চতুর্ভূজের পাশে সর্তা

শাখাওয়াত বকুল
গল্প
Bengali
চতুর্ভূজের পাশে সর্তা

একটি চতুর্ভূজের চারপ্রান্ত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সর্তাটা তার শেষ প্রান্তে এসে এমনভাবে ফু দিয়ে উঠে যেন এক অলৌলিক  আভা চারপাশে ছড়িয়ে যায়। এইভাবে শেষ প্রান্তে সর্তাটা এমনভাবে রাখে, যেন মনে হয়   টাস মারা আক্রান্ত ব্যাক্তিটির ব্যাথা ওখানেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সরিষার তেল তারপর ব্যথার স্থানটিতে ঘষতে থাকেন। আক্রান্ত ব্যক্তিটি তারপর কোন একসময় জানায় তার ব্যাথা সেরে গেছে। ব্যক্তির নাম সাগর বাপ। তার নাম সাগর বাপ কিভাবে হলো সে এক অজানা। গ্রামের লোকেদের এক সাধারণ ফ্যান্টাসি হলো কারও নাম পালটে দেয়া , একই সাথে নামের বিকৃতিও  তাদের খুবই বিনোদনের বিষয়। যে লোকটা অন্য মানুষের সম্মানের প্রতি সচেতন, তার নাম যখন সাগর বাপ হলো সে তখন আনন্দিতই হলো । পাড়ার মহিলারাও মহা উৎসাহে তার স্ত্রীর নামও রেখে দিল দরিয়ার মা। দরিয়ার মার ডান হাত ছিল বাকা, সে সব কাজ করতো বা হাত দিয়ে। জীবনের প্রতি অন্যরকম বিতৃষ্ণা,  তার জীবনযাপনে এক ঘোর অমানিশা ছিল। সাগর বাপের সংসার উদাসীনতা ,দরিয়ার মাকে বিশেষ কষ্ট দিত বলে মনে হয়না। আলাদা একটা বৃত্ত তাকে ঘিরে রাখতো। এমনি এক অলৌলিক বিকেলের আলো যখন সবার  মুখে মুখে একটু একটু আভা ছড়িয়ে যাচ্ছিল,যখন সাগর বাপ তখন আম গাছ থেকে আম পাড়ছিল, তখন দরিয়ার মা কোন এক কোনে,  কোন এক অলৌকিক হাসি গাছের উপর দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল, তা যখন গাছের পাতা ভেদ করে সাগর বাপের হ্নদয় অবধি কিভাবে পৌছেছিল, তা এখনও গ্রামবাসিদের  কাছে রহস্য উম্মোচনের এক অধ্যায়। কেননা দরিয়ার মার ভিতরে কখনো কোনদিন কেউ সামান্য প্রেমময় দৃষ্টি বা ঠোটের কোনায় সামান্য হাসি ঝুলে থাকতে দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা। গ্রামবাসিদের কেবল বন্দের মধ্যে  নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা ভুতুম গাছ আর দরিয়ার মার মুখ এক হয়েই ভেসে আসে। দরিয়ার মার মুখ এমন এক  নিঃশব্দ অন্ধকার ধারন করে রাখে গ্রামের মহিলাদের কাছে নিত্যদিনের আলোচনায় কেবলি এক বিদখুটে হয়ে আসে, তাদের ভেতরে থাকা ঝাল, ঝুল ঝুল হয়ে উঠে আসে, নবতর সমালোচনায় বিকৃত মুখগলো পালাগানের গুঞ্জন রুপে ফিরে ফিরে আসে। নিত্যদিনের আহারের মত করে, গ্যাসের ট্যাবলেটের মত নিয়মিত গেলে। কখনো কখনো কেউ কেউ অন্যদের সাথে কম সখ্যতার কারনে দরিয়ার মার সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে তোলবার চেষ্টা করে। দরিয়ার মার ঝাড়মোছা আর কুকুর তাড়ানোতে যে আগ্রহ ,মহিলাদের  আলাপে সেই রকম আগ্রহ কদাচিৎ দেখা যায়। একবার সর্ষে খেতের আইলধরে থাকা শাপ যে দরিয়ার মা অবলিলায় মারিয়ে গিয়েছিল,সে আলোচনা হরহামেসাই উঠে আসে। আবার গভীররাতে শিয়ালের আক্রমনে বিপন্ন কুকুরের বাচ্চা বাচানোর জন্য শিয়ালের লেজ ধরে ছিড়ে টিনের চালের উপর দিয়ে ফেলে দিয়েছিল, সেই কিংবদন্তিও বাদ যায়না আলোচনায়। গ্রামের পুরুষেরা যারা দাঁত মাজার পুর্বে অন্যের  সমালোচনা মুখের ভেতর পুরে দেয়, তারাও সাগর বাপের উদাসিন চলাফেরায় রসবোধ খুঁজে পায়। বিনোদনের ঘাটতি যেন সাগর বাপ।

শিল্পী: রিয়া দাস

 যার বাবুল নামক দুরন্ত এক কিশোরের বাবা হওয়া সত্ত্বেও সাগর বাপ নামটি সগৌরবে থেকে যায়, কেন থেকে যায় সেই রহস্য ভেদ করতে কেউ কেউ বলে উঠে , তার স্বশুর মহাশয়ই নাকি এই নামটি  দিয়ে ছিল।এই শ্বশুর মহাশয়ই পোড়াবাড়ি নামক জায়গা থেকে এক উদাসীন যুবককে বাড়ী নিয়ে এসেছিল এবং তার পালিত ডানহাত বাঁকা  দরিয়ার মার সাথে বিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনাটিকে সত্য বলে ধরে নিলে গ্রামবাসিদের আম পাড়ার সময় ঘটিত কিঞ্চিত প্রণোপোখ্যান মিথ্যে হয়ে যায়, এই আশঙ্কায় ছোরাবাপসহ  অপরাপদের গল্প জীবন্ত করার মহান দায়িত্ত্বে এগিয়ে আসে ধুরন্ধর পণ্ডিত ফয়জল, কানা হাসেন আর রসালো হোসেন। অনেকেই পন্ডিত ফয়জলের আম পাড়া বিষয়ক প্রণয়কাব্যকে অধিক পাত্তা না দেবার মৌন সিদ্ধান্তে বসে, তখনি হাছের বাপ যেন সত্যের এক উপাখ্যান হাজির করে গ্রামবাসিদের কাছে। অনেকেই পন্ডিত ফয়জলকে উপেক্ষা করার মৌনবাসনায় জল ঢেলে দিয়ে হাছের বাপের খাকানি তাদেরকে হতাশ ও হতভম্ভ করে দেয়। সেইই বলে উঠে,কিভাবে জলুর বাপের হাত ধরে বড়বাড়ীর আমগাছ  আমসুদ্ধ কিনেছিল এবং আমপাড়ার সময় জলুর মার অনুজ্জ্বল উপস্থিতি এই প্রেমময় ঘটনাইয় তার সাক্ষ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার এক আখ্যান হাসের বাপের অসাধারন বলার ক্ষমতায় মূর্ত থাকে বহুকাল। কিন্তু যখন দরিয়ার মার প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি যে সাগর বাপকে প্রেমের যমুনায় ভাসাতে পারে, এই ঘটনা যৎকিঞ্চিত গ্রামের লোকেরদের কাছে অবিশ্বাস দানা বাঁধে  কিন্তু পন্ডিত ফয়জল আর হাছের বাপের যুগল চেষ্টায় এই ঘটনার বিপরিত কোন কিছুই দাঁড়ায় না। অতএব, গ্রামবাসিরা তার শ্বশুরের আনা বা প্রেম দুটোর মাঝামাঝি চিন্তার খোরাক হারিয়ে তাদের বর্তমান  দাম্পত্য মধুর না অমধুর এই ভাবনায় বুদ হতে থাকে। যতদিন পর্যন্ত না বাবুল একটি নতুন ঘটনা, না ঘটায় ততদিন পর্যন্ত বাবুলের বাবা সাগর বাপের কাহিনিই  গল্পের খোরাক দেয়।গ্রামের লোকেদের বিনোদনের খোরাক যখন ক্রমশঃ থিতু হয়ে আসছিল , ঠিক তখনি গ্রামের অনিন্দ্যসুন্দরী মর্জিনাকে খড়েরপালার কাছে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে একটা সকালকে সারাদিনে পরিনত করে দেয় বাবুল। অনেকদিন পর গ্রামের লোকজন একটি নতুন উপাদেয় খাবার পেয়ে গোগ্রাসে  গেলবার অভিপ্রায় নিয়ে ইসমাঈলের দোকানের সামনে মিলিত হয়। অনেকের ভেতর কথার বুদুবুদ ফুটতে থাকলেও ঠিক কিভাবে একটি সামান্য ঘটনাকে একটি রসালো প্রেমোপোখ্যানে রুপান্তর করা যায়, সেই উপযুক্ত ভাষা না পেয়ে তারা কিছুটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় একে অন্যের দিকে। ক্রমশঃ তারা বিচলিত বোধ করতে থাকে। এমন সময় মতিনের উপস্থিতি এই বিচলিত লোকেদের মনের কোনার পূর্ণিমার আলো  এনে দেয়। তারা জানে মতিনের গল্প বলার ভঙ্গিতে এই রৌদ্রদীপ্ত দুপুর মুহুর্তেই শীতলতায় ভরিয়ে দেবে। মতিন এসেই নিজের গুনগান যখন বলতে থকে উপস্থিত লোকেরা অধৈর্য হয়ে উঠে কিন্তু ভরসার জায়গা যেহেতু মতিন, সেহেতু পন্ডিত ফয়জলের বলার উপর তাদের ভরসা নিহিত থাকেনা। পন্ডিত ফয়জল যে ওইবারই হাসের বাপের দ্বারা তার কাহিনির উদ্ধার পেয়েছিল সে কথা কোনভাবেই মন থেকে তাড়াতে পারেনা আর এই না তাড়ানোর যন্ত্রনা এই বাবুলের কর্মের কথনে উদ্ধার হবার একটা ক্ষীন আশা নিয়ে  উপস্থিত হয় ইসমাঈলের  দোকানের সামনে। তার ক্ষণিক আগের উপস্থিতিও গ্রামের অন্যান্যদের  অসস্থি  দেয়। মতিন এসে যখন নিজের বয়ানের পরপরই বাবুলের প্রসংগটি তোলে তখন গ্রামের জড়ো হওয়া লোকেদের মধ্যে পূর্বেই সঞ্চারিত আশা একটা কুলকিনারা পায়। বাবুল যে এই রকম একটি কাজ করতে পারে , উপস্থিত কয়েকজন নাকি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল, আশাবালী যখন দাঁতের  মধ্যে পানের পাতা সরাতে সরাতে এই কথা বলবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে তখন, অনেকেই তার না বলতে পারার বেদনা  হঠাৎ জেগে উঠে। এই সুযোগ যে আশাবালীর মতো তারাও পেতে পারতো সে অন্ধকার তাদের চোখেমুখে ভেসে উঠে। তখন আশাবালীর কথাকে ম্লান করে দিয়ে, মতিন বাবুল সংক্রান্ত এমন এমন তথ্য উপস্থাপন  করে, লোকেদের চোখ তখন আগ্রহে চকচক করে উঠে। এহেন পরিস্থিতিতে তারা যে পূর্বেই যা বলবার তা যে বলেনি তার যথার্থতা খুঁজে পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। কেউ কেউ এরই মধ্যে দ্বিতীয়বার পানটাও মুখে  পুরে নেয়। এইসব কথা খুব বেশিদিন আগায় না কারন বাবুলের মর্জিনাভীতি অপর এক প্রণয়কাব্যকে অসমাপ্ত রেখে দিতে বাধ্য করে। কেউ কেউ তখন মর্জিনার বাপদাদাদার প্রতি অগাধ সম্মান বা বাবুলের ভীতিকেও সামনে নিয়ে আসে। লোকেদের যখন কিছু উপাদানই অবশিষ্ট থাকেনা, তাদের আলোচনার তীর তখন সাগর বাপের দিকেই তাক করে প্রতিটি রাত অসন্তোষ নিয়ে কাটায়।

একদিন গ্রামের লোকেরা সকালের রোদপোহানেতে ব্যস্ত থাকাকালীন সময়ে সাগর বাপ যখন সামনে দিয়ে লুঙ্গিটা টেনে টেনে যায়, তখন তারা তাদের আকুপাকু ভাবকে আড়াল করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই জানতে পারে সাগর বাপের পুরোনো পেশায় একটি নতুন বাক খেতে বসেছে। সে বানারপাড়ের একলোকের পুরোনো ঘর এত কমদামে কিনেছে যে, এবার লাভের আশায় জলুর বাপ কোনকিছু না বলেই সাগর  বাপের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। সেইবারও যখন অবধারিতভাবেই পুরোনো টিন আর রোয়া সারক বিক্রি করে ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন জলুর বাপকে একদিন বড়বাড়ীর ক্ষেতে কাজরত অবস্থায় আবিস্কার করে গ্রামবাসি। সেই দায় সাগর বাপ অনায়াসে একটি ঋনের উপর দিয়ে পার করে , অন্যদিকে দরিয়ার মার কাসার থালাবাসন আর কানের দুল ক্ষতির পথে নিজেদের জলাঞ্জলি দেয়। এতেও দরিয়ার মাকে বিশেষ কষ্ট না দেবার বিষয়টি কতিপয় মহিলাদের স্বামীকে না দোষারুপ করার ব্রত সামনে দাঁড় করায়। সাগর বাপ যে এইরকম একটি সম্মানজনক পেশায় কিছু সম্মানিত মানুষের সাথে চলাচল করতে পারে এই তৃপ্তিই দরিয়ার মার দরিয়ায় আলাদা ঢেউ তোলেনা, বরং পরের ব্যবসায় যে নিশ্চিত লাভ আসছে এটা একমত ঠিক করাই থাকে।

গ্রামের মানুষেরা সাগর বাপকে আরও একটি নতুন পেশায় আবিস্কার করে। ঘটকালি জিনিসটা চিরকালই মানুষের অবিশ্বাসের পেশা। সাগর বাপ যখন শিউলির বিয়া কমলাপুরের এক সম্ভ্রান্ত বাড়িতে দিবার  অভিপ্রায় নিয়ে শিউলির মাকে বলে, তখন শিউলির মা তার পুরানা ঘর বেচাকেনায় যে তার যথাযথ উন্নতি নাই ,সেই কথাই তাকে স্বরণ করিয়ে দেয়। তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে, একদিন সত্যি সত্যি তারিখ  চেয়ে বসে শিউলির বাপের কাছে। শিউলির বাপ এমন রগচটা মানুষ, যার বগলে পাজুন রেখে ,শিউলির মাকে পাজুন না পাবার অপরাধে বেদম পিটানোর ইতিহাস গ্রামের প্রচলিত গল্পকে নতুন মাত্রা দেয়। সেই শিউলির বাপ যখন সাগর বাপের দৃষ্টি ছুঁয়ে সামনের টোলে এসে বসে জামাইদের বৃত্তান্ত জানতে চায়,  তখন সাগর বাপের আলাদা সাহস সঞ্চার করতে হয়। অবশেষে যখন কমলাপুরের ঐ ছেলের সাথেই শিউলির বিবাহ হয়ে যায়, তখন গ্রামবাসিদের বিহ্বলতা কয়েকদিনেও কাটেনা। উপরন্তু শিউলির বাপের সাথে বিশেষ সখ্যতা গ্রামবাসিদের সমীহের কারন হয়ে দেখা দেয়। তবে সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই কমলাপুরের ঐ বাড়ীতে সাগর বাপের ঘনঘন যাতায়াত আলোচনায় আবার মোড় ঘূরিয়ে দেয়। তবে কমলাপুরের লোকজনের কথা অনুযায়ী উনি যে খাবার দাবারের প্রতি একটা ভক্তি পোষন করে এর বেশি কিছু জানা যায়না। শিউলির বাবার বাড়িতে আসাকালীন সময়েও এর বাড়তি কাহিনী বের করার মনোবাসনা নিয়ে যারা হাজির হয় তারা বিশেষ রসদ সংগ্রহ না করবার বেদনায় পুকুরে অসময়ে গোসল করবার অপরাধে নিজ নিজ বাচ্চাদের খড়ি বা কঞ্চি দিয়ে পিটায়।

এরমধ্যেই শীতকালে নানান জনের হালখাতা চলে আসে। গ্রামের কিশোর কিশোরীরা হিসাব করে বের করে কবে কার কার হালখাতা। অতি  উৎসাহি পৌঢ়রা নতুন খবর নিয়ে আসে এবার আরও কার কার নতুন হালখাতা জোড়া দিচ্ছে। বরাবরই মোফাজ্জল ডাক্তার আর খালেক ডাক্তারের হালখাতায় হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত করে আসে গল্পবলার জাদুকর মকবুল। মকবুলের গল্প গ্রামের মানুষ  বলে মকবুলের কিরসা(কিসসা)। সারারাত মোহগ্রস্ত করে রাখে মানুষকে, যার মোহময়তা সহজেই কেটে একটা স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছন্দপতন দেখা দেয়।

মকবুলের নামের সাথে যে সাগর বাপের নামের হুবুহু মিল রয়েছে এই কথা প্রথম বারের মত তার মনে হয়। এমন বিস্ময়কর  কিসসা বলার ক্ষমতা যে তার নাই সেই হাহাকার মনের ভেতর জমে উঠে এক অজানা অতৃপ্তি কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে যেতে থাকে  তাকে। রোয়া সারকের হিসাব বেমালুম ভুলে গিয়ে কিসসার  অপার বিস্ময়কর ক্ষমতাপ্রাপ্তির লোভ তাকে পেয়ে বসে। মকবুল যখন একটা গামছাকে অনায়াসে রাজপুত্রের ঘোড়া বানিয়ে টাক টাক শব্দ করে  এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন বরিল বিলের শাদা ধবধবে পাবদা মাছের অনায়াস চলাফেরাকে মনে করিয়ে এক বিমুগ্ধতায় কেবলি সুর হয়ে অনন্য স্বরে পরিনত হয়। গলা খাকারি দিয়ে সাগর বাপ যখন কিসসা বলার চেষ্টায় রত তখন বিনোদিনীর চুলটা যেন আলতো করে তার মুখের উপর পড়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। গ্রামবাসিরা তার কিসসায় মুগ্ধ না হয়ে তার অর্ধেক চিবানো পাতায় ভাঙ্গা দাঁতের উপর দেখতে পায়।

মকবুল যখন তুমুল জনপ্রিয়তার  রেশ ছড়িয়ে মানুষের মনের মধ্যে বিশেষ আসন গেরে বসে, ঠিক তখনি কোন এক বিকেলের আলোয় তার অতি আদরের হলুদ চাদরটা জড়িয়ে হাজির হয় কালুর বাড়ির সামনে। আত্ত্বভোলা কালু এক বিচিত্র ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে মকবুলের গানের ক্যাসেট বাজাচ্ছিল, ঠিক তখনি সাগর বাপের বেরসিক ডাক, তার বিরক্তির চুড়ান্ত হয়ে ঘরের সারকের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করায় , যেন রোয়া সারক ছাড়া সাগর বাপের অন্য কোন কারনেই কাউকে ডাকার মৌন অসম্মতি জানান দেয়। বিরক্তির পরম রেশ নিয়ে কালু যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন সাগর বাপ মকবুলের শেরপুরের বাড়িতে যাবার ইচ্ছা পোষন করে হাসি দেয়। কালু সেই অকৃত্রিম হাসি উপেক্ষা করে মকবুলের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রটা যে কালুর ,সেইটা হারানোর ভয়ে তার মনের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। তবুও কোনরকমে দুরের পথের খরচান্ত বিষয়ের দিকটি সাগর বাপকে দমানোর জন্য যথেষ্ঠ কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে মনে মনে তিন আনি বাজার পেরিয়ে মকবুলের বাড়ীর সামনে কালু নিজেকে আবিস্কার করে। শেষপর্যন্ত খরচের বিষয়টা টের পেয়ে নিরাশ বদনে সাগর বাপের প্রস্থান কালু আর সাগর বাপকে যুগপদ  আনন্দ আর হতাশায় ভরে দেয়।

এমনি এক আলোকোজ্জল মঞ্চে মকবুল যখন গানের ঢালা নিয়ে হাজির হয়, এপাশে ওপাশে থাকা সস্তা জিলাপির দোকান শূণ্য হয়ে লোকজন ছোট্ট তাবুর নিচে জমায়েত হয়। অপূর্ব হ্যাজাকের আলো প্রতিটা পুরুষের হ্নদয় গহবর কানায় কানায় পূর্ণ করে, দেউরি বেড়ার আড়ালে থাকা মহিলারদেরও আল্লাদের সীমা থাকেনা, উপরন্তু কার কার কাছে পানের সাথে জর্দা নাই সেটাও তখন অবিবেচ্য হয়ে দেখা দেয়। প্রাণের পরম ভালোলাগা তখন ভালোবাসায় পরিনত হতে দেরি করেনা। আড়ালে আবঢালে থাকা ভালোবাসা মকবুলের গানের সাথে মিলিয়ে পরম পুলকিত বোধ করে , রাজকন্যার সাথে নিজেকে মিলিয়ে রাজপুত্রের ঘোড়ার পিছনে চড়লে কেমন পুলক বোধ হতো তার একটি অবাস্তব চিত্রও কিশোরীদের মনে ঘোরপাক খেতে থাকে। কলাপাতায় করে আনা জিলাপি আর নাড়ু প্রেমিকের হাত ঘুরে যখন সম্ভাব্য প্রেমিকার হাতে উঠে আসে তখন মুখ ঝামটার আড়ালে যে প্রেমময় দৃষ্টি থাকে তা ভাবীদের দৃষ্টি এড়াতে অসক্ষম হয়ে উঠে। আর সকালের আলোচনায় যখন জিলাপির মত করে ভাবীদের মুখের রস হাসিনা কিংবা জমিলার   সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে তখন জমিলা কিংবা হাসিনা কেউও তার জোরালো প্রতিবাদ করবার ভাষা হারিয়ে কল্পিত প্রেমিকের কাছে সমর্পিত হয়। বুকের ভেতর রিন রিন করে একটা সুখের মতো ব্যথা সমগ্র শরীরকে সেই দোলাচলে নিয়ে যায়, যার আনন্দ শুধু সেইই বুঝে। এদিকে জমে উঠে মকবুলের মোহময়ী কিসসা। গহর বাদশা আর বানেছা পরীর কাহিনী জীবন্ত হয়ে  উঠে দর্শক শ্রোতার কাছে। অদৃশ্যমান গহর বাদশা যখন বানেছা পরীকে সাথে নিয়ে উড়ে যায়, পরীর ক্ষমতায় গ্রামের মহিলারা  আড়াল থেকে যেন পুরুষের চাইতে আলাদা উচ্চতায় নিজেদের দাঁড় করায়, ডানার মত বাড়তি যোগ্যতা নিজেদের মধ্যেও  দেখে। এক সময় বিপুল উৎসাহ সমগ্র মাঠকে আন্দোলিত করে আশপাশকে ঐন্দ্রজালিক মোহে বেঁধে  ফেলে,তখন সাগর বাপ তার নিজের নাম নিয়ে একটা আলাদা উত্তেজনা বোধ করতে থাকে। মনে পড়ে একমাত্র তার চাচাশ্বশুরই  তাকে মকবুল বলে ডাকে বলে গান অপছন্দ করা ঐ মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতায়  তার মন ভরে উঠে। সাগর বাপ তখন বানেছা পরীর কথা ভাবতে ভাবতে আলাদা একটা জগতে হাবুডুবু খেতে থাকে, তখনি  দরিয়ার মার  বিষন্ন মুখ তার সমস্ত কল্পনাকে বানার  গাঙয়ের ঘোলাজলের মতো ম্লান করে দেয়, বিরক্তি আর বিষন্নতায় উঠে গিয়ে পান চিবিয়ে সেই আসন্ন বিরক্তিকে পাশ কাটানোর সাময়িক চেষ্টায় আপাত সফলতা পায়।

তারপর একদিন বানার গাঙ এ  মাছ ধরবার কথা বলে যখন সাগর বাপ দক্ষিনের দিকে তার তৌড়া জাল নিয়ে  যেতে থাকে,তখন বানারের কোন এক বাঁকে কোন এক সোনাঝরা আলোয় কারো নোলক তার   দৃষ্টিকে স্থির সীমারেখায় আটকে দেয়। বাড়ি আর স্বজনের কথা ওই মোহময় নোলক স্বরন করতে দেয়না। নোলক পরিহিত নারীটিকে সামনা সামনি হ্নদয়ের গহন খুলে কথা না বলবার বেদনা তার পুরোনো ঘর কেনাবেচার ব্যবসাকে অন্তর্হিত করে, প্রতিনিয়তই তার হাতে অবধারিতভাবে উঠে আসে জাল। বানারের আকর্ষন তাকে বিমোহিত করে বলে কেউ মনে করতে পারেনা বলেই, গ্রামের মানুষ আরেকদফা সাগর বাপের সাম্প্রতিক চলাফেরার উপর নজর রাখবার অনির্ধারিত দায়িত্ব নেয়। সাগর বাপের যে কোন কাজের গুনমুগ্ধ দরিয়ার মার এইসকল জালকেন্দ্রিক ঐন্দ্রজালিক ভাবনায় তাকে আকর্ষিত করেনা। উপরন্ত দুইএকটা টেংরা মাছই মুল্যবান এমন একটা মুখভঙ্গি অপরাপরদের দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। বানার গাঙয়ের ঘোলাজল এখন এক অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়।

সাগর বাপের জাল ফেলার বিশেষ ভঙ্গি অনেকের একটি মশকরার উপাদান হলেও, নোলকধারীর কাছে এক জাদুকরি কৌশলই মনে হয়। সাগর বাপ বারবার জাল ফেলে ফেলে নোলকের অধিকারিনীর কাছাকাছি পৌঁছাতে চায়। একদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসবার কালীন সময়ে সাগর বাপ দেখ, গাঙয়ের ঢেউয়ের মত উত্তাল এক শরীর তার দিকে এগিয়ে আসে। মনের পুলক আর রক্তের দ্রুত চলাচলে সাগর বাপের হ্নদয় এক অজানা আশংকায় গুটিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ঘনাতে থাকে, কিছুটা কুয়াশা আর অন্ধকার নোলকের মানুষটির আগমন অস্পষ্ট করে তোলে। আবছা অন্ধকার আর মনের শিহরন দুটোই সমান্তরাল রেখায় চলতে থাকে। অন্ধকারে মুর্তিটি ক্রমশঃ তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং জানান দেয় সাগর বাপের প্রতিটি জাল ফেলা কত গভীর নজরে তার গহীন হ্নদয়ে পৌছে। নির্বাক সাগর বাপ ঐদিন নিশ্চুপতাকে সঙ্গি করে বাড়ি ফেরে আর একটি রাত তার ভোর হয় চোখের পাতায় নোলকের ঝলকানিতে।

তারপর সাগর বাপের মাথায় কেবলি নোলকের ঝলকানি আর সামনে দন্ডায়মান কর্মব্যস্ত দরিয়ার মার বিষন্ন মুখ।  বিপন্ন মন আর উদভ্রান্ত চিন্তা সাগর বাপকে ক্রমশঃ বানার গাঙের বাঁকে পাকখেয়ে থাকা  ঘোলা জলের ঘোর তাকে একটি রৌদ্রদীপ্ত সূর্যের প্রখরতাকে সামনে নিয়ে আসে। দরিয়ার মার কর্মব্যস্ত দিন সাগর বাপের টিনের চালার লাভসহ বিক্রির সমুহ সম্ভাবনা সামনে  এসে আটানী বাজারের মোড়ের ভীরের মত করে, সত্রাশিয়া বাজারের ভাঙ্গা রাস্তার মত ধুলিমলিন অথচ বাস্তব হয়ে উঠে। তবুও নোলকের টান এড়ানো সাগর বাপের নরম নরম ভোলাভালা হ্নদয়ের পক্ষে যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, ঠিক তখনি কোন এক ভোরে দরিয়ার মার বিষন্ন চিৎকারে আকাশ পাতাল ভারি হয়ে উঠলেও ,কারো কারো এই সন্দেহ মনের কোনায় চিকচিক করে উঠে সাগর বাপের ফিরে আসা সংক্রান্ত আগমনি চিন্তায়। আপাতভাবে সাগর বাপের অন্তর্হিত হবার ভাবনা গ্রামবাসিদের নতুন চিন্তা বিশেষত যারা গল্পের বয়ানে পারদর্শি তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এইভাবে কিছু রাত ভোর হয়,  কিছু পুর্ণিমা অমাবশ্যায় ফিরে  ফিরে আসে,অপূর্ণ চাঁদ পূর্ণ হয়।গাঙয়ের ঘোলা জল আরো শুকিয়ে যায়, সাগর বাপ ফিরে আসেনা অপরদিকে কাহিনীর ঢালপালা যাদের দ্বারা বিস্তার লাভ করে তারাও বিশেষ কোন কাহিনী হাজির করতে পারেনা। রাতের কোন নিঃসীম অন্ধকারে কোন এক প্রহরে বাবুলের পাশে শুয়ে থাকা দরিয়ার মার নিঃস্বাসহীনতা, ভোরের সময়ে জড়ো হওয়া মহিলা আর পুরূষের আলাদা আলাদা করে এই চলে যাওয়াকে ব্যাখা করে এবং ঠিক শোক,  না প্রবল অভাবই তাকে অন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করলো ,তার সুরাহা গ্রামবাসিদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে কেননা  দরিয়ার মার মুখভঙ্গিতে সাগর বাপের অন্তর্হিত হবার পূর্বাপর পরিবর্তন গ্রামের সবচেয়ে এলেমধারী হাসিনার মাও বলে উঠতে পারেনা।

কিন্তু সাগর বাপতো জানে মকবুলের কিসসার বানেছা পরীর নোলক না থাকা যে সমস্যা সৃষ্টি করে নাই, তা কোন এক সন্ধায় নোলকের সন্ধানে বের হওয়া মানুষটির  কাছে এক ভরপুর জোসনায় ভরে উঠে।বানেছা পরীকে তুচ্ছ করে সাগর বাপ যখন নোলক নারীর বুকের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে তখনও নারীটি বুঝতে পারেনি সাগর বাপের ছন্নছাড়া জীবনে কাম ব্যতিত অন্য কোন কাজেই বিশেষ সফলতা আসে বলে মনে করতে পারেনা।

এইভাবে তুমুল সন্ধ্যা গভীর রাতে পৌছে আর গভীর রাত ভোরের আলোয় তার প্রস্থান ঘোষনা করে তবু নোলকনারীর ঘোর কাটেনা। আর এই ঘোর কাটতে না কাটতেই ঘরের ভেতর থাকা শেষ চাল ডাল ফুরিয়ে সাগর বাপকে নতুন কাজের সন্ধানের মুখোমুখি দাঁড় করায়। নোলক নারীটি কেবল গভীর আবেশে জড়িয়ে  থাকা হাত কল্পনায় সামনে নিয়ে আসলেও সাগর বাপকে যেতে হয় নতুন কাজের সন্ধানে। নতুন কাজ আর পান চিবানো যখন বিপরিত মেরুতে,তখনও নিরাশ বদন নোলকনারীটিকে হতাশ করেনা। উপরন্তু গৃহস্ত বাড়িতে কাজ করেই সাগর বাপকে ধরে রাখবার বাসনা যখন একমত পাকা করেই ফেলে,  তখন সাগর বাপ পান চিবাতে চিবাতে মোহময় ভঙ্গিতে তার পুরোনো ঘরের ব্যবসার যে পূর্বকালে খুব পয়সার যোগান দিয়েছিল তাই বলতে বলতে ঘরের ভেতর কেরোসিনের আলোর বাকী কেরোসিনের সঞ্চয়  আগামীদিন কাজে আসবে এই কথার ভেতরে নিভিয়ে দিয়ে ওপাশ ফেরে শুয়ে থাকে।

পরদিন একটি উজ্জ্বল ভোরে গামছা আর তার হলুদ চাদরটি সযতনে কাঁধে নিয়ে পুরোনো ঘরের সন্ধানে বের হয়ে। সাগর বাপ বেশকিছু রাতকে ভোর হতে দেয় নোলক নারীটিকে একলা থাকার পূনঃপূনঃ পরিস্থিতি নিয়ে। অতঃপর নোলক নারীটির রাত আর উজ্জ্বল ভোরকে এক করে দিয়ে তিনি তার অপেক্ষাকে দীর্ঘ করে তোলে।

শাখাওয়াত বকুল। গল্পকার, অনুবাদক ও শিক্ষক। জন্ম ও বেড়ে উঠা মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ। ছোট কাগজ 'অতঃপর' সম্পাদনা করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..