চেয়ারম্যান সাহেব খুব অনেস্ট

মাসকাওয়াথ আহসান
রম্য রচনা
Bengali
চেয়ারম্যান সাহেব খুব অনেস্ট

 

মাকেন্দো গ্রামে ভীষণ বিপর্যয় নেমে আসে। এ গ্রামের কৃষক ও কারিগরেরা শ্রমে-রক্ত-ঘামে যে টাকা-পয়সা উপার্জন করে; শ্রমিকেরা দূরদেশে গিয়ে জীবন পানি করে যে উপার্জন মাকেন্দোতে পাঠায়; তাই হাওয়া হয়ে যায়, ব্যাংক অফ মাকেন্দো আর পিতার দোয়া সমবায় সমিতি থেকে।

মাকেন্দোর রাজনীতিক, আমলা, সহসভাপতি, গ্রামভক্ত; সবাই প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মাকেন্দোবাসীকে গ্রামপ্রেম ও পবিত্র ইতিহাসের প্রতি ভক্তি শিক্ষা দেয়। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, যে-ই গ্রামপ্রেম, ইতিহাসের পবিত্রতা শিক্ষা দেয়, সেই কিছুকাল পর মাকেন্দোর বিপুল অর্থ লোপাট করে পগার পার হয়ে যায়।

এই যেমন মাকেন্দোর প্রধান দারোগা যে সারাক্ষণ গ্রামপ্রেম, পবিত্র ইতিহাসের মন্ত্রপাঠ করতো; কথায় কথায়, দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্সের কথা বলতো; লোকটি অবসর নেবার পর জানা গেলো, সে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছে।

লোকটি বুদ্ধি দিয়েছিলো, এই যে যারা হতাশায় পড়ে নেশা-টেশা করে, মাকেন্দোর বিপুল উন্নয়নের সমালোচনা করে; এরা হচ্ছে মাকেন্দো বাগানের আগাছা। সুতরাং সে আগাছা পরিষ্কার করতে “অপারেশন হারকিউলিস” পরিচালনা করতে হবে। সেই মতে মাকেন্দোর অনেক আগাছা পরিষ্কার করার পর; অবশেষে দেখা গেলো প্রধান দারোগাই ছিলো সবচেয়ে ঘন আগাছা।

প্রধান দারোগার দুর্নীতির খবর চাউর হয়ে যাবার পর চারিদিকে রি রি পড়ে যায়। লোকজন সমালোচনা করে, চেয়ারম্যান সাহেব এ কাকে প্রধান দারোগা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

অমনি মাকেন্দোর যে কোন স্ক্যান্ডালে উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি এমিরেটাস এসে পড়ে। এমিরেটাস চুক চুক করে বলে, উনি যাকেই বিশ্বাস করে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন, সেই বিশ্বাসভঙ্গ করে; উনি কী করবেন!

মাকেন্দোতে প্রাচীন বাতাবি লেবু বাগানে গড়ে ওঠা সংবাদপত্র অফিসে বসে এমভি এডিটরস গিল্ড গোল টেবিল রচনা করে বলে, কিন্তু দেখতে হবে চেয়ারম্যান সাহেব অত্যন্ত সৎ। তিনি নিজের বাগানে নিজের মরিচ, শসা, ঝিঙ্গে ফলিয়ে খান। তিনি একজন গণিমিয়া গরীব কৃষক। তার দলের লোকেরা ডাকাত হলে উনি কী করবেন!

গোলটেবিলে মাকেন্দো মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ বলে, আমি একদিন চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনি তিনি নামাজে। একটু পরে আমাকে উনার কক্ষে নিয়ে গেলে দেখি, মাটিতে মাদূর পেতে উনি জিকিরে ফিকিরে রয়েছেন। পাশে বসে এক আধ্যাত্মিক দরবেশ বসে। ভক্তিতে তার চক্ষু নিমীলিত।

উনি ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজ হাতে খিঁচুড়ি রান্না করেন। এরপর মাটির সানকিতে পরিবেশন করেন সে পবিত্র তাবাররক। আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে সেই প্রসাদ খাই। এখন বলুন, এই সৎ মানুষটি কী করবেন, যদি তার দলের সব লোক ডাকাত হয়!

গোলটেবিলে বসা ইতিহাসবিদ গোঁফ কামড়ে কাঁদে, সায়েন্স ফিকশনবিদ গোল চশমার লেন্স মুছে আর কাঁদে, সংস্কৃতি খালা মেক-আপ ঠিক করে টিস্যু দিয়ে, পাছে চোখের জলে কাজল গলে পেত্নী সদৃশ হয় মুখখানা।

গোল টেবিল শেষে বিশাল কপালধারী সাংবাদিক তার মাথার তৈলাক্ত প্লটে হাত বুলিয়ে বলে, উনি আছেন বলেই আজো ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, ৩৫ শতাংশ লোক পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে যায়।

গ্রামের দিকে দিকে ডাকাতির খবর রটে যাবার পর গ্রামবাসীকে আস্থা দিতে আয়োজিত হয় যাত্রাপালা, “সততার ডালে দুষ্টু কাকেরা।” যাত্রার বিবেক এসে দাঁড়ায় স্যুট টাই আর ফুল হাতে নিয়ে। তারপর টেনে টেনে বলে, নজিরবিহীন প্রধান দারোগা, দশাসই প্রধান চৌকিদার দুর্নীতি করলে তার বিচার হবে, কেউ চেয়ারম্যানের প্রোটেকশন পাবে না। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না রে ও ভোলামন। দুর্নীতির প্রতি জিরোটলারেন্সে উদ্ধার হবে চুরি যাওয়া ধন।

দুঃসংবাদ আসে মাকেন্দো গ্রামের এক ওয়ার্ড কমিশনার পাশের বোকেন্দো গ্রামে বেড়াতে গেলে; তাকে জবেহ করে; নব্বুই কেজি মাংস মেপে রেশমী কাবাব, সুতলি কাবাব আর হালিম তৈরিতে সরবরাহ করা হয়েছে। ওয়ার্ড কমিশনার সোনার মানুষ; সোনা চোরাচালান করতো; কোথায় তার সোনা লুকিয়ে আছে; তা খুঁজতে মাকেন্দোর মানুষ মাটি খুঁড়তে শুরু করে!

আবার সমালোচনার ঢেউ ওঠে, এ কেমন সোনার ছেলেকে ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান!

এবার আবার সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স নেমে পড়ে অপতথ্যের ঠাকুর মা’র ঝুলি নিয়ে। মাকেন্দোর আরাফাতের ময়দানে শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার ছলে চোখ গোল গোল করে কেমিকেল আলী বলে, মাকেন্দোর প্রতিটি মানুষ অসত, কেবল চেয়ারম্যান ছাড়া। যে গ্রামে এক কেজি দুধে দেড় কেজি পানি মিশানো হয়, পচা মাছের কানে নেলপলিশ দিয়ে তাকে সতেজ দেখানো হয়; সেইখানে সোনাদানা পাচারকারীদের দিয়েই সোনার মাকেন্দো গড়তে হবে! ভরসা রাখুন; পরিসংখ্যান দেখুন, মাকেন্দোবাসীর মাথাপিছু আয় বোকেন্দোবাসীর চেয়ে বেশি। আর পোকেন্দোবাসী তো রুটির অভাবে কাঁদে। আছেন তো সুখে; তাই অকৃতজ্ঞ হচ্ছেন। ভুঁড়ি নড়িয়ে হাসে কেমিকেল আলী!

সিদ্ধান্ত হয়, সততা সপ্তাহ পালিত হবে, গোটা মাকেন্দো জুড়ে। লেগে পড়ে চলিষ্ণুতেলকল্পদ্রুম খেতাব পাওয়া লেখকেরা। তারা চেয়ারম্যানের সততার নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরে গল্প-কবিতা-স্মৃতিকথা লেখে।

“তিনি তো রাজা নন, গরীব কৃষক এক। তাঁত বুনে তৈরি করেন পরিধেয়। তুলনা তো তার কেবল বাদশাহ আলমগীরের সঙ্গে চলে। যিনি টুপি সেলাই দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। কুমারে তাহার পড়াইতো এক মৌলবী দিল্লির। মৌলিবীর পদ প্রক্ষালন করে যে শিক্ষকের মর্যাদা স্থাপন করেছিলো। আমাদের হৃদয় সম্রাটের কথা আর কী বলবো, গোপন রাখার শর্তে একটি তথ্য দিই, একদিন দেখি কী, তিনি বারান্দায় বসে নামাজ পড়ার সময় তাঁর জায়নামাজ ম্যাজিক কার্পেট হয়ে বাগানময় একবার উড়ে এলো। বুঝলিনা রে বুঝলি না; চেয়ারম্যান কী ধন বুঝলি না।”

এই সততার রচনা পড়ে ভক্তিরসে মাকেন্দো জুড়ে মাসব্যাপী কান্দন কর্মসূচি পালন করে রুদালি সমাজ, “কাঁদো মাকেন্দো কাঁদো।”

(মার্কেজের উপন্যাস অনুসরণে কাল্পনিক গল্প )

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ