প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আজ কুড়ি বছরের বেশি সময় পরে এ বাড়িতে এলাম। সেফু চলে যাবার পর কেবল দুই বার এসেছিলাম। দু’বারই সামনের গেইট দিয়ে। নিত্যকার অভ্যেসমত পেছনের গেইট দিয়ে নয়। প্রথমবার এসেছিলাম লাইন ধরে শোয়ানো সাদা কাফনে মোড়া সেই তিন নিথর দেহ দেখতে। লোবান গোলাপজলের গন্ধ আর তেলোয়াতের সুর ছাপিয়ে কানে বাজছিল রনির গলা। ও আমাকে খেপাচ্ছে ছড়া কেটে, ‘খোঁপা দোপাটি, তুমি প্যাকাটি, মুরগি ঝুঁটি, ফোঁস’! চোখের ওপর সিনেমার পর্দার মত ভেসে উঠেছিল আসমা ফুপুর মুখ, ‘র নিইই ই এক চড়ে দাঁত সব ফেলে দেব’ আর হাত তোলার সাথে সাথেই ফুপুর কোল থেকে উলের গোল্লাটা গড়িয়ে নামছে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে। ঠিক তখুনি অস্থির সেফু কাফনের সাদা কাপড় সরিয়ে যেন অনুযোগ করছে, ‘ইস তোর মত ছোট চুল থাকলে কী ভালো হত! উলটো করে ঝুঁটি বাঁধা যেত। আম্মাটা কিসসু বোঝে না!’
গল্পের অডিওপাঠ শুনুন এখানে:
পরেরবার মা জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। বড়চাচীই ডেকে পাঠিয়েছিলেন । একটানা বৃষ্টি হয়েছিল আগের দিন। সেফুর সেই রান্নাবাটিটা চাচী আমাকে দিতে চান। আমি রাজি হইনি। সেফু নেই আমি আর কারো সাথেই রান্নাবাটি খেলবো না । মা চাচীকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। আমি সেই ফাঁকে সবার চোখ এড়িয়ে চলে গিয়েছিলাম পেছনের উঠোনে। উঠোনের টোল খাওয়া জায়গাগুলোতে বৃষ্টির জল জমে টইটম্বুর। কদিন আগেই কাঠগোলাপ গাছটার চারপাশে সেফু আর আমি ইট সাজিয়ে গোল ঘেরা দিয়েছিলাম। ইটের ঘেরে আটকানো জলে উল্টো আকাশ দুলছে সেইসাথে আমার বুকের ভেতর সবুজ পাথরটাও দুলে দুলে হুল ফোটাচ্ছিল। আমি জলের ভেতরেই হাত দিয়ে মাটি সরাচ্ছিলাম। ঠিক জানতাম কোথায় আছে। সেফু ফিরলেই দিয়ে দেবার কথা বড়চাচীকে। আমার হাতের ধাক্কায় জলে ভাসা চাঁদের আলোটা ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল। সারা হাত কাদামাখা হলো কিন্তু পাথরটা খুঁজে পেলাম না। আমি হাউমাউ কাঁদছিলাম। হায় ভগবান আমাদের যৌথ পাপের শাস্তি কেন সেফুকে দিলে? আমাকেও তুলে নাও। অন্ধকারে শিরীণ বিবির ঘোলা চোখ যেন ধমকাচ্ছিল, ‘গলায় রক্ত উইঠা মইরবি’। সেফুদের বাড়ির আম্বিয়া বুয়া ভেতরে গিয়ে মা’কে আর বড়চাচীকে ডেকে এনেছিল। দাদাজানের কাশির আওয়াজ শুনছিলাম কাছেপিঠেই। বড়চাচী নেমে এসেছিল উঠোনে। আমাকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসেছিল। আমি চাচীর কোলে মুখ গুঁজে সেফুর কাছে মাফ চাইছিলাম। সেইই আমার শেষ আসা। পরদিন বড়চাচী আম্বিয়া বুয়াকে দিয়ে সেফুর রান্নাবাটির সেটটা পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আমি আর কোনদিন রান্নাবাটি খেলিনি।
কাঠগোলাপের চারাটা সেইবার বড়চাচা বলি খেলার মেলা থেকে কিনেছিলেন । সামনের উঠোনেই লাগানোর কথা। সেফুর জেদে পেছনের উঠোনে ওর ঠাঁই হলো। আমাদের পাঠ্যবইয়ে ‘পল্লীস্মৃতি’ কবিতায় একটা দোলনায় দোলা মেয়ের ছবি ছিল। সেফু বলতো এই গাছ বড় হলে আমরাও দোলনা ঝোলাবো। তারপর কাঠগোলাপের সুবাস মেখে দুলবো দোলনায়। তাছাড়া সামনের দিকে দাদাজানের চেম্বার। দোলনা তো দূর, খেলতেই যেতে পারি না আমরা! সেফু বড়চাচীর বেশি বয়েসের কন্যা। দুই ভাইয়ের অনেক পরে ওর জন্ম। মেজ ভাইয়ার ষোল বছরের ছোট আর বড় ভাইয়ার সাথে ওর প্রায় কুড়ি বছরের ফারাক। বড় ভাইয়া আমেরিকায় থাকেন। ওঁর ছেলে ওয়াসিফ তখন কিন্ডারগার্টেনে পড়তো। বড়চাচা চাচী সেফুর কথা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু গাছটা লাগানোর দুদিন পর থেকেই কেমন যেন নির্জীব হতে লাগলো। আমি আর সেফু প্রতিদিন খেলার আগে এবং পরে গাছটার সাথে কথা বলি, নিয়ম করে জল দি। শমসু মামা গোবর সার এনে গোড়ায় দিয়েছিলেন। তবুও গাছটা পাতা খসিয়ে বিবর্ণ হচ্ছিলো।
এয়ারপোর্টে থেকে আসার সময় গাড়িটা যখন গলিতে ঢুকলো রাস্তার মুখ থেকেই বিশাল পনের তলা বিল্ডিঙটার মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম। মা জানালেন সেফুদের বিরান মাঠটা পাল্টে এখন লিবার্টি টাওয়ার নামের এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। টাওয়ারের চুড়োর সেই আবছা আভাস দেখে অনেক দিন পর আমার বুকের ভেতর সেই হুহু হাওয়াটা পাক খেতে শুরু করেছিল।
যখন দেশ ছাড়ি নিধির তখন দেড় বছর বয়স। এখন ওর নয় বছর আট মাস। সেফুর শেষ বয়েসের চেয়ে পাঁচ মাস কম আর আমার তখনকার বয়েসের চেয়ে আটমাস বেশি। নিধি হবার সময় আমি প্রায়ই সেফুকে স্বপ্নে দেখতাম। রান্নাবাটির সেই খেলনা চুলোতে সেফু অবিরাম জবা ফুলের কলি আর ইটের গুড়োর মিশেলে সালুন রেঁধে যেত হাত ঘুরিয়ে। শেষদিন আমাদের রান্নাবাটির খেলায় এটাই রেঁধেছিল সেফু। অংক খাতার কাগজ ছিঁড়ে আমিও সাদা ভাত রেঁধেছিলাম ডেকচি উপচিয়ে। ছয় বছরের লিটন পা মুড়ে বাবু হয়ে বসেছিল খাওয়ার অপেক্ষায়।
আজ বড়বউদিকে নিয়ে বেরোলাম সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে। বড়বউদি যখন বউ হয়ে আসে তখন সেই দুর্ঘটনার স্মৃতিতে পলি পড়েছে সবার মনে। কেবল আমার মনেই তখনো এবং এখনো আগের মতই তাজা সেফু আর সেইসাথে তাজা সেই সবুজ চোরকাঁটা। বড়চাচী পুরোনো বাড়িতেই থাকেন। তাই নতুন বিল্ডিঙ ঘুরে যাব বলাতে বড়বউদি একটু অবাকই হলেন। ‘ওখানে চেনা কেউ থাকে না তো!’ । আমি চুপচাপ নিজের মতই হাঁটছিলাম। এদিক দিয়েই সেফুদের বাড়ি যেতাম আমি। উঁচু দেয়ালটা টপকানোর জন্যে কত কথাই না শুনতে হয়েছে আমাকে! দেখলাম বিরান সেই মাঠের সীমান্তে কারুকাজ করা বিরাট ফটক। দুই কিনারায় পিলারের মাথায় টোপর পড়া সাঁঝবাতি । বউদি জানালো চল্লিশটা এ্যাপার্টমেন্ট এখানে। মূল বাড়িটা বড় চাচা রিয়েলটরকে দেননি। তাই নিয়ে ওঁর ছেলেদের সাথে এবং ভাইদের সাথে বেশ টানাপোড়েন চলছে। গত কাল রাতে মায়ের কাছেও এইসব খুঁটিনাটি শুনেছি। দেশে এসেছি তিনদিন হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে পাড়াতে ঢোকার সময় যতটা অচেনা লাগছিল তারচেয়েও বেশি অচেনা লাগছে এখন। সিটিজেনশীপের গিট্টু এড়াতে প্রায় আটবছর আসিনি আমি। কানাডার নীল পাসপোর্ট হাতে পেয়ে তবেই এলাম।
মাঠটাকে কল্পনায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছিলো আমার। সেফু, আসমা ফুপু কিংবা রনিকে না দেখলেও বউদি সেই খানাখন্দভরা মাঠটা দেখেছে। পাশের বস্তির লোকেরা গণশৌচাগারে অপেক্ষার চাপ নিতে না পারলে দিব্যি এই মাঠে পেট খালি করতো। একটা বিচ্ছিরী গন্ধ ঝুলে থাকতো বাতাসে। দেয়াল পেরোতে এইদিকে একটু কষ্টই হতো আমার। দু’তিনবারের চেষ্টায় দেয়ালের ওপর মাথাটা তুলতে পারতাম। মাঝে মাঝে লিটন বা রনি উঠোনে থাকলে দরজা খুলে দিত। দিবাকর থাকলে দেয়াল পার হয়ে আগে নামতো। ও অনেকটা লম্বা । দিবাকর আমার খুড়তুতো দাদা, রনির চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়তো। একসময় রনির সাথে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। ক্লাস নাইনে ওঠার পর কী যে হলো! ওদের বন্ধুত্ব ছুটে গেল।
কত কথা হুড়মুড়িয়ে ভিড় করছে মনে! পাড়াটা আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আর জোর করে জাগছে কুড়ি বছর আগের সেই সময়। কানে ফিরছে শাড়িওয়ালা কিংবা বর্তনপিয়ালীওয়ালার থিল দুপুরের পাড়া কাঁপানো হাঁক। কেমন নিবিড় মায়ার বাঁধন ছিল সেই সময়। এ বাড়ি, ও বাড়ি হুটহাট চলে যাওয়া যেত। আসমা ফুপু খেলার সময় বাগে পেলে আমার অবাধ্য চুলের জটা ছাড়িয়ে দিত অথবা জামার বোতাম ছুটে গেলে ‘দাঁড়া’ বলে সুঁই সুতো এনে ফটাফট লাগিয়ে দিত। আসমা ফুপু সেফুর একমাত্র ফুপু। ফুপা মারা যাবার পরে রনি আর লিটনকে নিয়ে এবাড়িতেই থাকতো।
আমরা স্কুল থেকে ফিরে গায়ে কোনমতে দুই মগ জল ঢেলে কাকিমার হাতে লাইন ধরে ভাত খেতাম। তারপরেই ছুট – সেফুদের বাড়ি। কোন কোনদিন সেফুরা আসতো এ বাড়িতে। তবে আমাদের বাড়িতে ছেলে বেশি তাই মার্বেল কিংবা সাত-চাড়া অথবা ব্যাডমিন্টন সাথে বাবা চাচাদের তাসের আড্ডা আর কড়া চুরুট কিংবা ট্রিপল ফাইভের ধোঁয়া। প্রতিমা মাসিদের বাড়িতে কোন বাচ্চা নেই। তাই ও বাড়িতে ছোটরা কেউ যেত না, কেবল আমিই ঝুপ করে দেয়াল টপকে নামতাম।
আমি গাছ চড়তাম, সাইকেল চালাতাম কিন্তু মার্বেল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন বা সাত-চাড়াতে কেন জানি আমার কোন আগ্রহ ছিল না । আমার পছন্দ ছিল রান্নাবাটি খেলা। সেফুর রান্নাবাটির সরঞ্জাম আমার চাইতে সমৃদ্ধ। কী নেই? হাতা,বেড়ি, খুন্তি, কড়াই, তাওয়া, শিলনোড়া, অ্যালুমিনামের বটি থেকে কাঠের মিটসেফ! সেফুদের বাড়িতে আমি কখনোই বড় রাস্তা ধরে যেতাম না। প্রতিমা মাসিদের দেয়াল টপকে রাস্তা পেরুলেই সেফুদের ইস্পাত রঙা বড় গেইট। আমি ওদিকেও ঢুকতাম না। কারণ বড় গেইটের মুখে দাদাজানের চেম্বার। প্রায় দুপুরে দাদাজান গড়গড়া মুখে চামড়া বাঁধাই করা আইনের বই পড়তেন। আর আমাদের দেখলেই নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ শুরু করে দিতেন। এক কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করতেন দাদাজান।
প্রতিমা মাসিদের দেয়াল থেকে লাফিয়ে মাটিতে পা দেয়া মাত্রই প্রতিমা মাসির শাশুড়ি খনখনে গলায় শাপান্ত করতো , ‘দুরু দুরু। ঠ্যাঙ ভাঙি মর’। বুড়ি যেন আমার এই ‘ঝুপ’ আওয়াজের জন্যে অপেক্ষায় থাকতেন। মায়ের সাথে দেখা হলেই ছিল নিত্য নালিশ। ‘ওবা বউ তঁর ছোড মাইয়া ইবা এন মদ্দান্যা খোত্তুন হইল্? সুদ্দ্যা তো এইরম্মা ন আসিল।( বউ তোমার মেয়েটা এমন মরদমার্কা কীভাবে হলো। ‘সুদ্দ্যা’ তো এমন ছিল না) সুদ্দ্যা মানে ‘সুদত্ত’ আমার বাবা।
শেষের সেদিন আমি দেয়াল পেরিয়ে প্রায় হামা দিয়ে বুড়ির গাছের তিনটে জবা ফুলের কলি তুলেছিলাম। আশ্চর্য বুড়ি টেরই পায়নি! কলিগুলো আমাদের রান্নাবাটি খেলার মোরগ। সেফুদের বারান্দার এক কোণে আমাদের রান্নাবাটির সরঞ্জাম সাজানো। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। তিনটে বাজার কিছু বাকি। পাঁচটা বাজার আগেই আমাকে ফিরতে হবে। অংকের মাস্টারমশাই আসবেন। সামনে আমার বৃত্তি পরীক্ষা। সেফু উঠোনেই ছিল, আমার অপেক্ষায়। দেয়ালের ওপারে আমার মাথা জাগতেই ও গেইট খুলে দিল। আমি ঢুকেই দেখি বারান্দায় প্রতিমা মাসি আর আসমা ফুফু উল বুনছেন। আমাকে দেখেই প্রতিমা মাসি বললো ‘এসেছে’। আসমা ফুপু ঠোঁট টিপে হাসলো। আমি কলি তিনটা শক্ত মুঠিতে লুকিয়ে, হাতটা স্কার্টের ঝুলে প্যাঁচিয়ে রাখলাম। দেখতে পেলে পাড়া মাথায় করবে প্রতিমা মাসি। বড়চাচী সেফুর চুল বেঁধে দিয়েছে তেল চপচপ করে। সেফুর চোখ ফোলা। নিশ্চয় এই তেল লাগানো নিয়ে এক প্রস্থ হয়ে গেছে চাচীর সঙ্গে। আমি ওর মন খুশি করতে মুঠি খুলে জবার কলি তিনটে দেখাই। নিমেষেই সেফুর চোখ চকচক। ‘আজ মুরগীর সালুন হবে’। বারান্দায় ওঠার আগে কাঠগোলাপ গাছটার কাছে যাই। নাহ্ কোন উন্নতি নেই। আরও পাতা ঝরেছে। গাছটার পলকা ডালে হাত বুলাই আমি। এখনো রোদে তেজ, ফেরার সময় জল দেব আমরা। সেফু বললো, ‘কাল পরশু শমসু মামা থাকবে, পানি দেবে। তুই কিন্তু ঈদের দিন দেখে যাবি’।
লিটন ছাগলটাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছে। দু’দিন পরেই কোরবানীর ঈদ। আমাদের ছুটি চলছে। কোরবানীর লাল গরুটা চলে গেছে সেফুদের গ্রামের বাড়ি। এই ছাগল কোরবানী হবে কাল। ঈদের দুদিন আগে। সেটার ভাগ আমাদের বাড়িতেও আসবে। আমার কষ্ট হয়। ছাগলটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নি আমি। লিটনকে ডাকি ইশারায়। লিটন আসমা ফুফুর ছোট ছেলে। আসমা ফুপু আর প্রতিমা মাসি তখন ডিজাইন বইয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্যাটার্ণ মেলাচ্ছে ।
আমরা মেঝেতে বসতে না বসতেই সেফু সিমেন্টের ব্লকের ওপর লাল ইটের টুকরো ঠুকে দ্রুত মশলা বাটতে লাগলো । ঠিক তখনই গেইটটা কঁকিয়ে উঠলো। আসমা ফুপু হইহই করে উঠলেন, ‘এ্যাই গেইটে খিল দেয়নি কে রে?’ আমার চোখ চলে যায় সেফুর দিকে। প্রতিমা মাসিকে দেখে সব গুবলেট হয়ে গিয়েছিল আমার আর জবা ফুলের কলি দেখে সেফুর। বোরকা পরা মহিলা ভেতরে ঢুকেই খিল তুলে দেয়। আসমা ফুপু চেঁচিয়ে ডাকেন শমসুকে। শমসু মামা একাধারে দাদাজানের পিয়ন আবার বাড়ির দারোয়ান।
বোরকার ঝাঁপ তুলে গাল ভরে হাসি দেয় মহিলা। ‘ওমা শিরীন !’ আসমা ফুপুর গলায় খুশি উপচায় । ‘সেফু যা তো একটা মোড়া নিয়ে আয়’, আমরা হা করে তখনো দেখছি ঘটনা। আসমা ফুপুর ডাকে সেফু চট করে ঘুরে কড়াইয়ে হাতা নাড়ে। ‘কী হল গেলি?’ ফুপু চেঁচায়। সেফু বিরক্ত মুখে ওঠে। শিরিন বিবি মাথা ঘুরিয়ে তখনও আমাকে প্রত্যক্ষ করছেন। সেফু উঠতেই আমিও ফের পিঠ ঘুরিয়ে আগের মত ভাতের চাল বানাই। তবে চোখে লেগে থাকে শিরীন বিবির ঘোলা চোখের ঘোর। এই মহিলার বাম চোখের ওপর দুধের সরের মত পাতলা ঘোলাটে পর্দা। ছোটবেলায় আমার মনে হতো চামচ দিয়ে সাবধানে তুলে ফেললেই চোখের ভেতরের কালো মণিটা ফের বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এবার মণিটা ধূসর নয় বরং হাল্কা সবুজ লাগছে আর অন্য চোখটাও অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। সেফু নয় বড় চাচীই মোড়া নিয়ে আসে সেফুর পেছনে। বড়চাচীও বেশ উচ্ছ্বসিত!
শিরীন বিবিকে আমরা ছেলেবেলা থেকেই দেখছি । ভাটিয়ারির জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড থেকে এটা সেটা এনে বিক্রি করে পাড়ায়। মাঝে মাঝেই হাওয়া হয়ে যায়। চার পাঁচ মাস পরে আবার নতুন কিছু নিয়ে উদয় হয়। সেবার মাকে একটা খুব সুন্দর কাচের বাক্সের ভেতরে ভরা সোনালি সিঁদুরদানী দিয়েছিল। বাবা বলে এসব চোরাই মাল। মা-চাচীরাও সম্ভবত জানেন যে শিরীন সুবিধার নয় কারণ যতই উচ্ছ্বাস দেখাক বারান্দা ছাড়িয়ে ওকে কেউই ভেতর ঘরে তোলে না। এবার অনেক দিন পরে এলো। প্রায় বছর খানেক তো হবে।
একটু পরেই আমরা শিরীনকে ভুলে যাই এবং আমাদের লাল মোরগের সালুন দিয়ে কাশফুলের মত সাদা ভাত রান্নার আঞ্জামে মাতি। হঠাৎ বড়চাচী ডাকেন। আমি প্রথমে শুনি নি । সেফু গুঁতো দেয়াতে আমি পেছন ফিরে দেখি। চাচী বলেন, ‘এইদিকে আয় পূর্বা’। আমি উঠে যাই কাছে। শিরীনের কোলের ওপরে একটা সাদা ধবধবে রুমাল পাতা। ব্লাউজের ভেতর থেকে ছোট লাল মলমলের ব্যাগ টেনে বার করলো সাবধানে। তারপর সেই সাদা রুমালে আলতো করে উপুড় করলো ব্যাগটা। অমনি নানা রঙের পাথর ছড়িয়ে পড়লো সেখানে। সূর্যের ঝাঁঝ কমেছে তখন। বারান্দার জাফরী কেটে তেরছা আলো পাথরগুলোর ওপর পেখম মেললো যেন। আমি বিভোর হয়ে দেখি। সবুজ বড় পাথরটাতে আমার চোখ লেগে থাকে। এটা অন্যরকম, অন্যগুলি সব ফিকে রঙের। বড়চাচীর কথায় সংবিৎ ফেরে আমার। ‘মাকে একটু ডেকে আন তো’। এতক্ষণে শিরীন বিবির কাছে আমার পরিচয় উন্মোচিত হয়। গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ওমা এইটা বউদির ছোট জন’! আমার স্কার্টের একপাশ উলটে ছিল আমি খেয়াল করিনি। শিরীনের চকচকে চোখ সেখানে হাঁটে। ‘এমন লম্বা ক্যামনে হইলো? শুভা, দীপা ওগো সাথে তো কোন মিলই নাই’। প্রতিমা মাসি ফোড়ন দেয়, ‘গেছো একটা। প্রতিদিন ঠাম্মার বকা খাচ্ছে তাও কথা শোনে না। আমি তো বউদিকে বলি, এরে নিয়ে কষ্ট আছে সামনে’। রাগে আমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোতে থাকে। মনে মনে বলি, দাঁড়াও ফেরার পথে পুরো জবা গাছটা ফর্সা করছি আজ। শিরীনের জরীপ ফুরায় না। ‘কী শুকনা, ফড়িঙের মত ঠ্যাঙ! ক্যামন ছুডু একখান জামা পরছে গো!’ আসমা ফুপু হাত দিয়ে আমার স্কার্টের ওঠানো অংশটা সমান করে দেন। খুব মোলায়েম করে বলেন, ‘যা তো বউদিকে একটু খবর দিয়ে আয়’। আমি তখনো শিরীন আর প্রতিমা মাসির মগজ চিবোচ্ছি মনে মনে। ফুপুর কথায় মন ফেরে। এখন যদি বাড়ি যাই মা আমাকে আর আসতে দেবে না। জুতসই উত্তর দেবার আগে সেফুই উদ্ধার করে। ‘আমরা খেলছি তো! ওর স্যার আসবে আম্মা। ওকে এমনিতেই একটু পরে চলে যেতে হবে’। আমার ওপর থেকে শিরীন বিবির দৃষ্টি পিছলে সেফুর ওপর সওয়ার হয়। ‘ওমা এই খড়খড়িটা কেডা?’ বড় চাচী বলে, ‘কে আর? আমার গলার কাঁটা। কথা একটাও মাটিতে পড়ে না’। আসমা ফুপু কথা ঘোরায়, ‘বড় ভাবি তুমি একটা ফোন দাও তো বউদি’কে’। বড়চাচী ইতস্তত করেন। ফোনটা দাদাজানের ঘরে। দাদীজান দুপুরের ভাতঘুমে এখন। তাও ‘আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে’ বলে ভেতরে ঢুকে যান বড়চাচী। আমিও সময় নষ্ট না করে আমাদের খেলার কোণে ফিরি। কিন্তু খেলায় মন বসে না। পা দুটো ভীষণ জ্বলতে থাকে। আমাদের স্কুলে ক্লাস সিক্স থেকে সালোয়ার। আমার ক্লাস ফাইভ এখন আর কদিন পরেই পা ঢাকবো, অন্তত স্কুলে! কিন্তু এমন বিশ্রী করে কেউ বলে নি কখনো। ফড়িঙের মত ঠ্যাঙ! আমার দুই চোখ জ্বলতে থাকে। স্কার্টের ঝুল টেনে পা ঢেকে রাখি তাও কেমন যেন মনে হয় পাদুটো ঠিক চোখের সামনে ঝুলছে অসভ্যের মত। আর শিরীন বিবির জ্বলজ্বলে চোখটা আমার পায়ের ওপর ফুটে আছে চোখ মেলে । খেলার ইচ্ছে উবে যায় আমার। আমি ওঠার জন্যে সিধে হই। ‘বাড়ি যাব’। সেফুর চোখে আকুতি। ‘আরেকটু থাক। তিনদিন থাকবোনা’ ওর হাত কিন্তু থামে না। সালুন ফুটছে মিছিমিছি চুলোয়। লিটন, বাবু হয়ে বসে তখনো, ওর সামনে ছোট প্লাস্টিকের প্লেট গ্লাস। আমার ছেঁড়া কাগজের ভাতও তাকিয়ে আছে চোখ মেলে। নিমেষে সব কেমন অর্থহীন লাগে আমার। আমি স্কার্ট ঝেড়ে উঠে দাঁড়াই। ওদের সামনে দিয়ে আমাকে নামতে হবে ভেবে আমার নাক ঘেমে ওঠে। হঠাৎ পেছনে আঁতকে ওঠার আওয়াজ। শিরীন বিবির কোলের রুমাল পড়ে গেছে মাটিতে। পাথরগুলো উল্লাসে এদিকওদিক ছুটছে। মনে বড় আনন্দ হয় আমার। ‘খুব হয়েছে’। বড়চাচীও বেরিয়ে আসে, ‘ওমা সেকি’! ওরা সবাই উবু হয়ে পাথর কুড়োতে থাকে। আমার পায়ের কাছে সাদা একটা চৌকো পাথর গড়িয়ে আসে। সেফু ,আমি, লিটনও পাথরের পেছনে ছুটি। ফুপুদের দেখাদেখি আমরাও মুঠি খুলে কুড়োনো সম্পদ শিরীনের সাদা রুমালের ওপরে রাখি। শিরীন বিবি পাথর গুনতে থাকেন আওয়াজ করে। আমরাও গুনি ওর সাথে, মনে মনে। উনপঞ্চাশ। শিরীন বিবি প্রায় কাঁদোকাঁদো গলায় বলে ‘একটা কম ভাবি। পঞ্চাশটা ছিল’। ‘কী রঙের পাথর?’ আসমা ফুপু জিজ্ঞেস করে। ‘মনে তো নাই আপা!’ শিরীন বিবির গলায় খেদ। ‘রঙ তো গুনি নাই পাথরগুলান গুনছি’।
আমি তুড়ন্ত চোখ বুলাই। সবুজ চকচকে পাথরটা নেই ওখানে। একটু আগের মনের ভার নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়। বড়চাচী আম্বিয়া বুয়াকে ডেকে সাবধানে ঝাড়ু দেওয়ায়। আমি সিঁড়ির দিকে পা চালাই। পেছন থেকে বড়চাচী বলেন, ‘পূর্বা মাকে বলিস আমি ফোন দিয়েছিলাম, লাইন যায়নি’। সেফু আসে আমার পেছন পেছন। শেষ সিঁড়িটায় পা দিতেই আমার চোখ থমকায়। সিঁড়ির ধার ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে পাথরটা। আমি সেফুর দিকে তাকাই। সেফুও দেখেছে। চোখে চোখে কথা বলি আমরা। হাসি খেলে যায় দুজনের ঠোঁটে। আলগোছে পাথরটা তুলি আমি। সবাই বারান্দায়। উঠোনের মাঝখানে কাঠগোলাপ গাছটার পাশে আমরা উবু হয়ে বসি। আস্তে করে গাছের গোড়ায় গুঁজে দি পাথরটা। সেফু পাশ থেকে ঝুরো মাটি তুলে চেপে দেয় জায়গাটা। পাতা ছাড়া ন্যাড়া গাছটাকে দেখতে হঠাৎ ফড়িঙের মত লাগে। আবার মনে পড়ে শিরীন বিবির কথা। আরও এক খাবলা মাটি মুঠোয় তুলে আমি পাথরের জায়গাটা উঁচু করে দি। শমসু মামা বলেছে এখানে রোদ বেশি তাই গাছটা মরে যাচ্ছে । এটা তুলে সামনে নিলেই আবার তাজা হবে। সেফু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।
সেফুর ঈদের পোশাক আসে নি তখনো অথচ কালই বাড়ি যাচ্ছে ওরা। কাপড়টা দেখেছি আমি। হাল্কা সবুজ আর হলুদের মিশেল। সারা গায়ে চুমকির কাজ। দুবাই থেকে এনেছে মেজ চাচা। এতক্ষণ ঈদের জামার কথা মনে ছিল না ওর। পাথরটা দেখেই মনে পড়েছে হয়তো বা। ‘ইস জামাটার সাথে কী সুন্দর ম্যাচিং হত বল্’! গলা নামিয়ে বলে সেফু। আর তখুনি শুনি শিরীন বিবি আম্বিয়া বুয়াকে শাসাচ্ছে , ‘ যদি পাথরডি পাইয়া আমারে না দ্যাও তাইলে কিনতু রক্তবমি কইরতে কইরতে মইরবা কইয়া দিলাম’। আম্বিয়া বুয়া কিছু বলতে গেলেই বড়চাচী থামিয়ে দেয়, ‘ আচ্ছা শিরীন কাল বিকেলে এসে খাসীর গোস্ত নিয়ে যেও। আম্বিয়া থাকবে বাড়িতে। পাথর পেলে ও তোমাকে দেবে’।
আমরা গাছটার পাশে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকি। শিরীন বিবি আমাদের পেরিয়ে যাবার সময় ওর সর পড়া চোখটা দিয়ে দেখে । আমাদের শোনাতেই যেন বিড়বিড় করে, ‘কেউ পাথরডি সরায়ে রাখলে রক্তিবমি কইরতে কইরতে মইরবে,’। ও গেইট পার হতেই সেফু ফিসফিস করলো, ‘আমার ভয় করছে পূর্বা। যদি সত্যি আমাদের রক্তবমি হয়?’। আমার ঠাম্মা প্রায়শ বলেন, ‘শকুনের শাপে গরু মরে না’। শিরীন বিবির তুলনায় নিজেদের বেশ উন্নত প্রাণী মনে হতে থাকে আমার। ঠোট উল্টে সেফুকে আশ্বস্ত করি, ‘ধুর আমরা কি চুরি করেছি নাকি? কুড়িয়ে পেয়েছি। একটু চাপে থাকুক তুই ফিরলেই বড়চাচীকে দেব’। দু’জন মিলে আরো কিছু মাটি তুলে চেপে দি গোড়ার চারপাশ।
সেই বিকেলই ছিল আমাদের শেষ বিকেল। ঈদের পরদিন কদুরখিল থেকে আসমা ফুপুর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল ও আর রনি।আধঘণ্টার পথ । টেক্সির সামনে রনির চাচা বসেছিলেন। পেছনে ওরা তিনজন। উনিই নিতে এসেছিলেন ওদের। লিটনের গা গরম ছিল বলে বড়চাচী ওকে যেতে দেয়নি। ওদের ট্যাক্সি কে পিষে চলে গিয়েছিল শহরমূখী ‘মায়ের দোয়া’ নামের বাস। টেক্সি ড্রাইভার সহ ওরা তিনজন স্পট ডেড। রনির চাচা আশ্চর্যজনক ভাবে ছিটকে পড়েছিলেন ঘাসের ওপর। ছোটখাটো চোট ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। বাবা ভোর রাতে ছুটেছিলেন কদুরখিল। আমি সকালে বেশ বেলায় ঘুম ভেঙে ঘোরের মধ্যে শুনেছিলাম সেফু নেই আর। আমার দুনিয়াটা সেইদিন ঝপ করে খেই হারিয়েছিল সময়ের! সেফুর সাথে সাথে আমার ছেলেবেলাও থমকে গিয়েছিল চিরতরে।
কখন যে চলে এসেছি পুরোনো বাড়িটাতে খেয়ালই করিনি। এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আর বাড়ির পেছনের উঠোনের মাঝখানে এক চিলতে গলি আর সেখানেই সেই কাঠের গেইটের জায়গায় লাল লোহার ছোট গেইট। ঠেলা দিতেই খুলে গেল। মনে পড়লো কাঠের সেই পলকা গেইটটা কী কঠিন ভাবে আঁটকানো থাকতো আর এই কঠিন লোহার গেইট আলতো ছোঁয়াতেই চিচিংফাঁক!
ভেতর থেকে কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসছে। কুকুর আছে এ বাড়িতে! দাদাজান কুকুর পছন্দ করতেন না। আসমা ফুপুর কথা মনে হলো। গেইটের আওয়াজ পেলেই হাঁকতো, ‘শমসু দ্যাখ কে এলো!’ লিটন এখন সিঙ্গাপুরে বড় চাকরী করে। দুর্ঘটনার পরে ওকে ওর চাচারা নিয়ে গিয়েছিল। ও থাকেনি। ফিরে এসেছিল বড়চাচীর কাছে। পরে বুয়েটে পড়তো। বড় চাচার দুই ছেলে দূরে থাকে তাই ও কাছাকাছি সিঙ্গাপুরেই আছে। প্রায়ই আসে চাচা চাচীকে দেখতে। হজ্জ্ব করিয়ে এনেছে ওদের। চাচী সকালে ফোনে বলছিলেন। কেউ একজন বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। বউদি বলে, ‘চাচা পূর্বাকে নিয়ে এসেছি’। ইনি বড়চাচা!
উঠোন জুড়ে মিষ্টি সুবাস! কী আশ্চর্য সেই কাঠগোলাপ গাছটা বেঁচে আছে! ফুলের ভারে কেমন নুইয়ে পড়েছে! বারান্দায় লাইট জ্বালায় কেউ। মসৃণ পাতাগুলোতে লাইটের আলোয় কাচের মত চমকাচ্ছে। এখানে দোলনায় দোলার কথা ছিল আমাদের। আমার গা কাঁটা দেয়। আবছা আঁধারেও মনে হয় পাতাগুলো যেন এক একটা সবুজ পাথর। গাছের নিচটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। পাশেই বসার জায়গা। ভেতরে কোথাও খচ করে সেই চোরকাঁটাটা সবুজ রঙ ধরায়। আমি সিঁড়ি নয় যেন স্মৃতির পাহাড় ডিঙিয়ে উঠি বারান্দায়। বড়চাচী আমাকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, ‘তুই আর এলি না, বন্ধুর কথাও ভুলে গেলি!’ আমার বলা হয়না বন্ধুর জন্যেই আসা হয়নি আমার। ভেতরের ঘরে ঢুকি আমরা। বড় চাচা আমার মাথায় হাত রাখেন প্রণামের প্রতিউত্তরে।
দেয়াল জুড়ে সেফুর বিরাট ছবি। নিধির সাথে কী মিল! উল্টো দিকের দেয়ালে আসমা ফুপু আর রনির ছবিও বাঁধাই করা। সেফুর ছবিটা সেই ঈদেই তোলা নিশ্চিত। হাল্কা সবুজ ওড়না আর চুমকীর সবুজ হলুদ প্রিন্টের সেই চেনা জামাটা পরা। যাক ঈদের জামা সেলানো হয়েছিল তবে। উলটো করে চুল বেঁধেছে সেফু। ওর পছন্দের স্টাইল। আহা ঈদ বলে বড়চাচী ছাড় দিয়েছিল হয়তোবা। ঘাড় কাত করে হাসছে আমার দিকে চেয়ে। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বড়চাচী বলেন, ‘ঈদের দিনেই তোলা হয়েছিল’। আমি বলি, ‘জামাটা আমার মনে আছে, মেজ চাচা এনেছিল দুবাই থেকে’। আরও জানাই রান্নাবাটির সেটটা আমি নিয়ে গেছি কানাডাতে। নিধিও খুব খেলেছে সেই সেট দিয়ে। স্কুলেও দেখিয়েছে। ওটা আমার প্রজন্মের দলিল হয়ে গেছে।
আমার কাছে সেফুর কোন ছবি নেই জানাতেই চাচী উঠে যান এ্যালবাম আনতে। মাথা থেকে কাপড় খসতেই গলার লকেটটা বেরিয়ে আসে। ওমা! আমি নিজেকে সামলাতে পারিনা, ‘চাচী খুব সুন্দরতো পান্নাটা!’ চাচী আবার বসেন। হাত দিয়ে ছুঁয়ে থাকেন লকেটটা তারপরে বলেন, ‘এটা একটা মামুলী সবুজ কাচ। পান্না নারে। সেই ঈদের দুই তিনদিন আগে শিরীন এসেছিল। তোরা খেলছিলি। মনে আছে? পাথরগুলো পড়ে গেল!’ আমার নিঃশ্বাস আঁটকে থাকে। চাচীর গলা কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে যেন! ‘ শিরীন একটা আস্ত শয়তান। ও ইচ্ছে করে টাকা খসাতে পাথরগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। এমন করেই অনেক গৃহস্থকে ফাঁসিয়েছে। আমরা ঈদের দিন বাড়ি যাওয়ার জন্যে বেরোচ্ছি ঠিক তখনই সেফু পেয়েছিল এটা। সিঁড়ির কোণে পড়েছিল। আবদার করে বলেছিল ওর জামার সাথে ম্যাচ করে লকেট বানিয়ে দিতে। গতবছর লকেট করেছি। দুর্ঘটনার মাসখানেক পরে শিরীন এসেছিল। তোর বড়চাচা ওর কথামত পান্না ধরেই টাকা দিতে যাবেন ঠিক তখনই মেজভাই পাথরটা দেখতে চাইলেন। উনি এসব চেনেন। দূর থেকে একপলক দেখেই বললেন, ‘এটা তো ইমিটিশন’! শিরীনকে চাপ দিতেই ও স্বীকার করেছিল। পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশে নেমে এসেছিল দাম। তোর মেজ চাচা তো সেটাও দেবেন না। ওকে জেলের ভাত খাওয়াবেন বলে ধমকাচ্ছেন। আমিই থামালাম। আমার মেয়েটা গলায় পরতে চেয়েছিল। এই পাথরের জন্যেই কী সব বদ দোয়া দিয়েছিল শিরীন! সেফু তো সারা রাস্তা আমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছে ওকে খবর দিয়ে যেন জানাই যে পাথরটা পাওয়া গেছে। সেদিন আমি মেয়েটার ওপর কী বিরক্তই হয়েছিলাম! তুই তো আর চুরি করিস নি, কুড়িয়ে পেয়েছিস। আল্লাহর বিচার বোঝার সাধ্য নাই আমার। শিরীন এখনো বেঁচে আছে। এইসব দুইনম্বরী করেই খাচ্ছে কিন্তু আমার মেয়েটা? এগারো না হতেই আল্লাহ পাক তুলে নিয়ে গেলেন´! খালাম্মার চোখ দিয়ে জল গড়ায়। আমার কেমন অবশ অবশ লাগে। অনেকদিন ধরে চেপে থাকা বিশাল একটা পাথর বুক থেকে সরে গেল যেন। খালাম্মা হঠাৎ গলা থেকে চেইনটা খুলে আমার দিকে তাকান। আমি কিছু বোঝার আগেই লকেটটা আমার গলায় পরিয়ে দেন তিনি। ‘এটা তোর কাছেই থাক, তোর বন্ধুর স্মৃতি’।
আমি খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বিশ বছর আগের সেই বিকেলের মত বুক ভেঙে কাঁদি। চোখ চলে যায় দেয়ালে। দেখি সেফু ঘাড় কাত করে আমাদের দেখছে হাসি মুখে!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..