চুক্তি

অনসূয়া যূথিকা
ছোটগল্প
Bengali
চুক্তি

চুয়াডাঙ্গা জেলার এক শান্ত, ছায়া নিবিড় গ্রাম শিমুলতলী। এই গ্রামের মেয়ে আঁখি, আঁখি ঢালী। যে গ্রামের অধিকার মানুষ গরীব আর উত্তরের সহজাত ঔদার্যবোধ নিয়ে শান্ত ;সহজ সরল স্বভাবের। আঁখির বাবা জোতদার, বর্ধিঞ্চু কৃষকও বলা চলে। গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের মজুত, কেবল অহঙ্কার না সম্ভ্রমও জাগায় লোকের মনে।

শিমুলতলী গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আছে, আছে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ও। কিলো পাঁচেক দূরের উপজেলা সদরে আছে ডিগ্রি কলেজও। কিন্তু জোতদারের মেয়েদের পড়ালেখার চাইতে খবরদারিতে বেশি মনোযোগ!

জোতদারের আদিবাড়ি খুলনার খালিসপুরে, শিমুলতলী গ্রামে সে বসতি গড়েছে বিবাহ সূত্রে। শ্বশুরের একমাত্র কন্যা এবং একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে কুলসুমা বাণুই সব সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু খুলনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকে নাই জোতদারের। পাঁচ মেয়ের তিনটেকে চালান করে দেয় সে খালিসপুরে তার বুড়ি মায়ের কাছে। দাদির স্নেহ আদরের বড় হয়তো হয় তারা কিন্তু মানুষের তো কেবল গায়েগতরে বড় হলে চলেনা আরো কিছু লাগে।

হঠাৎই একটা ফেসবুক আইডির খোঁজ জানলাম।তাকে ফেক বলবো না কী বলবো জানিনা। আইডির নাম এঞ্জেল আঁখি! যদিও সে মানুষই। সত্যি সত্যি এঞ্জেল না বটে, তবুও ছবি দেখে ইস্তক ভাবছি কেবলই। মানুষ এতো সুন্দর হয়! এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ঘরের মেয়ে আঁখি, তার বাপের টাকার সাথে সাথে রুপের গর্বও ছিল ।তবে অল্প বয়সেই যাকে বলে ইঁচড়েপাকা মেয়ে।তাই হয়েছে এঞ্জেল! হায় সত্যি সত্যি যদি তার স্বভাবটাও রূপের মতোই মোহনীয় হতো!

এঞ্জেল আঁখি বলি বা আঁখি ঢালি বা ওরফে প্রতিমা বা ওরফে অর্পিতা দেবনাথ বলি আদতে মানুষনতো একটাই। চুয়াডাঙ্গার শিমুলতলীর ঢালী জোতদারের বেটি আঁখি ঢালী! মাত্র চৌদ্দ বছরেই বহু প্রেম কাহিনী তে অভিনয় শেষ হয়েছিল যার।

খুলনার খালিসপুরের বাড়িতে দাদি আর ছোট বোনেদের সাথে আঁখির মন টিকতোনা একদমই। তাই একাই রওনা দিতো ঢাকা,মাসির বাড়ি। কখনো আবার চিটাগাং কখনো চুয়াডাঙ্গা, কখনো খুলনা শহরে বা আরো কোনখানে ।তবে ঢাকা শহরে আসতো বেশি, ঢাকারই চমকই আলেদা। মাসির এক মেয়ে ছিলো আঁখির সমবয়সী। তার সাথে পাড়ার এবাড়ি ওবাড়ি ঘোরার ফাঁকেই প্রেম প্রেম খেলা জমে যায় এক সনাতন ধর্মাবলম্বী যুবকের সাথে। পাড়ার কেবল কানেকশনের কর্মী সে যুবকের নাম অপূর্ব। পুরো নাম যে অপূর্ব কুমার দেবনাথ সেই যুবক কখনো বলেনা। লোকে তাকে অপূর্ব বলেই জানতো, তার ধর্ম বিশ্বাস কি তা জানবার কোন প্রয়োজন কখনো কারো হয়নি,কারণ সে নিজেই। অপূর্ব নিজেই নিজেকে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে মিশে নিজের আচরণ সেইরকমই রেখেছে জন্য কারো মনে কখনো সে ভিন্ন ধর্মের সেই প্রশ্ন আসেনি৷ কিন্তু এলো, আর সেটা বেশ প্রকট ভাবেই।

চুয়াডাঙ্গা বা খালিসপুরে ডজন ডজন প্রেম প্রেম খেলা হয়েছিল বটে কিন্তু সেইগুলোর কোনটাই আঁখির জন্য খুব জোড়ালো কিছু মনের কারবার ছিল না। অপূর্বর সঙ্গে সেই খেলা খেলা মিসকলের প্রেমটাই কিকরে যেনো জমে গেলো তার। হয়তো বয়সও একটা বিষয়, বিশ একুশের বাঙালি মেয়েরা সাধারণ সংসারী হতে চায়। অপূর্ব কি করে সে জানতো, বাড়ির খোঁজ সে নিলো না। হঠাৎই এরপর তার মাথায় যে কি ভুত চাপে সেই জানে। আঁখি ঢালী সিদ্ধান্ত নিতে কসুর করলো না, একার সিদ্ধান্তে অপূর্বকে বিয়ে করতে একপায়ে খাঁড়া হয়ে যায়। অপূর্বকে রাজি করাতে পেরে সে নিজের উপরই খুব খুশি হয়। সংসার করতে গেলে যে কেবল মিয়া বিবি রাজি হলে হয়না আরো কিছু বিষয় আসেই তা সে তার হঠকারী বুদ্ধির জন্য ভাবলোনা।

দেশ গ্রামে বলে স্ত্রী বুদ্ধি! আর লোকে এরকম ধিঙ্গিপানা মেয়েদের বলে বটে উড়নচণ্ডী! তা সেই উড়নচণ্ডী কেন কে জানে ঐ হিন্দু ছেলের সাথে কাগজে কলমে এক চুক্তি করে বসে ।রিতিমতো স্ট্যাম্প পেপারে, নোটারি পাবলিক মারফত। চুক্তি মতে তারা স্বামি স্ত্রির মতোই থাকবে!! যদিও তাদের কোন ধর্ম বা আইনগত ভাবে বিয়েই হয়নি,রেজিস্ট্রিও না। আঁখি ঢালী কি চেয়েছিল এরকম জোড়াতালি দেয়া সম্পর্ক! এরকম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সংসার! হিন্দু মুসলিমের বিয়ে তো অসম্ভব কিছু না সমাজে, অপ্রচলিতও না! তবুও কেন অপূর্ব বিয়ে না করে চুক্তিতে সংসার করতে বাধ্য করলো আঁখিকে! কি ছিল এই উড়নচণ্ডী মেয়েটার দোষ!!

আঁখি আর অপূর্ব স্বামীস্ত্রীর পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়ে এক ভাড়া বাসায় উঠে, সাবলেট হিসাবে। অপূর্ব জানায় না নিজের পরিবারকে কিছুই, স্বাভাবিক। এমনকি তার নিজের পরিবার যে এই শহরেরই আরেক মহল্লার বাসিন্দা সেটাও গোপন করে রাখে। আঁখির সঙ্গে সে সবসময় থাকেনা এক বাড়িতে নানান অযুহাতে। অথচ আঁখির বাড়িতে সবাই জানে তার বিয়ের কথা। বেশ কয়েকবার আঁখি বাড়িতেও যায় অপূর্বকে সঙ্গে করে। বাড়ির লোকেরা যথেষ্ট রকম আদর সমাদর করেন নতুন জামাইয়ের। কিন্তু উহ্য থাকে অপূর্বর প্রকৃত চেহারা, প্রকৃত ধর্ম। সে কখনো কাউকে জানায় না, জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে না যে সে সনাতন ধর্মাবলম্বী একজন মুসলমান না। সেও বাকিদের সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে বেড়ায়, বাকিদের মতোই কবজি ডুবিয়ে গরুর মাংস দিয়ে পোলাউ খায়। গোপন করে রাখতে পারে যে সে আদতে ইসকন পন্থী মহাপ্রসাদ ভোজী, পেঁয়াজ রসুন ছাড়া নিরামিষ খেয়ে অভ্যস্ত।

সময় যায়,এক সময় আঁখি একটু একটু করে বুঝতে পারে অপূর্বকে যেমন সে জানতো তেমনটা সে না। অপূর্ব তাকে সংসার খরচ হিসেবে নামমাত্র যে টাকা দিতো তাতে শহরের বাসাবাড়িতে টিকে থাকা যায় না। বাড়ি থেকে প্রায়ই নানান নাটক করে বড় অঙ্কের টাকা আনতে হতো অপূর্বর নানান বায়না আবদার মিটাতে। অপূর্ব অপূর্ব সব বিনোদন আর আবদারের চোটে প্রকাশ হতে থাকে তার অপ্রকাশিত চরিত্র! আঁখি জানতে পারে কেবল অপারেটর অপূর্বর নানান কিছিমের শখের কথা, নেশার কথা। ব্যাটারি ভেজানো পানি, বাংলা মদ, কিংবা কেরু বা চুয়ানি কোনটাতেই আপত্তি নাই অপূর্বর। চলে গাজা আর আরো কিছু মাদকের আসক্তিও। আঁখি তাই টাকা যোগানো সোনার ডিমপাড়া হাঁস তার কাছে! এমন এমন আরো কতো কতো আঁখি ঢালী আছে অপূর্বর!? থাকতে হয় ওদের!

হঠাৎই এক মাদক মামলায় গ্রেফতার হয় অপূর্ব,। ঘটনাক্রমে তার পরিবার, বন্ধু মহল, বাড়ির লোকেরা জানতে পারেন আঁখির কথা । তখনো সংসার সংসার খেলার নেশা কাটেনা আঁখির।

ঢালী জোতদারের কন্যা সহজেই ফিরতে পারতো বাড়ি, ফিরতে পারতো চুয়াডাঙ্গায়। শিমুলতলী গ্রামের ছায়া ঘেরা বাড়িতে নিজের জ্বলে অঙ্গার হওয়া মনটাকে জুড়াতে পারতো কিন্তু তা হলোনা ধিঙি মেয়েটার।

উড়নচণ্ডী পায়ে পড়লো অপূর্বর মায়ের! বউ বলে মেনে নিতে স্বিকার করতে করজোরে ভিক্ষা চাইলো! সব খুলে বললো তাকে, সেই মমতাময়ী মাতৃমূর্তিকে!! সব শুনে মালা রাণী দেবনাথ কিছুতেই মানতে পারেন না এ অনাচার। যা তখনো আঁখি ঢালীর অজানা ছিল, অপূর্বর ধর্ম বিশ্বাস তা তখনো অজানাই থাকে। অপূর্বর মা শ্রীমতী দেবনাথও জানতেন না আঁখি হিন্দু মেয়ে না! তিনি কেবল অনাচার বুঝেই বিয়ের কথা বলতে গেলেন!

বৈষ্ণববাড়ির নিষ্ঠাবান এয়োস্ত্রী এই নারী, বিয়ের জন্য চাপ দেন তখন ছেলেকে ।শ্রীমতী দেবনাথ নিষ্ঠাবান বিধবা, আচারনিষ্ঠ। নিজের ভাইয়ের তত্বাবধানে ছেলের বিয়ের ব্যবস্হা করেন পাড়ার কালি মন্দিরে। তড়িঘড়ি করে তালঠেকা বিয়ের আয়োজন।পাত্রী মুসলমানের মেয়ে জানলে বেঁকে বসবেন পুরোহিত, অপূর্বর বুদ্ধিতে এটা বুঝে গেলেন তার কংস মামা। পাল্টে গেল নাম, আঁখি থেকে অর্পিতা।সাকিন মায় পুরো পরিচয়।বাপ মায়ের নাম, ঠিকানা, গোত্র সবই অপূর্ব আর তার মামার ঠিক করা ।কেবল কালীবাড়িতে যখন আঁখিকে আনা হলো তখন সে পুরো জড়ভরত! কি ঘটছে সেটা বুঝতে পেরে বিমূঢ়! বিয়ের আচার হয়ে গেলো
স্বামির সহধর্মিনী হয়ে গলবস্ত্রে প্রণাম করে স্বামিসহ গুরুজনদের।সাস্টাঙ্গে প্রণাম রক্ষাকালী দেবীকে।এরপরে ঘরে উঠে হিঁদুর বাড়ির নিয়ম মেনে কেটে যেতে পারতো দিন মাস বছর।কিন্তু বিধিবাম!

হিন্দুর বাড়িতে বউ হিসাবে নিজেকে মানাতে চেস্টা যে করেনি করেনি আঁখি ওরফে অর্পিতা দেবনাথ তা না। কিন্তু মুসলমানের পেঁয়াজ রসুন দিয়ে জমিয়ে রান্না আমিষ খেয়ে অভ্যস্ত জিহ্বায় বড় বিস্বাদ ঠেকতো শ্বশুর বাড়ির খাবার।বাড়িতে মন টেকেনা, উড়ু উড়ু মন বড়। স্বামী আয় করেনা, হাত তোলা হয়ে থাকতে হয় তাকে শাশুড়ির কাছে। অপূর্ব কখন যে কোথায় থাকে কি করে সে জানেনা। বাড়ি থেকে টাকা, কাপড় পাঠানো ছাড়া তার চলেনা। কিন্তু এই তত্ব গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সাথে আর তেমন যোগাযোগ রাখতে পারেনা সে। হিন্দুর বাড়ির বউ এখন সে, পোয়াতি। তাকে বহু রকমের বহু আচার মেনে চলতে হয়, যা তার মুসলমানি মগজে বিতৃষ্ণা জাগায়। তবুও সে করে, মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় তার নাই বলে।

এরপর তার এক ছেলে জন্মায়।বাড়িতে নিত্য অশান্তি, ঝগড়া! বৈষ্ণব বাড়ির নিরামিষ খাবার আঁখিরতো বটেই এক সময় ছেলেরও মুখে আর রোচেনা। ছেলে দিন দিন রোগা হতে থাকে, আঁখিরও জৌলুশ হারিয়ে কেমন পাঁশুটে চেহারা দেখতে হয়। শ্রীমতী দেবনাথ দস্তুর মতো সংসার সামলান। দৌরদন্ডপ্রতাপ সেই নারীর সামনে আঁখি ঢালী বড় পলকা। কারণ তার স্বামীর কোন আয় নাই, সংসার চালান মালা রাণী!

তাঁর পুজার ঘর তো বটেই, হেঁশেলেও আঁখি ওরফে অর্পিতার ঢুকবার অধিকার ছিল না। রোজ মহাপ্রসাদ রাঁধা হয় যে বাড়িতে সেখানে আর যাই হোক ম্লেচ্ছ কন্যার প্রবেশ নৈব নৈব চঃ…!

স্বামীর বাড়ি ছাড়ে আঁখি ওরফে অর্পিতা ওরফে….. ওরফে…. হয় এঞ্জেল আঁখি! তার অনেকগুলো ফেইসবুক আইডি অনেকগুলো সেলফোনের নম্বর! সে তার এই এতোগুলা আইডি, নম্বর, পরিচয় দিয়ে কেবলই তার স্বামী পুঙ্গবটিকে বোঝার চেষ্টা করে চলে এতোটা বছর ধরে। ছেলের জন্য অপূর্ব বা তার মা খোরপোশ হিসেবে কিছুই দেন না, খবরও নেন না। তারা জানেনও না আঁখি আর তার ছেলে কোথায় কিভাবে আছে। আঁখি বহু রকম করে ছেলের জন্য তার বাবার আবেগ জাগাবার চেষ্টা করে করে ব্যর্থ! অপূর্বরা এরকমই হয়, তা সে যে সমাজের যে পরিবারের যে ধর্মের হোক না কেন! নিজের সন্তানের দায়িত্বও এনা নেয় না।

প্রেম না, সংসার না, সন্তান না কেবল বল্গাহীন লাগামহীন বন্ধনহীন জীবনই এদের একমাত্র কাম্য!

অনসূয়া যূথিকা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ