ছন্দে, ছড়ায়, কবিতায় একগুচ্ছ বৃষ্টি

মানবেশ মিদ্দার
কবিতা
Bengali
ছন্দে, ছড়ায়, কবিতায় একগুচ্ছ বৃষ্টি

তুমি বর্ষা

খিলখিলিয়ে ঝিরঝিরিয়ে,
হাওয়ায় হাওয়ায় সিরসিরিয়ে,
দুলকি দুলে হেলদুলিয়ে,
নামছে কারা ঝমঝমিয়ে?

টাপুর টুপুর জল ঝরিয়ে,
ধানের খেতে ঢেউ উড়িয়ে,
ভিজে বাতাস হনহনিয়ে,
ছুটছে বুঝি পুবের বায়ে?

শিরিষ ফুলে রঙ লাগিয়ে,
টগর, জুঁই-এ বাস মখিয়ে,
আকাশ মাঝে সাঁঝ ঘনিয়ে,
কে ঐ বেড়ায় মেঘের গাঁয়ে?

শুকনো গ্রামের রুক্ষ পথে,
আসছে কে ঐ জলের রথে?
ডমরু বাজে আলোর সাথে,
গাছের শাখা নৃত্যে মাতে।

জলপরীরা আকাশ পথে,
ছন্দ-মাতাল কাহার সাথে,
মুক্ত-ধারা আচম্বিতে,
ঝরায় কে গো হস্ত হতে।

হাসছে কারা আঁধার রাতে,
আকাশ পথে মেঘের সাথে?
কোন সে মনের উষ্কানিতে
তুফান ওঠে নদীর স্রোতে?

কোন সে চোখের ভুল-ভুলানি?
নাচে ময়ূর, ময়ূর-রাণী,
আকাশ জোড়া মানিক খনি,
কার ইশারায় ঝরছে চুনি।

পুবের হাওয়ায় করা ইশারায়
রাঙা মেঘ ঐ ওড়না উড়ায়?
কোন সে হাতের তুলির ছোঁয়ায়
রামধনু ঐ নীল নীলিমায়?

পাগল হাওয়া কোন সে তানে,
এলোমেলো ঝাউয়ের বনে?
দাদুরী আজ মত্ত গানে,
কে আজ মাতাল প্রাণে প্রাণে?

জলের সাথে আকাশ পথে,
কে ঐ বলো গভীর রাতে,
টিপটিপিয়ে আড়ি পাতে,
ভাব জমাতে কবির সাথে?

তুমি বরোষা,
আনো ভরোসা,
মুছে দুরাশা,
ঠেলে হতাশা।

তুমি শীতলা,
চির চপলা,
ধরা সুজলা,
করো সুফলা।

ডাকে ঝর্ণা,
মেঘ বর্ণা,
চির যৌবনা,
ঝরে পড়না।

বাদলের তান,
মন আনচান,
বায়ু শন শন,
স্বপ্নের গান।

ওগো বৃষ্টি,
দাও পুষ্টি,
জীব গোষ্ঠী,
নব সৃষ্টি।

ওগো বাদল,
ওরে পাগলা,
করো উতলা,
বেলা অবেলা।

মাঠ থই থই
নাচে জল ঐ
বাদলের হাওয়া
ঐ ছোটে ঐ।

ঐ চাতকেরা,
জল যাচকেরা,
হাসি খুশী ভরা।
মুছে যায় খরা।

শোন ঐ শোন
রিমঝিম গান,
বন মাঝে শোন
পাখি কলতান।

বর্ষার সাঁঝে,
ছুটি আজ কাজে,
মন ভিজে ভিজে,
স্মৃতি ছবি সাজে।

বাদলের জলে,
নদী কলকলে,
অজানার কুলে,
মন ভেসে চলে।

বৃষ্টির সুরে,
মন ভবঘুরে,
দূরে বহু দূরে
এলোমেলো ওড়ে।

আষাঢ় আগমন

মেঘ-মাল্লারে বাজালো কে সুর?
জমে রাশি রাশি মেঘ মেঘ মেঘ।
বইছে বাতাস এলো মেলো চলে
ওই চেয়ে দেখো বেগ বেগ বেগ।

ঘণঘটা আজ নৈর্ঋত কোণে,
ঘণ কালো মেঘ ওই ওই ওই।
নাই নাই নাই সাদা বক আজ,
নভে রামধনু কই কই কই?

এসো এসো এসো নব মেঘ-ভার,
নব জল ধরা ঢালো ঢালো ঢালো।
খর বয়ে এসো নবীন আষাঢ়,
দিঘল সুনীল কালো কালো কালো।

গুরু গুরু গুরু মেঘ মৃদঙ্গ,
বৃষ্টি বাদল ঝর্ ঝর্ ঝর্।
পূবালী হওয়ায় আষাঢ় আগমনী,
মেঘে ঢাকা নভে কড়্ কড়্ কড়্।

ঝুরু ঝুরু ঝুরু বৃষ্টির গান,
বিজলীর ছটা চিক্ চিক্ চিক্।
বাদল বাতাসে হিমেল পরশ
নিবারিবে তৃষা ঠিক্ ঠিক্ ঠিক্।

নিদাঘ দগ্ধ বনভূমি মনে
বদলের দোলা দোল্ দোল্ দোল্।
নব-বর্ষার নব স্নানে
সবুজের ডালা খোল্ খোল্ খোল্।

নেত্র মুদিয়া আজ দিনমণি
ঘুমে ঢুলু ঢুলু ঢুলু -,
শ্রীমতী সন্ধ্যা বাসর রচিল।
ঝর ঝর বারি কুলু কুলু কুলু।

ফটিক জল, স্ফটিক পান,
চাতকের গান শোন্ শোন্ শোন্
একলা কুটীরে একা একা বসি
ভাবো কার কথা কোন্ কোন্ কোন্।

বৃষ্টি এলি

আজকে রাতে বৃষ্টি এলি!                         আমার গাঁয়ের পথ ধরে।
গভীর রাতে মেঘের সাথে                       ঝোড়ো হাওয়ার হাত ধরে।
ভাবলি বুঝি কেউ জেগে নেই!                নিশুত্ রাতে এই গাঁয়ে !
একলা আমি জেগে আছি                       তোর-ই আশায় পথ চেয়ে।
আমার হাতের এই বাঁশিটাই                   মেঘ গুলোকে ডাক দিলো,
‘মল্লারে’ তোর মন ভুলালো                     ভুলেই গেলি মন ভুলো!
ও-ই মেয়েটা! এ-ই দিকে দেখ;             জ্বালনা বিজ্লি দপ্ করে।
বাতায়নে এই-তো আমি                         বাঁশি হাতে চুপ করে।
জানলা দিয়ে আয় চলে আয়                   জল ছিটিয়ে বিছ্নাতে,
ঝড়-বাদলে ভাসিয়ে দে তুই –                একলা, এ-ঘর আজ রাতে।

ভিজে কবিতা

মেঘের ছানা,
মেললো ডানা।
ঝির-ঝিরানি টাপুর টুপুর।

মিষ্টি পানা,
বৃষ্টি দানা,
রিন-রিনানি নুপুর নুপুর।

গরম বেলা,
জলের খেলা,
ছল-ছলানি শীতল শীতল।

মানিক জ্বালা,
মেঘের মালা,
গুর-গুরানি এতাল বেতাল।

পুকুর ধারে
জলের পরে,
ঝুম-ঝুমিতে ঝুমুর ঝুমুর।

মনের ঘরে,
হৃদয় দ্বারে,
বাজনা বাজে ধুকুর পুকুর।

মেঘের মাথা,
আলোয় গাথা
মন-মানসী অবুঝ অবুঝ।

খুললো খাতা,
নতুন পাতা,
গাছ-গাছালি সবুজ সবুজ।

ডাল ভেঙেছে,
ঘর উড়েছে,
পাক-পাখালীর ওড়া উড়ি।

জল চুমেছে,
জুঁই ফুটেছে,
রঙ বেরঙের জড়া জড়ি।

দিবস অবস,
সাঁঝের আভাস,
ঝুম-নিঝুমের মাঝে মাঝে।

মাখছে সুবাস,
বাউল বাতাস,
ঝড়-ঝাপটে ভিজে ভিজে।

ঋতুরাণীর হোলি খেলা

(ফাগুন-দিনের হঠাৎ বৃষ্টি নিয়ে লেখা)

ঋতুরাজের ঘরের দোরে হঠাৎ করে নাড়লো কড়া।
কে গো এলে সাত সকালে, চুপ কেনো গো, দাওনা সাড়া।
আঁধার এখন কাটেনি যে, কে গো এলে শেষ প্রহরে?
এমন জোরে নাড়লে কড়া ভয় লাগে গো ঘুমের ঘোরে।

চুপি চুপি মেঘ জমেছে ঋতুরাজের ঘরের দোরে।
ঋতুর রাণী হঠাৎ করে আজ এসেছে রাজার ঘরে।
এক দিনও সে পায়নি সুযোগ, শাওন রাণীর ভীষণ বিরাগ,
ঋতু রাজের দোল হোলিতে একদিনও সে পাইনি সোহাগ।

তাইতো মিঠি বৃষ্টি রাণী মেঘ সাজিয়ে পেতেছে ফাঁদ,
মেঘ উড়িয়ে ঘরের দোরে, নিভিয়ে দিয়ে ফাল্গুনী চাঁদ।
একটি বার খুললে দুয়ার ধরবে চেপে বসন্তকে,
ঋতু রাজের রঙ ধোয়াবে চেপ্পে ধরে জলের বুকে।

চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে ফুল পাপড়ি আবীর পরাগ।
গায়ের জোরে বর্ষা-রাণী মাখবে গায়ে রাজার সোহাগ।
বসন্ত কি এসব জানে! ভাবলো বুঝি বৈশাখী ঝড়,
রাগ হয়েছে হঠাৎ করে ভাঙবে বুঝি রাজবাড়ি ঘর!

ভয় পেয়ে তাই বসন্তরাজ হাজার ফুলের পাপড়ি নিলো,
লাখো ফুলের আবীর পরাগ ফুলে পাতায় ছড়িয়ে দিলো।
গরম রাগী বোশেখ মেয়ের ভাঙাবে রাগ রেণু খেলে।
ছড়িয়ে দেবে পলাশ পারুল রাগী মেয়ের মুখে চুলে।

বর্ষারাণী দুয়ার ঘেঁষে ফুঁসছে ভীষণ অভিমানে,
হাজার সঙের রঙের নেশা ভাসাবে আজ জলের বানে।
মহুল নেশায় জল ঢালবে, তড়িৎ হেসে ছোঁয়াবে দাঁত,
মেঘলা অলোক বৃষ্টি-ঝলক, রাজার বুকে ঝর্ণা প্রপাত।

বোশেখ ভেবে যেই খুলেছে ঋতুরাজা কপাট দুয়ার,
বসন্ত রাজ ডুবে গেলো বয়ে গেলো বর্ষা জোয়ার।
সারা গায়ে বর্ষা রাণী মাখলো আবীর, ফুলেল হোলি,
বসন্তকে জড়িয়ে বুকে মাটির উপর কোলাকুলি।
বাদল রাণীর হৃদয় নাচে ডমরু গুরু মন্দ্র তালে,
বসন্তকে ভাসিয়ে নিয়ে বর্ষা চলে সাগর জলে।

বৃষ্টি রাণীর মান ভেঙেছে বসন্তকে হারিয়ে দিয়ে,
ফিরাবে আবার রাজ-ঋতুকে নতুন করে রঙ মাখিয়ে।
মুকুট আবার রাজার মাথায় রঙ-ঝিলিকে টাটকা ফুলে,
তুলির টানে ফুটবে গোলাপ বৃষ্টি জলে আবীর গুলে।

আবছায়া বৃষ্টির কবিতা

বাদল ঝরা পশ্চিমি মেঘ এক রাশ সিঁদুর লেপেছে গায়ে, –
শীতল জলে নেয়ে, –
বিকেল বেলা।
এখনও আঁধার নামেনি চারিধারে কাজল মাখেনি সাঁঝবেলা।

জলে ভেজা হাওয়া ঢেউ তুলে মেঘে চুপি চুপি আঁকে ছবি।
পশ্চিমি লাল রবি –
রঙ ঢালে।
জলরঙে আবছায়া ছবি গুলো ভেসে ভেসে চলে হলুদ বিকেলে।

ছবি গুলো ঢাকা পড়ে সাঁঝের আঁধার যখন বিন্দু বিন্দু করে নামে।
রঙের ঘোর ভাঙে।
শব্দ জাগে;
আঁধারের অন্দরে অরোরার মতো ছবি অচেনা রাগিনীতে বা রাগে।

এলোমেলো শব্দেরা কবিতায় সারবেঁধে থামে, কখনো বা গানে,-
অরূপ সরূপের টানে –
মেঘ, বৃষ্টি;
এতটুকু অনুভব অবয়ব অনুবাদ জীবন, শত শত ভাষাদের সৃষ্টি।

পথ, রথ, মূর্তির মতো হয়তোবা ভাবি, বৃষ্টির রামধনু-কবি আমি;
মেঘে, জলে নামি –
ছবি আঁকি।
আকাশের, আঁধারের, আলোকেরও আড়ালে হাসে কেউ; সবটাই ফাঁকি।

মানবেশ মিদ্দার। কবি। পড়াশুনা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে সংস্কৃত বিষয় নিয়ে। কিশোর বয়স থেকেই লেখালিখির একটা ইচ্ছা জেগেছিলো, স্কুলের দেয়াল পত্রিকা দিয়েই লেখালিখির শুরু। এই লেখা নিতান্তই নেশার। অনেক পরে দু-একটা পত্রিকায় লেখা পাঠানো শুরু হয় এবং কোথাও কোথাও প্রকাশও হতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ