ঘৃণা (পর্ব – ৫)

শাহীদ লোটাস
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
ঘৃণা (পর্ব – ৫)

রান্না ঘরে গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া গেল। হামিদা খাতুন তসবি টানছেন, মাত্র আসরের নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসেছেন তিনি, তসবি শেষ না হলে জায়নামাজ ছেড়ে উঠবেন না। হামিদা খাতুন পড়ছেন‘ সুবহানআল্লাহ, সুবহানআল্লাহ, সুবহানআল্লাহ’। আবার গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া গেলো। ঘটনা কি? রান্না ঘরে জোছনার মা আছে, সেই কি গ্লাস ভাঙ্গছে? হামিদা খাতুনের জপমালা ঠিক হচ্ছে না, বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে, ধ্যান ভেঙ্গে যাচ্ছে, আল্লাহর নাম পাঠের সময় দুনিয়াবি কোন খেয়াল রাখা ঠিক না, সব শয়তানের ধোঁকা। তিনি আবার মনে মনে বলতে শুরু করলেন ‘আল হামদুলিল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ’। কিছুক্ষণ পর আবারও গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া গেলো, বাসায় কি কেউ নেই নাকি?  হামিদা খাতুন মাসলা থেকে উঠলেন না তিনি তিন তসবি শেষ না করে জায়নামাজ ছেড়ে উঠবেন না, তিনি মানে মনে পড়ছেন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। হাদিস শরীফে আছে যে ব্যক্তি সকাল, সন্ধ্যায় ১০০ বার সুবহানআল্লাহ পড়বে তার আমল নামায় ১০০ হজ্বের নেক লেখা হবে, যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যায় ১০০ বার‘ আল হামদুলিল্লাহ পড়বে তার আমল নামায় ১০০ ঘোড়া জিহাদের জন্য সদকা করার সোয়াব লেখা হবে, যে ব্যক্তি সকাল  সন্ধ্যায় ১০০ বার ‘ লাই লাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়বে তার আমল নামায় ১০০ গোলাম আজাদের সোয়াব লেখা হবে আর যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যায় ১০০ বার ‘আল্লাহু আকবর’ পড়বে ঐ দিন তার চেয়ে বেশি নেককারী একমাত্র সেই ব্যক্তিই। হামিদা খাতুন ‘ আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়ালেন, এমন সময় বাসন্তীর গলা শোনা গেলো, ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সে চেঁচিয়ে বলছে, কি ব্যাপার গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ আসে কোথা থেকে ? বলতে বলতে মনে হয় রান্না ঘরের দিকেই গোল সে, রান্নাঘরে গিয়ে বাসন্তীর গলার স্বর আরও চড়া আকার ধারণ করলো, চেঁচিয়ে জোছনার মাকে ঢাকছে বাসন্তী। হামিদা খাতুনের তিন তসবি পাঠ শেষ হয়েছে, আজ পাঠ ঠিক-ঠাক হয়নি বলে তার ধারণা।

তিনি রান্না ঘরে গিয়ে দেখলেন, জোছনার মেয়ে শাবনুর মেঝেতে বসে আছে সামনে ভাঙ্গা গ্লাস, শাবনুর বাসন্তীকে দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। হামিদা খাতুন জোছনার মায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন। জোছনার মা এই বাসার পুরাতন গৃহকর্মী,  সাত আট মাস আগে একবার ভেগে গিয়েছিলো এখন আবার এসেছে। একটি কাজের মেয়ে থাকা সত্যেও তাকে রাখা হয়েছে আবার। জোছনার মায়ের রান্না এই বাসায় সবার ভালো লাগে, তাই মাঝে মধ্যে তাকে রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয়,  তাছাড়া তার কাজকর্ম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

জোছনার মা দৌড়াতে দৌড়াতে রান্না ঘরে আসলো, বাসন্তী আর হামিদা খাতুনকে দেখে হকচকায়ে গেলে সে। জোছনার মার হাতে একটি মেঙ্গো জুস, সেই জুস আড়াল করার চেষ্টা করছে, চেষ্টা সফল হচ্ছে না।

বাসন্তী ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, কোথায় ছিলে?

জোছনার মা কিছুটা ঘাবড়ে গেছে, সে বুঝতে পেরেছে সামনের ভাঙ্গা গ্লাসগুলো তার নাতিই ভেঙ্গেছে।

হামিদা খাতুন শান্ত গলায় বললেন, তোমার আক্কেল জ্ঞান কোন দিনই হবে না নাকি? একে একা রেখে কোথায় গিয়ে ছিলে? গ্লাস ভাঙ্গা খেলা খেলছে, বটি দিয়ে খেলা খেললে কি হতো? আমাদের ফাঁসাতে, তাই না?

জোছনার মা ভাঙ্গা গ্লাস পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। কাঁচের গুড়ো গুড়ো টুকরো অনেকটুকু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। বাসন্তীর চোখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো তারপর আর তাকাতে পারলো না সে । পাশে শাবনুর কাঁদছে সে দিকেও জোছনার মা তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।

ইসমাইল মাস্টার বাসায় ফিরলেন। তিনি এসেই বাসন্তীকে ঢাকতে লাগলেন। ইসমাইল মাস্টারের ডাকার ধরন দেখে বুঝা যায় বিরাট কিছু হয়ে গেছে। কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু না হলেও ইদানীং তিনি হইচই করেন। বাসন্তী বাবার কাছে চলে গেলো । হামিদা খাতুনও বাসন্তীর পিছু পিছু গেলেন।

ইসমাইল মাস্টার কাপড় বদল করছেন, হামিদা খাতুন সেই কাপড় আলনায় রাখছে। ইসমাইল মাস্টার খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন, চারদিকে ইনফুয়েঞ্জা শুরু হয়ে গেছে, বুঝলে, ইনফুয়েঞ্জা, আজ ইস্কুলে দুইজন শিক্ষক অনুপস্থিত, সর্দি জ্বর, এই ঋতুতে সর্দি-জ্বর কোন কালে দেখেছে ? প্রশ্ন করে ইসমাইল মাস্টার হামিদা খাতুনের মুখের দিকে তাকালেন, হামিদা খাতুন কি বলে শুনার অপেক্ষায় রইলেন।

হামিদা খাতুন বললেন, হুঁ।

বাসন্তী এসেও আবার চলে গেলো, বাবা তাকে এমনি এমনি ডেকেছেন, আসলে তিনি ডেকেছেন মাকে, মাকে সরাসরি ঢাকতে লজ্জা পান বলে বাসন্তীকে ডাকা।

: সিজন সব উলট পালট হয়ে যাচ্ছে, গ্রীষ্মকালে ঝড়-তুফান নেই বর্ষাকালেও নেই, বছরে বছরে দুই একবার ঝড় আসে, এই দুই একবারেই দেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে যায়, আবার নামও নেয়, সিডর, আইলা, কোমেন, আগে যে আম পড়া জড় হতো সেই সব কি পাঠ্য বই ছাড়া বাস্তবে আর পাওয়া যায়? এই বলে ইসমাইল মাস্টার হামিদা খাতুনের মুখে আবার তাকালেন।

হামিদা খাতুন আগের মতোই বললেন, হুঁ।

: আমরা সিলেটের মানুষ বড় আরামে আছি, ঢাকায় যারা থাকে তাদের বারোটা বেজে যাচ্ছে, মুক্ত হাওয়া নেই, গাছের ছায়া নেই, একটু দৌড়ানের মত খোলা জায়গাও নেই, সব সময় গ্যাসীয় আবহাওয়া, তাদের এসি ছাড়া বুদ্ধি নাই, এসিতে আবার নানান কাহিনী, দুই দিন পর হাঁপানি, ক্যানসার, নানান রোগ।

এমন সময় বাসন্তীর গলার আওয়াজ আবার পাওয়া গেলো । কাজের মেয়েকে কি যেন বলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইসমাইল মাস্টার তোয়ালে নিয়ে রান্না ঘরে গেলেন। বাসন্তী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তিনি পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করলেন, রেণু ফ্যা ফ্যা করে দাঁড়িয়ে আছে রান্না ঘরের এক কোনায়। ইসমাইল মাস্টার কে দেখে বাসন্তী আরও রেগে গেলো ।

ইসমাইল মাস্টার বললেন, কি হয়েছে?

বাসন্তী উত্তর না দিয়ে হামিদা খাতুনের দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলল, মা একে আজই বিদায় করো, চোর রেখে বিপদ ডেকো না।

কিছুক্ষণ পর জানা গেলো বাসন্তীর ভ্যানিটিব্যাগ থেকে দুইশ টাকা পাওয়া যাচ্ছে না । এর আগেও রেণু বেশ কয়েকবার ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়েছে, এই বার টাকা পাওয়া যাচ্ছে না দেখে বাসন্তী নিশ্চিত টাকাটা রেণুই নিয়েছে। জোছনার মা কিছুই হয়নি এমন দায় ছাড়া ভাব নিয়ে নিজের মনে কাজ করছে ।

ইসমাইল মাস্টার শান্ত কণ্ঠে রেণুকে জিজ্ঞাসা করলেন, টাকা কোথায় রেখেছিস?

রেণু কেঁদে ফেললো, এই এক ঝামেলা, কাজের লোকদের কিছু বললেই ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে ফেলে।

ইসমাইল মাস্টার বললেন, আর যেন এসব না শুনি, চুরি-চোট্টামি আমার পছন্দ নয়, টাকার দরকার থাকলে আমাকে বলবি, কিছু খেতে মন চাইলে আমাকে জানাবি, চুরি করবি কেন?

রেণু কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি চুরি করতাম কেড়ে, আমি কোনতা জানি না।

: না জানলে নাই, এখন কান্না বন্ধ।

রেণু এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। গরীব মানুষ, মাস্টার সাহেবের মায়া ধরে গেছে, হামিদা খাতুন বিরক্ত হয়ে বললেন,  হয়েছে, কান্না থামিয়ে কাজ করো।

ইসমাইল মাস্টার ফ্রেশ হয়ে এলেন, সামনে চা নাস্তা দেওয়া হয়েছে, রেণুই সব নিয়ে এলো। মাস্টার সাহেব ভাবতে লাগলেন, এই দেশের সব চেয়ে হৃদয়বান মানুষও হয়তো কাজের লোকদের সাথে সৌহার্দ্য আচরণ করেন না, সবাই চায় কাজের লোকজন মনিবদের ভয় পাক, এতে সুবিধে আছে, কাজকর্ম ওরা ঠিকঠাক করবে, অলসতা কখনই করবে না।

হামিদা খাতুন কি বলতে ইসমাইল মাস্টারের কাছে আসলেন, সম্ভবত এখনি চলে যাবেন। অথচ এক সময় এই বারান্দায় তারা দুজন বসে কতো গল্প করেছেন। ছেলে হলো মেয়ে হলো দুজনই ব্যস্ত হয়ে গেলেন, হঠাৎ এক সময় বুঝতে পারলেন তারা দুজন দুজনের কাছ থেকে অনেক দুরে সরে গেছেন, কাছে আসা আর স্বাভাবিক মনে হল না, কখনো অভিমান, কখনো রাগ, সব মিলিয়ে নিজের মতো চলতে লাগলেন দু-জন। চলতে চলতে আবার এক সময় বুঝতে পারলেন ছেলে মানুষী তাদের আর মানায় না তখন কাছে আসতেও কেন যেন লজ্জা লজ্জা লাগতে লাগলো, সেই লজ্জা চিরদিনের জন্য বাসা বেধে রইলো দুজনের মনে।

হামিদা খাতুন সামনের চেয়ারে বসলেন, ইসমাইল মাস্টারের কেন যেন কাশি এসে গেলো, অনেক দিন পর তিনি স্ত্রীর সঙ্গে বারান্দায় বসে আছেন।

হামিদা খাতুন আম গাছটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ সাজ্জাদের কোন ফোনতে পেলাম নাতো, ছেলেটা কেমন আছে?  কি খরব?  কিছুই জানি না।

ইসমাইল মাস্টার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ওর মোবাইল ফোন তো আজ বন্ধ, বিষয় কিছুই বুঝতে পারছি না।

: একবার খোঁজ নেওয়া দরকারও মনে হল না?

ইসমাইল মাস্টার থ খেয়ে গেলেন। হামিদা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ইসমাইল মাস্টারআমতা আমতা স্বরে বললেন, একবার পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিবো কি?

: খোঁজ নিবেন কেন? খোঁজ নেওয়ার কথা না বললে এক পা ও তো নড়বেন না, সংসারের প্রতি কোন খেয়াল আছে আপনার? এই বলে হামিদা খাতুন উঠে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হবে, তা না হলে ইসমাইল মাস্টার এখনি পত্রিকা অফিসের দিকে রওনা হতেন। মাগরিবের নামাজের পরেও পত্রিকা অফিস খোলা থাকে। মন বড় অস্থির করছে তার। হামিদাতো ঠিকিই বলেছে, খোঁজ নেওয়াত তার উচিৎ ছিল। ইসমাইল মাস্টার সিদ্ধান্ত নিলেন, রুমীকে নিয়ে এখনি একবার পত্রিকা অফিসে যাবেন, ঘটনা কি জানা দরকার।

ইসমাইল মাস্টার রুমীকে নিয়ে পত্রিকা অফিসের দিকে রওনা দিলেন। তাদের ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গেলো। এই ফাঁকে একবার মাজারেও গিয়েছিলো দুজন। মাজারে রাতের সময়টায় লোকজন থাকে বেশি, দুর-দূরান্তে থেকে আসা ভক্ত আশে কানদের ভিড় থাকে অনেক। শিষ্য সাধকদের মানত করা ছাগল, ভেড়া, গরু ঘুরে ঘুরে দেখলো তারা । ইসমাইল মাস্টার রুমীকে মাজারের পাশের পুকুরের গজার মাছের কাহিনী বললেন বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। ফিরতে ফিরতে আবার সেই সিলেটের ইতিহাসের কিছু আলোচনাও হল। পত্রিকা অফিসের একজন ইসমাইল মাস্টার কে বলেছেন, স্যার আপনার লেখার হাত ভালো, আগে লেখা-লেখি করতেন এখন করছেন না কেন? আবার শুরু করুন, দেশে এখন কত বিষয়, বিষয়ের কোন শেষ নেই, স্টার্ট করুণ স্যার।

এই বিষয়টিও ইসমাইল মাস্টার কে বেশ ভাবাচ্ছে, কিছু একটা করতে হবে, সামনে দীর্ঘ অবসর, অলস জীবন যাপনে কোন আনন্দ নেই।

রিক্সায় বসে আছেন ইসমাইল মাস্টার আর রুমী। আজ আর বৃষ্টি হবে না, মেঘ মুক্ত আকাশ, তারকা রাশিতে ঝলমল করছে আকাশের ভিটা। রাত হলেও রোড-ঘাটে ব্যস্ততা আছে। অনেক দিন পর ইসমাইল মাস্টার রাতের আলোয়ে পথে বের হয়েছেন, বেশ ভালো লাগছে তার, মন কেন যেন শান্ত শান্ত আবার চঞ্চলও লাগছে।

ইসমাইল মাস্টার রুমীকে বললেন, রুমী কি করা যায় বলতো?

রুমী কিছু বুঝতে পারলো না। মুখ ফিরে বলল, কোন বিষয়য়ে?

: সামনে অবসর জীবন যাপন আসছে, সময় কিভাবে কাটাবো বুঝতে পারছিনা।

: কেটে যাবে, সংসার দেখা শুনা করবেন, বই পড়বেন, শৈশব কৈশোর বন্ধুদের খোঁজে বের করবেন, আড্ডা দিবেন বিকেল বেলায় হাঁটবেন, রাত্রে টিভি দেখবেন।

: আমি এই সব নিয়ে ভাবছি না, আমি ভাবছি লেখালিখি আবার শুরু করবো কি না, এক সময় তো প্রচুর লিখতাম।

রুমী সামান্য অবাক হল, কিন্তু মাস্টার সাহেব কে তা বুঝতে দিলো না,স্বাভাবিক ভাবে বলল, লেখালেখি করতে চান?

: না, তা না, টুকটাক গবেষণা।

: মন্দ না, করতে পারেন।

ইসমাইল মাস্টার মনে হয় একটু হালকা হলেন, এখন মন বেশ ফুরফুরে লাগছে। রাতের শীতল বাতাস এসে লাগছে তাদের দুজনার গায়ে। তারকায় ঝলমল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন মাস্টার সাহেব। রিক্সা থেকে উপড়ে তাকাচ্ছেন তিনি, অনেক দিন পর আকাশ দেখা হচ্ছে তার। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে আকাশ কখনো পুরাতন হয় না, বৃষ্টির স্নান কখনো বিতৃষ্ণার হয় না, জোনাকির ঝিঝি কখনো কু মধুর হয় না। ইসমাইল মাস্টারের মনে কবি কবি ভাব চলে এসেছে, তিনি বললেন কোন বিষয় নিয়ে আগে লিখা যায়?

রুমী উত্তরে বলল, যে বিষয় গুলো আমরা খুব সাধারণ ভাবি গুরুত্ব দেই না, সেই বিষয় নিয়ে লিখা বুদ্ধি মানের কাজ হবে।

: বুঝিয়ে বল।

: আমরা লিখার জন্য খুব ভাবি, আনকমন আর চমকপ্রদ বিষয় খুঁজি, কিন্তু আমাদের চারপাশে যায় ঘটছে তা নিয়ে কখনো ভাবি না, আসলে চারপাশের সাধারণ বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার, এক দম কাছের বিষয় নিয়ে ভাবলে আরও ভালো হয়।

ইসমাইল মাস্টটার একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন।

রাতের খাবার সেরে ইসমাইল মাস্টার বিছানায় শুয়ে আছেন, তার ঘুম আসছে না। হামিদা খাতুন কাজকর্ম শেষ করে শুয়ে পড়লেন। মাস্টার সাহেব এখনো ঘুমায় নি।

পাশ থেকে হামিদা খাতুন বললেন, ঘুমচ্ছেন না কেন?

ইসমাইল মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এমনি।

: শরীর খারাপ, বাসন্তীকে ঢাকবো?

: না ঢাকতে হবে না, শরীর আমার ঠিকিই আছে।

: বাতি নিভিয়ে দিলাম, বলতে বলতে বাতি নিভিয়ে দিলেন হামিদা খাতুন।

রাত বোধহয় এগারোটার উপরেই হবে, চারদিক স্তব্ধ নীরবতায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

ইসমাইল মাস্টার বললেন, হামিদা লেখালিখিটা আবার শুরু করলে কেমন হয়?

হামিদা খাতুন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কিসের লেখা-লিখি?

: তুমি সব ভুলো গেলে? এক সময় কত গল্প কবিতাই না লিখতাম আমি!

হামিদা খাতুন নিচুস্বরে বললেন, ফাউল আলাপ বন্ধ করেন, আপনি আবার কবে গল্প কবিতা লিখতেন?

হঠাৎ ইসমাইল মাস্টারের কণ্ঠস্বরের বিকৃতি ঘটে গেলো, গলাভাঙার মত স্বরে তিনি বললেন, তোমার মনে নেই?

: না মনে নেই।

: তোমাকে নিয়েও তো বেশ কয়েকটা কবিতা লিখেছি!

: আমার বিষয়ে যা লিখেছেন তা কবিতা না, মন ভোলানো ফাউল প্যাঁচাল, রাত অনেক হয়েছে  ঘুমান।

ইসমাইল মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওপাশে কাত হয়ে শুয়ে রইলেন, তার ঘুম এলো অনেক পড়ে।

কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ’ অর্থ পাচার করলে স্থানীয় সম্পদ ক্রোক’ শিরোনামের এক খবর নিয়ে ইসমাইল মাস্টার বেশ উদ্বিগ্ন, রুমীকে ডেকে এনে তিনি পত্রিকা থেকে কিছু অংশ পড়েও শোনালেন,  ” কোন ব্যক্তি অর্থ বা সম্পদ বাংলাদেশ থেকে পাচার করলে, পাচার করা ওই অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনা না গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির দেশে থাকা সম্পদ বা অর্থ পাচার করা অর্থ সম্পদের সমমূল্যের অর্থ সম্পদ ক্রোক করার বিধান আসছে। ” এই বলে ইসমাইল মাস্টার রুমীর মুখে তাকালেন, তারপর আবার পড়তে পড়তে রুমীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, পাচার করা সম্পদ বা অর্থ যাই হোক না কেন জরিমানা কিন্তু দিগুণ হবে, রুমীর দিকে তাকিয়েই তিনি বললেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইন ২০১৫- এর খসড়া অনুমোদন করছেন মন্ত্রী সভা। কিছু সময় বিরতি নিয়ে ইসমাইল মাস্টার উদাসভাবে বললেন, দেখেছো দেশের কি অবস্থা? বলতে বলতে আবার থামলেন, আবার বলতে শুরু করলেন, বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক সমাজ, সরকারি আমলা প্রায় সবাই কোন না কোন ভাবে সুযোগ সন্ধানী, তারা কোন না কোন ভাবে দুর্নীতিতে জড়িত, সেই কারণেই ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়, অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার।

মাস্টার সাহেবের কথায় স্বর মিলিয়ে রুমী বলল, এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দুদকের সহায়তায় গণহারে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করা হয়, তার মানে কি দাঁড়ালো? ক্ষমতাধররা দুর্নীতি করলেও তারা পার পেয়ে যাবেন, তাদের কিছু হবে না, আবার তারাই ঘুরে ফিরে কোন না কোন ভাবে দেশ শাসনের অধিকার পাবেন, আবার দুর্নীতি করবেন ।

ইসমাইল মাস্টার দুঃখ করে বললেন, এই ভাবে চলতে থাকলেতো দেশ এগুবে না ! এর প্রতিবাদ করতে হবে! এই দেশে কি হয় না! বিনা বাধায় টেন্ডার বাজি, শেয়ার বাজার নিয়ে লক্ষ লক্ষ পরিবারের ভবিষ্যৎ হরণ, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক লুটপাট, খাল-বিল-নদী দখল, রাষ্ট্রের ভূমি সম্পদ লুটপাট, সবই হচ্ছে। আমরা সবাই এখন এসব বুঝতে পারি। বড় পরিতাপের বিষয় হল যখন জাতীয় বাজেটের দোহাই দিয়ে এই সব কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, কেন এই সব করবে ? যারা অবৈধ উপায়ে কালো টাকার কুমির হয়েছে, তাদের টাকা জব্দ করতে হবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে, তবেই না অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো বন্ধ হবে।

রুমী বিনয়ের সঙ্গে মাস্টার সাহেবের কথায় সমর্থন দিয়ে বলল, জী হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

ইসমাইল মাস্টার নিজের কথার নিজেই ভুল ধরে বললেন, এতে আবার সমস্যাও আছে, বিদেশে অর্থ পাচার বেড়ে যাবে ।

রুমী এবার সংলাপ একটু বারিয়ে বলল, অর্থ পচার সাধারণত যারা করেন তারা ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হন, একজন দরিদ্র ব্যক্তি কখনই অর্থ পাচার করতে পারেন না, দরিদ্র ব্যক্তি যা করতে পারে তা হল, বিদেশের মাটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার পারিশ্রমিক নিজ দেশে সঞ্চয় করতে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজন দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকেন, যে কারণে নির্বাচনের সময় যখন ঘনিয়ে আসে  তখন আসন্ন অনিশ্চয়তার কারণে তাদের অর্থ তারা বিদেশে পাচার করতে থাকেন, কারণ তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অর্থ সম্পদ গড়েছেন, তার দল পরবর্তীতে ক্ষমতায় না এলে তিনি বিপদে পরে যাবেন, যার প্রমাণ স্বরূপ ২০০৫. ২০০৬. ২০১২ সালে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়া। তাছাড়াও বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, নিজেদের সন্তান পরিবার নিজের নিরাপত্তার  নিশ্চয়তার জন্য বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছেন, সবচেয়ে বড় বিষয় টাকা পাচারের বিষয়টি সুশাসনের সঙ্গে জড়িত। অস্বচ্ছ ব্যবসায়ী লেনদেন, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে এই অর্থ স্থানান্তর করা হয়। দেশে বিনিয়োগ ব্যবসার পরিবেশ ভালো না থাকাও অর্থ পাচার অনেক হারে বেশি হওয়ারও একটি কারণ। আমাদের সম্পদ, আমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত বাংলাদেশের অর্থ চলে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।

ইসমাইল মাস্টার নড়েচড়ে বসতে বসতে বললেন, ঠিক বলেছ। বলতে বলতে রুমীর মুখে তাকিয়ে রইলেন আরও কিছু শোনার অপেক্ষায়।

রুমী বলল, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সঙ্গে ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির ( ইউএফআই ) যৌথভাবে প্রণয়ন করে ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ : ১৯৯০-২০০৮, ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে এলডিসিভুক্ত ৪৮টি দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা তুলে ধরা হয়, এতে বলা হয় ১৯ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৪১৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে পাচার হয় ১১১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, এরশাদ সরকারের পতনের সময় এ অর্থ পাচার হয়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫- এ পাঁচ বছরে অর্থ পাচার হয় ২০১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল নাগাদ অর্থ পাচারের পরিমাণ ৬৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ডলার, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ১ হাজার ২১৬ কোটি ডলার, ২০০৬-০৮ সালে ১ হাজার ২৩৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।

২০১১ সালে পাচার হয় অন্তত ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার,  ২০১২ সালে ১৭৮ কোটি ডলার। তথ্যমতে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে, ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার, আর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ থেকে কোন অর্থই বিদেশে পাচার হয়নি। ২০০৯ সালে অর্থ পাচার কিছুটা কমে গিয়ে আবার ২০১২ সালে বেড়ে যায়। এই অর্থ পাচারের কারণে সরকার ঋণ ও অনুদান নিচ্ছে বাইরের দেশগুলো থেকে অন্যদিকে দেশের নিজস্ব আয় বাইরে চলে যাচ্ছে, ফলে আয় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছে আমাদের মাঝে।

এমন সময় বাসন্তী চা-বিস্কিট নিয়ে এলো, রুমী ভদ্রতার খাতিরে বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করেছিলো, বাসন্তী বোধয় খেয়াল করেনি, চা রেখেই চলে গেছে। ইসমাইল মাস্টার এক পিস বিস্কিট মুখে নিয়ে বললেন, ওয়ান-ইলেভেনের প্রভাব সমস্ত বাংলাদেশের মতো তোমাদের ঐখানেও কি পড়েছিল নাকি?

রুমীও এক পিস বিস্কুট মুখে দিয়ে বলল, জী, আমাদের ওখানেও পড়েছিলো।

ইসমাইল মাস্টার একটু নড়ে চড়ে বসতে বসতে বললেন, ওয়ান-ইলেভেন আসলে ব্যাপারটা কি ? আমরা সবাই জানি ওয়ান-ইলেভেন হল বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্নীতিবিরোধী একটি চমৎকার সময়, যে সময় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ দুর্নীতিবাজ কেউ রেহাই পায়নি, যে সময় এই দেশের প্রায় সবাই সুফি হয়ে যাচ্ছিল, আমরা এমনটা ইতো সবাই জানি তাই না ? আসলে ভেতরে অন্য কিছু কি আছে?  সে সময় কি দুর্নীতি একেবারেই হয়নি?

রুমী ইসমাইল মাস্টারের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ওয়ান-ইলেভেন হচ্ছে স্বাধীন বাংলার এমন এক সময় বা অবস্থা যে অবস্থাতে ওয়ান-ইলেভেনের মুল লক্ষ্য সাধিত হলে বাংলাদেশের শুধু বাংলাদেশ নামটিই থাকতো আর ষোল কোটি বাঙালিকে ম্যাজিক দেখানোর মতো অবশ করে এই দেশ আবার ফিরে যেতো ১৯৭১ এর আগের অবস্থানে। বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষ বুঝতেই পারতো না আসলে এই দেশে কি হচ্ছে, সবাই দেখত স্বাধীনতার পর সব চেয়ে নেতৃত্বদানকারী প্রভাবশালী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় নেতা-কর্মী এমন কি সাধারণ সমর্থকও দুর্নীতির দায়ে জেলে যাচ্ছে, জেল হচ্ছে । জনগণ ওয়ান-ইলেভেনের দেশ পরিচালনাকারী সবাইকে বাহবা দিতো যেমনটি দিয়েছেন, যে এমন শাসকেই এই দেশে দরকার ছিল এতো দিন, যে শাসক কাউকেই ভয় পাচ্ছে না, যার বাঁচা মরার কোন চিন্তা নেই, মূল চিন্তা দেশে কোন দুর্নীতিবাজ থাকবে না, যে দুর্নীতি করবে তার রেহাই নেই। জনগণের বাহবা পেয়ে তারা এমন কাণ্ড ঘটাত যার জন্য দেশ হারাত প্রকৃত স্বাধীনতা। কেউ বুঝতেই পারতো না, এই দুর্নীতি দুর্নীতি করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে যেমন ধ্বংস করা হচ্ছে তেমনি ধ্বংস করা হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার জেট ফোর্সের অধিনায়ক বীরউত্তম মেজর জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি-কে।

: বুঝতে পারলাম না?

: সহজ করে বললে এই রকম হয়, বাংলাদেশের বড় দুটি দলের নাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), এই দু-দলের সদস্যই মূলত বাংলাদেশের প্রধান প্রধান কর্তাব্যক্তি। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দী করা হয় মূলত এই দু-দলের নেতা-কর্মীদেরকেই, খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন তখন জামায়েত বা অন্যান্য দলের কোন নেতা কর্মীকে কিন্তু কারাবন্দী করা হয়নি, যাদের আমরা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বলে জানি । যাই হোক আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-নেত্রদের গ্রেফতার, কারা বন্দি বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই দু-দলকে নেতা শূন্য নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল ওয়ান-ইলেভেনের মূল্য লক্ষ্য, আর যখন এই বড় দু-দলের নেতৃত্ব নেওয়ার মতো কেউ থাকতো না তখনই বাংলার জনগণ দেখতে পেতো দুর্নীতিবিরোধী নামক অভিযানের মূল রূপরেখা। দুর্নীতির দায়ে এই দুই দল ধ্বংস হলে যখন কোন শক্তিশালী দল বা দলের কোন প্রবীণ নেতা আর পাওয়া যেতো না গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের মসনদে বসে যেতো ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো, ওয়ান-ইলেভেনের মূল্য লক্ষ্য ছিল এই, যার কলকাঠি নড়িয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। দেখছেন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র কত হিংস্র, কত দ্রুত, যেখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সাধারণ তৃণমূলের নেতাকে অন্যায়ভাবে কিছু করা হলে দেশে জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়ে যায়, সেখানে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার মত প্রধান ব্যক্তিদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দিলো, তারেক রহমানকে চোরের মতো মারধর করা হলো, অথচ এই দেশের একজনও টু-শব্দ পর্যন্ত করলো না!

ইসমাইল মাস্টার চশমা খোলে গ্লাস মুছে বললেন, সবাই তো তখন ইয়াহ নফসি ইয়া নফসিতে ব্যস্ত, কে কাকে দেখবে বল?

: সবাই যদি, ইয়া নফসি ইয়া নফসি বলে চুপ থাকে, তাহলে সবাই বিপদে পড়বে একসঙ্গে, ওয়ান-ইলেভেন আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। স্বাধীন বাংলার সকল রাজনৈতিক দলকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এক হয়ে কাজ করতে হবে, নইলে ওত পেতে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার দেশ দখল করে সবার বারোটা বাজিয়ে দিবে নিশ্চিত।

ইসমাইল মাস্টার চশমা পড়লেন, রুমীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, মনে করো যুদ্ধাপরাধের যে ইস্যুতে আমরা জামায়েত ইসলামকে ঘৃণা করি, বলি জামায়েত ইসলাম স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে গঠিত একটি দল, সেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে যদি বর্তমান জামায়েত ইসলামী মেনে নেয় অর্থাৎ তাদের দলে যে কয়জন যুদ্ধাপরাধের দায়ে এই দেশে অপরাধী তাদের বিচার হয়, তখন কি জামায়েত ইসলামীকে এই দেশের জনগণ স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিবে না? তখনও কি যুদ্ধাপরাধের দল না বলে জামায়েত ইসলামকে একটি ইসলামী দল বলা হবে না? তখন তো সেই দলের নেতা-নেতৃত্ব বা সকলেই স্বাধীন বাংলার নাগরিক।

রুমী মৃদু হেসে উত্তর দিলো, বলল, জামায়েত ইসলামীর ভেতরে যে নেতা বা সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে দায়ী সেই সব নেতার বিচার হলে বা জামায়েত ইসলামী দল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বের করে দিলে  যে জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশে আসবে সেই জামায়েত ইসলাম হবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীদের থেকেও আরো বেশী ভয়ংকর। আমরা হয়তো নতুন জামায়েত ইসলাম পাবো, যে জামায়েত ইসলামীর নেতা বা সমর্থক ৫২ দেখেনি ৭১ দেখেনি, এর পরেই তাদের জন্ম, তারা যুদ্ধাপরাধী নয়, আঙ্গুল দিয়ে যাদের কে বলা যাবে না স্বাধীনতাবিরোধী, তার মানে তারা বাংলাদেশেরেই লোক।  কিন্তু সেই নব্য জামায়েত ইসলামীদের যে বিশ্বাস, তাদের যে ধারণা তা কোথায় যাবে?

: তাদের আবার কি ধারণা?

: তাদের ধারণা ৭১ সালে পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মাঝে কোন যুদ্ধ হয়নি, ১৯৭১ সালে হয়েছিলো ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধের ফল হল বাংলাদেশ, পাকিস্তান বাংলাদেশের কোন নেতার কাছে কোন ব্যক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, করেছে ভারতের কাছে। তাদের এই ধারণা, বাঙালি জাতীকে এই ছোট করে দেখা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা, সেটা কি স্বঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধী থেকে ভয়ংকর  নয় ? তারা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদে মিশে গিয়ে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে না? স্বঘোষিত শত্রুকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু বন্ধু রূপি শত্রুকে ধ্বংস করা যা না,খুব কঠিন হয়ে যায়। জামায়েত ইসলামী যুদ্ধাপরাধী দল হোক আর নাই হোক তারা কখনই বাঙালির ভালো চাইবে না, বাঙালি জাতীয়তাবাদে কখনই আদর্শিক হবে না, এই বিষয় সকলকেই সচেতন থাকতে হবে । তাদের উৎপাটন ছাড়া অন্যকোন পথ আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

: তাদের উৎপাটন করার আগে আরেকটি বিষয় আমাদের ভাবতে হবে, আমরা যদি নীতি হীন হই, দুর্নীতিবাজ হই, তাহলে অন্যকে দোষারোপ করে কোন লাভ হবে না, আমরা এতো লোভী যে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান বিষয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননায় সোনা-রূপা নিয়েও জালিয়াতি পর্যন্ত করি।

রুমী হাসতে হাসতে বলল, এই সোনা-রূপা নিয়ে জালিয়াতি যখন মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি করলো তখন এর অপরাধে অপরাধী ছিল মাত্র কয়েকজন, আর যখন এই জালিয়াতির কোন বিচার হল না, তখন এই জালিয়াতির অপরাধে অপরাধী হল পুরো বাঙালিজাতি। এই জালিয়াতির জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা কলঙ্কের অহেতুক বোঝা  বয়ে বেড়াচ্ছি। এর প্রধান কারণ, এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা সকল রাজনৈতিক দলের ভেতরে আইন মানার প্রবণতা কতখানি তা লক্ষ্য করলেই অনুমান করা যাবে। আমরা সব সময় শুনে আসছি আইনের চোখে সবাই সমান, এই বাক্য এখন অন্য সব বাণীর মতই বাণী হয়ে আছে, বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। বাস্তবে যা দেখা যা তা হল প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের জন্য আইনের প্রয়োগ এক রকম আর সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ আরেক রকম। এই বৈষম্য সৃষ্টি করে মূলত ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিগণ, তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আমরা জনগণ যেমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছি তেমনি কলঙ্কিত হচ্ছে জাতি। এর মূল কারণ জনপ্রিয়তা, নেতা এবং নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি যদি জানতো তারা জনপ্রিয় নয়, জনগণ তৃতীয় চোখ দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড বিচার বিবেচনা করেন, তাহলে তারা যাই করুক একটু ভেবে চিন্তে করতেন। এক দৃষ্টিতে, আমাদের দেশে জনপ্রিয় দলগুলো তাদের জনপ্রিয়তাকে জনগণের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেন। এতে করে তারা নিজেরাই নিজেদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত করেন জাতির ।

: মানে?

: মানে, জনপ্রিয়তার কারণে কোন এক দল বাংলার মসনদে বসে যান, আর সেই সুযোগে জনগণের স্বার্থ থেকে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন বেশি। রাজনীতির নামে ক্ষমতায় এসে নেতারা যদি স্বার্থ নীতি করাই ফরজ মনে করেন তখন কি তাদের জনপ্রিয়তাই জনগণের জন্য কাল হয়ে দাড়ায় না? গণতন্ত্র গণ তত্র বলে বিশেষ কয়টি দল বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয় তৈরি হয়ে গেছে এই দেশে, আমরা বোকারা বুঝতে পারছি না, বুঝতে পারছি না তাদের ধোঁকার এই রাজনীতি…

শাহীদ লোটাস। বাংলা ভাষার লেখক, বাংলাদেশ-এর নেত্রকোনা জেলায় মোহনগঞ্জ থানায় ৩০ মে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে শাহীদ লোটাস-এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহবোধ করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ