ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
সাজ্জাদ চলে যাওয়ার পর, বড্ড একা লাগছে রুমীর। রাত কোন প্রাকরে কাটলেও দিনের সময়টুকু কিছুতেই কাটতে চায় না। হামিদা খাতুন এখন সুস্থ, সত্যি কথা বলতে তিনি অসুস্থ মানুষ নন, হাসি-খুশি সাদামাটা একজন গৃহিণী, পরিবারের কাজ-কর্ম খুব যত্ন সহকারে করেন, পরিবারের সকল সদস্যদের কখন কি লাগবে সব কিছু তার জানা। সময় মতো খাওয়া দাওয়া, গোসল, লেখা-পড়া, ঘুম, সব কিছু তার নজরদারতে চলে, দৈনিক কাজে কখনো কোন অনিয়ম তিনি হতে দেন না। আর যখন মাথায় ঝামেলা হয় তখনকার কথা আলাদা। আজ সকালে তিনি নিজেই রান্না করেছেন, অথচ কাজের মহিলা আছে, কাজের মানুষের হাতের রান্না তার ভালো লাগে না। রান্নাবান্না সেরে সবাইকে নিয়ে তিনি এক সঙ্গে খেতে বসেন। ইসমাইল মাস্টার সকালে খানা-দানা করেই ইশকুলে চলে যান, ফিরেন বিকাল বেলায়, তিনি আসলে রুমীর নিঃসঙ্গ ভাবটা মোটা-মুটি কেটে যায়, খবরের কাগজ নিয়ে ইসমাইল মাস্টার যখন বসেন, রুমীকে ডাকেন, এক সঙ্গে চা খান, দেশের হালচাল নিয়ে দু একটি কথা বলেন, অধিকাংশই সিলেটের ঐতিহ্য নিয়ে কথা হয়, সিলেট পীর ফকিরের জায়গা, এই শহরের মাটিতে অনেক পবিত্র মানুষ শায়িত আছেন, এই শহরে কোন অভাব-অনটন নেই, ইত্যাদি। ইশকুলের কোন ব্যাপারকে ইসমাইল মাস্টার জটিল মনে করলে রুমীর সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করেন, অনেক সময় দেখা যায় সমস্যা বলতে ইসমাইল মাস্টারের জীবনে কোন কিছু আসেনি, যায় এসেছে তা ক্ষণিক বিচলিত হবার মতো কৌতূহল। ইসমাইল মাস্টার প্রতিদিন সকাল সাতটায় বাজারে যান, বাজার করতে তিনি পছন্দ করেনে, তার কেনা-কাটা দেখেই মনে হয় মাছ তার খুব প্রিয়, সুরমা নদীর মাছ হলে তো কথাই নেই।
ইসমাইল মাস্টারের বাসাটি বেস সুন্দর। বাসার চারদিক লম্বা লম্বা সুপারি গাছে ঘেরা, উপড়ের দিকে না তাকালে গাছের মাথা দেখা যায় না, গেইটের দু-পাশে বড় দুটি গাছ, একটি আম অন্যটি কাঁঠাল গাছ, এই গাছ দুটি ডাল-পাতায় ঝোপ-ঝাড় হয়ে আছে, দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরাতন, গাছের তলায় অনেকটুকু জায়গা জুরে ছায়া পড়ে থাকে সব সময়, বাসার পিছনেও অনেক গাছ, অধিকাংশই ফলের গাছ, পেয়ারা, লিচু, জলপাই, কামরাঙ্গা, ইত্যাদি, সেই তুলনায় ফুলের গাছ নেই বললেই চলে। বারান্দার সামনে ক্ষণিকটা জায়গা ফুলের বাগান রয়েছে, সেখানে কয়েকটি গোলাপ গাছ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাগানো হয়েছে ডালিয়া ফুল, হলুদ গাঁদা, কচমচ, আরও কিছু গাছ আছে তার আশেপাশে । আম গাছের চারদিক গোল করে ইট দিয়ে বাঁধানো, সেখানে বসে থাকতে মন্দ লাগে না, শীতল ভাব সেখানে সব সময়ই থাকে। রুমী বসে আছে আম গাছের নিচে।
আজ আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে, মনে হয় বৃষ্টি নামবে। শুধু বৃষ্টি না ভারি বর্ষণও হতে পারে। স্বাভাবিক প্রকৃতির মাঝে নেমে এসেছে লাল রঙের মেঘ, ঝড়ো মেঘ দিচ্ছে হানা। দেখতে দেখতে মুহূর্তেই চারদিক আঁধারে ঢেকে ফেললো। পথচারীর হাঁকডাক শুনতে ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে সবাই ব্যস্ত, এখনি নিরাপদ জায়গায় যাওয়া যেন সবারই দরকার। রুমী আমতলা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সারাদিন পত্রিকা পড়াটাও তেমন ভালো লাগছে না আর, কাজ নেই বলে এখন চার ওয়াক্ত নামাযে যায় সে, মসজিদের মুসল্লি অধিকাংশই স্থানীয় লোকজন, রুমীর প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই, হয়তো বা তারা ভালোভাবে রুমীকে খেয়াল করেনি, খেয়াল করলে কিছু জিজ্ঞাসা করার কথা। সিলেট বিভাগীয় শহর হলেও এই শহরে লোকজন যান্ত্রিক না, সবাই সবার সঙ্গে আন্তরিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে।
আছরের নামাজ পড়ে আবারও পত্রিকা নিয়ে বসেছিল রুমী, মেঘের খেলা দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। ইসমাইল মাস্টার এখনো আসেননি। এতক্ষণে এসে পড়ার কথা। মনে হয় পথেই আছে। দেরি হলে তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হতে পারে, আবার কোথাও আশ্রয় নিলে কিছুই হবে না।
একবার বারান্দায় আবার আমতলায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো রুমী। বাসন্তী বোধহয় এলো। সাদা ড্রেসে মেয়েটাকে অন্য রকম লাগে। এই মেয়ে ডাক্তার হবে, শত শত রোগীকে দেখবে, অনেকেই তাকে ঈশ্বরের কাছাকাছি ভাবা শুরু করবে, ভাবা যায়!
বাসন্তী যখন চলাচল করে ডানে বামে তাকায় না, সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটে। এমন হতে পারে ডানে বামের সব কিছু সে আগে থেকেই দেখে ফেলে কিন্তু গুরুত্ব দেয় না বা কাউকে বুঝতে দেয় না। বাসন্তীর সঙ্গে এখনো মানিয়ে উঠতে পারছে না রুমী, মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, বুদ্ধিমতী মেয়েরা সম্ভবত অনেক রাগী, বাসন্তীও বেশ রাগী, যখন তখন রেগে যায়। কোন কথায় রাগবে আবার কোন কথায় খুশী হবে আগে থেকে বোঝা মুশকিল। বিশেষ কোন প্রয়োজন না হলে বাসন্তীর সঙ্গে কথাই বলে না রুমী। কথা বলার সময় এমন ভাবে কথা বলে সে, যেন বলা বাক্য প্যাঁচ মেরে অন্যদিকে ঘোরানো যায়।
রুমী আমতলায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে আম-কাঁঠাল গাছের ডাল দোল খাওয়া শুরু হয়ে গেছে, দিনের শেষ আলোটুকু অন্ধকারে ম্লান হয়ে আসছে। শহরের প্রতিটি রুমে বাতি জ্বলে উঠেছে, এখনই বৃষ্টি নামবে। শুধু বৃষ্টি না কাল বৈশাখী ঝড়। রুমী রুমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি শুরু হল। আজ আর মাগরিবের নামাজ পড়া হবে না, বাসায় নামাজ পড়ার মতো এত বড় মুসল্লি সে না। সে শখের নামাজি। মনে হয় ভালো বৃষ্টিই শুরু হয়েছে। মাস্টার সাব কোথাও আটকে গেছেন। কাছে কোথাও বাজ পড়লো বোধয়, কি কঠিন বজ্রপাতের শব্দ, মনে হল আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, এমন সময় কারেন্টও গেলো চলে। অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছে চারদিক। মোবাইল ফোনের লাইট জ্বেলে মোমবাতি বের করলো, মোমবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় বসে রইলো রুমী।
হঠাৎ এমন সময় দুই হাতে দুই কাপ চা নিয়ে উপস্থিত হল বাসন্তী। বাসন্তীর আগমনে কিছুটা বিচলিত বোধ করলো রুমী, বাসন্তী চা নিয়ে এসেছে, আবার চা খাচ্ছে, কি সহজ স্বাভাবিক আচরণ। বাসন্তী চেয়ার টেনে আরাম করে বসলো, টেবিলের এক পাশে কাপ রেখে বলল, আপনার জন্য নিয়ে এলাম, মা বলছিলেন আমি নাকি আপনার সঙ্গে কথাই বলি না, কথা বলতে আসলাম, অসুবিধা নেই তো?
রুমী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না না অসুবিধা থাকবে কেন, আপনি বসুন, আসলে আপনার সাথে তেমন ভাবে কথা হয়নি, আপনার লেখা পড়া কেমন চলছে?
: ভালো, ভদ্র করে হলেও আমার বলা উচিত, আপনি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, আমাকে ছোট বোনের মত মনে করে তুমি তুমি ডাকবেন, কিন্তু বলতে পারছি না, আজ আপনাকে আমি তুমি বলতে বললে কাল করবেন আরেক চিন্তা। অনেকেই আবার বন্ধুর বোনের সাথে প্রেম করে মজা পায় ।
বাসন্তীর মুখে এই কথা শোনার জন্য রুমী প্রস্তুত ছিল না, রুমী হিমশিম খেয়ে গেল।
বাসন্তী নিজ থেকেই আবার শুরু করলো, বলল, আপনি করেনটা কি?
রুমী উত্তরে বলল, তেমন কিছু না।
: ইনকাম সোর্স নেই?
: আমার একটা প্রেস আছে, কম্পিউটার কম্পোজ করার দোকান আছে।
: ভাইয়ার কাছে শুনলাম, কিসের পত্রিকা ফত্রিকা নাকি বের করেন, সেটা আবার কি?
রুমী এখনো চায়ে হাত দেয়নি, তার মাথা ভন ভন করছে,
: চা খাচ্ছেন না কেন? চা খান, অতি ভদ্রতা আমি পছন্দ করি না, যারা বেশি বিনয়ী ভাব দেখায়, তাদের মাঝেই গণ্ডগোল। চা খান ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রুমী চা নীল, কাপে চুমুক দিয়েই বুঝল চিনি নেই, নিশ্চয়ই এই মেয়ে চা বানিয়ে এনেছে, মাঝে মধ্যেই ও চায়ে চিনি দেয় না। কিছু বলতে গেলে কথার মোড় নিবে আরেক লাইনে, তখন শুরু হবে আরেক কাণ্ড।
: কীসের পত্রিকা, একটু বুঝিয়ে বলুন তো, শুনি, না বলতে মানা?
: না, মানা থাকবে কেন? আমি একটা পত্রিকার সম্পাদনা করি, প্রতি মাসে একবার ছাপা হয় আমাদের কাগজ, আমার পত্রিকায় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সব লেখা ছাপা হয়। যারা পরিবারতন্ত্রের পক্ষে না, বা মনে করেন দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তন দরকার তারাই লেখাগুলো পাঠায়।
: অনেকদিন আগে ভাইয়ার রুমে একটা বই দেখে ছিলাম, নামটা মনে নেই, সম্ভবত আপনার লেখা, কিছু মনে করবেন না, পুরাতন কাগজের সঙ্গে সের দরে বইটি বিক্রিও করে ফেলেছি, কি সব কবিতা টবিতা, দুই এক পাতা পড়েই বিরক্তি ধরে যায়, আপনি কি কবিতাও লেখা লেখি করেন নাকি?
রুমী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, জী সামান্য লেখালেখি করি।
: ভালো, লেখকরা আবার চরিত্রের দিক থেকে বেশ খোলা-মেলা হয়, আপনারও কি সেই অভ্যাস আছে?
রুমী কথা বলল না, চুপচাপ চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিলো।
: মা কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে গল্প করতে বলেছিল, করলাম। অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ে কথাও বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না, আমি খোলা-মেলা আলোচনা পছন্দ করি। আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে বলুন, উত্তর দিবো।
রুমী চায়ে আবার চুমুক দিলো, কিছুই বলল না।
: কিছুই জানার নেই?
রুমী এবারো কথা বলল না।
এমন সময় ইসমাইল মাস্টার বৃষ্টিতে চুবাচুবি হয়ে বাসায় ফিরলেন। তার সমস্ত শরীর ভিজে একাকার।
গতকাল বৃষ্টি ছিল না, চকচকে রোদ ছিল। লাগাতার বৃষ্টিতে ভেজা পথ-ঘাট সব শুকিয়ে গেছে এক দিনেই, গত কালের তাপমাত্রা আর রৌদ্রের ভাবভঙ্গি দেখে সবাই মনে করেছিলো বৃষ্টি বুঝি আর আসবে না, আসলেও কয়েকদিন পরে, কিন্তু ভোর না হতেই আজ আবার আকাশ ভারি হতে লাগলো, দিনের আলো যতই বারে আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে মেঘও বারতে লাগলো, এক সময় আকাশ বাতাস কালো করে অন্ধকার করে ফেললো সব, হাল্কা বাতাস বইলো কিছুটা সময়, তারপর শুরু হল মুষলধারা বৃষ্টি। মুহূর্তেই পথঘাট জনশূন্য হয়ে গেলো। যারা ব্যস্ততার কারণে বাইরে বের হয়েছিলো তারাও নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলো, নতুন করে বাইরে কেউ বের হল না আর, মনে হচ্ছে আজ আর বৃষ্টি থামবে না। এই বৃষ্টি কয়দিন থাকে কে জানে। এখন বাজে সকাল এগারোটা। সকালের নাস্তা খেয়ে রুমী আবার ঘুমিয়ে পরেছে। বৃষ্টির দিন জেগে থেকেই বা লাভ কি? তারচেয়ে বরং ঘুমানোই ভালো। বাসন্তী নিজের ঘরে। জোছনার মা রেণু এতক্ষণ টিভি দেখছিল, কারেন্ট চলে যাওয়াতে তারা থুম ধরে বসে আছে। ভালোই হয়েছে বোকার দল ঝড়-তুফানের দিনে টিভি ছেড়ে বসে ছিল, বজ্রপাত-টজ্রপাত কতো কিছুই হচ্ছে, জায়গা মতো একটা পড়লেই টিভি যাবে ফেটে, এই কথা ওদের বলতে গেলেই বুঝবে উল্টো, মন বিরক্ত করে থাকবে, মনে মনে বলবে, মালিক কাজের মানুষকে মানুষ মনে করে না, একটু টেলিভিশনের সামনে বসলেই নানান আলাপ, ঠাঠার ওজুহাতে টিভি দিলো বন্ধ করে। ইসমাইল মাস্টার গতকালের পুরাতন পত্রিকা নিয়ে বসে আছেন, রুমের ভিতর এই ভাবে বসে থাকতে তার ভালো লাগছে না? দিনের বেলায় ঘুমের অভ্যাস নেই থাকলে লম্বা একটা ঘুম দিতেন তিনি। হামিদা খাতুন বিছানায় সুটকেস মেলে কি যেন করছিলেন, সেখান থেকেই বললেন, তরি-তরকারি শেষ, দুপুরে কি রান্না করবো?
ইসমাইল মাস্টার পত্রিকায় চোখ রেখেই বললেন, ফ্রিজে কিছুই নেই?
: গরুর গোস্ত আছে।
: বৃষ্টি থামুক। বৃষ্টির মাঝে তো আর বাজারে যেতে পারি না।
দুজনেই আবার চুপ হয়ে গেলেন।
তাদের কথা হয় খুবই পাতলা পাতলা। সংসারের প্রয়োজনীয় দু একটা কথা ছাড়া কথাই হয় না। কিন্তু এমন অবস্থা তাদের ছিল না। এক সময় তারা দুজন জমিয়ে গল্প করতেন। ইসমাইল মাস্টার জমিয়ে গল্প করতে পারেন না, গল্প করতে গেলেই তার মাঝে উপদেশদাতা উপদেশদাতা ভাব চলে আসে, তিনি কথায় কথায় নানান কিছু বোঝাতে চেষ্টা করেন, তিনি যেন ক্লাস টু-থ্রির ছাত্র পড়াচ্ছেন এমন ভাবে কথা বলেন। এই ভাবের কারণে হামিদা খাতুন স্বামীর সঙ্গে খোশ-গল্প করা ছেড়েই দিয়েছেন। বাসন্তী মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলতে আসে বাবার সঙ্গে, কথা বলতেও ঠিক না প্রয়োজনের জন্যই, কলেজের বেতন, যাতায়াত ভাড়া, টিউটরের মাসিক বেতন ইত্যাদির টাকাগুলো ইসমাইল মাস্টারের হাত দিয়েই যায়, সেই সময় তিনি বাসন্তীকে দুই একটি কথা বলার চেষ্টা করেন, আলেকজান্ডার ফ্রেমিং কিভাবে হাঁচির মাধ্যমে পেনিসিলিন ভি আবিষ্কার করে ফেললেন, মানুষ দিন দিন কতো উন্নত চিকিৎসার দিকে যাচ্ছে, এখন যক্ষ্মারোগ কোন ব্যাপারই না কিন্তু এক সময় যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথা চলতো, ডাক্তার হতে গেলে ভালো করে স্টাডি করতে হবে, কোন কাজ পরিশ্রম ছাড়া হয় না, ডাক্তারি মুখস্থ বিদ্যায় চলে না, আউট নলেজ থাকতে হবে, বলতে বলতে তিনি বাসন্তীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, তখন বাসন্তী বেশ বিব্রত বোধ করে, কখন বাবার সামনে থেকে যাবে এই চিন্তায় থাকে তার মাঝে।
পরিবারের লোকজন এখন ইসমাইল মাস্টারকে তেমন ভয়ঙ্কর মানুষ বলে আর ভাবেন না। এটাও একটা ভালো দিক, আগে যেমন হামিদা বা বাসন্তী কথায় কথায় গাল ফুলিয়ে থাকতো, মুখ ভারী করে না খেয়ে থাকতো এখন আর সে সব তারা করে না। ইসমাইল মাস্টারের কোন কাজে তারা বিরক্ত হলে সামনা সামনে প্রতিবাদ করে, মুখ ফসকে হামিদা খাতুন আর বাসন্তীর অনেক কথাই বের হয়ে আসে।
দিন পাল্টে গেছে, এখন সবাই ব্যস্ত, সবাই থাকে সবার ধান্দায়। বাসন্তীর কলেজ, সাজ্জাদের পত্রিকা, হামিদার সংসার, সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কারো খোশ-গল্পের সময় নেই। মাস্টার সাবকে কেউ সময় দিতে পারেন না, এতে মাস্টার সাব কাউকে দোষারোপও করেন না, মানুষের জীবন একটি সূত্রের মধ্যদিয়ে সব সময় চলে।
ইসমাইল মাস্টারের দৈনিক কাজের রুটিন একই, তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠেন, ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে যান, বাজার থেকে ফিরে গোসল করেন, খাওয়া-দাওয়া করে ইস্কুলে যান, ইস্কুল থেকে ফিরেন বিকাল বেলায়, ফ্রেশ-ট্রেস হয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেন বারান্দায়, সে সময় তার সামনে চা-নাস্তা আসে, কোন কোন দিন বাসন্তী দিয়ে যায় আবার কোন কোন দিন দিয়ে যায় কাজের মেয়েটা।
বাসন্তী যত বড় হচ্ছে তত বুদ্ধিমান হচ্ছে বলেও ইসমাইল মাস্টারের ধারণা। বাসন্তী যে বাবার সঙ্গে শুধু দূরত্ব বজায় রেখে চলে তাও না, সময় সুযোগ পেলে বাবাকে সে সময়ও দেয়, তখন মনে হয় বাসন্তী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক বুদ্ধিমতী বালিকা, তখন ইসমাইল মাস্টার মেয়েকে দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।
ইসমাইল মাস্টারের একটি বদ সমস্যা আছে, তিনি যেনতেন উ ছিলায় যে কোন কাজ ফেলে রাখেন, যেমন আজ বৃষ্টির উছিলায় ইস্কুলে যাননি, এই নিয়ে হামিদা খাতুন বেশ রাগারাগি করেন, তবুও মাস্টার সাহেবের হোশ হয় না।
ইসমাইল মাস্টার পত্রিকায় চোখ রেখে বললেন, ব্যথাটা কি আরও হয়?
হামিদা খাতুন খাটে বসে আছেন, তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন, না।
: একবার ডাক্তারের কাছে গেলে হতো না? ডাক্তার তো যেতে বলেছিল।
হামিদা খাতুন কথা বললেন না, চুপচাপ নিজের মতো কাজ করতে থাকলেন।
: চল একবার ডাক্তারের কাছে যাই। আমার শরীর টাও কেমন দুর্বল দুর্বল লাগে, একবার চেকআপ করানো দরকার, বুড়ো বয়সে নানা রোগে বাসা বাধে, একবার কাত করতে পারলেই শেষ।
হামিদা খাতুন মাস্টার সাহেবের এই কথারও কোন প্রতি উত্তর করলেন না।
ইসমাইল মাস্টার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, তিনি গম্ভীর হয়েই বললেন, গতকালের পত্রিকায় ইটারেস্টিং একটা খবর ছিল চোখেই পড়েনি।
বলতে বলতে তিনি কি যেন মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন।
বৃষ্টি কমতে শুরু করেছে, আকাশও পরিষ্কার হচ্ছে মনে হয়।
হামিদা খাতুন বললেন, এই ভাবে ইস্কুল কামাই করলে মানুষে কি বলবে ? আর কয়টা দিন ইতো আছে।
ইসমাইল মাস্টার কথা বললেন না। মহিলা মানুষ লাইনে আসে না। তার স্ত্রী আরও বেলাইনের। কিন্তু হামিদাতো এমন ছিল না, দিন দিন কেমন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে, কথায় কোন রসকষ নেই, ইসমাইল মাস্টার কেসটা ধরতে পারছেন না।
ঘুম থেকে উঠেই বাসন্তী রুমী কে প্রশ্ন করেছিলো, বলুন তো দিক কয়টি?
রুমী তখন ঘুমে, বাসন্তীকে দেখে ঘুমের ঘোরেই লাফ দিয়ে উঠে পরে সে, সহজ ভাবে উত্তর দেয়, দিক দশটি।
বাসন্তী চোখ কচলাতে কচলাতে আবারও বলে, নাম গুলো বলুন?
দশদিকের নাম বলতে পারেনি রুমী, এমনিতেই কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া মাথা ঝিম ঝিম করছিলো, তার মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা মোটেই ভালো লাগছিলো না। বাসন্তী আর কিছু না বলে চলে যায়, রুমী বসা অবস্থায়ই রইলো অনেকক্ষণ, এত সকালে উঠে কি করবে সে এই ভেবে আবার বিছানায় গড়ান দিলো কিন্তু এক মিনিটের জন্যও আর ঘুমাতে পারলো না। মাথায় ঝিঝির মতো শব্দ করতে লাগলো দশদিক। কিছুতেই নাম গুলো মনে আসছে না। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম এ পর্যন্ত এসেই আর কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু বাসন্তীর এই দশ দিক নিয়ে প্রশ্নের একটি সূত্র বের করতে পেরেছে অতি সহজে, আজ দশদিন যাবৎ এই বাসায় উঠেছে সে, এ কথা স্মরণ করে দিতেই বাসন্তীর এই প্রশ্ন। বাসন্তী ইন ডাইরেক্ট বলতে চেয়েছে, বন্ধুর বাসায় এসে এত দিন থাকাটা ছোটলোকি, কারো সামান্যতম মান-সম্মান থাকলে এত দিন অন্যের বাসায় থাকার কথা না। এই মুহূর্তে বাসন্তীর কথায় মানসিক যন্ত্রণা পাওয়া হবে চরম বোকামি। এই মেয়ে যা বলার বলুক, বিপদে যখন পড়েছে সব কিছু মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
হামিদা খাতুনের সঙ্গে রুমীর বেশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে। হামিদা খাতুন এখন রুমীকে‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি সবসময় সংসার নিয়ে ব্যস্ত, এই ব্যস্ততার মাঝেও রুমীর খেয়াল রাখেন, মাঝে মধ্যে নিজের স্বামীর নালিশ করতেও বাদ রাখেন না। গত পরশু ইসমাইল মাস্টার এ বড় এক মাছ নিয়ে বাসায় ফিরল, তখন সন্ধ্যা, ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বাজারে উঁকি দিয়েছিলেন, উঁকি দেওয়াতেই মাছ কেনা, তিনি হাসিমুখেই বাসায় ফিরেছিলেন একটু পরেই ঘটলো অন্য বিষয়, শুরু হল খুব হই চই, রুমী দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে মাস্টার সাব অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন, হামিদা খাতুন রুমীকে বললেন, দেখে যা কি করেছে, এই বয়সেও বাজার করাটা শিখল না, নিয়ে এসেছে পঁচা মাছ।
মাস্টার সাব, মিনমিন করে বললেন, লোকটা বলল সুরমা নদীতে ধরা, বিকালেই ধরা পড়েছে।
হামিদা খাতুন চেঁচিয়ে বললেন, এই মাছ আজ বিকালেই ধরা? আপনার দিন দিন এই জ্ঞান হচ্ছে? বিকালের মাছ কি একটু নড়াচড়াও করবেনা?
তাদের তক-বিতর্ক এক পর্যায় বিরাট আকার ধারণ করলো, ইসমাইল মাস্টার প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, তিনি আর বাসায় খাবেন না, দরকার হলে না খেয়ে বাকি জীবন পার করে দিবেন। বাসার অশান্তি তার আর ভালো লাগেনা। হামিদা খাতুনও এই প্রতিজ্ঞার স্থায়িত্ব দেখার অপেক্ষায় রইলেন। ইসমাইল মাস্টার রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন, সকালেও না খেয়ে ইস্কুলে গেলেন, যথাসময়ে ফিরলেন বিকালে, হাসিমুখে রাতে সবার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলেন, রাগা-রাগীর বিষয়টি তার আর মনেই রইলো না।
রুমী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে বসে রইলো বারান্দায়। দশ দিকের নামগুলো মনে করার চেষ্টা করছে। একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে সে এত ভাবছে কেন? বিষয়টা মাথা থেকে যাচ্ছেই না। সাজ্জাদ চার দিনের কথা বলে এই যে গেল এখনো ফিরল না, ও থাকলে এতটা খারাপ লাগতো না। বদমাইশ ঢাকায় গিয়ে এখন ধরেছে আরেক বাহানা, বলে আরও দু-চার দিনের কি নাকি একটা জরুরী কাজ আছে, শেষ হলেই চলে আসবে।
বাসন্তী রুমীর দিকেই আসছে। বাসন্তীর এই আগমনে রুমী কিছুটা বিচলিত বোধ করছে, বনে যখন থাকতে হবে বাঘকে রাজা মানাই ভালো, রাজার সামনে প্রজার কোন মান-অপমান থাকে না।
বাসন্তী রুমীর সামনে এসে দাঁড়ালো রুমী বসা থেকে দাঁড়াবে না বসেই থাকবে বুঝতে পারছে না, শরীরে ঝিম ঝিম ভাব চলে এসেছে। বাসন্তী মনে হয় কিছু একটা বলবে। এমন সময় হঠাৎ করে দশদিকের নাম মনে পড়ে গেল রুমীর, এই তো মনে পড়েছে, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈর্ঋত, ঊর্ধ্ব, অধঃ-।
: বাবা আপনাকে ডাকছেন।
বলেই বাসন্তী চলে গেল। বাসন্তীর চলে যাওয়ার ধরণটাও বেশ ভয়ঙ্কর। কোন মানুষকে রুমী ভয় পায় না, তবে এই মেয়েকে কেন এত ভয় পায় সে, এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইসমাইল মাস্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো রুমী। ইসমাইল মাস্টার বোধয় আজও ইস্কুল কামাই দিবেন, তার ভাব ভঙ্গি তেমনি বোঝাচ্ছে। আজকাল রুমী মাস্টার সাবকে একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, সে বুঝে গেছে মাস্টার সাহেবের সাথে কথা বলা মানে অহেতুক প্যাঁচালে সময় নষ্ট করা।
রুমীকে দেখেই ইসমাইল মাস্টার বললেন, বসো বসো, বলতে বলতে চশমার গ্লাস মুছে চশমাটা পড়লেন।
: একা একা সারা দিন বাসায় থাকো, বুঝতে পারি ভালো লাগেনা তোমার, কি আর করবে, গাধাটা ঢাকায় গিয়ে হাওয়া হয়ে গেল, আজ ছুটি নিলাম, তোমাকে আমাদের শহরটা দেখাবো, আগে কখনো সিলেট এসেছিলে?
রুমী সোফায় বসতে বসতে বলল, না, এবারই প্রথম।
ইসমাইল মাস্টার খুব আগ্রহ নিয়ে রুমীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে তুমি সিলেটের তেমন কিছুই চিন না। কোন স্থান বা দেশকে জানতে হলে প্রথমে তার সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা উচিৎ, সিলেট সম্পর্কে কি কোন ধারণা আছে তোমার?
রুমী হালকা মোচর দিয়ে বলল, সিলেটে হযরত শাহ জালাল (র:) এর মাজার আছে, সিলেট চায়ের জন্য বিখ্যাত, এই সব মোটামুটি জানি।
: ভালো, কিন্তু তোমাকে আরও জানতে হবে, প্রথমে জানতে হবে সিলেটের স্থানাঙ্ক, যে কোন স্থান সম্পর্কে জানতে হলে সেই স্থানের স্থানাঙ্ক জানা খুবেই জরুরী। সিলেটের স্থানাঙ্ক হল ২৪º৫৩’উত্তর ৯১º৫২’পূর্ব বুঝলে?
রুমী একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, জী হ্যাঁ, বুঝেছি।
ইসমাইল মাস্টার চশমা খুললেন, চশমা খোলে রুমীর দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকালেন এবং গাম্ভীর্য নিয়ে বলতে লাগলেন, ৩১ শে মার্চ ২০০৯ সালে সিলেট মেট্রোপলিটন শহরের মর্যাদা লাভ করে, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বীকৃতি পায় ৯ই এপ্রিল ২০০১ সালে, বুঝলে?
: জী, বুঝতে পেরেছি।
: সিলেটে কয়টি পৌরসভা আছে বলতে পারো?
রুমী ইতস্তত করে বলল, না, বলতে পারবো না।
ইসমাইল মাস্টার সম্ভবত একটু বিরক্ত হলেন, বিরক্তি নিয়ে বললেন, জানা দরকার ছিল, সিলেট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, এই বিভাগে কয়টি পৌরসভা থাকবে তোমরা জানবে না? কি আশ্চর্য!
খানিকটা বিরতি নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন তিনি, সিলেট বিভাগ ৪টি জেলা নিয়ে গঠিত, জেলাগুলো হল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার।
বাসন্তী চা নিয়ে এসেছে, মেয়েটা সব সময় মুখ গোমরা করে রাখে, গোমরা মুখো মেয়ে-ছেলে দেখতে ভালো লাগে না, মেয়েরা থাকবে হাসিখুশি, আর এত সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে যদি গোমরা মেরে থাকে কেমন দেখায়! এমনও হতে পারে বাসন্তী গোমরা না, রুমীকে দেখলেই গোমরা হয়ে যায়, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সে বেশ হাসি-খুশিই থাকে।
রুমী চায়ে চুমুক দিয়ে ইসমাইল মাস্টারের দিকে তাকাল।
: সিলেট বিভাগে থানার সংখ্যা ৪০টি। এই বলে ইসমাইল মাস্টার চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, ওঃ সিলেট বিভাগের আয়তন বলা হয়নি, কোন শহর বা দেশকে জানতে হলে তার আয়তন জানাও খুব জরুরী। সিলেট বিভাগের আয়তন হল ১২.৫৯৬ বর্গ কিলোমিটার, সিলেট জেলার আয়তন ৩.৪৯০ বর্গকিলোমিটার। এই বলে তিনি আবারো চায়ে চুমুক দিলেন। শাহী ঈদগাহ, হযরত শাহজালালের দরগাহ, শাহ পরাণের মাজার, আলী আমজদের ঘড়িঘর, লাক্কাতুরা চা বাগান, এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ড, জাফলং, এসব সহ সিলেটে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, সুনামগঞ্জে আছে হাছন রাজার বাড়ী, টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকের ঘাট, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত আছে মৌলভীবাজারে, জৈন্তার রাজবাড়ী, শ্রী চৈতন্যের জন্মস্থান, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী, তুমি দেখলেই বুঝবে কি সুন্দর সিলেট। তুমি তো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও চিনো না?
রুমী কাপ রাখতে রাখতে বলল, না, তবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ফ্রেন্ড আছে।
: তোমার বন্ধু? কি করে?
: চাকরী,
: এম.এ.জি.ওসমানী মেডিকেল কলেজ চিনো?
: না:
: ভোলাগঞ্জ, সৈয়দ বাড়ী টুল টিকর, এই নামগুলোই মনে হয় প্রথম শুনছো,তাইনা?
রুমী মহা বিপদে পড়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না।
: ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, কীন ব্রিজ সবই তোমাকে চিনাতে হবে।
: জী, সবই চিনে রাখা ভালো, এলাম যখন সব কিছু দেখেই যাই।
: হুঁ, আমি সিলেট সম্পর্কে একটু ইতিহাস লিখেছিলাম, সিলেটের ডাকে প্রকাশিতও হয়েছিলো, তুমি বোধহয় দেখনি, না দেখেছ?
রুমী বিস্ময় প্রকাশ করার চেষ্টা করে বলল, ইতিহাস? কই নাতো!
: বসো নিয়ে আসছি। এই বলে ইসমাইল মাস্টার কিয়ৎ ক্ষণ দেরি করলেন না তার রুমে চলে গেলেন। বাসন্তী দাঁড়িয়ে ছিল বাবা চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, রুমীর ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে পালিয়ে যেতে, কিন্তু যাওয়া যাবে না। বিপদ যখন আসে চার দিক দিয়েই আসে। মাস্টার সাহেব মনে হয় আজ সিলেটের ইতিহাস নিয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দিবেন।
: এই দেখ পেয়েছি। বলতে বলতে ইসমাইল মাস্টার ফিরে আসলেন। হাসি মুখে বললেন, জোর করে ধরেছিল বলে লেখা, হাতে সময় ছিলোনা, বলতে পারো এক বসাতে লেখাটা শেষ করতে হয়েছে। বলতে বলতে তিনি হাসলেন। আগের জায়গায় বসে আদিকালের পত্রিকার পাতাটি মেলে নিজেই পড়তে লাগলেন তার স্বরচিত সিলেটের ইতিহাস, বাসন্তী চলে গেলো। মনে হয়, এই বাসায় যে আসে তাকেই মাস্টার সাব সিলেট নিয়ে লেখা তার ইতিহাস শুনিয়ে ছাড়েন।
ইসমাইল মাস্টার, গুরু গম্ভীর স্বরে পড়তে লাগলেন,
ইতিহাসবিদদের মতে বহুযুগ ধরে সিলেট একটি বাণিজ্যিক শহর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত শহর, ধারণা করা হয়, হরি কেলা রাজত্বের মূল ভূখণ্ড ছিল এই সিলেটে। ১৪শ শতকের দিকে এই অঞ্চলে ইসলামী প্রভাব দেখা যায় সূফী দার্শনিকদের আগমনের মাধ্যমে। ১৩০৩ সালে মুসলিম সাধু হযরত শাহজালাল (র:) মক্কা থেকে দিল্লি ও ঢাকা হয়ে সিলেটে আসেন। তাঁর ছিল পরিসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, তিঁনি মূলত ইসলাম প্রচার করার জন্যই এই শহরে আগমন করেছিলেন, তাঁর ইসলাম প্রচারের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে ইসলাম শুধু সিলেটেই নয় এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সিলেট শহরের মুসলিম সাধু হযরত শাহজালাল (র:) এর দরগাহ অবস্থিত, এই দরগাহ শরীফ সিলেটের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া হযরত শাহ পরান (র:) শাহ কামাল (র:) এর সান্নিধ্যে এসেও সিলেটের বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তাদের শাসনামলে সমগ্র ভারত বর্ষের মতো এই শান্ত প্রিয় এলাকাতেও শাসন চালাত। ১৭৭৮ সালে রবার্ট লিন্ডেস যখন সিলেটের দায়ভার পান তখন সিলেটের সর্বস্তরের জনতা তাকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ১৭৮১ সালে সিলেটে বড় ধরণের বন্যা হয়, বন্যায় অসংখ্য পাখি নিহত হয়, ফসল নষ্ট হয়, এই বন্যার জন্য সিলেটের আমজনতা ব্রিটিশদের কেই দায়ী করেন। পীরজাদা নামে পরিচিত সৈয়দ মাহাদী ও সৈয়দ হাদীর নেতৃত্বে এর প্রতিবাদে একটি আন্দোলনও হয়ে যায় তখন, যার শেষ পরিণতি যুদ্ধেও লিপ্ত হতে হয় সিলেট বাসীদের। দুঃখের বিষয় সেই যুদ্ধের ফল শ্রুতিতে অনেক সিলেট বাসী নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে জানের ভয়ে-প্রাণের ভয়ে পাড়ি জমান সুদূর লন্ডনে, এবং এক সময় সিলেটের সেই সব মানুষ লন্ডনেই বসত গড়ে তুলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেট ও আসাম একত্র ছিল। ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ গঠনের সময় আসাম থেকে সিলেটকে আলাদা করা হয়। ১৯৭১ সালে লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে লাখো নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন হল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সিলেট স্বাধীন বাংলার ভূখণ্ডে পড়ে। উত্তর ,পূর্ব, ও দক্ষিণদিকের উঁচু উঁচু পর্বত শ্রেণীর পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে বর্তমানে সিলেট বিভাগ। সিলেটের চার পাশে অবস্থান করছে, মেঘালয়, খাসিয়া, জয়ন্তীয়া, ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চল। সিলেটের প্রাচীন নাম শ্রী হট্ট। সিলেট বিভাগ পূর্ব দিক থেকে ত্রিবেণীর আকারে পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে। উত্তরে মেঘালয়, দক্ষিণে ত্রিপুরা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, পশ্চিমে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ…
মাস্টার সাহেবের এই ইতিহাস পাঠ খুব অসহ্য লাগছে রুমীর, উনি যে বক্তৃতা শুরু করেছেন তা কখন শেষ হবে কে জানে। রুমী সব বিরক্তি ছাপিয়ে তবোও অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে মাস্টার সাহেবের দিকে, রুমী এমন ভাব করছে যেন সে এই রচনায় অবাক থেকে অবাক হচ্ছে। তার অঙ্গ ভঙ্গিমা যেন বিস্ময় নিয়ে বলছে, কি করে এত জ্ঞানগর্ভ ইতিহাস মাস্টার সাব রচনা করলেন?
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..