চরিত্র

মুবিন খান
প্রবন্ধ
Bengali
চরিত্র

আপনারা বিলি গ্রাহামকে চেনেন? বিলি গ্রাহামকে না চিনলেও তার কথাবার্তাকে চিনবেন।’হোয়েন ওয়েল্থ ইজ লস্ট, নাথিং ইজ লস্ট; হোয়েন হেল্থ ইজ লস্ট, সামথিং ইজ লস্ট; হোয়েন ক্যারেকটার ইজ লস্ট, অল ইজ লস্ট।’ বিলি গ্রাহামের এই কথা বাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বিলি গ্রাহাম ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক। আমেরিকান। ১৯৪৯ সালের পর বিলি গ্রাহাম বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এমনি অনেক বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন যেগুলো বাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। তার আরেকটি বাণী হলো, ‘মাই হোম ইজ ইন হ্যাভেন, আই’ম জাস্ট ট্র্যাভেলিং থ্রু দ্য ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘করেজ ইজ কন্টাজিয়াস…।’

প্রশ্ন হলো, আমার বাড়ি স্বর্গে অথবা সাহস সংক্রামক- এইসব বাণীর চাইতে ‘চরিত্র গেল তো সব গেল’ বাণীটি কেন এত জয়প্রিয় হলো?

ছোটবেলায় দেখা একটা হিন্দি সিনেমার চটুল গানেও এই বাণীর ব্যবহার দেখেছিলাম। ব্যবহারের এই চটুলতা আবেগপ্রবণ বাঙালি মননেও আসন গেড়ে বসেছে। সমাজেও এর বিস্তার শেকড় ছড়িয়েছে। চরিত্রর এই স্খলন একটা দিককেই নির্দেশ করছে, সেটা পুরুষ যদি গোপনে নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, অথবা নারী যদি গোপনে পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাহলে চরিত্রে সমস্যা আছে। মানে হলো, চরিত্র আর চরিত্রর জায়গায় নাই। হীন হয়ে গেছে।

আসেন দেখি পাঠ্য বই চরিত্র বিষয়ে ছেলেমেয়েদের কী শেখায়। এসএসসি এইচএসসির পাঠ্য বইয়ে চরিত্র নিয়ে রচনা আছে। সেখানে ভূমিকায় লিখেছে, ‘সৃষ্টির ঊষা লগ্নে মানুষ সভ্য জীবন যাপন করত না। নানা বৈরী পরিবেশ ও হিংস্র জীব জন্তুর সাথে যুদ্ধ করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। তাছাড়া মানুষে মানুষে গোত্রে গোত্রেও সংঘাত লেগেই থাকত। তাই হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ছিল মানুষদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেসময় পশুর সাথে মানুষের পার্থক্য ছিল না বললেই চলে। কিন্তু কালক্রমে মানুষের আচরণ থেকে পশুত্ব ঘুচে যায়। মানুষ ক্রমাগত চর্চার ফলে অর্জন করে নানা মানবীয় গুণাবলী। এসব মানবীয় গুণের সমষ্টিই হচ্ছে চরিত্র।’

কঠিন সব কথাবার্তা। এর মানে কী দাঁড়াল তবে? আসেন আরেকটু দেখি।

চরিত্রর বৈশিষ্ট্য শিরোনাম দিয়ে লেখা আছে, ‘মানুষের বিভিন্ন অভ্যন্তরীন গুণাবলী যেমন সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, শৃঙ্খলা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ইত্যাদি একত্রে মিলিত হয়ে কোনও ব্যক্তি হয়ে ওঠে চরিত্রবান।’

দেখা যাচ্ছে কেউ যদি মিথ্যাচার করে কিংবা অসৎ হয় তাহলেও তার চরিত্র সমস্যায় আক্রান্ত ধরে নিতে হবে। মানুষের সঙ্গে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করলে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ধারণ না করলে তাকে চরিত্রহীন ধরে নেওয়া যেতে পারে।

কদিন আগে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসটি আলোচনায় এসেছিল। হাতের কাছে বইটি নেই বলে ইন্টারনেটে খুঁজতে গিয়ে বেশ অবাকই হতে হলো। কম করে হলেও ‘চরিত্রহীন’ বইটির পনের রকম প্রচ্ছদ পাওয়া গেল। প্রত্যেকেরই ‘চরিত্র’-ই ‘হীন’ হয়েছে কিনা জানি না তবে প্রত্যেক প্রকাশকই আপনাপন চারিত্রিক রুচি তুলে ধরেছেন প্রচ্ছদে। আমার খুব মজা লাগল। আমি মূল বই রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চরিত্রহীনের প্রচ্ছদ চরিত্র দেখতে লাগলাম। সেসবের রঙ রূপ রস গন্ধ সত্যিই প্রবল উৎসাহ উদ্দীপক।

আচ্ছা কেউ কী বলতে পারেন, সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, শৃঙ্খলা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, সাহসিকতা এইসব গুণাগুণ বাংলাদেশের কোন্ মানুষ নিজের মধ্যে ধারণ করেন? কোনও শিক্ষক? কবি, সাহিত্যিক? সাংবাদিক? সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা? পুলিশ? পীর?

আমি জানি না।

আমার একবন্ধু আছে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। খুব ভালো মানুষ। অনেক মোটা অঙ্কের বেতন পান। আদর্শ স্বামী এবং পিতা। তার ছেলেমেয়েরা অনেক ভালো স্কুলে লেখাপড়া করে। স্ত্রী সন্তানের কোনও চাওয়া সে অপূর্ণ রাখে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে সে যখন অফিস রওনা হয় তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর একটার ঘরে পৌঁছে যায়। আবার তিন চারটা বাজতেই সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার কোনও সমস্যা হয় না। সম্ভবত অফিসেরও কোনও সমস্যা হয় না। তার বেতন থেকে কখনও একটা টাকাও কাটা যায় না। উল্টো লোকে তার বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যায়। আর আমার বন্ধুটি আমার আরও আরও বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির ছাদে আড্ডা জমান। আমার বন্ধুপত্নী তার স্বামীটি যে বাড়ির বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন না, এতেই খুশি।

আমার এই বন্ধুটি প্রতিবেশীদের ঈর্ষা, প্রতিবেশীপত্নীদের ঈর্ষা, আমাদের অনেক বন্ধুদেরও ঈর্ষা।

হুমায়ুন আহমেদের ‘হিমু’ একবার এক পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্যার, আপনার বেতন কত?’

পুলিশ অফিসার অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কেন?’

জবাবে হিমু একটা হিসাব কষে দেখিয়েছিল। এক প্যাকেট বেনসনের দাম যদি একশ’ টাকা হয় তবে রোজ দুই প্যাকেট হিসাবে ছয় হাজার টাকা শুধু সিগারেটেই খরচ হয়। তারপর ছেলেমেয়ে বউ সংসারের খরচ তো আছেই। তাহলে একজন পুলিশ অফিসার কত টাকা বেতন পান?

এখন এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটের দাম দু শ’ সত্তর টাকা। তো দু প্যাকেট হিসাবে মাসিক খরচ ষোল হাজার দু শ’ টাকা। পুলিশের একজন সাব ইন্সপেক্টরের  ‘সরকারি বেতন স্কেল-২০১৫’ অনুযায়ী দশম গ্রেডের বেসিক ১৬ হাজার থেকে ৩৮ হাজার ৬৪০ টাকা । আর এএসআইয়ের বেতন হল ১২ হাজার ৫০০ থেকে ৩২ হাজার ২৪০ টাকা।

বিষয়টা দাঁড়াল, পুলিশের এসআই এবং এএসআইয়েরা বেতনের টাকা দিয়ে ধুমপান করেন এবং সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, শৃঙ্খলা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, সাহসিকতা দিয়ে স্ত্রী সংসার ছেলেমেয়ের খরচ চালান।একথা ঢালাওভাবে অবশ্যই সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে বারো ষোল হাজার টাকা বেতন পাওয়া লোকেরা বেনসন যে ফুঁকবেন না, এই সিদ্ধান্তে আসতে বুদ্ধিজীবী হওয়া লাগে না।

তো ওই পুলিশ অফিসারের বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি অথবা স্ত্রী-সন্তান কী অসৎ হওয়ার কারণে পুলিশ অফিসারকে চরিত্রহীন বলতে পেরেছেন? ভাবতে পেরেছেন কোনদিন? ভাববেন কি? হিমুর কথা থেকেই পুলিশের উদাহরণটি এল। কিন্তু এ প্রশ্নগুলো আসলে আয়ব্যয়ের অসাঞ্জস্যতা রয়েছে বেতনভুক্ত এমন যে কোনও পেশাজীবী ও পরিজনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

খুব বোরিং লাগছে, না? চলেন একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করি। চরিত্র বিষয়ক রচনা বলছে, মানুষের চরিত্র গঠনের প্রক্রিয়া মূলত শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। শিশুদের মনে যে ছাপ পড়ে তাই সারাজীবনের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়।

ছোটবেলা থেকে আমাদের পড়ানো হয়েছে, এই দেশ আমার মা, এই মাটি আমার মা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবাই দেশকে গালাগাল করছেন। কেউ দেশে থাকতে চান না। কোনক্রমে দেশ ছেড়ে পালাতে পারলেই বেঁচে যান। শুধু তাই নয়, নিজে তো থাকতে চানই না, অপরকেও পালিয়ে যেতে নিরলসভাবে উৎসাহিত করেন। আর যারা বিদেশে অবস্থান করছেন তাদেরকেও দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করছেন।

ক্লাস সেভেন একবার আমাদের স্কুল থেকে মতিঝিল এলাকার একটা স্কুলে ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম। তো আমাদের ক্লাসের হয়ে কয়েকজন ছেলে খেলেছিল যারা আসলে আমাদের ক্লাসের ছিল না। আমাদের স্পোর্টস টিচারই পুরো ব্যবস্থা করেছিলেন। সেদিন ম্যাচে জেতাটাই মূখ্য হয়ে উঠেছিল। ম্যাচ যে সততার সঙ্গে খেলতে হয় সেটি ছিল উপেক্ষিত। তো সততার প্রতি এই উপেক্ষা চরিত্রে যদি কোমলমতি আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেই ফেলে তো এর দায় আপনি কার ঘাড়ে চাপাবেন?

ক’বছর আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন একটা শিল্পর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। অভিভাবকেরাই নাকি পরীক্ষার দুয়েকদিন আগে থেকে প্রশ্নপত্রর জন্য ছুটাছুটি করেন। তারপর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পাশ করানোর পর সে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বানাতে চান, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান, চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট বানাতে চান, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারও বানাতে চান।

কিন্তু কখনও রাজনীতিবিদ বানাতে চান না। কেন চান না! অথচ রাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকের আমূল জীবন কাঠামো। তাহলে কেন চান না!

বেতনের টাকা দিয়ে ধুমপান করা এবং সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, শৃঙ্খলা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, সাহসিকতা দিয়ে স্ত্রী সংসার ছেলেমেয়ের খরচ চালানোর যে চর্চা পুলিশেরা করেন, রাজনীতিবিদরা সেই শিক্ষাটা দেন বলে? কিন্তু এই চর্চা তো প্রায় সকল সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিই করেন। তাহলে রাজনীতিবিদেরা কী দোষ করল!

কোনও দোষ করে নাই। বিষয় হলো, রাজনীতি যারা করেন তারা মোটামুটি সকল কিছুর উর্ধ্বে উঠে যান। ঈর্ষনীয় হয়ে ওঠেন। আক্ষরিক কোনও কাজ না করেও সীমাহীন সম্পদের মালিক বনে যান। কেননা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে গেলে অর্থনীতি জানা থাকা লাগে না, সমাজবিজ্ঞান জানা থাকা লাগে না, রাষ্ট্রবিজ্ঞান জানা থাকা লাগে না, কোনও আদর্শও লাগে না। শুধু রাগী টাইপ হওয়া লাগে; আর সেই রাগ প্রতিপক্ষর ওপর ঝারতে পারার যোগ্যতাটা লাগে। সেই যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেই খুব দ্রুত ফুলে ফেঁপে টাকার কুমির হয়ে যাওয়া যায়। তারপর পত্রিকায় শিরোনাম আসে, কোটিপতি ছাত্রনেতাদের গল্প। শিরোনামহীন এইরকম আরও কত যে আছে তার হিসাব কে রাখে? ফলে কোনও বাবা-মায়েরাই সন্তানকে রাজনীতিক বানাতে না চাইলেও দেশে রাজনীতিকের কোনও অভাব কখনও হয় নি। হবেও না বোধ করি।

এদেশের মানুষের রাজনীতির অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ বটে, তবে মধুর নয়। যেহেতু দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, ফলে সবসময়ই রাষ্ট্রর সঙ্গে সাধারণ মানুষের বৈরী সম্পর্ক ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে বিদেশি লোকে, কি ব্রিটিশ আর কি পাকিস্তান। সেকারণে এই বিদেশি লোকেদের জন্যে রাষ্ট্র পরিচালনাকে বাধাগ্রস্ত করা দরকার ছিল। হরতাল, ভাঙচুর ইত্যাদি মানুষ সমর্থন করেছে, পালন করেছে। উদ্দেশ্য ছিল এইসব বিদেশিদের তাড়ানো।

তারপর একাত্তর এল। যুদ্ধ হলো। স্বাধীন বাংলাদেশ হলো। কিন্তু হরতাল, ভাঙচুর, রাষ্ট্র অচল করে দেওয়া ইত্যাদি রাজনীতি করা লোকেদের চরিত্রে রয়েই গেল। রাষ্ট্রকে অচল করতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকদের যে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে সেটা ছায়া সরকার পাত্তা দেয় না। ওদিকে মুখে গণতন্ত্রর কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা রাষ্ট্র পরিচালকেরাও ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানি শাসকের আদল হয়ে ওঠে।

তবে আমি আশাবাদী মানুষ। নিরাশ হতে আমার ভালো লাগে না। আমি জানি ওপরের ওই সমীকরণের মানুষ তালিকার শীর্ষে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই ভালোমানুষ। এরা কারও সাতে পাঁচে থাকে না। চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যায়। সংসার চালায়। ছেলেপুলে মানুষ করে। মোট কথা হলো, বাংলাদেশটাকে এরাই বাঁচিয়ে রেখেছে। ওপরের সমীকরণের মতো যদি দেশের অর্ধেক মানুষও হতো, তাহলে বাংলাদেশটা থাকত না। ধ্বংস হয়ে যেত। এই মানুষেরাই, এই মানুষদের সন্তানেরাই একদিন বাংলাদেশটাকে তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাবে।

আমি আশাবাদী মানুষ। নিরাশ হতে আমার ভালো লাগে না।

 

ভদ্রলোক একটা গালি দিলেন। খুব নোংরা গালি। গালি খেয়ে রাগ হওয়ার কথা। আমার রাগ হলো না। খুব অবাক লাগল। এই অবাক হওয়াকে বলে আকাশ থেকে পড়া। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অচেনা অজানা কেউ কেন শুধু শুধু গালাগাল করবে!

আমি বললাম, ‘ভাই গালি দিলেন!’

‘হ্যাঁ দিলাম। তুইও দে।’

তুই তোকারিও করছেন! নিতান্ত অপরিচিত লোকজনকে কোনও লিটলম্যাগ সাহিত্য করা লোক যে এইভাবে তুই সম্বোধনে গালাগাল করতে পারেন আমার ধারণা ছিল না। আমার অবাক হওয়ার মাত্রা বাড়লো। ধাক্কার মতো খেলাম। সেটা সামলে নিয়ে বললাম,

‘দিব না। নোংরামি করতে পারা অবশ্য ক্রেডিট বটে।’

-‘হ, তুইও কর।’ ভদ্রলোক তার ভদ্রতা বজায় রাখলেন।

আমি বলি, ‘ধন্যবাদ দিব। আপনার মতো একটা লোক আমার বন্ধু সেইটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ দিব। ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন।’ বলে বিদায় নিলাম।

আমি যখন আমার ফোনের কিবোর্ডে টাইপ করে লিখি তখন কিবোর্ডে টুকটুক করে শব্দ হয়। শব্দটা আমার ভালো লাগে। কম্পিউটারের কিবোর্ডে লিখলেও শব্দ হয়। তবে সেটা কিবোর্ড আক্ষরিক চাপাচাপিরই শব্দ। ফোনের কিবোর্ডের শব্দটা সেরকম না। এই শব্দটাকে ডিজিটালি কিবোর্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

কলম দিয়ে কাগজে লিখলেও একটা শব্দ পাওয়া যায়। সেটাকে খসখস শব্দ বলে। খসখস শব্দটা আমার বেশি ভালো লাগে। খসখস শব্দটা রাতে বেশি পাওয়া যায়, শুনতে সুবিধা। আমার ধারণা লেখালেখি করা লোকেরা এই খসখস শব্দ শুনতে পেতেই রাতে লেখালেখি করেন। আমার এখন আর খসখস শব্দ শুনতে পাওয়ার সুবিধা নাই। কাগজ কলম নিয়ে বসার অবসর নাই।

ফলে খসখস শব্দ শোনা হয় না। মাঝে মাঝে টুকটুক শব্দ শুনি। রাত গভীর হলে শব্দ অন্যর বিরক্তির উদ্রেক করবে ভেবে লেখার সময় হেডফোন লাগিয়ে নিই। ফোন সাইলেন্ট করি না। বর্ণর পর বর্ণ এসে সাদা স্ক্রিন ভরে উঠতে থাকে। আর আমার কানে বাজতে থাকে টুকটুক টুকটুক টুকটুক। আমি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি। বড় মধুময় পরিবেশ। কিন্তু এই মধুময়তায়ও হঠাৎ হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে।

সেদিন আরেক ভদ্রলোক এসে ইংরেজিতে জানালেন তিনি আমার লেখা পড়েছেন। আমার খুব ভালো লাগল। ভদ্রলোক পড়ার তথ্য জানিয়ে ইংরেজিতেই আমার লেখার পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানালেন।

বাংলায় লেখা রচনার প্রতিক্রিয়া ইংরেজিতে কেন বলতে হলো এটা আমার বোধগম্য হলো না। আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার বঙ্গার্থ সাধ্যমত উদ্ধার করার চেষ্টা করলাম। উদ্ধার করার পর ভদ্রলোকের বক্তব্যকে বাণী বাণী লাগছিল। বঙ্গার্থ অবশ্য উৎসাহব্যঞ্জক। ভদ্রলোক বলেছেন,

‘চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রবন্ধ লেখা ভালো। কিন্তু আমাদের সন্তানদের নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা সম্বন্ধে শিক্ষা করা উত্তম।’

এই বলাবলিতে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিও রয়েছে। ভদ্রলোক কী আমাকে চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা নিয়ে না লিখে আপন সন্তানদের ‘চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা’ শিক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন? তা দিন। উত্তম পরামর্শ বটে।

কিন্তু ওই যে ‘কিন্তু সন্তানদের শিক্ষা করা উত্তম’ কথাটা? কী বোঝালেন ওটা দিয়ে? লেখালেখি বন্ধ করে সন্তানের শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে? পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা কেন! লিখতে নিষেধ করছেন কি! কেন করছেন? লিখলে সমস্যা কি! চরিত্র তো চর্চার বিষয়। নিয়ম হলো আমরা নিজেদের জীবনে চর্চা করব এবং আমাদের সন্তানেরা সেই চর্চা দেখতে দেখতে  বড় হবে। সেই দেখাদেখির মধ্যে সন্তানদের নিজের শিক্ষা এবং চর্চা, দুইই হয়ে যাবে। তাহলে লিখতে নিষেধ করছেন কেন!

এই যে চর্চার বিষয়টা, এটা কিন্তু আমাদের ছেলেবেলাতেই শিক্ষা করা হয়। পাঠ্য বইয়ে কবি গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’ কবিতার একটা লাইন ‘শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুরই অন্তরে’ দিয়ে বলা হয় ভাব সম্প্রসারণ কর। ছেলেমেয়েরা সেই কবিতার লাইনটার ভাব বুঝে নিয়ে সম্প্রসারণ করে। লেখে, পিতা যেমন, যে আদর্শে পিতা নিজেকে পরিচালন করেন, শিশু নিজেও সেই আদর্শ নিজের ভেতর ধারণ করে বাড়তে থাকে। বেড়ে বড় হয়ে সেও নিজেকে সেই আদর্শেই নিজেকে পরিচালন করে। তখন আমরা বলি, ‘যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র।’

যোগ্য মাতার পুত্র কিন্তু বলি না। যোগ্য মাতাপিতারও বলি না। শুধুই যোগ্য পিতার বলি। কেন বলি?

‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উচ্চারিত এই প্রবাদ আমরা সকলেই জানি। দমে দমে উচ্চারণও করি। তাহলে সন্তানের সফলতার সবটাই কেন অবলীলায় পিতাকে দিয়ে দেই? এটাও ওই চর্চারই কারণে। চর্চাগুলোই ধীরে ধীরে মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়। এই অভ্যাস ভালো কাজ মন্দ কাজ দুইয়েরই হয়। ভালো কাজ করাঅলারা তখন মন্দ কাজ করতে পারেন না। আর মন্দ কাজ করাঅলারা চরিত্র থেকে অপরাধবোধ হারিয়ে ফেলেন। অজান্তেই। মজা না?

এক ভদ্রমহিলা সেদিন কাউকে যাবজ্জীবন আয়না দেখার শাস্তি দিচ্ছিলেন। সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ভদ্রমহিলার সঙ্গে যে অন্যায় করেছেন সেটা তিনি যতবার আয়না দেখবেন ততবারই অপরাধীর নিজের অপরাধের কথা মনে পড়বে এবং সে অপরাধবোধ অনুভব করবে। কষ্ট পাবে। এই কষ্ট পাওয়ার শাস্তিটি অপরাধী যেন সারাজীবনই পায় ভদ্রমহিলা হয়ত সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছিলেন। আয়না আসলে সবাই দেখে না। অতিরিক্ত আয়না দেখা একধরনের মানসিক সমস্যা। আত্মমুগ্ধ মানুষ অতিরিক্ত আয়না দেখে। এখন কথা হচ্ছে, আপনি যার প্রতিই মুগ্ধ হবেন তার সকলই আপনার ভালো লাগবে। এই যুক্তি নিজের বেলাতেও প্রয়োজ্য। নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ মানুষ কেবল নিজের গুণটাই দেখে। নিজেকে ধীরে ধীরে সমালোচনার উর্দ্ধে ভাবতে থাকে। তো তাকে আয়না দেখার শাস্তি দিলে সেটা সত্যিই শাস্তি হলো কিনা ভেবে দেখা দরকার। আয়না দেখা লোকেরা আপন মুগ্ধতায়ই আয়না দেখবেন। যাবজ্জীবন দন্ড তখন তার কাছে শাপে বর হয়ে ওঠার কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যাবজ্জীবন দন্ড যিনি দিলেন সেটি শুধুই দন্ডদাতার আত্মতুষ্টি। সত্যিই তাই? অক্ষম বাসনার জ্বালা মোছা নয়?

তাহলে যিনি মুখ খারাপ করে নোংরা গালাগাল করলেন কিংবা যিনি লেখালেখি বন্ধ করে সন্তানদের শিক্ষা প্রদানের পরামর্শ দিলেন, তারাও কি জ্বালা মুছলেন? রহস্যময় প্রশ্নবোধক। আরও বড় রহস্য হলো, কী তাদের অক্ষম বাসনা? আমাকে গালাগালে তাদের জ্বালা কি মুছল? নাকি চাগান দিয়ে উঠল? জানার উপায় নাই। দরকারও নাই।

বাংলা ভাষায় পরমতসহিষ্ণুতা বলে একটা শব্দ আছে। অভিধানে এর অর্থ দেওয়া আছে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। ইংরেজি প্রতিশব্দ টলারেন্স যেন ঠিক সেভাবে বলতে পারে না যেভাবে ‘পরমতসহিষ্ণুতা’ শব্দটা বলছে। পরমতসহিষ্ণুতাকে গণতন্ত্রের একটি প্রধানতম নিয়ামক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশ করতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’। তো পরমতসহিষ্ণুতা শব্দকে আমরা স্কুল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত উপর্যপুরি ব্যবহার করছি। শিখছি। শেখাচ্ছি। ‘জাতীয় শব্দ’ বানিয়ে ফেলেছি। কিন্তু চর্চাটা কই? চর্চাটা করছি না। কেউ যখন আমার মতামতের বিরুদ্ধাচারণ করছে, তার মতামতকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করছি না। তার বক্তব্য যে অন্তঃসারশূন্য সেটা প্রমাণ করতে নিজের কথাগুলো বলছি না। তার দিকে তেড়ে যাচ্ছি, তাকে গালাগাল করছি অথবা তাকে নিশ্চুপ করিয়ে দিতে উদ্যত হচ্ছি।

নাহ্, হচ্ছে না। কথাবার্তা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। গাম্ভীর্যতা ভালো লাগে না। তারচেয়ে একটা ঘটনা বলি।

ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ায় পাড়ায় দেখেছি যারা রাগী যুবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের আড়ালে আবডালে গুন্ডাপান্ডা বললেও সম্মুখে সবাই খুব ভয় ও সমীহ করে। আমরা দেখেছি এসব রাগী রাগী যুবকেরা লেখাপড়ার বিষয়ে উদাসীন হয়। কিন্তু পরীক্ষায় ঠিকই উৎরে যায়। তারা কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও গাড়ি ঘোড়াতেই চড়ে। পাড়ার চায়ের দোকানে পরিষ্কার কাপ-গ্লাসে চা-পানি আসে। লন্ড্রিতে দ্রুত কাপড় ইস্ত্রি করে দেয়। অথচ আমরা বিকেলে হোটেলে ডালপুরি খেতে বসে চাইলেও মাংস তরকারির ঝোল পাওয়া যায় না। তেল চিটচিটে কাপে-গ্লাসে চা-পানি খেতে দেয়। লন্ড্রিও কোনদিন সঙ্গে সঙ্গে কাপড় ইস্ত্রি করে দেয় নাই। এসব বৈষম্য আমাদের নাড়া দিত।

তারপর কিশোর হতে হতে রাগী হয়ে উঠতে চাওয়াটা আমাদের অনেকের আদর্শ হয়ে উঠতে লাগল। আমাদের সঙ্গেরই কেউ কেউ রাগী হতে শুরুও করল। ধীরে ধীরে সেই রাগ প্রকাশ করতেও শুরু করল। অতঃপর তারা সঙ্গে থাকার ফলে আমরাও পরিষ্কার কাপ-গ্লাসে পানি খাই। না চাইতে মাংসর ঝোলে চুবিয়ে ডালপুরি খাই। আর তাদের ক্ষমতায় মুগ্ধ হই। তারপর আমাদেরই কেউ কেউ লেখাপড়ার প্রতিও উদাসীন হয়। এদেরও দেখি পরীক্ষায় উৎরে যেতে সমস্যা হয় না।

এই যে উদাসীনতার ধারা, এই ধারা কিন্তু প্রবহমান। তিন তিনটা প্রজন্ম ধরে প্রবহমান। এই উদাসীনতা কী এখন রাষ্ট্রর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে? অবকাঠামোয় ঢুকে গেছে?

‘নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম’ -সক্রেটিসের বাণী।

পুলিশ যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে এরা যতই রাগী হোক, রাগ দেখাত না। উকিল যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে অপরাধীরা শাস্তি পেত। শিক্ষক যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনেরা পরীক্ষায় উৎরে যেতে পারত না। রাজনীতিকরা যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তাহলে যোগ্যতাহীনরা দেশ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেত না… এইভাবে বলতে থাকলে ফুরাবে না। বলতে থাকাই লাগবে।

তো সক্রেটিসের এই বাণী বগলদাবা করে এগুলে দেখি, হায় হায়! কেউই দেশকে ভালো তো বাসছেই না উল্টো গণতন্ত্রর প্রধান নিয়ামককে বুইড়া আঙুল দেখিয়ে রাষ্ট্রর সাধারণ নাগরিকের দিকে নখ দন্ত বের করে খিঁচিয়ে তেড়ে আসছে।

সাধারণ নাগরিকের দায়িত্ব কী এখন? ভয় পাওয়া? সে নিষ্ঠার সঙ্গেই নিজেরই দায়িত্বটি পালন করছে। আর রাত জেগে জেগে কিবোর্ডের মিষ্টি মধুর টুকটুকটুকশব্দ শুনতে শুনতে সাদা স্ক্রিন ভরিয়ে ফেলছে। এই তার দৌড়। এই দৌড়টুকু দৌড়াতে তার বড় ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটুকু ছাড়া তার তো আর নেই কিছু।

সত্যিই নেই কিছু?

মুবিন খান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..