ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
প্রথম পর্ব
এই কথাগুলি বলে নীলকন্ঠবাবু দু’ হাত দুদিকে ছড়িয়ে যেন আকাশে ওড়ার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পায়ের গোড়াতেই হোগলার বন। যতদূর চোখ যায়, কেবল হোগলা গাছেরা মৃদু বাতাসে মাথা দোলায়। পিছনের একতলা একটি রংচটা মলিন বাড়ি। যেন সেটা বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মত। আমার মনে হল, এই সব হোগলার বনটন কিছুই নয়, নীলকন্ঠবাবুর মনের সমস্ত গোপন কথারাই কার্তিকের এই হিমেল বাতাসে দুলছে।
কথাগুলি ঘিরে ধরছিল আমায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। নীলকন্ঠবাবুর মুখ না দেখতে পেলেও আমার মনে হল, দু’দিকে হাত ছড়িয়ে এই যে তিনি এগিয়ে গেলেন, তা আসলে নিজেকে পাখিমুখ আড়াল করার জন্য। তখন তিনি হাঁ করে হিম টেনে নিচ্ছেন মুখের ভেতর। সেখান থেকেই, অনেকটা হিম খেয়ে তিনি স্বগোক্তির মতন বললেন, “আমি জানতাম, একমাত্র আপনিই পারেন ওকে সারিয়ে তুলতে। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল। আর আপনি তা পেরেছেন। বিনিময়ে আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারি না—কারণ আপনি এতদিনে জেনে গেছেন আমার দেবার মতন কিছুই নেই। সে সব সরিয়ে রেখে আপনাকে যা দেবার ছিল আমার, তা দিয়ে দিলাম এইমাত্র। আপনি তা অঞ্জলি পেতে গ্রহণ করুন।”
তখন আমি আবার পিছন ফিরে বাড়িটা দেখলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল—আত্মমগ্ন স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে বলা এই কথাগুলি অনেকটা দূরে থাকলেও কি শুনে ফেলল মৌলি? সে কি ছাদে আছে? দেখতে আমাদের? আর তাই আমার এই দ্বিতীয়বার পিছন ফেরা ছাদকে দেখার জন্য।
প্রায় ন্যাড়া ছাঁদ। না, সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বদলে চোখে পড়ল বাড়িটাকে। এখন থেকে এমনই দেখতে লাগছে যে, মনে হচ্ছে এই জলাভূমি ক্রমে এগিয়ে গিয়ে গিলে ফেলবে তাকে। আর এই বাড়ির তিনজন সদস্য তখন এক একটি পাখি হয়ে উড়ে যাবে ওই চাঁদের প্রতি।
হ্যাঁ, চাঁদের কারণেই তো এখানে আসা। ক’দিন ধরেই মিডিয়া সরগরম এই চাঁদ নিয়ে। আজকের দিনে চাঁদ অনেকটা নিচে নেমে আসবে। আমরা সেই দেখব। আর তাই নীলকন্ঠবাবুর চাপাচাপিতে আমি এ বাড়িতে থেকে গেলাম আবার। আজ চাঁদ দেখার রাত।
তার আগে নীলকন্ঠবাবু আমাকে ডেকে আনলেন এখানে। এদিকে রোদ আছে। মিঠে রোদ। গাছ আছে। আর আছে নৈঃশব্দ। বুঝিনি, তিনি যখন এই কথাগুলি বলবেন; যারা আমার শরীরকে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠবে এমনি করে। তারা আমাকে বেঁধে ফেলবে এমনি করে।
ওই ছাদটা কিন্তু মৌলির পক্ষে বিপদজনক। আমি এ বিষয়ে ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম প্রথমেই। কিন্তু ওঁনার স্ত্রী ছাঁদ ঘেরা নিয়ে বাধা দিলেন। বললেন, “এতদিনেও যখন ছাদ থেকে কোন বিপদ আসেনি তখন ওটা ভেবে কোন লাভ নেই।” শুনে ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। বুঝলাম, উনি স্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে যেতে অপারগ।
ভেবেছিলাম ছাদের উপর মৌলিকে দেখতে পাব। কিন্তু পরপর দু’বার পিছনে তাকিয়েও তাকে খুঁজে না পাওয়ায় বেশ হতাশ লাগল। তবে মৌলি এখন কোথায়? ওর ঘরে শুয়ে আছে? নাকি চাঁদ বা পাখিদের ছবি আঁকতে বসে গেছে?
এই সময় বাড়ির পিছনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মধুছন্দা মিত্র, ভদ্রলোকের স্ত্রী। প্রথমে কিছু বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। ভদ্রলোক ওঁকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখেননি। দেখার কথাও নয়। বাড়ির দিকে তাঁর পিছন। তিনি তখন পাখি হয়ে উড়ে যেতে চান দূর আকাশের প্রতি, বড় চাঁদের প্রতি।
“একটু শুনবে?”
এই কথাটি ভদ্রলোকের কানে পৌঁছে দিতে দু’বার উচ্চারণ করতে হল তাঁকে। তারপর নীলকন্ঠবাবু ঘুরলেন। মধুছন্দা বললে, “ওখানে দাঁড়িয়ে তুমি কী করছ? ওখানে কী আছে? ঘরে এসে বোস।”
“যাচ্ছি।” ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে আস্তে করে বললেন। বুঝলাম না কথাগুলো যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছল কিনা। আর পৌঁছলেও সেই কথাকে পাত্তা দিলেন না মধুছন্দা। বললেন, “এখুনি একবার এস। মৌলিকে দেখতে পাচ্ছি না।”
আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। মৌলিকে পাচ্ছি না মানে কী? সে কি বাড়িতে নেই?
“এই মাত্র খেয়ে উঠল মেয়েটা। আমি ঘরে না দেখে ভাবলাম ও বুঝি তোমাদের সঙ্গে এসেছে। এখন দেখছি তা নয়। ও গেল কই?”
নীলকন্ঠবাবু বললেন, “একসঙ্গেই তো খেলাম। বেশিক্ষণ তো হয়নি। দেখ, আছে কোথাও।”
“কোথাও মানেটা কী? ওকে কী চাঁদে গিয়ে বসে আছে?”
“ওভাবে বলছ কেন? দেখ কারও বাড়ি গেছে হয়ত।”
“সেটা আমাকে না বলে? আর কার বাড়িই বা যায় ও? এখানে ওর বন্ধু বলতে একমাত্র বোসেদের মানা ছিল। ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর আর কারও বাড়ি যায় নাকি মেয়েটা?”
আমরা এবার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। তিনটে ঘর। বাড়ির ভেতর অনেকটা ফাঁকা জায়গা। একদিকে দুটি সাইকেল। একটি মৌলির ও অপরটি নীলকন্ঠবাবুর। একটা সুপারি গাছ। বাইরে শীতের বাতাস থাকলেও একটু গরম ভাব ছিল। কিছু বাড়ির ভেতর বেশ ঠান্ডা।
আমরা খাবার ঘরটার ভেতর এলাম। আসলে এখানেই আমি থাকি, যখন আমাকে থাকতে হয়। ঘরটা বড়। একটিকে ডাইনিং টেবিল, অন্যদিকে একটা শক্তপোক্ত চৌকি পাতা। সেখানেই আমি শুই। ভদ্রলোক আবার নতুন করে মৌলির নাম ধরে হাঁকডাক করে এ ঘর ও ঘর করতে লাগলেন। আমি মনটাকে শান্ত করতে এক জায়গায় চুপ করে বসে পড়লাম।
****
নীলকন্ঠবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ ট্রেনে। আপ নামখানা লোকাল। পাশাপাশি বসে আসছি সেই শিয়ালদা থেকে। সুভাষগ্রাম স্টেশনে ভীড় আলগা হতেই নিজে থেকেই আলাপ জুড়লেন তিনি। বললেন, “স্বাস্থ্য-বিভাগে কাজ করেন বুঝি?”
আমি হেসে ফেললাম। বললাম, “ঠিক স্বাস্থ্য-বিভাগ নয়। আবার স্বাস্থ্য-বিভাগেও বলতে পারেন।”
ভদ্রলোক দ্বিধায় পড়ে বললেন, “ঠিক বুঝলাম না।”
“আমি এনজিও’তে কাজ করি। জানেনই তো, এনজিও সরকারি অনুদানে চললেও, সরকারি নয়।”
“জানি।” তিনি বললেন, “আসলে আপনার হাতে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ পত্রিকাটি দেখেই প্রশ্নটা করলাম। আপনি বোধহয় মানসিক কোন বিষয় নিয়েই কাজ করেন।”
“হ্যাঁ। আমার কাজ কাউন্সেলরের।”
“কাদের কাউন্সেলিং করেন?”
আমি যে হোমে কাজ করি, সেখানে তিরিশজন মহিলা পেশেন্ট থাকে। তাদের কাউন্সেলিং করাটা আমার কাজ।”
“তারা সকলেই কি মানসিক রোগী?”
“হ্যাঁ। মানসিক রোগীদের কেবলমাত্র ওষুদের মাধ্যমে ভালো করা যায় না। তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিং দরকার। কাউন্সেলিং ইজ আ পার্ট অফ ট্রিটমেন্ট।”
ঠিক। আমি একশো শতাংশ মানি।” বলে তিনি চুপ করে গেলেন খানিক। তিনি এত জোর দিয়ে কথাগুলি বললেন যে, আমার তখন অবাক লেগেছিল। সাধারণ মানুষ ত বটেই উচ্চ-শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও দেখেছি, এই সব বিষয়ে ঞ্জান-গম্যি প্রায় শূন্য। যাঁরা মন দিয়ে প্রত্যহ খবরের কাগজ পড়েন, তাঁরাও এই সব সামাজিক বিষয়ের খবর সযত্নে এড়িয়ে যান। যত মনোযোগ রাজনীতি ও খেলার খবরে।
মৌনতা ভেঙ্গে আমি এবার মুখ খুললাম। ট্রেনের দুলুনি কিছুটা আস্তে হলে বললাম, “আপনি কি স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করেন?”
“না। আমি ছাপাখানার লোক। তবে কাউন্সেলিং বিষয়ে আমি কিছু জানি। আপনি কি কাউন্সেলিং বিষয়ে কোন কোর্স করেছিলেন?”
“না। আমি সোসাল ওয়ার্কের ছাত্র। চাকরিটা হয়েছে সেখান থেকেই।”
“আপনার পরিচয়?”
“আমার নাম অরূপ বিশ্বাস। নামখানা স্টেশন থেকে কাছেই আমার বাড়ি।”
“মৌলি—” বলে তিনি সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকালেন। সেও শিয়ালদা থেকে আমাদের উল্টোদিকে জানালার ধারে বসে আসছে। খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটিকে। আকাশণীল রঙের ফিটিং চুরিদার পরেছে, সাদা বুটি দেওয়া ওড়নার মাঝে মাঝে নীল ফুল, ওড়নার লেস নীল রঙের। কানের দুল, চুলের ক্লিপ—নীল। গলার সাদা পুঁতির সুন্দর একটি হার। একবার তাকালে মেয়েটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে। সে একমনে জানালা দিয়ে বাইরের ছুটন্ত জগৎ দেখে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের ডাকে সে জানালা থেকে তার মিস্টি মুখখানাকে ফিরিয়ে তাঁর দিকে তাকাল। গোলাপি ঠোঁট দুটি অল্প একটু ফাঁক করল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
তাকে দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “ওই আমার মেয়ে—মৌলি। ওর কথাই আপনাকে এতক্ষণ ধরে বলছিলাম।”
আমি অবাক হলাম। আশ্চর্যের কথা এই যে উনি ওঁর মেয়ের বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি। মেয়েটি যে ওঁনার, সেটাও বোঝারও কোন উপায় ছিল না, কারণ ওদের মধ্যে কোন কথা হতে আমি দেখিনি। পত্রিকা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটির সঙ্গে আমার বার কয়েক চোখাচোখি হয়েছে, এইটুকুই। এর মাঝে মেয়েটির কথা আসে কোত্থেকে?
আমি চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম নীলকন্ঠ মিত্র। মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম ডাক্তারখানায়। কিন্তু সে জানতে পেরে ঢুকলই না। বাইরে থেকে চলে এল। আমিও আর জোর করিনি।”
এমন সুন্দর দেখতে মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। গায়ের রঙ দুধে-আলতার মত। বছর বাইশ বয়স হবে তার, মুখে একটা আলগা চটক আছে, যা বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়। সুতরাং আমি ভদ্রলোকের কাহিনির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম।
বারুইপুরের একটু ভেতর দিকে ওঁনার বাড়ি। আদতে উনি সাগরের লোক। আরও একটু এগিয়ে বললে, আদি বাড়ি মেদিনীপুর। ওঁনার বাবা অল্প বয়সে ব্যবসার কারণে নদী পেরিয়ে সাগরে চলে আসেন, আর ফিরে যাননি। সেখানেই জমি বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। সাগরেরই এক মেয়েকে বিয়ে করেন। শুরুর দিকে উনি কাঠ চালান করতেন, পরে কয়লার গোলা বানান। মেদিনীপুরে তিনি যেমন আর ফিরে যাননি, এই ভদ্রলোকও তেমনি এখানে জমি কিনে বাড়ি করে বসবাস করছেন—সাগরে ফেরেননি। সেখানে তাঁর আরও ভাই আছে, বাপের সম্পত্তি তারাই সব দেখাশোনা করে।
এই পর্যন্ত শুনে মনে হল, এ সব তো ঠিক আছে। কিন্তু এইগুলি তিনি বলতে চাইছেন না, তাঁর আসল বক্তব্য অন্য। হতে পারে ভদ্রলোক মেয়ের সামনে এই সব কথা বলতে চাইছেন না।
ঠিক তাই হল। তিনি বললেন, “এখন ত সবে দুপুর। আপনার যদি বাড়ি ফিরতে একঘন্টা দেরি হয়, কিছু অসুবিধে হবে?”
আমি হিসেব করে দেখলাম, অসুবিধে হবার কথা নয়। পনের দিন অন্তর আমি ছুটি পাই। শুক্রবার মাঝ বেলায় নাগাদ আমি আমার কর্মস্থল হাওড়ার অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাসে করে শিয়ালদা। সেখান থেকে ট্রেন। বাড়িতে যে আমার খুব কাজ থাকে, তা নয়। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য বরাদ্দ ছুটি না নিলে, পরে আর ছুটিই পাব না। কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে দেরি করাতে চাইছেন কেন? তাঁর নামার সময় এসে গেল। এখানে দেরিটা হবে কোথায়?
আমি সে সব না বলে বললাম, “না। খুব একটা অসুবিধে হবে না। তাছাড়া স্টেশনের কাছেই আমার বাড়ি—রাত হলেও অসুবিধা হয় না।”
“তবে আপনি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? বারুইপুরে একটু নামবেন দয়া করে?”
একটু অবাকই হলাম। সেই ভাবটা বজায় রেখেই বললাম, “কিন্তু কেন?”
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, “আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল। আমার মেয়ের বিষয়ে। আপনি যদি এইটুকু সময় আমাকে দেন, তাহলে চিরজীবন আমি কৃতঞ্জ থাকব।”
****
তিনি এমনভাবে অনুরোধ করলেন, যার পর আর না করা যায় না। তাঁর সঙ্গে বারুইপুরে ট্রেন থেকে নামলাম। সঙ্গে নিজের কাছে একটা কথা স্বীকার করে নিলাম অত্যন্ত গোপনে—যেহেতু কাহিনিটি তাঁর সুন্দরী মেয়েকে ঘিরে, তাই সেই বিষয়ে আমার বাড়তি একটা কৌতুহল ছিল।
স্টেশনের ভীড় কেটে গেলে ভদ্রলোক মেয়েকে আস্তে করে বললেন, “তুমি কি একটু বাড়ি চলে যাবে মা? তাহলে আমি একটু বাজার করে ফিরি।”
আমি চুপচাপ মেয়েটিকে দেখে যেতে লাগলাম। ও যে চলে যাবে, তা ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশন সবে শেষ করেছে, তার কেরিয়ারের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন রাখবেন। হয়ত জিগাসা করবেন, সোসাল ওয়ার্কে ভর্তি করলে তাতে চাকরি পাবার সম্ভাবনা কতটা। বা আমাদের অফিসেই ওর কোন চাকরি হতে পারে কিনা।
মৌলি ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা’ বলে আমাকে এক ঝলক দেখে বাড়ির পথ ধরল। আমি বিমর্ষ মুখে দেখলাম, সে চলে যাচ্ছে। মুখটা তেতো হয়ে গেল। বুড়োটা যে এমন করে আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, তা হলে কি আর নামি। এখন এই বুড়োটাকে কতক্ষণ সহ্য করতে হবে কে জানে!
ভদ্রলোক বাজারের দিকে গেলেন না, স্টেশনেই ফাঁকা একটা বেঞ্চে আমাকে নিয়ে বসলেন। তিনি কী এমন আমার মত অচেনা-অজানা ব্যক্তিকে বলতে চান যে মিথ্যে বলে মেয়েকে সরিয়ে দিতে হল? আমার কৌতুহলের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
তিনি বলতে শুরু করলেন, “আমার মেয়েকে নিয়েই আপনাকে বলতে চাই। ওকে দেখে আপনার কী মনে হল?” আমি চট করে কোন উত্তর দিলাম না। সত্যি বলতে কি, আমার মেজাজ একটু একটু করে সপ্তমে চড়ছিল। মনে হচ্ছিল, ও যদি পাশে বসত—কী ক্ষতি হোত? না হয় সে ভদ্রলোকের পাশেই বসত। কিন্তু থাকত এখানেই। আমি তার গায়ের গন্ধ পেতুম।
“একবার যখন আলাপ হয়ে গেল, আপনি আমার দেশের লোক, আপনাকেই সব বলা যায়। আমি খুব গভীর বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি ভাই—আপনি ছাড়া আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।” বলে তিনি আমার হাত দুটি ধরে ফেললেন। আমি ভারি অপ্রস্তুতে পরে গেলাম। হাত না ছেড়েই তিনি বলে যেতে থাকলেন, “আপনি আমার বাড়িতে আসুন—আজ হলে আজই, আমার কোন আপত্তি নেই। ওর মাকে কিছু বলবেন না, মেয়েকেও কোন রকম ভাবে আপনার আগমণের আসল হেতু জানানো চলবে না। আপনি আমার বাড়ি আসবেন আমার দেশের লোক হয়ে। আপনাকে তো বলেইছি, আমার মেয়ের গভীরতর অসুখের কথা।”
আমি আর অবাক হলাম না। বরং আমার সমস্ত মনোযোগ তাঁকে দিলাম। তিনি তাঁর জীবন কাহিনি বলতে শুরু করলেন।
“আমার মেয়ের নাম মৌলি। আমার একমাত্র সন্তান। ওকে ভালো করে মানুষ করব বলে আমরা সেকেন্ড ইস্যু নিইনি। কারণ তখন যেমন আমদের ইনকাম কম ছিল, গ্রহের ফেরে এখনও তেমন। যদিও আমি আপনাকে শুরুতে ছাপাখার লোক বলে পরিচয় দিয়েছি—তবে সেটা আমার অতীত। বর্তমানে আমি প্রায় বেকার বলতে পারেন।
“আমার মেয়ের মাথা ছোট থেকেই খুব পরিস্কার। কখনও সেকেন্ড হয়নি। মাধ্যমিকে ও নাইন্টি পারসেন্ট নাম্বার পায়। আমার সমস্যা ওকে নিয়েই। এখন ওর পুরো কথা বলার আগে আমাদের কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। নইলে ওর সমস্যার সমাধান করতে আপনার অসুবিধা হবে।
“আমি সাগরে ইস্কুল শেষ করে বারুইপুরের কলজে ভর্তি হই। এখানের পরিবেশ আমার তখন এত ভালো লাগত যে, বাড়ি যাবার নাম করতাম না। বাবার ব্যবসা আমার ভাল লাগত না। আমার আর দুটি যে ভাই ছিল, ওরা মাধ্যমিকের পর আর পড়েনি। তখন থেকেই বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করত।
“কলেজের কাছেই এক মেসে রয়ে গেলাম। পাশ করার পরও ফিরে গেলাম না, কারণ ওখানে আমার করার কিছু ছিল না। বাবা জানিতেন, আমি সরকারি চাকরি করব, তাই মেসে থেকে সরকারি চাকরিরি প্রস্তুতি নিচ্ছি। ব্যবসা ভাইরা দেখছে, তাই তিনিও চেয়েছিলেন আমি যেন চাকরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। ফলে তিনিও বাড়ি ফেরার ব্যাপারে চাপ দিতেন না।
“বাস্তবিক আমি তাই নিচ্ছিলাম। মেসে আমরা যে তিন চারজন ছিলাম, সকলেই কোচিং নিতাম। নানা পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আমার সঙ্গীরা একে একে একটা না একটা পরীক্ষা লাগিয়ে সফল হয়ে গেল, কিন্তু আমি আর পারলাম না। সকলের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে না। আমার ছিঁড়ল না। আমি ক্রমে ক্রমে হতাশ হয়ে গেলাম।
“বারুইপুরের যেখানে আমরা থাকতাম কাছাকাছি এক প্রেস ছিল। সেই প্রেসে আমার যাতাযাত ছিল কারণ আমি কলেজে পড়ার সময় একটি পত্রিকা করতাম, নাম ছিল ‘পুবের বাতাস’। বন্ধুরা সকলে চাঁদা দিয়ে পত্রিকাটি বের করতাম। কয়েকটি মাত্র সংখ্যা বেরিয়েছিল, পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই বাতাসের রেশ আমাদের সেই সময়কার সকলের মধ্যেই এমন করে চারিয়েছিল যে, এখনো পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে সেই কথা ওঠে।
“যাই হোক, সেই থেকে প্রেসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। প্রেসের কাজ আমার ভালো লাগল, পড়াশুনো ভালো না লাগলে প্রেসে গিয়ে বসে থাকতাম। কালির গন্ধ, ছাপাখানার গন্ধ আমাকে টানত। নিজে অল্প সল্প লিখতাম, তেমন কিছু নয়—একটা নেশা বা ঝোঁক বলতে পারেন। তখন ইচ্ছে হয়েছিল, পুবের বাতাস বন্ধ হয়েছে তো কি, আমার যে ডায়েরি ভর্তি কবিতা আছে—সে সব ঝাড়াই বাছাই করে একটা কবিতার বই বের করব।
“তখন বুঝতাম না অত, এখন বুঝি, আমি অত কেরিয়ারিস্ট নই। হয়ত তাই, সরকারি চাকরি লাগাতে পারিনি। তবে সে নিয়ে আমার কোন খেদ ছিল না। কালচারাল দিকটির প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। সেই বিষয়ে যদি কোন চাকরি পেতাম বেশ হোত। কিন্তু কী আর করা যাবে, সেটা হবার ছিল না! তাছাড়া কপাল বলে একটা ব্যাপার আছে—আমি খুব মানি। যে যতই চেষ্টা করুক, কপালে না থাকলে কিছুই জুটবে না।
“তাই পরে আমি প্রেসের কাজই বেছে নিই। নিজেই একটি প্রেস বসাই। নাম দিই ‘পুবের বাতাস প্রিন্টিং প্রেস’। আমার মাইল্ড একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে সাত মাস আগে। সেই থেকে আমার প্রেস বন্ধ। বিশ্রাম নেবার পর আমি প্রেসের তালা খুলেছিলাম। কিন্তু যারা আমার কাছে কাজ করাতো, তারা ততদিনে কি আর বসে থাকবে—অন্য প্রেস বেছে নিয়েছে। তাছাড়া কাজও কমে আসছিল। এখন তো পুরানো দিনের প্রেস আর চলেই না বলতে গেলে। বিয়ের কার্ডও অফসেটে হচ্ছে।”
এরপর ভদ্রলোক তুলে আনছেন এক পাখির কথা। সে পাখির নাম তিনি জানেন না। তিনি যখন থামলেন, একটা ডাউন ট্রেন এসে ঢুকল। লোকজনের কোলাহল মুছে গেলে, কিছুটা বিরতি নিয়ে তিনি শুরু করেন আবার।
“যখন খুব ভোর—পুব আকাশে রঙ ধরতে শুরু করেছে টগর ফুলের কুঁড়ির মত; পশ্চিমে তখনও আঁধার; ভোরের সেই মুহূর্তে এক ঝাঁক অতি ক্ষুদ্র পাখি অন্ধকার দিকে থেকে উড়ে যেত সেই আলোর দিকে। ওরা গিয়ে পুব ছুঁলেই আলো ধরে যেত আকাশের নানা কোণে—যেমনি করে টগরের কুঁড়িরা ফুটোন্মুখ হয়ে থাকে। সেটা তাঁর নিজের গাছ। যেমন তাঁর নিজের ঐ পুব আকাশের একটু নীল।
মেয়ে একদিন বললে, এই যে রোজ তুমি ছাদে এসে পাখি দেখ, ওদের নাম কী? আমি বলি, জানি না। দেখতে ভালো লাগে, তাই দেখি। সেই নাম দিল, পুবের পাখি। অসুস্থ হবার পর থেকে আর সে ওপরে যেত না। পাখি দেখত না। আমি কারণ জিগাসা করাতে ও বলে, ওর মা সেই সব পাখিদের ভাঙ্গা ঘরে বন্দি করে রেখেছে—ফলে তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে অশান্তিও হয়।”
এরপর আমরা দু’জনে স্টেশনে চুপ করে বসে থাকি। খানিকপর ভদ্রলোক উঠে গিয়ে সামনের স্টল থেকে দু’ ভাঁড় চা আনেন। আমার হাতে একটা দিয়ে বলেন, “একদিন আসুন আমার বাড়িতে। আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন।”
বুঝলাম তিনি কতটা অসহায়। মানসিক চাপ উজাড় করার লোক পাননি। এখন আমাকে পেয়ে মনের সব কথা উজাড় করে দিলেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “কাউন্সেলিং করাননি?”
চায়ে পরপর দুটি চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, “করিয়েছি। আজও তেমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছিলাম—গোবরায়। কিন্তু মৌলি বুঝে ফেলে। কান্নাকাটি শুরু করে। ফলে আমাকে চলে আসতেই হল। আসলে ওর কিছু সমস্যা নেই—এই কথাটা ওর কানের গোড়ায় ওর মা এমন করে জপে গেছে যে, মেয়েও নিজেকে নিয়ে ভাবে না। ও ভাবে, এই ঠিক আছে। কি যে করি—কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! অথচ আমি ত জানি, এসব ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই কাউন্সেলিং! মেয়ে অসুস্থ হবার পর এই বিষয়ে আমি দীর্ঘ পড়াশুনো করেছি। কাউন্সেলিং চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।”
এবার ওঁর চোখে চোখ রেখে বলি, “ওর মা’র কাউন্সেলিং করিয়েছেন?”
শুনে ভদ্রলোক একটু থমকে গেলেন। চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, “অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু—।”
****
এখন, এই হোগলার বনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যা বললেন, আমার মনে হল— যেন এই বিশেষ প্রিয় কথাটাই আমি শুনতে চাইছিলাম অনেকদিন ধরে। মনে হয়, পুব পাখিদের সঙ্গে এই বনের একটা সম্পর্ক আছে। আমি যখনই এই বাড়িতে এসেছি, চলে এসেছি হোগলার এই বনে। তাকিয়ে থেকেছি বনের মাথায় ওই আকাশের দিকে—যেখানে মেঘের মিশেলে আকাশ জাগরুক থাকে সর্বদা, নীল ঘন নীলের কোন বাহুল্য সেখানে চোখে পড়েনি।
সেদিন যখন সন্ধের মুখে আপ ট্রেনে চড়ে বসি, তিনি অনুনয় করেন আমাকে তাঁর বাড়িতে যাবার জন্য। বলেন, “কোন সাইক্রিয়াট্রিক কাউন্সিলর হিসেবে নয়—এক সাধারণ মানুষ হিসেবে, এক বন্ধু হিসেবে আমার বাড়িতে আসুন। আমার মেয়ে তো দেখল, আপনার সঙ্গে আমার কোন পূর্বে আলাপ নেই—ট্রেন পথেই বন্ধুত্ব হয়েছে। সেখান থেকে এক মানুষ অপর মানুষের বাড়ি যেতেই পারে। তাছাড়া আপনার প্রায় বাড়ির উপর দিয়েই আমাদের দেশের ফেরার পথ। সেই হিসেবে আপনি আমার দেশের লোক। সেই হিসেবে ট্রেন লেট করলেও তো আপনি আমার বাড়ি থেকে যেতে পারেন—তাই না?”
তখন আর না করতে পারিনি। ট্রেন লেটের ব্যাপারটা যে সত্যি—সেটা আমাদের মত দূর পাল্লার যাত্রীরা ছাড়া আর কে বোঝে। রাতের লাস্ট বাসটাও পাই না। তখন পায়ে হাঁটা ছাড়া গতি থাকে না। আর থাকার ব্যাপারে আমার কোন অসুবিধে নেই। এখানে আমার বাড়তি কোন রোজকারের ব্যাপার নেই, কিন্তু মৌলিকে ত দেখা যাবে। আর সেটাই বা কম কি?
আলাপ হবার পর দিন পনের কেটে গেল। আমি এদিকে ছটফট করে উঠলাম। মৌলিকে একবার দেখার জন্য এই ছটফটানি। ওই যে ভদ্রলোক বলেছিলেন, বাড়িতে থাকার কথা—মেয়ের সঙ্গে করে গল্প করে সময় কাটানোর এমন সুযোগ ক’জন পায়? আমিও সে সুযোগ ছাড়তে চাই না। কিন্তু নিজে থেকে ফোন করে জানতে পারি না, কবে নাগাদ গেলেই তাঁর চলবে।
অবশেষে তাঁর ফোন আসে। এক দুপুরের দিকে অফিসে টিফিন সেরে সবে বসেছি—তখন তাঁর ফোন। পরিচয় দিয়ে বললেন, “চিনতে পারছেন?”
বললাম, “পারছি।”
এরপর তিনি বললেন, “তাহলে আমার বাড়ি আসছেন কবে? আপনি আসবেন বলেছিলেন।”
বললাম, “যাব। আসলে সময় পাচ্ছি না। বাড়িতেও অসুবিধা রয়েছে—বাবার শরীরের কথা বলেছিলাম আপনাকে—”বলেই বলি, “এই শনিবার বাড়ি যেতে পারি। যদি যাই, তাহলে একবার ঘুরে আসব।”
তিনি বলেন, “আমার আলাদা ঘর আছে, দু’ চারদিন থেকে গেলেন সেখানে, আমার কোন অসুবিধা নেই। আমার মেয়ের সঙ্গে গল্প করুন, সাংস্কৃতিক জগত নিয়ে আলোচনা করুন—আমার মেয়ে এসব ভালোবাসে। সঙ্গে আমার স্ত্রীরও কাউন্সেলিং করুন। আমার মেয়ে বা স্ত্রী কেউ আপনার আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্য জানবে না। শনিবার অবশ্যই আসবেন—থাকবেন; হ্যাঁ, না থাকলে হবে না—কারণ ওইদিন আমি আপনাকে সব বলব। স্টেশনে বসে তো আর সব কথা বলা যায় না, সে জায়গাও ওটা নয়।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। যদি যেতে পারি, নিভৃতে বসে সে সব শুনব। না শুনলে আপনি যেমনটি চাইছেন, তেমনটি ঘটবে না।”
হ্যাঁ, তাহলে ওই কথাই রইল—”বলে ভদ্রলোক ফোন ছেড়ে দিলেন।
প্রথম দিনেই তাঁকে বলেছিলাম, “জানি না, আপনার বাড়ি যেতে পারব কি না। আমি যেখানে চাকরি করি, সেখানে থাকতে হয়। দুদিনের ছুটি পাই, বাড়ি ফিরি। পনের দিন—কখনো মাসে একবার। হাওড়ার যে এনজিও’তে আমি কাজ সেখানে মানসিক রোগিদের এক হোম আছে। আমরা অবশ্য পেশেন্ট বলি না, ক্লায়েন্ট বলি। এতে ওরা মানসিকভাবে ভালো থাকে।”
ওঁকে যেটা বলি না, তা হল, বাড়িতে আসা-যাবার পথেই বা কী করে সুযোগ পাব? আমার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। আমি যে খুব বেশি মাইনে পাই, তা নয়। মা ঘরে বসে রাখি বানায়, বোন ধূপ তৈরি করে। বাকি যা খরচ হয় সংসার চালাতে, তা আমার ঘাড়ে। বাবার একদিকটা পড়ে গেছে, বিছানায় শয্যাশায়ী। নিজেদের জমিও নেই যে কিছু ফসল হবে।
কিন্তু সময়ের অভাব থাকলেও যে সময় করা যায়—তার কারণ মৌলি। সেদিনের পর থেকে তাকে আর দেখিনি। সেদিন শনিবার সকালেই ভদ্রলোকের ফোন, “আসছেন তো?” অমনি মনে পড়ে গেল মৌলির মুখটা। কোন কিছু না ভেবেই বলে বলে দিই, “যাব।” তিনি খুশি হয়ে ফোন রেখে দিলেন। আমি ভাবলাম, শনিবার অনেক দেরি আছে, ততদিন মৌলিকে না দেখে আমাকে থাকতে হবে।
শনিবার একটু বিকেলে যখন নামলাম বারুইপুর স্টেশনে, দেখি তিনি উপস্থিত। কাছে এসে বললেন, “আজ কিন্তু থাকতে হবে—আসুন।” আমি কোন কথা বললাম না। তাঁর পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। ইচ্ছে করলে আমি আরও একটু আগে আসতেই পারতাম। তখন থাকলে ফেরার সম্ভাবনা জেগে থাকত। বিকেল করে নেমে আমি প্রথমেই সেই সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেছিলাম। ভদ্রলোকের কথায় আমার ইচ্ছেটা সহজ হয়ে গেল।
আমরা স্টেশনের বাইরে এসে অটো ধরলাম। গড়িয়ার অটো। অনেকটা যাবার পর অটো থামল। যেখানে নামলাম, সেখানে নানান বড় বড় গাছপালা। রাস্তার উপর বাড়িঘর বেশি নেই, দুই একটা দোকানপাট আছে। তবে চালু নয়। সেখানে দু’ একজন মেঠো লোক বসে আছে।
নেমে সরু পায়ে চলা রাস্তা, যা চলে গেছে বন চিরে ভেতরের দিকে—আমরা চলতে লাগলাম। ইতিমধ্যেই হালকা অন্ধকার আমাদের চারপাশে ভীড় করতে শুরু করেছে। খানিকপর ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে। বোধহয় অনেকটাই হাঁটতে হবে—তাই তিনি শুরু করলেন তাঁর মেয়ের কথা। আমিও নীরবে শুনে যেতে লাগলাম।
“উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পড়া পড়া করে ওর মায়ের সঙ্গে ওর প্রবল ঝগড়া হয়। হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায় সেটা। টানাটানিতে ও পড়ে যায়। পড়ার আগে মাথাটা খাটের কোণায় লাগে। মেয়ে ঞ্জান হারিয়ে ফেলে, দাঁত-কপাটি লেগে যায়। ওকে যখন পিজিতে নিয়ে যাই, মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। আমরা ভাবলাম, সব শেষ। কিন্তু পরে ডাক্তার বলে, দাঁত-কপাটি লেগে জিভ কেটে গিয়েছিল, তাই মুখে রক্ত আসছে।
“ওখানে দু’দিন চিকিৎসা চলে। সেখান থেকে ডাক্তার রেফার করেন বাঙ্গুর নিউরো’তে। আমরা নিয়ে যাইনি। তাহলে ওর একটি বছর নষ্ট হোত। দু’দিন পর ওর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। ঠিক করি, বাড়ি থেকে খানিক দূরেই এক নিউরো ডাক্তার চেম্বার করেন, ওঁনাকেই দেখাব। তাহলে ও পরীক্ষায় বসতে পারবে।
“কিন্তু সেই ডাক্তার নিজে হাতে রাখলেন না। তিনি রেফার করেন অপর এক ডাক্তারের কাছে। তিনি ডাক্তার বোস। গেলাম সেখানে। কিন্তু তিনি এমন ওষুধ দিলেন যে মেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমুতে লাগল—বিছানা ছেড়ে আর ওঠে না। যাই হোক ওই অবস্থাতেই ও পরীক্ষা দিল। গাড়ি করে নিয়ে গেছি, টলে পড়ে যাচ্ছে— ধরে ধরে হলে পোঁছে দিতে হোত। রেজাল্ট বেরুলে দেখা গেল, মোট পঁচাত্তর পার্সেন্ট নম্বর পেলেও, অঙ্কে মাত্র তিরিশ। হু হু করে সারা এলাকায় খবর রটে গেল, মৌলি ম্যাথে তিরিশ পেয়েছে। ওর মা মেয়েকে মারধোর করল। লজ্জায় মেয়ে বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দিল।
তারপরই শুরু হল তার অত্যাচার। বাইরে কোন ঝামেলা করে না, কিন্তু ওর মায়ের সঙ্গে সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি বা রাগারাগি হলেই ঘরের জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি করে। তবে ও মারধোর করে না বা নিজেকে মারে না। কিন্তু একজন স্কিজোফ্রেনিক পেশেন্ট সে—ভাঙ্গচুর করবেই। ও যখন শান্ত হয়, আমি অনেক করে বুঝিয়ে বলি, মা তুই এমনি করিস কেন? ও বলে, আমি মাথার ঠিক রাখতে পারি না বাবা—কি করি না করি কিছুই মাথায় থাকে না।”
তিনি থেমে যান। গায়ের পাতলা চাদরে ভাল করে মুড়ে নেন নিজেকে। চারিদিকে পুরোপুরি অন্ধকার। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর, সেখান দিয়েই যা আলো আসে। কিছু কিছু ল্যাম্পপোস্টে মৃদু আলো জ্বলে উঠেছে। আজ চাঁদ উঠবে আরও কিছু পরে।
বললাম, “এখন কাকে দেখাচ্ছেন?”
“কাউকেই না।”
“তাহলে ও এখন ঠিক আছে।”
“তাও নয়।”
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “ব্যাপারটা বুঝলাম না।”
“ওর এখন একজন ভাল কাউন্সেলর দরকার। আমি লাস্ট যে ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, তিনিই এই পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ওর এখন মেডিসিন দরকার নেই। যা দরকার তা হল প্রপার কাউন্সেলিং। সে জন্যই সেদিন গোবরা মেন্টাল হাসপাতালের কাছে এক কাউন্সেলিং সেন্টারে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আগে থেকেই টাইম বুক করা ছিল। তবে গোবরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও হত। কিন্তু সেখানে কেবল মানসিক রোগীর ভীড় দেখে যদি তার মনে কোন প্রতিক্রিয়া হয়—তাই সেদিকে যাইনি। কিন্তু বেসরকারি জায়গাতেও ও ঢুকতে চাইল না—চলে এল।”
“ওর মায়ের মত ও কি মনে করে ওর কাউন্সেলিং দরকার নেই?”
“সে নিয়ে আমাকে সোজাসুজি কিছু বলেনি। তবে আমার মনে হয়, আমি যে পদ্ধতি নিয়েছি, তাতে ওর আপত্তি থাকার কথা নয়।”
“আপনি তো ওকে পুব পাখি ধরে দিতে পারতেন।”
কথাটা শেষ করেছি কি করিনি—একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম, প্যাঁচা। দিনঘুমের খোলস গা থেকে সে ঝেড়ে ফেলল এইমাত্র। সেই ডানার শব্দে যেন ভদ্রলোকও কুয়াশার ভেতর থেকে জেগে উঠলেন। দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “কিন্তু পুব পাখির কথা আমি ত আপনাকে বলিনি! আমি এইটুকু পথে যা কথা বলেছি—তা আমার মেয়ের কথা। পুব পাখির কথা আসবে পরে, অনেক পরে।”
“এই রাস্তাটুকুর প্রায় পুরোটাই আপনি সেই পুব পাখির কথা আমাকে বলে গেছেন। শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়ে তারা যেন শূন্যেই মিলিয়ে যায়।”
“বললাম! কখন?”
এবার যেন তাঁর অবাক হবার পালা।
“নইলে আমি তা জানব কেমনে?”
“কিন্তু তা কিভাবে?”
তিনি আবার থামলেন। মাথার উপর প্যাঁচাটা তখন আলগা অন্ধকার আকাশের উপর চক্কর কাটছে। এখন সন্ধেরাত সবে। কিন্তু চারিদিক দেখে যেন মনে হয়, আমরা কোন প্রাচীন কালের এক সময়ের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে অন্ধকারও একটি চরিত্র হয়ে ওঠে।
বললাম, “আপনি প্রথম কবে সে পাখি দেখেন?”
তিনি যেন নিজের মধ্যে ফিরে এলেন। উৎসাহ নিয়ে বললেন, “এখানেই, বুঝলেন। তার আগে আমি কখনও দেখিনি এমন অদ্ভূত পাখিদের ঝাঁক। সবে নতুন বাড়ি করেছি, একদিন রাত্রে ঘুম আসছে না—তখন ছাদে উঠে যাই। মাদুর পেতে শুয়ে পড়ি, রাতের আকাশ ও তারাদের দেখতে থাকি। এইভাবে পুব পাখিদের চোখে পড়ে একদিন।”
“মেয়েকে কবে দেখালেন?”
“ও তখন সেভেনে পড়ে। সেই বয়স থেকেই ওর মা ওকে চাপ দিত। মাধ্যমিকে যখন প্রথম কুড়ির মধ্যে স্থান করে নেয়, ওর মা ওর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিল—উচ্চ মাধ্যমিকে এক থেকে দশের মধ্যে আসতে হবে। সেই চাপ মেয়েটা আর নিতে পারল না—মেয়ে আমার পাগল হয়ে গেল।”
বলে ভদ্রলোক থামলেন। আমি দেখলাম, পাশের নারকেল গাছের পাতা অন্ধকারের ধাক্কায় দুলছে। একটু একটু করে কুয়াশার ঘোর কাটিয়ে ফুটে উঠছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নক্ষত্ররা। ভদ্রলোকের হাতে তিন ব্যাটারি একটা টর্চ। তার আলো আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে। আমার মনে হল, আলো আসছে ঐ দুরাগত নক্ষত্র থেকে। তার আলোতেই পথ চিনে আমরা চলেছি।
ভদ্রলোক বললেন, “তখন একদিন ওর মা পড়া পয়ার করে প্রচন্ড মারে। মেয়ের মানে লাগে। সেই রাতে বাবা-মেয়েতে আর ঘুমাইনি। সারারাত আমরা ছাদেই ছিলাম। তখন ওকে পুব পাখির গল্প করতে থাকলাম। ওই পাখি যে আমি রোজ রাতে যে দেখতাম, তা নয়। রোজ কি আর ছাদে উঠে বসে থাকা যায়। তাছাড়া রাতে যে রোজ ওরা একই পথে যাবে, তার নিশ্চয়তা কি?”
“তারপর?”
“মেয়েকে দেখলাম, মন দিয়ে পাখির কথা শুনতে। ও বললে, না বাবা। সে পাখিরা একই পথে যায়। আমরা আজ সে পাখি দেখব। দেখবে, ওর আমার বন্ধু হবে। সত্যিকারের বন্ধু। যাই হোক, সেদিন আমরা পাখি দেখেছিলাম। পরে আরও কিছুদিন—একটানা। তারপর সে উতসাহে আমাদের ভাটা পড়ে। এখন আমার মনে হয়, যদি জীবনে এই পাখিদের আমি টানা রাখতে পারতাম—তাহলে মেয়েটা তার জীবনের এই পর্যায়ে আসত না। এতদিন ডাক্তার-ঘর করতে করতে, সাইক্রিয়াট্রিক বিভাগের বিভিন্ন ঘর ঘুরতে ঘুরতে আমিই বোধহয়—কখন কি বলি না বলি, খেয়ালই থাকে না! কিন্তু পুব পাখি? ভোরের ওই সময়টুকু ছাড়া যে তার আর কোন অস্তিত্ব নেই। ওর মা তো এই অয়াখির কথাকে নিখাদ কল্পনাই বলে উড়িয়ে দেয়। সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না এই পাখিদের অস্তিত্ব। এখন সেই পাখি কি করে আমি তাকে এনে দেব!”
“ও যা জিনিস পছন্দ করে, ওকে তাই দিতে হবে। যে কথা ওর মনের কথা নয়, তা বলা চলবে না। মোট কথা কোন ভাবেই ওর উত্তেজনা ঘটায়, সেই জিনিস ওর সামনে আনা বা বলা চলবে না। সাইক্রিয়াট্রিক পেশেন্টকে কিভাবে কাউন্সেলিং করতে হয়, এই নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। নিজেই তো কাজটা ভালো পারতেন।”
“পারতাম। কিন্তু আমি হেরে যাচ্ছি, জানেন। পারছি না। আমি আপনার পরিচয় গোপন করে নিয়ে যেতে চাইছি একমাত্র ওর মায়ের জন্য। আপনি সেদিন ঠিকই বলেছিলেন। ওর মায়ের ঠিক ঠিক কাউন্সেলিং করলে তবেই আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। কি অসুবিধে হত বলুন, যদি মেয়ের মন রাখার জন্যও স্বীকার করে নিল, পুব পাখি আছে? মেয়ে তো ভালো থাকত।
ক’দিন আগের একটি ঘটনার কথা আপনাকে বলি। আমাদের বাড়িতে তিনটি বিড়াল আছে। মেয়েরই পোষা। ও পশুপাখি ভালোবাসে। একটা বেড়াল ঘরের মধ্যে পেচ্ছাপ করে ফেলেছিল। ওর মা কাজ থেকে ফিরে তাতে পা দিয়ে হড়কে পড়ে যায়। সেই নিয়ে ওর মা তুমুল চিৎকার জোড়ে। ওকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না, এতে মেয়ের কোন দোষ নেই। বিড়াল যদি করে থাকে তাতে ও কী করবে।”
আমরা একটি বাড়িতে প্রবেশ করলাম। নিচু প্রাচীর, গিলের গেট। তাতে চাবি লাগান। মৌলি এসে দরজা তালা খুলে দিল। আঃ, কতদিন পর তাকে দেখলাম। মনে হল, আকাশে এখনো চাঁদ ওঠেনি তো কি হয়েছে, মাটিতে তো সত্যি চাঁদ আছে। আর তাতেই এই সমগ্র চরাচর আলো হয়ে রয়েছে।
আমার মনটা উষ্ণতায় ভরে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে মৌলির পুরো বাড়িটা দেখে নিলাম। তখনি মনে হল, এক ঝাঁক ছোট্ট পাখি যেন মাথার উপর দিয়ে চক্কর কেটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দ্বিতীয় পর্ব
এই সব কথাগুলি—যারা আমাকে ঘিরে ধরেছিল এই হোগলার বনের সামনে; বাতাসের স্পর্শের মতন যাদের অস্তিত্ব, যাদের আমি অনুভব করছি নিজস্ব হৃদয় দিয়ে; তারা, সেই সব কথারা আমাকে ছেড়ে ক্রমে ক্রমে বাতাসে মিশে, বাতাসের চাপে ফেটে যেতে থাকে। তখন কথাদের খোসাগুলি মাটিতে পড়ে যেতে থাকে—কথারা পাখি হয়ে উড়ে যেতে থাকে পুব আকাশে। ভদ্রলোক কথাদের এই ঘিরে ধরা বা মাটিতে পড়ে যাওয়াটা দেখেন না, কেবল দেখেন তাদের উড়ে যেতে। অজস্র শূন্যের জন্ম ও তাদের এই তড়িৎ গতিতে আকাশের মাঝে মিলিয়ে যেতে দেখে প্রশ্ন তোলেন, “পুব পাখিরা তবে কি ফিরে এল আবার?”
“আপনার মেয়ে পুব পাখির ছবি খুব ভাল আঁকে।”
তিনি আমার দিকে ঘুরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওসব দিকে ওর কত যে ন্যাক ছিল। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! এইসব করে কিছুই হয় না—এই কথা নিরন্তর ওর মাথায় পিন করে গেছে ওর মা, ওর মাথাটাকে চিবিয়ে খেয়েছে। কি সুন্দর আবৃত্তি করতে পারত। আমার কাছে আমার সম্পাদিত লিটিল ম্যাগটার যে দু একটি কপি ছিল, কতবার যে সে পড়েছে—তা আর কী বলব! ও তখন প্রায়ই বলত, আমি যখন কলেজে পড়ব, তোমার এই ম্যাগাজিনখানা বন্ধুদের নিয়ে আমি আবার বের করব—দেখে নিও। অথচ কী হয়ে গেল, দেখুন!”
বললাম, “মৌলি তো এখন অনেক ভালো হয়ে গেছে। আগের মত ওর মায়ের কথায় আর হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায় না। যাদের এক টুকরো আকাশ থাকে, এক সাদা ফুলের গাছ থাকে—তারা কেন অতি সাধারণ কথায় রেগে যাবে? তাদের তো একটা দাঁড়াবার জায়গা আছে।”
একবুক শ্বাস নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “আপনিই ওকে সারিয়ে তুলেছেন—মৌলি আপনার। ওর আর কোন সমস্যা নেই। আমি জানি ও ঠিক হয়ে গেছে।”
“ওকে যখন আমি পাখির ছবি আঁকতে বলি, আপনার মনে আছে নিশ্চই, আপনার সামনেই ও ছবি এঁকেছিল? এখন স্মৃতিকে উদ্ভাসিত করতে করতে ও ক্রমে নিজেকে ফিরে পেয়েছে।”
“কিন্তু ওর ছবিতে ছবিতে পাখিদের কোন রঙ থাকে না। রঙ হীন পাখি বলে কি কিছু হয়?”
না হবার কী আছে? সব পাখির যে রঙ থাকতে হবে, তার কোন মানে নেই। ও শুধু পাখির আউট লাইন করে, ভেতর রঙহীন। আকাশের কি রঙ হয়?”
“এই পাখি কী তবে আকাশের মত—শূন্য, ফাঁকা?”
তখন আমি পালটা বলি, “তার মানে কী আপনি বলতে চান, আকাশটা মিথ্যে?”
“সত্যিও তো নয়।”
“আকাশ কেবল পৃথিবীকে ধরে রাখে না, আমাদের অবচেতন মনে এমন আকাশ কী আমরা খুঁজে পাই না, যেখানের মেঘেদের আনাগোনা আমরা পড়তে পারি না? পশ্চিম আকাশে কোলে জন্মে যে পাখি পুব আকাশের তরল আলো পান করতে উড়ে যায়—সে কী তবে পাখি নয়?”
“পুব পাখিরা কথা বলে না। অথচ কী আশ্চর্যের ব্যাপার দেখুন, ওদের সঙ্গে কথা বলেই আমার মেয়ে আজ সুস্থ হয়ে উঠেছে!”
আমি অবাক হই না আর। তখন আমি নিচু হয়ে সেইসব কথাদের খোসা খুঁজতে থাকি। ভদ্রলোক আমাকে যে প্রস্তাব দিয়েছেন—মৌলিকে গ্রহণ করার, তারপরই আমরা দু’জনেই নীরব। বাতাস বয়, কার্তিকের আকাশ সন্ধের গন্ধ মাখতে শুরু করে—কথার খোলসের রেণু গুঁড়ো হয়ে মিশে যেতে থাকে বাতাসে। ওই খোলসের রেণু বাতাসকে এমনই আবিল করে তুলেছে যে বাতাস আর বাতাস নেই—কথাদের রেণু হয়ে আমার শরীরে প্রবেশ করে। যাকে এতদিন মনপ্রাণ দিয়ে চেয়ে এসেছি, এখন তাকে গ্রহণ করতে আমার মন জুড়ে কেবল দ্বিধার চাষ।
মনে পরছিল, সেদিন সকালে মৌলি সাদা খাতার পাতায় একটার পর একটা ছবি এঁকে যাচ্ছিল। পুব পাখির ছবি। তার ঘরের ভেতর-বাইরে- ছাদের আলসেতে রোদ পোহায়। যেন এটাই পাখিদের নিজেদের ঘর নিজেদের বাড়ি। বাইরের যে বাগান, তাও পুব পাখিদের নিজস্ব। পাখিদের ছবি গড়িয়ে চলে আসছে সেখানে, যেখানে এখন আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভদ্রলোক আমাকে এইকথা গুলি যখন বললেন, তখন বাতাসে রেণুর স্রোত।
বাতাস তো ভিজে। তাই সে ধীরে বয়। শুকনো হলে উড়ে যেত। মন হল সেই বাতাসের মত। ভিজে যায়, আবার শুকনো হয়ে ওঠে। মৌলি আমাকে নিয়ে চলে যেত এই হোগলার বন পেরিয়ে দূর থেকে দূরে—পুব পাখিদের গান শুনবে বলে। যেখানে গিয়ে আমরা দাঁড়াতাম, আগে পিছে কিছু দেখা যেত না। শুনতাম কেবল নৈঃশব্দের ঝংকার।
মৌলি কিন্তু সে পাখির ডাক ঠিকই শুনতে পেত। আমার হাত চেপে ধরে বারবার বলত, “শুনতে পাচ্ছ?” বলতাম না কিছু। বলার কোন ভাষা আমার ছিল না। কারণ নৈঃশব্দের এমন রূপ যে হতে পারে, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। ওর বারবার একই কথা বলাতে আমি সেদিন বুঝেছি, নৈঃশব্দই হল পুব পাখিদের ঠোঁটের ভাষা।
সে তখন আপন মনে বলে চলে, “এখানে পাখিরা আর আসে না কেন জান? এখানে পাখিদের আর নিজস্ব কোন আকাশ নেই। আকাশ আজ ভাগ হয়ে গেছে পাড়ায় পাড়ায়, এ বাড়ি ও বাড়িতে। যে অন্ধকার থেকে তারা পাড়ি দিত পুবের আলো খেতে—সেই পশ্চিমেই যেন আজ সবসময় সূর্য উঠে থাকে—সোলার লাইতের আলোয়। পাখিরা আর ঝাঁক বেঁধে, ডানায় সংগীতের ঝংকার তুলে উড়ে যাবে কেন?”
“কিন্ত তোমরা আকাশের অধিকার ছেড়ে দিলে কেন?”
“ছাড়িনি। আসলে হয় কী, পৃথিবী যেমন ঘোরে—মানুষের মনও ঘুরে ঘুরে যায়। তেমনি ওই আকাশও ঘোরে। তাই আকাশের দিকরাও নিরন্তর নিজেদের মধ্যে বদল ঘটায়।”
মৌলি কোন একদিন দেখেছিল, ওর মা সমস্ত পুব পাখিকে তাদের বাতিল ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে খাটের নিচে রেখে দিচ্ছে। ও তখন চিৎকার করে বলেছিল, ও কী করছ মা, দরকারে বাবার প্রেসের ভেতর ওদের ঢুকিয়ে দাও, সেখানে আর কিছু না হোক—কাগজ-কালি খেয়ে তারা বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু তার মা শোনেনি। মা চেয়েছিল, অন্ধকার কোণে তারা আলো-বাতাস না খেয়ে মারা যাক। সে তখন পাগলের মত তার মাকে বাধা দিচ্ছে, দরজা-জানালা হাট করে খুলে দেবার চেষ্টা করছে আর বলছে, “ওদের অন্তত বাবার ‘পুবের বাতাস’ পত্রিকায় ছাপা হয়ে দিয়ে যেতে দাও—।”
সেই প্রথম দিনের পর থেকে আমি আসি মাঝে মাঝেই। থাকি। তেমনিই একদিন খুব ভোরেই মৌলি আমাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়েছে এইখানে। হাত ধরে টেনে এনেছিল এই নীরবতার প্রতি, যেখানে আমরা আগেও কত গল্প করেছি; যেখানে দাঁড়ালে পৃথিবীটাকে খুব নিজের বলে মনে হয়।
সেদিন সে বলে, “একটা বাঁশি থাকলে বেশ হোত না? কেমন তুমি এখানে দাঁড়িয়ে বাজাতে আর পুব পাখিরা দলে দলে চলে আসত।”
আমি হাসলাম। মৌলি বলল, “তুমি কখনও পুবের পাখি দেখনি? নাকি তোমাদের ওদিক দিয়ে ওরা ওড়ে না?”
“হয়ত আছে, কিন্তু আমার জানা নেই।”
“তার মানে নেই, এই তো? শূন্য থেকে শুরু হয়ে সে পাখি শূন্যতেই মিলায়। আর যেখানে শূন্যতা নেই সেখানে পাখি নেই।”
“আমি এক পাখির কথা জানি, যা আকাশে চাঁদ হয়ে ফুটে থাকবে। সেটাকে তুমি গল্প বলতে পার, উপকথার কাহিনি বলতে পার—কিন্তু সেটাকে তুমি উপেক্ষা করতে পার না, যেমন আমি পারি না পুব পাখির কথা।”
সে উৎসাহিত হয়ে বলল, “কিরকম? আমি শুনতে চাই।”
“তবে শোন—ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। ক্রমে মানুষ-প্রকৃতি-আকাশ-সূর্য সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তখন কোন চাঁদ ছিল না। ফলে রাতে মানুষ কিছু দেখতে পারছিল না। তখন তারা ঈশ্বরকে ডেকে এর প্রতিবিধান করতে বললেন। তখন ঈশ্বর বললেন দেখ বাপু, আমার কাছে আর কোন উপাদান নেই, যা দিয়ে আমি মৃদু আলোর চাঁদ সৃষ্টি করতে পারি। কারণ পৃথিবী তৈরির সময় আমি তা সব শেষ করে ফেলেছি। এখন চাঁদ যদি কাউকে হতেই হয়, তা তোমাদের মধ্য থেকেই হতে হবে। এই বলে তিনি এক হরিণকে চাঁদ হবার প্রস্তাব দিলেন। হরিণ রাজি হল না। তখন এক ছোটো পাখি এগিয়ে এল। ঈশ্বর তাকে চাঁদ করে দিলেন। সে ধীরে ধীরে চাঁদ হয়ে উঠল। এখন আমরা যে আলো পাই, তা ঐ চাঁদের আলো।”
“ওটা ছিল পুব পাখি। তুমি আজকেও এখানে থেকে যাও। তুমি আজকের কাগজ পড়নি? আজই সেইদিন, যেদিন ষাট বছর পর চাঁদ সবচেয়ে কাছে আসছে আজ। আজ তাই চাঁদ উৎসব। তাই আজ আত তোমাকে ছাড়ব না। একসঙ্গে চাঁদ দেখব। দেখব বড় চাঁদের ভেতর থেকে কিভাবে পুব পাখিরা নেমে আসছে আমাদের বাড়ির প্রতি। এই হোগলার বনে তারা খেলে বেড়াবে, আমাদের প্রেসের ঘরে তারা বাসা বাঁধবে। যারা বলে পুব পাখি বলে কিছু নেই—সবই শূন্য-ফাঁকা—তারা সকলেই জানে শূন্যতার কোন রঙ হয় না।”
‘কিন্তু আজ যে আমার কাজ ছিল—। আজ নিয়ে টানা তিনি দিন রয়ে যাচ্ছি তোমাদের বাড়ি।”
“সে কাজ কি পরে করলে হয় না? চাঁদের থেকে, আমার থেকেও তা এত দরকারি? তুমি তো অফিস করেই আসছ। একবার না হয় নিজের বাড়ি নাই বা গেলে। যদিও জানি তপমার বাবা শয্যাশায়ী, মা বাতে পঙ্গু—তোমার যাওয়া দরকার; কিন্তু এমন অনুরোধ কী আগে তোমায় করেছি কোনদিন? করিনি। আসলে তোমাকে আমি আটকাতে চাচ্ছি এই কারণে যে, আমি বুঝে গেছি সেই পুব পাখিরা আর আসে না কেন। এক এক করে তারা সকলেই চাঁদের টানে চাঁদের দিকে চলে যাওয়ায় এত বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে চাঁদ। তার ভেতর অনেকটা ফাঁকা থাকবে, পুব পাখিদের পরিস্কার দেখা যাবে। তাদের আমি ডেকে নিতে পারব। তখন আবার তারা উড়ে যাবে পুব আকাশের দিকে।”
সেদিন সেই বনের ভেতর দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেতে যেতে আমরা বুঝেছিলাম আমাদের ভেতর কিছু একটা জড়িয়ে যাচ্ছে। সেটা কি জিনিস, আমরা তৎক্ষণাৎ তা বুঝিনি। আমরা ভেবেছি হোগলার শুকনো পাতা। আমরা ভেবেছি লতাপাতার ঘর্ষণ ঘটছে, তাই ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে শরীর। এর কারণ আমরা বুঝলাম এক ফাঁকা জায়গায় এসে। এইভাবে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে গা জড়াজড়ি করে আমরা কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়ালই নেই! এখানটা পৃথিবীর ছাদের মতন, শুকনো ঘাস, পোকামাকড়ের বাসা—যেন এক নতুন পৃথিবীর শুরু হয়েছে এখান থেকেই। বিঘত খানেক এই জায়গাটা বাদ দিয়ে আবার শুরু হয়েছে হোগলার বন। তার শেষটা আমরা কেউই দেখতে পাই না কারণ আকাশটা যে গোঁত খেয়ে নেমেছে ওদিকেই!
সেখানে আমরা কতক্ষণ ছিলাম, তা আজ আর মনে করতে পারি না। কেবল মনে আছে, সেখানে আমরা কোন কথা বলছিলাম না। কারণ আমরা দুজনেই খেয়াল করে দেখেছিলাম, ঘাসেদের ভেতর থাকা নীল ফুলের ছোট্ট কুঁড়িরা একটু একটু করে তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপড়ি মেলে দিচ্ছে—আর তা যেন আমাদের দেখেই! হয়ত এভাবেই, এমন শূন্যতার মাঝেই পুব পাখির জন্ম হয়। মনে আছে, আস্তে আস্তে আমরা সেই ভূমির উপর বসে পড়ি—যেন কোন শব্দ না হয়। নতুন পৃথিবী যেখানে জেগে ওঠে—সেখানটি শব্দহীন হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
সেই নীরবতাই আমাদের মধ্যকার ভাষা হয়ে উঠল। যেভাবে গিয়েছিলাম, সেভাবে ফেরা হল না। আগে পিছে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এলাম। মৌলির মা তখন রোদ মেখে অফিস যাচ্ছেন। সন্ধ্যের মুখে ফিরে এসে আমাকে ডেকে নিলেন একান্তে।
****
ভদ্রমহিলা বললেন, “আপনি আসলে কী চান বলুন তো? আমার স্বামী আপনার যে পরিচয় দিচ্ছেন, আমার মনে হয় সেটি সঠিক নয়। আপনি আমাদের দেশের বাড়ির লোক, সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, এর বাইরেও অনেক কিছু আছে, যা আপনারা আমার থেকে লুকিয়ে যাচ্ছেন।
“আপনাকে জানানোর জন্য বলি, ছয় মাস আগে আমার স্বামীর একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। বাকি ছয়মাস ওকে বাড়িতে বিশ্রাম নিতে হয়েছে। সেই হিসেবে বুঝতেই পারছেন, টানা একবছর ওর কোন কাজ ছিল না। পরে গিয়ে যখন প্রেস খুলল, তখন আর সেই বাজার নেই। ওর কাছে যারা কাজ নিয়ে আসত, সকলেই তখন অন্য প্রেস দেখে নিয়েছে, সেখানে তারা জমিয়ে ফেলেছে, আবার কেন পুরানো জায়গায় আসবে।
যাই হোক, এসব আপনাকে আমি কেন বলছি। আমার মনে হয়, আপনাদের এই অসম বয়সের বন্ধুত্বের মেয়াদ এবারে শেষ হওয়াই ভাল। ঘরে আমার একটা সোমত্ত মেয়ে আছে—আমি আপনাকে খারাপ বলছি না, বা অন্য মানে করছি না। কিন্তু তার তো একটা ফিউচার আছে। আপনিও নিশ্চই ওর বিদ্যে-বুদ্ধির পরিচয় এতদিনে পেয়েছেন—আমার মেয়ে সবার চেয়ে আলাদা। নিজের মেয়ে বলে গর্ব করছি না, কিন্তু ওর ব্রেন যে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত নয়, সেটা আপনাকেও মানতে হবে। নেহাত মাঝে কয়েকমাস ও অসুস্থ হয়ে পড়ল তাই, নইলে ওর এখন স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়াশুনো করার কথা। ছবি এঁকে, কবিতা লিখে কী হয় বলুন? ওসব অলসদের কাজ। ওতে বাহবা পাবেন, জীবন কিন্তু ঝলমল করবে না।”
“এখন আপনি আমাকে কী করতে বলেন?”
“আমার মেয়ে সুস্থই আছে। সে হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, ভাংচুর করে, ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে—এমন আচরণ তো অনেকেই করে। ওর বাবা ওকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছিল, আমি বন্ধ করে দিয়েছি। এমনিতেই ওর ভুল চিকিৎসা হয়েছে। ডিপ্রেশনের ওষুধ খেয়ে ও সবসময় ঘুমাত। নড়তে চড়তে পারত না। এখন ও দিব্যি আছে—গ্র্যাজুয়েশন করল। দুটো ব্যাচ পড়ায়। নিজের হাত খরচ ও চালায়। আমার ইচ্ছে ওকে ডব্লুবিসিএসে বসাব। তার জন্য কোচিং দিতে হবে। আমার মনে হয়, ওর আর কোন কাউন্সেলিং এর দরকার নেই।”
বললাম, “আপনি পুবের পাখি দেখেছেন কখনও? তাদের গায়ের রঙ কেমন জানেন?”
“না, জানি না। আর জানতে চাইও না। পুবের পাখি বলে কিছু আছে বলে আমি শুনিনি কোনদিন। আমার মনে হয়, এই সব বাপ-মেয়ের মনের অলীক কল্পনা—অবাস্তব। নইলে পাখি আছে, তার রঙ নেই—এমন শুনেছেন কোনদিন?”
“তাতে কী হল? আমাদের যে মন, তারই বা রঙ কী—আপনি বলতে পারেন? মনকে দেখাতে পারেন? তার অর্থ কি এই দাঁড়াল যে, মন বলে কিছু নেই?”
“আশ্চর্য কথা বলেন তো আপনি! দেখেছেন আমাদের এই অবস্থা; ওর বাবার কাজ নেই—কিছুদিন আগে কলকাতায় একটা বইয়ের দোকানে কাজ করেছিল, কিন্তু যাতায়াতে অসুবিধা হওয়ায় সেটা ছেড়ে দেয়। এখানে বইয়ের দোকান কোথায় যে কাজ পাবে? লোকের মধ্যে বই পড়ার চলই কমে আসছে, এখন কী আর ওসব আবেগ নিয়ে বসে থাকলে সংসার চলবে? আমাদের প্রেসটাই দেখুন না উঠে গেল। ও আর কাজ পাবে না, এভাবেই বাকি জীবন ওকে কাটাতে হবে। এখন আমার এই একার টাকাতেই আমাদের সংসার চালাতে হবে। আর ক’টাকাই বা আমি রোজকার করি। বিয়ের আগে এক নার্সিংহোমে রিশেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করতাম। পরে ছেড়ে দিই। কিন্তু আমাকে আবার সেখানে কাজ নিতে হয়েছে। আমার অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাঁরা আবার আমাকে বহাল করেছেন। আর এই অবস্থায় আপনি পাখিদের কথা বলছেন! আপনি তো একজন সুস্থ মস্তিকের মানুষ। বলুন দিকি, এক ঝাঁক পাখিদের কী অন্ধকার ঘরে বন্দি করা যায়? সম্ভব? আর আপনি যতই নানা যুক্তির জাল সাজান, পুব পাখি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই—এই সত্য আপনিও জানেন। আমার গুণধর স্বামী এইভাবেই আমাদের একমাত্র সন্তানের মাথা খেয়ে রেখেছেন!”
একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকলেন, “আমার বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। যেহেতু তখন ওর একটা চালু প্রেস ছিল, ছেলে হসেবে ওর মধ্যে কোন দোষ ছিল না—সুপুরুষ, সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগেনি। বিয়ের পর অনেক বছরই ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। আমার কিছু জমান টাকা ছিল, ওর ছিল—সব দিয়ে, ধার করে একটুকরো জমি কিনে আমরা প্রথমে একতলাটা বানাই। পরে পরে দু’তলাতে একটা ঘর করতে পারি যেটতে আপনি থাকেন—বাকিটা ফাঁকা থেকে যায়। সংসার খরচ, মেয়ের পড়ার খরচ—সব নিয়ে আর বাকিটা গড়া হয়ে ওঠেনি। কারণ তখন আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আর গড়েই বা কী হবে—মেয়ে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবে, এখানে থাকবে কে?”
আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সন্তর্পণে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দেখি, নীলফুলগুলি স্বস্থানে আছে কিনা।
আমাকে দেওয়া মৌলির প্রথম উপহার।
তৃতীয় পর্ব
দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আমরা এখানে এসেছিলাম। কেন জানি, তিনি আর ঘরের মধ্যে থাকতে চাইছিলেন না। মা-মেয়েতে খেতে বসেছে, আমরা বাইরে চলে এলাম। বুঝলাম তিনি একটু আলাদা জায়গা খুঁজছেন কোন কথা বলার জন্য।
হোগলার বনের ধারে এসে তিনি খানিক পদচারণা করলেন। আমি তখন এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। রোদটা ভালো লাগছিল। তিনি প্রথমে কিছু ভণিতা করলেন। তাঁর সঙ্গে ভদ্রমহিলার আলাপ, প্রেমপর্ব ও অবশেষে বিবাহ। এই সব আমি ইতিমধ্যেই মৌলির কাছে শুনে নিয়েছি। কিন্তু এখন, এই সব কথা তিনি আমাকে বলছেন কেন—যা আমাকে না জানালেও চলে। যাইহোক, তারপর শুরু করলেন আসল কথা।
ভদ্রলোক বললেন, “তিন মাস হয়ে গেল, আপনি আমাদের বাড়িতে আসছেন, সময় দিচ্ছেন। সেই থেকে আমার মেয়ের মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আমি লক্ষ করছি। আপনি আসলে ও খুশি থাকে, ভালো থাকে। আপনি অনেকদিন আগে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। মেয়েকে এমন একজনের কাছে রাখতে, যার কাছে ও ভালো থাকে, খুশি থাকে। যেখানে তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে সে উত্তেজিত হবে না, তাকে উত্তেজিত করে, এমন কিছু ঘটবে না, কেউ তাকে তার অপছন্দের বিষয়ে কথা বলে তাকে বিরক্ত করবে না।
“সেদিন আপনাকে আমি বলতে পারিনি যা তা হল এই, আমাদের এর আলাদা করে কোথাও যাবার জায়গা নেই। এই পৃথিবীতে আমাদের আপনজন বলতে এই টগরগাছ-পুব আকাশ আর পুব পাখি। আমাদের যে গ্রামের বাড়ির কথা আপনাকে বলেছি, বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই, যাতাযাত নেই কোন পক্ষেই। ফলে আমাদের কোন স্বজন নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি গত হবার কারণে ওদিকেও যাওয়া হয় না আর। আমরা সকলেই আজ সকলের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি।
“সেদিক থেকে আপনি ব্যাতিক্রম। বিশ্বাস করুণ, আমি আমার জীবনে আর কোন মানুষকে এতটা ব্যতিক্রম দেখিনি। আমি জানি আপনার জীবনে চড়াই-উৎরাই আছে—সেটা যেমন আপনার বাবার অসুস্থতা নিয়ে, তেমনি আপনার কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। কিন্ত এর বাইরে যে বৃহত্তর বাঁচার জগত আছে, তা আপনার জানা। আর তাই পুব পাখিকে আপনি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। আর সেদিক দিয়ে আপনি আমাদের দুজনের কাছেই আপনজন। ঐ টগর গাছ ও আকাশের মতন।
“আমি আমার মেয়েকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে চাই। আমি জানি আপনার কাছে ও ভালো থাকবে সুখে থাকবে। আপনার মধ্যে ও এমন একজনকে পেয়েছে, যার কাছে বাঁচার মন্ত্র আছে। মৌলি আপনাকে ভালবাসে, সেটা হয়ত আপনিও বোঝেন। আমি চাই আপনারা বিবাহ করুন। ওকে এই পরিবেশ থেকে বার করে নিয়ে যান।
আজকের আকাশে সেই বড় চাঁদ উঠবে; সে লাল ও গোল; এক বৃহৎ। সব কিছু থেকে গিয়ে তার ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসবে সমস্ত পুব পাখি। মৌলি বলে, আসলে ওরা চাঁদে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে যায়নি, ওরা গেছিল চাঁদের বুড়ির চরকার সুতো যোগান দিতে।
এইভাবে সে এক নিদারুণ কাহিনি গড়ে তোলে। কিভাবে সেই পাখিরা চাঁদের মাটিতে তুল বীজ বুনে দেয়—সেই নিয়ে সে নানা কাহিনি বুনতে থাকে আর মুখশ্রী হয়ে ওঠে অতীব উজ্জ্বল। সেই যে তাকে প্রথম দিন দেখেছিলাম—তখন সে ক্লাস সেভেন, তেমনই। আর এখন, তাকে ঘরের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, তার মা খুঁজে পাচ্ছে না। সে গেল কোথায়, অরূপ?”
বলতে বলতে ভদ্রলোক কেমন যেন বিহ্বল হয়ে যান। ভদ্রমহিলা বেশ শক্ত। তিনিই যা হাঁক ডাক করার করলেন। আমি ভাবছিলাম, মৌলি গেল কোথায়? গেলই যদি আমাকে জানাল না কেন? আমি যখন এখানে আসি না, দিনের মধ্যে ও পাঁচবার করে ফোন করে। যা ঘটছে সবই আমাকে জানায়। ওর সমস্ত পরিকল্পনার কথাও জানতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে ও আমাকে অন্ধকারে রাখল কেন? ব্যাপারটা ক্রমে আমার কাছে এক মস্ত ধাঁ ধাঁ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঘরে ফোন রেখে কোথাও উধাও হয়ে গেল সে নিমেষে? ওর মা যখন রান্নাঘর গুছাচ্ছিল, তখনই ও সরে পড়ে। গেল কোথায় সে? ব্যাপারটা ভাবার।
এদিকে মেয়ের ভাবনা ছেড়ে তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়েছে। পরস্পরকে দোষারোপের পালা চলছে। কিন্তু এই করলে তো এখন হবে না। মৌলিকে খুঁজে বের করতে হবে।
ওদের কিছু না বলে আমি বেরিয়ে যাই। ও কি তবে প্রেসের কাছে গেল। আমরা যেখানে প্রথম অটো থেকে নেমেছিলাম, প্রেস সেখানেই। তালা বন্ধ। সেখানে ও নেই। কারণ ও যেভাবে বেরিয়েছে তাতে চাবি খুঁজে নিতে সময় পাবে না। মৌলির মধ্যে হঠাৎ কী হল যে এমন কান্ড করল?
****
আমি হোগলার বনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি। আলগা শীত বাতাসে বনের মাথারা দুলছে। ওদিকে আকাশে মেঘে মাখামাখি। একটু পরেই চাঁদ উঠবে। আকাশ মাখামাখি হবে চাঁদে। শুনতে পাচ্ছি স্বামী-স্ত্রী’র তীব্র গলায় ঝগড়ার শব্দ। ভদ্রলোককে এই প্রথম কোমর সোজা করে উঠতে দেখলাম আমি।
আমি একটু একটু করে প্রবেশ করলাম হোগলার বনের ভেতর—কতদিন পর। সেই সব কথারা, যারা আমাকে আশ্রয় করে নিয়েছিল, যারা আমার মনকে আবিল করে তুলেছিল—মন তো শূন্য স্বরূপ—কিন্তু আমি তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ক্রমে তারা সেই কথার খোলস মোচন করে যে নিরবিচ্ছিন্ন শূন্যতার পরতে মিশে যেতে থাকল তাদের উড়ন্ত ডানার সহিত—তাতে, সেদিন যে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল নিরবিচ্ছিন্ন শূন্যতার ভিতর—তাতে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল।
আমি অনুমানে ধরে নিতে পারি মৌলি আজকের এই বিশেষ দিনটিকে বেছে নিয়েছে পুব পাখির মুক্তির দিন হিসেবে। প্রথমে সে অন্ধকার ঘরের খাটের নিচে দেখেছে, তারপর চলে গেছে তার বাবার বন্ধ প্রেসের সামনে। জানি না তার হাতে সে ঘরের চাবি আছে কিনা। কিন্তু সেখানে সে গেছে এই কারণে যে খাটের নিচে সে পাখিদের পায়নি। প্রেসের ভেতরও পাবে না।
ধীরে ধীরে আমি বনের সেই মাঝে এসে দাঁড়ালাম যেখানে একখন্ড ফাঁকা ঢালু ভূমিতে সেই যে একদিন এক নতুন পৃথিবী জেগে উঠেছিল। সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখি, নৈঃশব্দ আজও তেমনি প্রবাহমাণ।
আমি পাঞ্জাবির পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তুলে আনি শুকিয়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া একগুচ্ছ নীলফুল। মুঠোয়নিয়ে সেই ফুলেদের আমি ছুঁড়ে দিই উপর আকাশে। সেটি নিচে নামে না, বাতাসের বিভিন্ন স্তরে সেটি পাক খেতে খেতে একসময় বাতাসের চাপে ফট করে ফেটে যায়। আর তা থেকে অজস্র শূন্যর জন্ম হয়। প্রতিটি শূন্য রূপান্তরিত হয় এক একটি পাখিতে। বর্ণহীন, কেবলমাত্র আউটলাইন সমৃদ্ধ সেই সব পাখিরা বাতাসে একটা গোঁত্তা খেয়ে সোজা উড়ে যেতে থাকে উপর আকাশে। সেখানে তখন ঘষা চাঁদের উপস্থিতি। চাঁদ, সে যে এক বৃহৎ পক্ষী হয়ে বিশাল দুটি আলোর ডানা মেলে ধীর ভাবে আকাশের কোণ থেকে উঠে আসছে মাঝ আকাশের প্রতি। পুব পাখিরা দ্রুত চলে যেতে থাকে সেদিকে।
আর তাই, একবার মৌলি বলছিল, চাঁদের এত বৃহৎ হবার কারণ। অজস্র পুব পাখি ধারণ করে করে, চাঁদের আকার এখন এইরূপ। সেই যে একটি শূন্যতার পাখি দিয়ে ঈশ্বর চাঁদকে সৃষ্টি করলেন, সে ক্রমে ক্রমে বিবর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকল একলা থাকার কারণে। সে তাই ডেকে নিতে থাকল চারিদিকে যত পুব পাখি আছে, তাদের। আর তাই সে আর পুব পাখিদের দেখতে পায় না।
আমি তখন তাকে বলি, “তুমি চাইলে কি তারা আর আসবে না এখানে?”
সে তখন ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে আলগোছে। বলে, “এইভাবে আকারে ক্রমে স্ফিত হতে থাকল চাঁদ। আর সেখানে সকল পুব পাখির মোচ্ছবের দিন। আর কেবল পুব পাখিই কেন, চড়ুই-কাক-দোয়েল-বুলবুলি-ফিঙ্গে—যে সব পাখিরা ক্রমে লুপ্ত হয়ে আসছে আমাদের ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট, জীবন থেকে—তারাও পাড়ি জমিয়েছে ঐ একই পথে। তাই চাঁদ যে ক্রমে ফুলে ফুলে বৃহৎ হবেই—এর আর বেশি কথা কি। আমরাও যদি সেই চাঁদে যেতে পারি, বেশ হয়।”
“সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে বলে ভাবছ?”
“উঁ—ভাবছি তোমাকেও সেখানে নিয়ে যাই? নইলে আমি একা গিয়ে কী করব?”
“তুমি তোমার বাবাকে যা সব বলেছিলে—সেখানের চরকা বুড়ির কথা—”
“হুম! আমি ভাবছিলাম, সেখানে তাদের চাঁদ হয়ে থাকা ছাড়া আর কাজই বা কি? নিশ্চয় তারা চরকা বুড়িকে নানা কাজে সাহায্য করে থাকে—তার সুতো বুনে দেয়।”
****
আমি স্থির সেখানেই। দেখি কিভাবে মেঘেরা পালটে যায়, যেন তাদের প্রাণ আছে। বাতাস এখানে কোলাহলে মত্ত। দূরে দূরে অবস্থিত হোগলার বন দোলে। তাদের মাথায় ছুঁয়ে উড়ে যায় শীতের নানা পতঙ্গ।
তখন আমি নীল ফুল খুঁজি। সেই ঘাস নেই, মাটি নেই—তাই ফুলও অধরা। একইভাবে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এই বোধ জন্মায় যে—এই সকল মাটি-বন-অরণ্য, নৈঃশব্দ বলে কিছু নেই, কিছু হয় না—আসলে যা বেঁচে আছে তা হল অনন্ত শূন্যতা।
সবই ফাঁকা, সবই শূন্য। সেই শূন্যতার মাঝে আমি ক্রমে ক্রমে এক শূন্যতার পাখি হয়ে উঠি। আউটলাইন সমৃদ্ধ পাখি হয়ে আমি দ্রুত উড়ে যাতে থাকি সেই চাঁদের প্রতি। কারণ আমি জানি, মৌলিকে ওখানেই পাওয়া যাবে, সে ওখানেই গেছে। কেরিয়ার সর্বস্বতাকে বাদ দিয়ে যে সকল মানুষ নিজের মত করে সামান্যটুকু নিয়ে বাঁচতে চায়—তারা সকলেই তো চাঁদের পাখি।
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..