সেন্টারে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে একটা নতুন জার্মান সুটকেশ কিনলাম। দুপুরের মধ্যেই সোনেফিল্ড বিমানবন্দর থেকে উড়লাম আকাশে লন্ডনের পথে।

লন্ডন, ২০১৮

গোলাম কবির। কবি, সংবাদকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ২৫ আগস্ট, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ লক্ষীপুর জেলার দত্তপাড়া উত্তর মাগুরী গ্রামে জন্ম। বর্তমানে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বরোতে বসবাস। পিতা- মরহুম মোবারক আলী, মাতা- মরহুমা জয়গুণ ভানু। ৭ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বোন সবার বড়।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..